#বিষ_করেছি_পান(৪৫)
(কপি করা নিষেধ)
ছুটি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে বাঁধনকে এক হাত আগলে ধরে। ঠান্ডায় শরীর হিম হয়ে নিস্তেজ হয়ে আছে। একহাতে ছুটিকে ধরে অন্য হাতে মোটা দড়ির গিট্টু খুলতে ব্যস্ত বাঁধন। ডান পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে ছুটিকে নিয়ে হাঁটু মুড়ে বসেছে। ব্যথায় আঙুলটা যেনো ফেটে যাচ্ছে। বার বার ডাকছে,
— ছুটি? এই ছুটি? কথা বল আমার সাথে। ছুটি?
ছুটি ফুপিয়েই যাচ্ছে। শরীরের সমস্ত ভার বাঁধনের উপর ছেড়ে দিয়েছে। বাঁধন দড়ি ছাড়িয়ে সিমেন্টের মেঝেতে হাটু মুড়ে বসে ছুটিকে দুহাতে বুকের উপর আগলে নেয়।
গালে হাত দিয়ে বলে,
— কিভাবে এলি তুই? ঐ সোহাগ তোকে নিয়ে এসেছে? কেনো এসেছিস ওর সাথে? এই ছুটি? চোখ খুল। কথা বল আমার সাথে।
ছুটি চোখ খুলে তাকায়। বাঁধনের প্রশ্নের উত্তর দেয়না। বাঁধন ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে ছিলো। এবার সেটা বাইরে প্রকাশ পায়। ধমকে বলে উঠে,
— ঐ সোহাগের সাথে এতো কিসের ভাব তোর? তোর বোনের সাথে কি অসভ্যতামোটা করেছিলো দেখিস নি তুই? ওকে পাইনি জন্য তোর পেছনে পড়েছে এবার। কি বলে ভুলিয়েছে তোকে হ্যা? সোহাগ কতো খারাপ একটা ছেলে তুই জানিস না? শুরু থেকে তোদের দুই বোনের পেছনে পড়ে আছে। কি ভেবেছিস আমি দেখিনি তাইনা? বুঝিনা কিছু? চোখ নেই আমার? বড়টাতো চলে গিয়ে বেঁচে গেছে লেগে আছে তোর সাথে।
হটাৎ ই বাঁধনের ভয় হতে শুরু করে।ছুটির মুখটা দুহাতে আজলা তুলে আতঙ্ক গলায় বলে,
— তোর সাথে কিছু করেনিতো? গায়ে হাত দিয়েছে তোর? কোথায় ছুঁয়েছে। আল্লাহ! ছুটি উত্তর দে। কোই কোই ছুঁয়েছে ঐ ডাফার তোকে?
বাঁধনের চিৎকারে ছুটি হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। ছিহ! বাঁধন ভাই কিসব ভাবছে! ছুটির শরীরে হাত দিবে? সেটা ছুটি মেনে নিবে? হার মেনে কাঁদার মেয়ে ছুটি নয়। তবে বাঁধনের চিন্তা ধারা আর চোখে মুখে অবিশ্বাস ছুটিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ছোট্ট মনে নিমেষেই আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। ছুটিকে আরো অবাক করে দিয়ে বাঁধন ডানে বামে চোখ ঘুরিয়ে ছুটিকে আদ্যপান্ত দেখে। ছুটি ফুপানোর মাঝেই ডাকে, ‘ বাঁধন ভাইই…’। বাঁধন শোনে না। অভিমানী ছুটি আরো জোরে কেঁদে উঠে। বাঁধনকে বোঝার ক্ষমতা তার নেই। বাঁধনের ভেতর কি হচ্ছে তা ছুটির জানারো কথা নয়। বাঁধন আবার ছুটিকে টেনে ধরে,
