#বিষ_করেছি_পান(৩৯)
(কপি করা নিষেধ)
রিতী ড্রয়িংরুমে এসে সোহাগ কে আর পেলো না। মেইন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেলো শ্বাশুড়ি কে। রিতীর দিকেই তাকিয়ে আছে। রিতী দৌড়ে কাছে গেলো। ব্যস্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,
— আম্মা আপনার ছেলে আসছিলো নিচে।
— বাইরে চলে গেছে।
— কোথায়?
সোহাগী উত্তর দিলো না। রিতীর হাত ধরে এনে সোফায় বসলো। রিতীকেও বসালো। রিতী এখনো তাকিয়ে আছে শ্বশুড়ির পানে। সোহাগী হাঁসফাঁস করছে। চিন্তায় মুখটা একটুখানি দেখাচ্ছে। রিতী অবস্হা দেখে ডাকলো,
— আম্মা?
— বউমা? তুমি নাকি কাল চলে যাবা?
— আমি তো বলিনি আম্মা।
— আমার পোলায় কি কইলো এইডা? আম্মা? ও আম্মা? তুমি আমার পোলারে ভালোবাসো না? জোর করি বিয়া করছো না? আমার পোলারে মাইনা নিছো না? বিয়ার পরের রাইতে আমার পোলা বাড়িত থাইকা বাইরাইয়া গেলো কেন? ও আম্মা? আমরা তো তোমার ভরসায় আছিলাম। তুমি কেন চইলা যাবা?
উত্তেজনায় গা কাঁপছে সোহাগীর। রিতী হাত দুটো মুঠো করে ফ্লোরে বসে পড়ছে। চোখে মুখে আতঙ্ক! রিতী কি উত্তর দিবে?
— আম্মা! আমার পোলা তোমার স্বামী! স্বামী কি চিনো? বুঝো স্বামী মানে কি?
রিতী হাত দুটো ছাড়িয়ে নিলো। টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা হাতে নিলো।
— আম্মা আপনি পানি খান। নেন পানি নেন।
সোহাগীর মুখের সামনে ধরে। রিতীর হাতেই সোহাগী গলা ভেজায়। একটু ধীর স্থির হয়। ফের বলে,
— আমার পোলা যা কইলো তা কি সত্যি? আল্লাহ না করুক সব যেনো মিথ্যা হয়। আমরা মুসলমান ঘরের মেয়ে। আমাদের কাছে স্বামী হলো আবরণ। মহামূল্যবান অলংকার। মায়ের পরে যদি কারো পায়ের নিচে জান্নাত হতো তাহলে সেই জায়গায় স্বামীকেই বসানো হতো। বিয়ের পর স্বামীই একটা মেয়ের পরিচয়। সুখ। স্বামীর ঘর ই নিজের ঘর। সেই ঘর ছাড়ি তুমি চলে যাবা আম্মা? আমারে শ্বাশুড়ি না ভাবি বন্ধু ভাবী কওতো আম্মা তোমাদের মধ্যে কি প্রবলেম হয়ছে? আমি ছাড়া কে আছে তোমার বড় শুভাকাঙ্ক্ষী কওতো আম্মা? খুলে কও নয়তো বুঝবো কেমনে?
