বিষ_করেছি_পান(৩৮)

0
428

#বিষ_করেছি_পান(৩৮)

(কপি করা নিষেধ)
প্রথমবার কল হতেই রিসিভ করে ছানোয়ার।
— রিতী?
— বাবা!
— কোথায় তুমি? ফোন তুলছিলে না কেনো? টেনশন হয়না বাবার? কাল থেকে ফোন দিচ্ছি। তোমার রুমমেট রাও ফোন তুলছে না। ঠিক আছো তো?
— হ্যা বাবা আমি ঠিক আছি। তোমরা ভালো আছো?
— হ্যা। ক্লাসে গিয়েছিলে?
— হ্যা।
— রাতে খেয়েছো?
— হ্যা।
— এখন কি করছো?
পাশেই সোহাগ এসে দাঁড়ায়। ফোনের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
— সংসার করছে।
রিতী তৎক্ষনাৎ সোহাগের থেকে সরে দাঁড়ায়। ছানোয়ার প্রশ্ন করতে করতে উত্তেজিত হয়ে পড়ে,
— কে? কে কথা বললো? রিতী তুমি কোথায়? ছেলের ভয়েজ এলো কোথা থেকে?
— বাবা..বাবা.. ঐতো ফোনে। ফোনে। রাইমা আপু নাটক দেখছে।
— নাটকের ভয়েজ এতোটা দৃঢ় শুনাবে নাতো। কই এখন তো শব্দ পাচ্ছিনা।
— আমি দূরে সরে দাঁড়িয়েছি তো।
সোহাগ আবার রিতী পাশে এসে দাঁড়ায়। মাথা ঝুমিয়ে বলে, — হ্যা শ্বশুরবাবা।
— ঐতো.. আবার।
রিতী সোহাগের দিকে চোখ রাঙিয়ে বারান্দা থেকে দৌড়ে ভেতরে আসে। পেছন পেছন সোহাগ ও আসে।
— বাবা বললাম তো নাটকের আওয়াজ।
— সত্যি তো?
— হ্যা। মিথ্যা হবে কেনো? আমি কি তোমাকে মিথ্যে বলি বাবা?
— না। তোমার রুমমেটকে ফোনটা দাও তো। কথা বলি।
— ইসস বাবা! তুমি কেনো কথা বলবে কারণ ছাড়া? এমন করলে কি মনে করবে?
সোহাগ রিতীর দিকে এগোতে এগোতে বললো,
— দাও কথা বলি।
রিতী আবার অন্যদিকে সরে গেলো। ছানোয়ার কে বললো,
— বাবা আমার পড়া আছে। আমি রাখি?
— তোমার মার সাথে কথা বলো।
— মার সাথে কাল বলে নিবো। এক্সাম আছে বাবা। এখন পড়ি?
ছানোয়ারকে কিছু বলার সুযোগ না সোহাগ ফোন কেড়ে নেয়। কল কেটে বিছানায় ঢিল ছুড়ে। টুপ করে কল কাটতেই রিতী চেঁচিয়ে উঠে,
— এইই.. সমস্যা কি আপনার? দেখছিলেন না বাবার সাথে কথা বলছিলাম?
— সত্য কথাতো আর বলছিলে না। সব মিথ্যা কথা।
— তো আমি কি এখন বলবো যে আমি শ্বশুর বাড়ি এসেছি? শ্বশুরীর হাতের আদর খাচ্ছি, শ্বশুরের দোয়া নিচ্ছি, ননদিনীর ভালোবাসা নিচ্ছি।
— স্বামীরটা ইগনোর করছি। তাইতো?
রিতী মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ায়। স্বামী মাই ফুট! এরকম একটা ভঙ্গি। সোহাগ মৃদু হাসে। রিতীর মুখ বরাবর দাঁড়ায়। রয়ে সয়ে প্রশ্ন করে,
— আমাকে অপছন্দের কারণটা কি?
— পছন্দ অপছন্দ কোন ব্যপার না। আমলেই নেই না।
— সেজন্য বুঝি এতো সহজেই নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে নিলে? আমি তো ছিলাম ভাসা ভাসা। গভীরে টানলো কে? আমার ঘরে আসা, শ্বশুর শাশুড়ি, আত্ত্বীয় স্বজন, এবাড়ির কোনায় কোনায় নিজের অস্তিত্ব রাখা হচ্ছে! এতো সহজেই আপন করা হচ্ছে? তুমি কি চাও পিরীতি?
সোহাগের কথায় রিতীর পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়। ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিয়ে তার দিকে তেড়ে যায়। রাগে দুঃখে অন্ধ হয়ে গেছে পিরিতি। সোহাগের গলা চেপে ধরে। প্রচন্ড জোরে চাপ দেওয়াতে কাশি উঠে। কাশতে কাশতে রিতীকে ছাড়াতে চেষ্টা করে।
— আমার সাথে এতো কিছু করে এখন বলা হচ্ছে আমি কি চাই তাইনা? তোর সব জুলুম ভুলে চলে গিয়েছিলাম তবুও তুই আমায় শান্তি দিলিনা। ভার্সিটিতে গিয়ে তোর এই খুমাটা ঠিকই আমাকে দেখালি। সবার সামনে জড়িয়ে ধরে আমাকে কালারিং করে দিলি। জোর করে তুলে এনে তোর ঘরের দায়িত্ব তুলে দিলি।দুনিয়াকে জানিয়ে আবার বিয়ে করলি। বাধ্য হয়ে তোর ঘরে প্রতিটা রাত থাকতে হচ্ছে আমাকে। এর পরেও তুই বলবি আমি কি চাই? আর কতভাবে কষ্ট দিবি তুই আমাকে। আমার শরীরটাই যদি তোর প্রয়োজন হয় সেটাও তো গ্ৰহণ করছিস না। দু দুটো রাত কেটে গেছে শরীরটাই যদি লাগতো তোর আমি এখনো অক্ষত থাকতাম না। আমার ভেতরটা জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে ছাই করে দিচ্ছিস তুই। প্রতিনিয়ত এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এর দিকে তাড়িয়ে নিচ্ছিস। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। আমি দূর্বল হয়ে পড়ছি। আমার বেঁচে থাকার ইচ্ছে টা চলে যাচ্ছে। মুক্তি চাই আমি। প্লিজ মুক্তি চাই আমি।

