বিষ_করেছি_পান(৪০)

0
620

#বিষ_করেছি_পান(৪০)

(কপি করা নিষেধ)
ঘুম থেকে উঠতে উঠতে দেড়ি হয়ে গেলো। ঘড়িতে এগারোটা তেরো। রিতী তাড়াহুড়ো করে ফ্রেশ হয়ে কিচেনে চলে এলো। ব্রেকফাস্ট তো সেই সকালেই সবাই করে নিয়েছে। ডাইনিং এ ঢাকা দেখে রিতী দম ফেললো। তাদের দুজনের খাবার নিশ্চয় রেখে দিয়েছে। শ্বশুরবাড়িতে ঘুমাও আর না ঘুমাও। সকাল সকাল ঠিকই উঠা চাই। আদিযুগ থেকে এ নিয়ম চলে আসছে। রিতীর লজ্জা লাগছে। দুদিন ও হয়নি শ্বশুরবাড়িতে। এখনি ব্রেকফাস্টে থাকতে পারলো না?
সোহাগী রিতীকে দেখে বললো,
— উঠেছো আম্মা? সোহাগ উঠেছে?
— না আম্মা।
— আচ্ছা ঘুমাক। বসো। খেয়ে নাও।
— আমাকে ডাকলেন না কেনো আম্মা? দেড়ি হয়ে গেলো উঠতে।
— ডাকবো কিরে? ঘুমাইতে গেছো কখন! যে সকাল সকাল উঠবা?শোন আমি তোমার তেমন শাশুড়ি না। ঘুমানোর সময় ই তো এখন। এই বয়সে আরাম করবা নাতো কোন বয়সে করবা? যতদিন আমি আছি সংসারের দিক তোমার নজর দিতে হবো না। আমার পোলারে সময় দেও। লেখাপড়া করো। বড় চাকরি করো। তাতেই আমরা সবাই সন্তুষ্ট।

রিতী খাওয়া বাদ দিয়ে একমনে তাকিয়ে থাকে। বাবা মায়েরা এমন কেনো? তারা সব সময় সন্তানকে উপরে দেখতে চায়। শ্বশুড়ীরা যদি নিজেদের শাশুড়ি না ভেবে মা ভাবতো তাহলে হয়তো আমাদের দেশের মেয়েরা সংসার ধর্ম পালন করতে গিয়ে নিজেদের সপ্নকে পায়ে পিষে ফেলতে হতো না।