রিতী কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না।তার শ্বশুর শ্বাশুড়ি এদের মন মানসিকতা এতো ভালো কেনো? এতো সহজ সরল জন্য ই বুঝি ছেলেটাকে ভালোভাবে মানুষ করতে পারেনি? শ্বাশুড়ি কে কি বলবে তার ছেলের কির্তীকলাপের জন্য তাকে কাছে টানতে পারছেনা? ভীষণ কষ্ট পাবে মহিলা। মা তো! রিতী সে সমন্ধে কিছু বলেনা।
— না না আম্মা। তেমন কিছু হয়নাই। আপনার ছেলে একটুতেই রেগে গেলো আমার উপর। তেমন কোন কারণ নেই।
রিতীর কথা শুনে সোহাগী মুচকি হাসে। আয়েশ করে সোফায় বসে বলে,
— আমারে বোকা পাই ও না। তোমার শ্বশুরের ঘর করতাছি ত্রিশ বছর হয়লো। আমার সব ই জানা। উনি আমারে পছন্দ করতো কিন্তু আমি করতাম না। সন্ডা পন্ডা লোক ছিলো। আমিতো প্রথমে মানতেই পারিনাই। পরে আস্তে আস্তে বুঝলাম মানুষ টা খারাপ না। ভালোবেসে ফেললাম। লোকটাও আমারে এতো ভালোবাসে যে আমার জন্য সব করে। আমি তারে যা যা বলতাম তাই করতো। বিয়ের পর আমরা পড়াশোনা শেষ করলাম। তোমার শ্বশুর ব্যবসায় ঢুকলো। বাজে অভ্যাস গুলো একেবারে ছাড়লো তারপর সোহাগরে জম্ম দিলাম। আগে কিন্তু নেই নাই। আমার শ্বশুড়ী আমারে সব শিখায়ে দিতো। পোলা বড় করলাম এইযে পোলার বউও আনলাম এখনো আমার সুখ এক রত্তি কমেনাই। মাঝে মাঝে তোমাদের জন্য টেনশন হয় এই যা। এই ত্রিশ বছরে তোমার শ্বশুর আমারে এতো সুখ দিছে যা ধারণা করতে পারবা না। যেদিন থেকে আমি তারে মন থেকে মানি নিছি সেদিন থাইকা আমিই মানুষটার বস। ঘাড় ত্যরামি যতই করুক সোজা সব আমার কাছে আসিই হয়। সোহাগ টা হয়ছে একদম তার বাপের মতো। বাপ মায়ের কথা মানবো না। কিন্তু বউ পাগলা। যেদিন আমার পোলা কইলো তোমার কথা! তারে ফাঁদে ফালায়ে বিয়ে করছো সেইদিন ই বুঝছি তুমিই তারে ঠিক করতে পারবা। আমার তো ভাবছিলাম আমি কোনদিন পোলার বউয়ের মুখটাও দেখতে পারমুনা। পোলা আমার বিয়ে শাদী সংসার পছন্দ করেনা। আম্মা মেয়ে মানুষের হাতে অনেক ক্ষমতা। একটা মেয়ে মানুষ একসাথে অনেক গুলা পুরুষ মানুষেরে পরিচালনা করার ক্ষমতা রাখে। সেখানে তোমার মতো বুদ্ধিমতী আমার একটা ত্যাড়া পোলারে কেনো সোজা করতে পারবানা? আমার সোহাগ তোমারে এতো ভালোবাসে দেখো তুমি যা বলবা তাই মেনে নিবো। একটুও অবাধ্য হবোনা। মান অভিমানের পালা ছেড়ে আমার পোলারে আপন করে নাও আম্মা। ধৈর্য ধরো। দেখবা তুমিই পৃথিবীর সব থেকে বেশি সুখী হবা।
— আপনি ঘরে যান আম্মা। আব্বা ঘরে। আপনি যান।
— তোমার আব্বায় ঘুমায়। একা একা কি বসে থাকবা? পোলাটা কখন না কখন ফেরে দরজা তো খোলা। তুমি কি কাল আসলেই চলে যাবা?
— আমি বলি নাই আম্মা। এইটা আপনার ছেলের রাগের কথা। উনি এতোরাতে কোথায় যেতে পারে আম্মা?
সোহাগীর মুখটা কালো হয়ে যায়। মা সে। ছেলের হাব ভাব চাল চলন রগে রগে চেনা। নতুন বউটার সামনে মান ইজ্জত যেনো খোয়া না যায়। মনে মনে দোয়া পড়লো। তবে সেই দোয়া কবুল হলোনা। শেষ রাতের দিকে সোহাগ ঠিকই বাড়ি ফিরলো।
রিতী সোহাগী সোফায় বসেই গল্প করে সোহাগের জন্য অপেক্ষা করছিলো। সোহাগ এসেই রিতীর পা ধরে বসে গেলো। উদ্ভ্রান্ত চেহারা। চুলে ধুলো লেগে আছে। দাঁড়িও ধুলোতে সাদা হয়ে গেছে। চোখ দুটো লাল টকটকে রক্তের ফুলকির মতো লাগছে। মুখ থেকে ভুস ভুস করে মদের গন্ধ বেরোচ্ছে। সোহাগের এ রুপ দেখে রিতী ভয় পেয়ে গেলো। মদের গন্ধ পেটে যেতেই নাড়িভুঁড়ি মোচর দিয়ে উঠলো।সোফা ছেড়ে উঠে দু পা পিছিয়ে গেলো। সোহাগ হামাগুড়ি দিয়ে রিতীর পা টেনে ধরলো। সোহাগীর দিক তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলো।
— আম্মা?