কান্নায় ভেঙে পড়ে রিতী। হাত দুটো নরম হয়ে আসতেই ছাড়িয়ে নেয় সোহাগ। রিতীর কান্না দেখে দম বন্ধ হয়ে আসছে সোহাগের। তার কারণে রিতী কষ্ট পাচ্ছে। একসময় সে তো এটাই চাইতো। রিতীর কষ্ট দেখে ভালো লাগতো। কিন্তু আজ ভালো লাগছে না। মায়া ভরা চোখ দুটো থেকে গড়িয়ে যাওয়া জল সোহাগ বিন্দু মাত্র সহ্য করতে পারছেনা। সোহাগের ক্ষমতাও নেই এই জল গড়িয়ে পরা বন্ধ করবার। কারণ সে রিতীকে মুক্তি দিতে পারবেনা। দু দুবার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে তারা। এতো সহজে এই বন্ধন ছুটাতে পারবেনা। রিতীর হাত দুটো মুঠোয় চাপ দিয়ে থমথমে গলায় সগোক্তি করে।
— তোমার ভবিষ্যৎ আমি পিরিতী। এই বাড়ি তোমার আপনালয়। আমার মা বাবা তোমার পরিবার। তুমি চাও বা না চাও তোমার কোন মুক্তি নেই।
— আপনার বাড়ি আমার মতো মেয়ের সপ্ন। আপনার মা বাবার মতো ভালো শ্বশুড় শাশুড়ি আমার জন্য নেয়ামত। কিন্তু আপনি আমার জন্য অভিশাপ।
— যেদিন থেকে তুমি আমার বউ হয়েছো সেদিন থেকে আমি তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করিনা পিরিতি। ভবিষ্যত এও করবোনা। আমি ভুল ছিলাম। আমার মস্তিষ্ক বিকৃতি ধরনের ছিলো। ট্রাস্ট মি। বউ বউ ই হয়। তুমি আমার বউ। তুমি আমার সব। আমার আর কিছু চাইনা। তোমাকে পেয়েছি আমার সব পাওয়া হয়ে গিয়েছে। একবার ট্রাস্ট করে দেখো। আমি কখনোই তোমাকে কষ্ট দিবোনা।
— আপনি নিজেই আমার জন্য এক পৃথিবী কষ্টের। কিসের জন্য আপনার কাছে থাকবো আমি? কি আছে আমাকে দেবার মতো আপনার?
— কি চাই তোমার? শুধু একবার বলো আমি সব দেব তোমাকে।
— কিচ্ছু দিতে পারবেন না। আমাকে স্ত্রী করার কোন যোগ্যতা নেই আপনার। কোন দিক দিয়ে সুখ দিবেন আমাকে? একটা মেয়ে একজন স্বামীর কাছে যা চায় তার কিছুই নেই আপনার। না আর্থিক,না শারীরিক,না মানসিক! কোন দিক থেকেই আমাকে তুষ্ট করতে পারবেন না। বাপের হোটেলে বসে কতদিন? বাপের সাথে কাজ করতেন সেই যোগ্যতাটাও তো আপনার নেই। মূর্খ কথাকার। আমার জন্য নিজেকে হেফাজত না করে শরীরটা ভোগ করিয়েছেন কত মেয়ে দিয়ে। শুধু কি একটা মেয়েই কলঙ্কিত হয়? ছেলেরা হয়না? আপনার এই সৌন্দর্যে অদৃশ্য কালি পড়ে গেছে যা আমাকে আর আকর্ষন করেনা। যখনি আপনার ছোঁয়া পাই তখনি আমার মনে হয় আমি কয়েকজনের ব্যবহৃত ছুড়ে ফেলা নোংরা একটা ব্যক্তির ছোঁয়া পাচ্ছি। আমি নিজেকে হাজার চেষ্টা করেও মানিয়ে নিতে পারি না। আপনার ব্যবহার, আপনার চরিত্র, আপনার চালচলন, কার্যকলাপ , আপনার জগণ্য স্মৃতি সব কিছু আমাকে বিষিয়ে রাখে। আমি কিছুতেই মানসিক শান্তি পাইনা। আমার হাঁসফাঁস লাগে।যখন মনে হয় আমি বিবাহিত আর আমার স্বামী সকলের ঘৃণীয় ঐ বখাটে সোহাগ আমি মরতে মরতেও বেঁচে থাকি। আমার আপনাকে সহ্য হয়না। আমি পারিনা।