‘ এইসব গলিতে দিন দুপুরে মানুষ খুন করে ফেলে রাখে। আর তুই ঐ সোহাগের পেছনে চলে এলি? কি চক্কর চলে তোর সাথে বল? আগে কাকা ছিলো কিছু বলিনি কিন্তু এখন তুই আমার কাছে আছিস,তোর কিছু হলে আমাকে কাকার মুখোমুখি হতে হবে। এতোটা টেনশন কেনো দিস? খারাপ লোক ভালো লোক চেনার বয়স হয়নি এখনো তোর? ফারদার যদি তোকে ঐ সোহাগের সাথে দেখেছি ছুটি আমি তোকে কি করবো নিজেও জানি না। ‘
‘ সোহাগ ভাই আমার কিচচচু করবেনা।’
হিকচি তুলতে তুলতে বলে ছুটি। বাঁধনের মেজাজ আরো খারাপ হয়ে যায়।
‘ এতো রাতে বেঁধে গলিতে ফেলে রাখছে তার পরেও বলিস কিচ্ছু করবেনা। মরতে চাস? মরণের পাখা গজিয়েছে তোর না? সকালেই দেখবি রাম ধা এনে কল্লা কাটবে। তারপর বুড়িগঙ্গায় ফেলে আসবে। ‘
ছুটিকে বাহুতে ধরে টেনে বেরিয়ে আসতে চায় বাঁধন। দুই গলির মাথায় আসতেই মুখোমুখি হয় সোহাগের। হাতে খাবারের প্যাকেট। ছুটিকে নিতেই সোহাগের এখানে আসা। সন্ধ্যায় রাগের মাথায় ফেলে গেলেও মাথাটা যেই ঠান্ডা হলো সেই ছুটে এসেছে ছুটির জন্য। ছুটির মন গলানোর নিয়ে এসেছে ধোয়া উঠানো বিফস্টেক। হাত পা ধরে যদি একমাত্র শালিকার মন গলাতে পারে। রাগ দেখিয়ে বেঁধে আর যাই হোক ছুটিকে দিয়ে কাজ হাসিল করা অসম্ভব।সেটা সোহাগের মাথায় কেস করেছে। বাঁধনকে দেখে সোহাগ চমকেই যায়। আশা করে উঠতে পারেনি ঠিক। সোহাগকে দেখেই বাঁধন আগলা করে ছুটির হাত।ধপধপ পা ফেলে টেনে ধরে সোহাগের শার্টের কলার। পর পর কয়েকবার নাকের উপর ঘুষি পড়াতে সোহাগের নাক রক্তে লাল হয়। ছুটি নিরব দর্শক। চোখের সামনেই হয়ে যায় একখন্ড বক্সিং। কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছেনা। সোহাগ গুন্ডার অভিজ্ঞ শক্তপোক্ত হাত আর বাঁধনের নরম হাতে আঘাত। বাঁধনের সমস্ত রাগ যেনো মেটাচ্ছে। সোহাগ ও ছাড় দিচ্ছেনা। বাঁধনের তলপেট বরাবর শক্ত লাথিটা পড়তেই বাঁধন কুকিয়ে উঠে। দুপা পিছিয়ে যায়। গায়ে কাটা দেয় ছুটির। চিৎকার করে ডাকে,’ বাঁধন…’ । বাঁধন অশ্রাব্য একটা গালি ছুড়েই সোহাগকে মাত করে দেয়। কখনো মারামারি হাতাহাতিতে যোগ না দেওয়া প্রফুল্ল শান্ত বাঁধন এতোটা ক্ষেপা হতে পারে ছুটি আজ না দেখলে বিশ্বাস ই করতো না। কি করবে সে? একদিকে বোনের কলিজা আরেকদিকে নিজের জান, দুজনেই রক্তাক্ত। এদের থামানোর সু্যোগ ছুটির নেই। শত চেষ্টায় জেগে থাকতে চাওয়া চোখ দুটো বুঝার আগে একটা বাক্য কর্ণগোচর হয়,’ আমার ছুটির আশেপাশে আমি তোকে কোনদিন দেখতে চাইনা।’
কম্বল মোড়ে বেঘোরে শুয়ে আছে ছুটি। শরীর থেকে থেকে মৃদু কেঁপে কেঁপে উঠছে। ছুটির উপর ঝিমা সটানে শুয়ে জাপটে চেপে ধরে আছে। বাঁধন উঠে আলমারি থেকে আরেকটা কম্বল বের করে ঝিমা সমেত দিয়ে দেয়। ঘন্টা খানেকের মধ্যে ছুটির কাঁপা থামে। ঝিমাকে হাই তুলতে দেখে বাঁধন বলে,