সোহাগী খেয়াল করলো। রিতীকে কেমন জানি লাগছে। ভালোভাবে নজর দিয়ে পরক্ষনেই চোখ ফিরিয়ে নিলো। রিতী শুধু ফ্রুটস খাচ্ছে। জুসের গ্লাসটাও ছুয়ে দেখেনি। সোহাগী মুচকি হেসে রিতীর কপালে হাত রাখলো।কপাল, গা গরম। সোহাগী মধুর কৌটাটা এনে রিতীর মুখে একচামচ দিলো। রিতী টুপ করে গিলে নিয়েই বললো,
— আম্মা,আমি মধু খাইনা।
— আরেক চামচ খাও। টেস্ট তো খারাপ না। সয়ে যাবে।
টেবিল ফ্যান টা ছেড়ে দিয়ে রিতীর ঘোমটা খুলে দিলো।
— আম্মা কি করছেন?
— তোমার আব্বা এখন বাসায় আসবেনা। দেখি চুল গুলো শুকিয়ে দেই। ঠান্ডা লেগে যাবে। এমনিতেই গা গরম। ঘরে গিয়ে ওয়ার্ডোবের উপর দেখবে মেডিসিন বক্স আছে। একটা ইসোনিক্স আরেকটা নাপা খেয়ে নিবা। ইনশাআল্লাহ শরীর খারাপ করবেনা। মাথা ব্যথা করছে আম্মা?
— একটু একটু।
— বক্সে মুভ ও পাবা। লাগিয়ে শুয়ে আরেকটু ঘুমাবা। লাঞ্চে ডেকে দিবোনি। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো।
সোহাগী তাড়া দিয়ে খাইয়ে রিতীকে উপরে পাঠিয়ে দিলো। সিড়িতে দাঁড়িয়ে রিতী আরেকবার সোহাগীকে দেখে নিলো। রুম্পার কথা মনে পড়ছে রিতীর। রুম্পাও এমনটাই করে। রিতী চটপট রুম্পা আর সোহাগীর মিল অমিল খুঁজতে লাগলো। দুই মিনিট তল্লাসী দিয়ে তাদের মধ্যে শুধু একটা অমিল খুঁজে পেলো। রুম্পা রিতীর উপর চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে যত্ন নেয় আর সোহাগী নরমভাবে কথা বলে যত্ন নেয়। রুমে গিয়ে রিতী দরজা লাগিয়ে দিলো। বিছানায় সোহাগ নেই। নিশ্চয় উঠে গেছে।রিতী ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগোলো। চুলে চিরুনি করে বেণী করে নিলো। মেডিসিন নিলো। ঘাড় ঘুড়াতেই সোহাগের চোখে চোখ পড়ে গেলো। উদাম গায়ে সোহাগ রিতীর দিকে এগিয়ে এলো। শুধু থ্রী কোয়ার্টার পরা। রিতী চোখ নামালো না। সোহাগের বুক পিঠ হাত পা চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো। ফর্সা লোমশ শরীরে নতুন পুরোনো দু ধরনের দাগ। নতুন দাগ মানে রিতীর নখের আঁচড় খামচির দাগ। এখনো লাল টকটকে হয়ে আছে। পুরোনো দাগ গুলো গভীর।কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। সোহাগ সামনে এসে রিতীকে দুহাতে আগলে নেয়। রিতীও সোহাগের কাঁধে মাথা রাখে যাতে পিঠের দাগ গুলোও পর্যবেক্ষন করতে পারে। এগুলো তো কাটা দাগ। শরীর কাটা লম্বা দাগ কিভাবে হবে? নিজে নিজে কি একাই শরীর কেটেছে? ছুড়ি কাচি দিয়ে এরকম ক্ষত করা পসিবল নয়। তাহলে? মাথায় চাপ দিতেই রিতীর মনে পড়ে যায় তার পাও তো কেটেছে কাচ দিয়ে। সেম দাগ! তাহলে মদের বোতল গুলো যে ভেঙ্গে সারা ঘর ছড়িয়ে ছিলো একারণেই! রাগ জেদের বশে সোহাগ নিজেকে কষ্ট দিয়েছে? কেনো? রিতীর জন্য? রিতী কি বলেছে মদ খেতে? সে তো মদ সহ্য ই করতে পারেনা। কাল রাতেও তো মদ খেয়ে এসেছে। তারপরেও কিভাবে এলাও করলো সে? রিতীর নিজের উপর নিজেরই এখন রাগ হচ্ছে। ধাক্কা দিয়ে সোহাগকে সরিয়ে দিয়ে বিছানায় যায়। কম্বলে মুখ ঢেকে চোখ বন্ধ করে। এদিকে সোহাগ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। কি হলো? এইতো জড়িয়ে ধরেছিলো। আবার এরকম কেনো করলো?
— পিরিতি? এই বউ?
রিতী জবাব দিলো না। সোহাগ গিয়ে নিজেও কম্বলের নিচে ঢুকে পড়লো। ঠান্ডা শরীরের ছোঁয়া লাগতেই রাতের মতো আবারো রিতী থরথর করে কেঁপে উঠলো।
— এই পিরিতি? কি হয়েছে বউ?
রিতী ঘাড় ঘুরে তাকালো। সোহাগের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করলো,
— আপনার তৃষ্ণা মিটে গেছে? এবার নিশ্চয়ই আমার মুক্তি মিলবে?