সোহাগ মাথা নিচু করে আছে। এতো নিম্নস্তরে সোহাগ নিজের জায়গা তৈরী করেছে! অথচ সে সবসময় ভাবতো তার জাগয়া উঁচু স্তরের একটা দামী চেয়ারে। যার আছে কাড়ি কাড়ি টাকা। আশেপাশে সুন্দরী মেয়ের আনাগোনা। বিলাশবহূল জীবন যাপন। দামী দামী মদ যার অভিজাত্য। এতো বড় স্তরের লোক হয়েও মিশেছে নিচু স্তরের মানুষের সাথে। তাদের জীবনের স্বাদ ও ভোগ করেছে। নিজেকে পরিচিত করেছে নিরহংকার একজন করে। অথচ সে এসবের কিছুই না। তার কিছুই নেই। রিতী তাকে আজ তার আসল স্থানটা আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলো। এতোটা অক্ষম যে যা নিয়ে এতো বড়াই যেখান থেকে আসে এতো এতো টাকা যার উত্তরাধিকার একমাত্র সে, যে চেয়ার একমাত্র তার সে চেয়ারে বসায় যোগ্যতা টুকুও তার নেই। খাদে পড়ে আছে সে। সেখান থেকে উঠার সামর্থ্য নেই। যার প্রতি মেয়েরা নিমেষেই আকর্ষিত হয়, বিছানায় যাবার জন্য একপায়ের উপর খাড়া থাকে আজ সে পারছেনা তার স্ত্রীকে আকর্ষণ করতে। পারছেনা স্ত্রীকে সুখী করতে। নিজেকে ব্যর্থ একজন পুরুষ মনে হচ্ছে। অক্ষম একটা ব্যক্তিত্ত্ব সে। নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হচ্ছে। পাশেই বসে ঢুকরে কাঁদছে পিরিতি। জীবনে কখনো কাউকে সোহাগ এভাবে কাঁদতে দেখেনি। এতোটা কাঁদাচ্ছে সোহাগ রিতীকে? এতোটা জগণ্য স্বামী সে? ফ্যালফ্যাল করে রিতীর দিকে দেখছে। বউটার কান্না তাকে এতো কষ্ট দিচ্ছে!