সোহাগী উঠে দাঁড়ালো। রিতী কখনো এসব পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়নি তাই ভীষণ ভয় পেয়েছে সোহাগী বুঝতে পেরে সোহাগকে ধরতে গেলো। কিন্তু আটকাতে পারলোনা। সোহাগ একেবারে মুখ থুবড়ে রিতীর পায়ে পড়লো। পা দুটো জাপটে ধরেই চিৎকার করে উঠলো।
— তুমি কোথায় যাবে না পিরিতি। প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি সরি। সব কিছুর জন্য আমি সরি। আমি আর তোমাকে হার্ড করবো না। তুমি যা বলবে তাই শুনবো । আমি তোমাকে কিছুতেই আলাদা হতে দিবো না। কিছুতেই না।
সোহাগ পাগলের মতো করছে। রিতীর শাড়ীর কুঁচি নামিয়ে ফেলছে। রিতী কোন মতে ধরে আছে। কলিজা যেনো শুকিয়ে মরে গেছে। নিভু নিভু আওয়াজে রিতী ডাকলো,
— আম্মা! আপনার ছেলেকে সরান.. না….
সোহাগ আরো জোরে চেপে ধরলো।
— কেনো সরাবে? সরাবে না? আমি ছাড়বো না। পিরিতি তুমি চলে গেলে আমার কষ্ট হয়। আমি তোমাকে কতটুকু চাই তুমি জানোনা? আমাকে কি একটু কম ঘৃণা করা যায়না? ট্রাস্ট মি তোমাকে দেখার পর থেকে আমার কাউকে মনে ধরে না। বিয়ের পর থেকে আমি তোমার হয়ে গেছি। কোন মেয়ের ধারে কাছে যাইনা। তুমি ছাড়া আমার কাউকে লাগবেনা। আমার তুমি হলেই চলবে। প্লিজ আমাকে ঘৃণা করোনা। আমি ভূল করেছি। তখন তো তুমি ছিলে না। আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমি আর একটুও কষ্ট দেবো না। তোমার যা চাই সব তোমার কাছে হাজির করবো। একটুও খারাপ আচরণ করবো না। প্লিজ একবার ট্রাস্ট করো। আমি আর বখাটেপানা করবোনা। তোমার সব অভিযোগ মাথা পেতে নিবো। সব ঠিক করে দেবো। প্লিজ…
রিতীর যেনো জান বেরিয়ে গেলো। ওক ওক করে বমির ঢেকুর উঠতে লাগলো। সোহাগীকে ডাকলো,– আম্মা?
সোহাগী দৌড়ে গিয়ে কাজের লোককে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে এলো। সোহাগকে রিতীর থেকে টেনে নিয়ে এলো। হাত সরিয়ে নেবার সময় সোহাগ আঁকড়ে ধরতে গিয়ে রিতীর পায়ে আচড় কেটে দিলো। রিতী আহ করে উঠে সোফায় বসে পড়লো। বাকি কাজটুকু কাজের লোকটাই করে দিলো। রিতী পা চেপে ধরে সোফায় মাথা এলিয়ে ঠোঁট চেপে কাঁদতে লাগলো। কান্না কমে এলে গালে কারো ছোঁয়া অনুভব করলো। রিতী চোখ খুলে তাকালো। রমিজউদ্দিন কে দেখেই নড়েচড়ে বসলো। রমিজউদ্দিন এর হাতে টিস্যু। টিস্যু দিয়ে রিতীর চোখের পানি মুছে দিচ্ছিল। পাশেই চোখ পড়লো বাড়ির বাকি দের। সবাই জেগে গেছে। ছোট ননদটা রিতীকে বললো,
— ভাবী। ভাইয়ার পক্ষ থেকে সরি।
রিতী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।
— মামনী ভাবী ভয় পেয়েছে। আমাদের রুমে নিয়ে যাই?
সোহাগী রিতীর দিকে তাকালো। রমিজউদ্দিন জিজ্ঞেস করলো,
— এখন সোহাগ ঠিক আছেনা?