রিতীর দুই চোখ দিয়ে রাগ ঝড়ে পড়ছে। হুট করে কেনো এতো রেগে গেলো সোহাগ বুঝতে পারলো না। চোখ বন্ধ করে সোজা হয়ে শুলো।
— তুমি নিশ্চয় পানি নও ?
রিতী নিজের রাগ কে সংযত করে নিলো। ক্রোধ কন্ঠেই বললো,
— আমি রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। বিশ্বাস করুন। আমি কোন পানি নই আবার জুস ও নই। হাতের খেলনাও নই।
— তুমি আমার বউ। এ বাড়ির বউ। আমার তৃষ্ণা যদি এতোটাই ভাসা হতো তাহলে তোমাকে পাবার জন্য এতোটা মরিয়া কখনোই হতাম না। সোহাগ কখনো সামান্য কিছুর জন্য নিজের ধাচ, ঐশর্য্য, অহংকারকে মাটিতে নামায় না। আমার এ তৃষ্ণা কখনোই কমবে না ।এটা আমি বুঝে গেছি। বরং আরো বেড়ে যাচ্ছে। সেজন্য ই তুমি আমার বাড়িতে আছো। অনান্য মেয়েদের মতো হোটেলে বা রিসোর্টে নয়। আমার থেকে আর তোমার মুক্তি মিলবে না। হাজার দূরে গেলেও আমার শিকলে ঠিকই বাঁধা থাকবে।
সোহাগ রিতীকে নিজের দিকে টানলো। আদুরে গলায় ডাকলো,
— আসো বউ বুকে আসো।
রিতী নড়লো না। শক্ত হয়ে থাকলো। সোহাগ জোরে টান দিতেই রিতী ছিটকে গেলো। বিছানা থেকে নেমে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়ালো। রুমের এদিক সেদিক চোখ বুলাতে লাগলো। কোমড় বেঁধে তল্লাসী লাগালো। সোহাগ উঠে বসলো। আশ্চার্য হয়ে গেলো।
— আরে কি করছো? কি খুঁজছো তুমি? পিরিতি? এভাবে গোছানো রুমটা উল্টা পাল্টা করছো কেনো?
রিতী পাত্তা দেয়না। যা ভেবেছিলো তাই। ঘরের মিনি ফ্রিজটা একদম খালি পড়ে থাকলেও কাবার্ডের ব্যাক সাইড আর আলমারির দুই পার্ট একদম খালি নয়। ঔষধের শিশির আকার থেকে বড় বড় কাঁচের বোতল। রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে রিতীর। উত্তেজনায় একটা বোতল ফ্লোরে ছুঁড়ে দিলো। টুকরো টুকরো হয়ে নীল পানির সাথে কাচ ফ্লোরে ছড়িয়ে গেলো। সোহাগ লাফিয়ে উঠলো। আরেকটা বোতল ছুড়ার আগেই
” ডোন্ট ডোন্ট! পিরিতি!” বলে ছুটে আসলো। রিতীকে আটকে দিয়ে বোতল কেড়ে নিলো।
— এসব কি করছো? পাগল হয়েছো? এভাবে ছুঁড়ে দিচ্ছো? তুমি জানো একেকটা বোতলের দাম কত?
— আমার থেকেও বেশী?
— এটা কি ধরনের প্রশ্ন?
— যে ঘরে আমি আছি তোমার স্পর্ধা কি করে হয় এখনো এসব সে ঘরে রাখার?
— আমি.. আমি এক্ষুনি সরাচ্ছি।
— এই কাঁচ গুলো দিয়ে শরীরে ক্ষত করেছো তাইনা? হাজারটা মেয়ের ক্ষত নিয়েও স্বাদ মেটেনি এখন কাঁচের ক্ষত নেওয়া হচ্ছে। আমি ছাড়া কারো রাইট নেই আঘাত দেওয়ার।
রিতী সোহাগের উপর রিতীমতো চিল্লাচ্ছে। চোখ মুখ দুটোই লাল হয়ে উঠেছে। সোহাগ দরজার দিক ছুটলো। হাসানকে জোরে জোরে ডাকতে লাগলো।
— এই হাসান। হাসান! ঐ বেটা তোদের আমার রুম পরিস্কার করতে বলছিলাম। এই তোদের পরিষ্কার? তাড়াতাড়ি এগুলো সরা এখান থেকে।
কাজের লোক গুলো দৌড়ে এলো ঝাড়ু বেলচা নিয়ে। ঘরে ঢুকেই রিতীকে দেখে ঢুক গিললো। রিতী শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুঁজে ভয়ঙ্কর রাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিতীকে অবাক করে দিয়ে আরো ছয় সাতটা বোতল কাপড়ের কাবার্ড থেকে বের করে নিলো। সোহাগ তাড়া দিলো,
— আরো কোথাও থাকলে এক্ষুনি সব বের করে নে। নয়তো তদের ভাগ্যে আর মাল জুটবেনা।
রিতীর বুঝতে বাকি রইলো না। সোহাগ যে একা খায়না। জনদরদী হয়ে এদের পেটেও ঢুকায়। সোহাগের দিকে তাকিয়ে দাঁত কটমট করে বললো,
— সরিয়ে কি লাভ? গিলা তো আর বাদ দিবে না।
সোহাগ দাঁতে কামড় দিলো।দু হাত ক্রস করে কানে ধরলো।
— সরি! আর খাবো না। কোনদিন খাবো না। প্রমিজ! তোমার কসম! না আল্লাহর কসম। সরি।