— যা শুয়ে পর।
— এখানে ঘুম হবেনা।
বাঁধন ছুটির দিকে নজর ফেরায়। ট্রাউজারের পকেটে দু হাত গলায়। কি বুঝে পর পর মাথা ঝাঁকায়। মুখের উপর চোখ রেখেই বলে,
— অন্য রুমে গিয়ে শুয়ে পর। আমি আছি।
— তোমার রেস্ট প্রয়োজন ভাইয়া।
বাঁধন উত্তর করে না। ঝিমা মিনিট দুয়েক অপেক্ষা করে উঠে যায়। যাবার সময় দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে যায়। বাঁধন কিছুক্ষণ সেভাবেই ছুটির উপর চোখ রাখে। বাইরে থেকে হাওয়া আসছে । বারান্দার গ্লাসটা টেনে দিয়ে মাঝ ফ্লোরে এসে দাঁড়ায়। আনমনেই কয়েকবার পায়চারি করে। ছুটির দিকে তাকিয়ে চেয়ারটা টেনে বিছানার সামনে রাখে। ছুটির মুখ বরাবর টেনে বসে পা দুটো বিছানায় তুলে দেয়। চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে। মাথা তুলে আবার ছুটিকে দেখে। দ্বিতীয় বার আর চোখ ফেরায় না। পা নামিয়ে ছুটির দিকে ঝুঁকে আসে। ছুটি বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। মাঝে মাঝে চোখের পাপড়ি একটু নেচে নেচে উঠছে। পর পর নিচের ঠোটটা বাকদিকে নড়ছে। ঘন শ্বাস পড়ছে।সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে ছুটির ঘুমকে পরখ করছে বাঁধন। জোরে শ্বাস টেনে আচমকা ঘুমন্ত ছুটিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,
‘ তোর জন্য কেনো আমার এতোটা হাঁসফাঁস লাগে? এতোটা ডেস্পারেট কেনো হয়ে গেলাম? কে তুই?’
পর পর তিনটি প্রশ্ন করে বাঁধন সোজা হয়ে চেয়ারে মাথা এলিয়ে দেয়। ফের ছুটির দিকে ঝুঁকে বলে,
‘ এই বাঁধন আজ পর্যন্ত বাইরের কারো গাঁয়ে হাত তুলেছে কেউ বলতে পারবেনা। প্রাণচঞ্চল, সুপুরুষ, সাদা চকচকা বাঁধনের লাইফে আজকের ঘটনাটা কতটুকু কালি ফেলে দিলো তুই জানিস ছুটি? আমি কিভাবে এতোটা ডেস্পারেট হতে পারলাম? হাউ? ‘
এদিক ওদিক তাকিয়ে হাঁসফাঁস করে বাঁধন। পরমুহূর্তেই গলায় অবাকতা ছড়ায় ,
‘ তোর জন্য! কেনো? ‘
উত্তর মেলেনা। সময়ের পর সময় যায় উত্তর মেলেনা। ক্যালকুলেশনে যা আসে তা ভূল। এই ফলাফল কখনোই হবার কথা নয়। কখনোই না।
_________________
রমিজউদ্দিন দেখা করতে এসেছে রিতীর সাথে। রিতীই মূলত দেখা করতে চেয়েছে। সোহাগের এতো বড় একটা কাজের পর রমিজউদ্দিন এর সাথে দেখা করাটা রিতীর জরুরি হয়ে পড়েছে। গাড়িতেই বসেছে রমিজউদ্দিন। রিতী আসতেই গেইট খুলে দেয়। রিতী উঠে বসে। সালাম দিয়ে বলে,
— বাবা কেমন আছেন?