— হ। গোসল করিয়ে খাইয়ে দিয়ে আসছি। বউমাকে ডাকে।
— বউমা যাও মা। ব্যান্ড ছাড়া রাস্তার পচা খেয়েছিলো বোধহয়, কতটুকু খেয়েছিলো বুঝতে পারছি। তাই পাগলামো করেছে। রুমে যাও। আশাকরি আর সমস্যা হবেনা। ভয় পেও না।
রিতীর শরীর সায় দিচ্ছে না। মনের ভেতর কি হচ্ছে সেই একমাত্র জানে। দীর্ঘশ্বাস বার বার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। দাঁতে দাঁত চেপে ধরে।
— এই মুসিবত ঝামেলা থেকে আমাকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাও আল্লাহ!
দুটো দিনেই হাঁপিয়ে গেছে। এই বাড়িতে এই অসভ্য লোকটার সাথে কিভাবে দিনের পর দিন কাটাবে ভেবে পায় না।রিতীকে সাহায্য করলো ননদরা। হাত ধরে দরজা অব্দি পৌঁছে দিয়েই যে যার ঘরে চলে গেলো। রিতী দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে। দরজা লাগিয়ে দরজায় পিঠ লাগিয়ে দাঁড়ায়। বিছানার একপাশে সোহাগ শুয়ে আছে। গলা অব্দি কম্বল টানা। ঘুমিয়েছে?
হয়তো তাই। ক্লান্ত হয়ে আছে। এতো পাগলামি করে…! রিতী মনে মনে বলে, — ‘সোহাগ! আপনাকে আমার আরও বাজিয়ে দেখার আছে!’
সোহাগের পাশেই উল্টো ঘুরে শুয়ে পড়ে রিতী।কম্বলটা গায়ে টেনে নেয়। শরীরটা দূর্বল লাগছে। তবে ঘুম আসছে না। মনের ভেতর হাজারো অস্থিরতার আনাগোনা। আচমকা খোলা কোমড়ে সোহাগের হাতের ঠান্ডা স্পর্শ পেতেই কেঁপে উঠে রিতী। পেছন ফেরার আগেই নিজের সোহাগ চেপে আসে রিতীর দিকে। অর্ধখোলা পিঠ সোহাগের ঠান্ডা বুকে লাগতেই হাত বাড়িয়ে সোহাগকে ছোঁয় রিতী। সোহাগের গা খালি। গোছলের পরে কিছু পরেনি। তার উপর ঠান্ডা! রিতী আমতা আমতা করে বলে,
— সোহাগ! ঘুমাননি?
— উহু।
— আপনি বমি করেছেন। দূর্বল শরীর। ঘুমিয়ে পড়ুন।
— উহু! আমাকে দাও… তোমার উষ্ণতা।
— সোহা…গ !
রিতীর শরীরের ভাঁজে ঢুকে যায় সোহাগ। অসহ্য শিহরণে জাগিয়ে তুলে রিতীকে। আর পার পায়না রিতী। সোহাগের মুখখানা আঁজলা ভরে কম্বলের নিচ থেকে টেনে তুলে ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে দেয়। দমবন্ধ কর একটা সময় পার করে সোহাগকে ছেড়ে জোরে জোরে শ্বাস নেয়। সোহাগ রিতীকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে গলায় মুখ ঢুবায়। ছোট ছোট আদরে ভরিয়ে তোলে রিতীকে। সুখের ব্যথায় আহ! করে মৃদু চিৎকার করে উঠে রিতী। তৎক্ষণাৎ সোহাগ ব্যস্ত হয়ে পড়ে রিতীকে নিয়ে। গালে ঠোঁট ঘেঁষে অস্থির কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
— ব্যাথা পেয়েছো জান? সরি জান। আর ব্যথা দিবো না জান।
সোহাগের অস্থিরতায় পুলকিত হয় রিতী। আড়ালে মুখ লুকিয়ে মৃদু হাসে। সোহাগ এমন ভাবে রিতীকে আদর করছে যেনো কোনো বিড়াল ছানাকে আদর করছে। একটু শক্ত করে ধরলেই ব্যথায় নুইয়ে যাবে।তবে কি সত্যি সত্যিই বখাটে টা প্রেমে পড়লো? রিতী খিলখিল করে হেসে উঠে। আপন করে নেয় সোহাগকে।
চলবে,
লাবিবা_তানহা_এলিজা~