রিতীর আর ঘুম হলো না। আঁচল ছেড়ে মাথায় দিয়ে হন হন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। সোহাগ মনে মনে আওড়ালো — ঘূর্ণিঝড়!!

লাঞ্চের সময় রিতী চুপচাপ খেয়ে উঠলো। রাগ এখনো কমেনি। একদিকে এবাড়ির লোকের মাথায় তুলে রাখা আরেক দিকে নিজের পরিবারের চিন্তা। তার উপর সোহাগ টা অন্যরকম আচরণ করছে। রিতী যাই বলছে তাই মানছে। কেনো এসব? তাকে আটকানোর জন্য এতো চেষ্টা! এক লোকমা করে মুখে তুলছে আর রিতীর দিকে তাকাচ্ছে। নতুন নতুন প্রেমে পড়লে যে চেহারার ভাবভঙ্গি হয় সোহাগকে ঠিক সেরকম দেখাচ্ছে। রিতীর রাগ ও পড়ে যাচ্ছে। এরকম করলে কার না রাগ পড়বে? সোহাগ উঠে যাবার সময় টাওয়েলে হাত মুছার সময় রিতীর পেছনে দাঁড়ায়। একটু নিচু হয়ে মুখটা রিতীর কানের কাছে নিয়ে আসে। ফিসফিসিয়ে বলে,
— তোমার এই জল্লাদপানা আমাকে একদম সময় জ্ঞান ভুলিয়ে দিচ্ছে। বিয়ে করতে না করতেই দুই বছর পর টেনে নিয়ে গেছে। নতুন সংসারের স্বাদ না পেয়ে একদম পুরান সংসারের স্বাদ পাচ্ছি। তবুও ভালো লাগছে। তোমার এই ডাইনি লুক টা আমার দারুন লেগেছে। তুমি যতই চেচাও আমার ততোই ভালো লাগে। এতো ভালো লাগবে জানলে আরো আগেই তুলে নিয়ে আসতাম । তাহলে মনে হয় আরো জল্লাদপনা দেখতে পারতাম। তুমি যাই করোনা কেনো আমার তাই ভালো লাগে। এতো কেনো ভালো লাগে? পাগল হয়ে যাবো আমি। পিরিতি…! ইস…স! হায়রে….!

রিতী উল্টো দিকে মুখ করে হাতে মুখ চেপে ফিক করে হেসে দেয়। ডাইনিং এ শ্বশুর শাশুড়ির সামনে। তাই কোনভাবে চেপে যায়। সোহাগ বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে না। রিতী সোহাগের থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছে। বাগানে নেমে ননদদের সাথে গল্প করছে। এদিক ওদিক হেঁটে হেঁটে দেখছে। সন্ধ্যার পরেও ননদদের সাথেই আছে। ননদরা রিতীকে চেপে ধরেছে। কোথা থেকে লাল টকটকে একটা বেনারসী এনে সুন্দরভাবে রিতীকে পরিয়ে দিয়েছে। খোঁপায় বেলীর মালা গুঁজে দিয়ে ঠোঁট দুটো শুধু লাল টকটকে করে রাঙিয়েছে। বেলীর মালায় হাত রেখে রিতী জিজ্ঞেস করে,
— এসব কোথায় পেলে?
— তোমার জন্য অর্ডার করা হয়েছিলো। মাত্র দিয়ে গেলো যে।
— ওয়াও.. কি সুন্দর! কে অর্ডার করেছে? তোমরা? সবাই খিলখিল করে হেসে বললো,
— না। আমাদের বস।
— বস!
সবাই রিতীকে ধরে ছবি তুলতে লাগলো। রিতীও অনেক রকম পোজ দিলো। ডিনারের আগ পর্যন্ত রিতী একদম ঘর মুখো হচ্ছেনা না জানি তার কোন অকাজ আবার চোখে পড়ে রিতীর মাথা আবার খারাপ হয়। তাই এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয়। কিন্তু তার এই এড়িয়ে যাওয়াতে একজনের যে কি সুবিধা টা হলো! সে জানতেই পারলো না তার জন্য ঘরে ঠিক কি সারপ্রাইজ তৈরী হচ্ছে।

চলবে,
লাবিবা তানহা এলিজা ~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here