কান্না থেমে এসেছে রিতীর। একটু পর পর ফুঁপিয়ে উঠছে। শরীরটা বসে থাকতে সায় দিচ্ছেনা। ফ্লোরটাও অনেক ঠান্ডা লাগছে। এতোক্ষণ কান্না করে মনটাকে অনেক টা হাল্কা লাগছে। নিজের রাগটা আজ পুরোপুরি সোহাগের উপর উগলে দিয়েছে। বিষন্নতা কেটে গেছে। রিতী মুখ তুলে সোহাগের দিকে তাকায়। সোহাগ রিতীর দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো ছলছল করছে। একি সোহাগ কাঁদছে! রিতী একটু নড়েচড়ে বসে। সোহাগের মুখোমুখি হয় যাতে ভালোভাবে দেখতে পারে। সোহাগের গাল বেয়ে টুপ করে জল গড়িয়ে পড়লো। রিতী যেনো ঐ জল দেখে শান্তি পেলো। খুব ভালো লাগলো। তার থেকে বেশি ভালো লাগলো সোহাগের অপরাধী মুখখানা দেখে। করুণ ভেজা চোখে তাকিয়ে আছে রিতীর দিকে। আজ বুঝি বেশি হার্ড করেছে রিতী সোহাগকে? ভেবেই রিতীর মনে খুশির জোয়ার বয়ে গেলো। সোহাগ নিজের অপরাধ বুঝতে পেরেছে। অনুভব করতে পেরেছে। রিতীর জন্য মনের কোঠায় জায়গা তৈরি করেছে। নিজের গ্যাং ছেড়েছে। আজকাল বাড়ীর ছেলে হয়ে গিয়েছে। যতটুকু সম্ভব পিরিতি পিরিতি করেই দিন কাটিয়েছে। এসব কিছু রিতীর অজানা নয়। জানতে পারা কঠিন কোন বিষয় ও নয়। শুধু যে সোহাগ রিতীর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলো তা কিন্তু নয়। রিতীর ও মাঝে মাঝে স্বামীকে দেখার বড্ড সাধ জাগতো। হুজুকের বশে আড়াল থেকে সোহাগকে কয়েকবার দেখেছিলো। সোহাগের উৎসুক চেহারা, ভারাক্রান্ত দেহ সবটাই রিতীর চোখে ধরা পড়েছে। রিতী জানে একবার সে সোহাগের সাথে নিজেকে জড়িয়েছে। জেনে শুনে বিষ পান করেছে। এর থেকে নিস্তার নেই। রিতী এও জানে সোহাগের সাথে তার সংসার হবার সম্ভাবনা নেই। থাকলেও খুবই কম। তাই সে সোহাগ আর তার পরিবারের সবটা মেনে নিয়েছে। নিজের ইচ্ছেতেই আছে। যতক্ষন এ বাসায় থাকবে ততক্ষন ই তার সংসারের সময় চলবে। এরপর আর কোনদিন তার স্বামীর ঘরে সংসার হবে কিনা সে জানে না। তাই যতক্ষন এই সুযোগ পাচ্ছে ততক্ষন বাড়ির বউ হয়ে থাকছে। রিতী সোহাগের চারচোখ এক হয়ে আছে। কেউ চোখ নামিয়ে নিচ্ছে না। ঘরময় পিনপতন নিরবতা। মাঝে মাঝে দু একবার রিতীর ফুপানোর আওয়াজ ভেসে আসছে। সোহাগের এমন রুপ রিতীকে আন্দোলিত করছে। রিতী জানে সোহাগ তার কাছে ক্ষমা চাইবে। রিতী তখন পারবেনা আর সোহাগকে ক্ষমা না করে থাকতে। সে সময়টার অপেক্ষাতেই আছে। ঘন্টা খানেক পর সোহাগ চোখ দুটো মুছে নেয়। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। রিতীর সামনে উঠে আসে। নিজেকে শক্ত রেখে বলে,
— আমি কখনো নিজেকে ছাড়া অন্য কারো কথা ভাবিনি। যেহেতু তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী আমার অর্ধেক অংশ তাই আজ আমি প্রথমবারের মতো তোমার কথা ভাবলাম। কাল সকালে খেয়ে দেয়ে চলে যেও। ড্রাইভার তোমাকে পৌঁছে দিবে।
সোহাগ এটুকু বলেই আর থামলো না। হন হন করে ঘর থেকে চলে গেলো।
রিতী আকষ্মিক এমন সিদ্ধান্তে চমকালো। ভড়কালো। অবাক হলো। সোহাগকে ডাকার চেষ্টা করলো। গলা থেকে আওয়াজ বেরোলো না। ঠায় বসে রইলো।

চলবে,
লাবিবা তানহা এলিজা ~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here