— বাড়ি চলো সবাই ভালো থাকবে।
রমিজউদ্দিন এর সোজা সাপ্টা উত্তর । রিতী মাথাটা নিচু করে রাখে। কিছুক্ষণ নিরবতার পর রমিজউদ্দিন বলে,
— বাড়ি ফেরার প্রয়োজন নেই। হলেই থাকো। পড়াশোনা শেষ করো। তারপর দেখা যাবে।
রিতী অবাক হয়। এক মুখে দুই কথা। রমিজউদ্দিন হালকা হেসে বলে,
— আমার একটাই ছেলে। যেদিন থেকে বুঝতে পেরেছি আমার ছেলে তার জীবন নিয়ে সিরিয়াস নয়, খেয়ালখুশি পনাতেই তার দিন চলবে সেদিন থেকেই আমার দুচিন্তার শুরু। আমি যদি ভীত না গড়ে যেতে পারি তাহলে আমার এই সব কিছু মানুষ অনাহারীর মতো খুবলে খুবলে খাবে। পৈতৃক সম্পত্তি হলে মেনে নিতে পারতাম কিন্তু আফসোস আমার সম্পত্তির নব্বই ভাগই আমার রক্তে গড়া। কতটা পরিশ্রম কষ্ট করে যে আজ এই পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছি তা একমাত্র আমি আর তোমার আম্মাই জানি। মানুষ সম্পদ গড়ে কেনো জানো? সুখে থাকার জন্য। আর বাবারা সম্পদ গড়ে তাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। যেদিন মা হবে সেদিন বুঝবে। সন্তানের ভালো থাকাটাই বাবা মার সবার আগে কাম্য। আমার এতো সম্পদ যদি আমার ছেলে, নাতি ভোগ না করে যেতে পারে তাহলে আমার এতো পরিশ্রম সবটাই বৃথা যাবে। মিথ্যে হয়ে যাবে আমার কষ্ট। সব সময় চেয়েছি যেনো আমার পরিবারে যোগ্য কেউ আসে যার হাতে আমি সবটা তুলে দিয়ে নিশ্চিত হতে পারি যে আমার বংধর ই এর ভোগ বিলাস করবে। তোমার কথা জানার পর তাই দ্বিমত করিনি। সবাই যোগ্য স্বামী পায়না। তবে চাইলেই সুখী হতে পারে। তোমার ভাগ্যকে সেই কাতারে ফেলে আমি এগিয়েছি। আমি জানি তুমি আমার হাল ধরতে পারবে। সেজন্য তোমাকে অবশ্যই আমার চেয়ারে বসার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।
— আব্বা…..?
— পড়াশোনা শেষ করো। আমি বেঁচে থাকতেই হাতে হাতে সবটা শিখিয়ে পরিয়ে দিবো। সব সময় ছেলেরাই যদি দায়িত্ব নেয় মেয়েরা তো পিছিয়ে থাকবেই। তুমি নিশ্চয় পিছিয়ে থাকার জন্য স্ট্রাগল করছো না। আমি চাই আমার নাতি নাতনি আমার সম্পদ ভোগ করুক। তারা ভালো জীবন যাপন করুক। আমার অক্লান্ত পরিশ্রম তাদের জন্যই।
রিতী কি বলবে জানেনা। এতোটা বিশ্বাস? এতোটা যোগ্য ভাবে তাকে? শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে অকপটে মাথা নেড়ে চুপ থাকে।
— সোহাগের খবর জানো?
রিতী চমকে তাকায়। মাথা নাড়িয়ে বলে,
— জানি। দেখা হয়। পথে দাঁড়িয়ে থাকে।
রমিজউদ্দিন বাঁকা হাসে। রিতীর মাথায় হাত রেখে বলে,
— এটা কোন খবর নয়। ও আবার মদে ঢুবে থাকতে শুরু করেছে। নেশা থেকে একবার দূরে সরিয়ে আবার নেশার দিকে ঠেলে দিচ্ছো ধ্বংস হয়ে যাবে যে।
— আবার!
— নেশা ছাড়া মানুষের জীবন মূল্যহীন। নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে বলেই জীবনের অর্থ মেলে। কেউ টাকার নেশা,কেউ ক্যারিয়ারের নেশা, কারো উড়ার নেশা, কারো ঘুরার নেশা, কারো মৃত্যুর নেশা আবার কারো বাঁচার নেশা । তোমার হাজবেন্ডের মৃত্যুর নেশা পেয়েছে। তার টনিক তোমার ভালোবাসা। নিজের মানুষের প্রতি অবহেলা করোনা। একবার হারালে আর ফিরে পাবে না। তাকে ভালো রাখার দায়িত্ব তোমার ই।
তুমিই পারো তাকে ঠিক রাখতে।
— কিভাবে?
— দেখা করো। কথা বলো। বোঝাও। লুকিয়ে থাকলে কি চলবে? তোমার কাছেই তো আমার ছেলেটা হেরে বসে আছে।
রিতী জোর করে হালকা হাসে। চোখে মুখে চিন্তার ছাপ পড়ে। ঠিকই তো। নিজেকে লুকাতে সোহাগের সাথে সে অনেক টা অন্যায় করে ফেলেছে।
চলবে,