বিষ_করেছি_পান (৪)

0
528

#বিষ_করেছি_পান (৪)

(কপি করা নিষেধ)
রুম্পা ঝালে অনবরত শুষিয়ে যাচ্ছে। তাকে পানি এগিয়ে দিচ্ছে ছানোয়ার। দুজনের মধ্যে একটু আগে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়ে গিয়েছে। ছানোয়ার রেগে মেগে কাঁচা মরিচ খাইয়ে দিয়েছে রুম্পাকে। এটা তিনি বরাবরই ঝগড়ার সময় করেন। স্ত্রী ঝাল খেতে পারেন না এটা যেদিন জানতে পেরেছিলেন সেদিন থেকেই এই কাজটা করে আসছে। রণচন্ডী রুপ ধারণ করা রুম্পাকে ঘায়েল করার এই একটাই উপায় উপর ওয়ালা তাকে দিয়েছেন। সেজন্য অনেক বার তিনি খোদার পানে শোকরিয়া আদায় করেছেন। এজন্য কখনো এই ঘরে কাঁচা মরিচের অভাব পড়ে না। গ্লাসটা সরিয়ে দিয়ে রুম্পা তেতে উঠল। ছানোয়ারের উপর চিল্লিয়ে বললো,
— মরিচ খাইয়ে স্বাদ মেটেনি? এখন কি পেটে পানি ভর্তি করিয়ে মারতে চাও?
— তোমার তো ঝাল কমছেনা রুম্পা।
ছানোয়ার আহত গলায় বললেন। ঝালটা যেনো আজ একটু বেশিই হয়ে গিয়েছে।
— তুমি তো এটাই চাও। আমাকে খেয়ে তোমার শান্তি হবে। ওমাগো ঠোঁট জলে গেলো গো। আমি মরলে আমার তিন তিনটা বাচ্চার কি হবে গো __ ওদের কে দেখবে গো __ কে মানুষ করবে?
— এই এই এখানে মরার কথা কোথা থেকে আসছে? আমি কি একবারও বলেছি তোমার মরার কথা?
— বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই যথেষ্ট।
— তুমি বুদ্ধিমান?
— কি বললে?

দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছুটি বাবা মার ঝগড়া দেখছিলো। কিন্তু কি নিয়ে ঝগড়া বেঁধেছে আন্দাজ করতে পারছেনা। তার বাবা মার অবশ্য ঝগড়া করার জন্য যথেষ্ট কোন কারন লাগে না। একটুতেই বেঁধে যায়।এসব দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে তিনভাইবোন। ছুটি পা টিপে টিপে রুমের দিকে এগোয়। তখনি মায়ের চোখে পড়ে যায়।
— এই ছুটি। এই হলো তোর সময় বাড়ি ফেরা?
ছুটি আর ঘরে গেলো না। মায়ের দিকে এগিয়ে গেলো। মনে মনে বিরবির করলো
— যেখানে সন্ধ্যে হয় সেখানেই বাঘের ভয়। আগে জানলে আরেকটু রাত করে ফিরতাম।
রুম্পা ছুটির হাতে পলি দেখে বললো,
— কিরে তোর হাতে?
— আইসক্রিম মা।
— দেতো খাই। তোর বাপে আজকেও আমাকে মরিচ খাইয়ে দিয়েছে। এই শেষ বার বলে দিলাম ছুটি। এর পর যদি ফের এরকম কিছু করে তোর বাপে তোরা তিনভাইবোন এর একটা বিহিত করেই ছাড়বি।
— করবো।

রুম্পা একটি আইসক্রিম শেষ করলো। তারপর বাকিটাও নিয়ে মুখে পুরে দিলো। ছুটি একটু হকচকিয়ে গেলো। নিজেরা খেয়ে রিতীর জন্য এই দুটোই এনেছিলো। তার মা যে এমন রাক্ষসের মতো আইসক্রিম খাবে সেটা জানলে ছুটি আরো দুটো আইসক্রিম নিয়ে আসতো। রিতীর আইসক্রিমে কিছুতেই ভাগ বসাতে দিতো না। ছুটির মনে হলো রিতীর ভাগ্যে নেই। কি নেই?কে নেই? সোহাগ কি নেই?

রিতী বইয়ের উপর হামলে পরেছে। সন্ধ্যা লাগলেই এই মেয়ের পড়তে বসতে হয়। বাইরে তুফান বয়ে গেলেও একে এখান থেকে তুলা যাবেনা যতক্ষন না সে নিজে উঠে। ছুটি তমালকে খুঁজতে লাগলো। আজ মা অনেক চেঁচামেচি করেছে। তমাল টা নিশ্চয় ভয় পেয়েছে। মায়ের চেঁচামেচি দেখলেই এই ছেলে ভয়ে গুটিয়ে পালায়। এভাবে চলতে থাকলে ছুটি ভেবে নিয়েছে তমালের ভবিষ্যত কি হবে? তমাল ভালোবেসে বিয়ে করে বউ নিয়ে আসবে। দরজায় দাঁড়িয়ে বলবে,
— মা আমি বিয়ে করেছি। তোমার বউমাকে বরণ করে ঘরে তুলে নাও।
মা পায়ের স্যান্ডেল তমালের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলবে,
— হতচ্ছাড়া বিয়ে করেছিস? তোর বউয়ের শখ আজ মেটাচ্ছি।
তমালকে আর কোথাও পাওয়া যাবেনা। যাক সব যাক। নতুন বউ চুলোয় যাক। তমাল শুধু মায়ের হাত থেকে বেঁচে যাক।

তমালকে খুঁজে পাওয়া গেলো বারান্দার এক চিপায়। ছুটিকে দেখে দৌড়ে এসে চেপে ধরলো। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
‘ রাক্ষসী আজ ক্ষেপেছে। চুপ চাপ ঘরে গিয়ে পড়তে বসো। নাহলে কপালে দুঃখ আছে।’
তমালের কথা শুনে ছুটি মুচকি হাসে। কোলে তুলে নিয়ে নিজের রুমে আসে। পুচকেটা তাকে শাষাচ্ছে। কি একটা অবস্থা! ভেবেই আবারো ছুটির হাসি পায় । তমালের গালে চুমু দিয়ে বলে,
— সামনের বছর তোকেও স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিবো। তারপর মা রেগে গেলে দৌড়ে গিয়ে পড়তে বসবি। তখন আর তোকে লুকানোর জায়গা খুঁজতে হবেনা।
— না না। আমি স্কুলে ভর্তি হবো না। সংসারের যে হাল! তোমাদের দুজনকে লেখাপড়া করাতেই সব যায় যায়।তার উপর আবার আমি! সামান্য বয়েজ স্কুলের গনিত শিক্ষকের কি এতো সামর্থ্য!
বলেই কোল থেকে নেমে বিছানায় পায়ের উপর পা তুলে সটানে শুয়ে পরে তমাল। ভাব খানা এমন যে সে নিজেই একজন গণিত মাস্টার। এইভাবে মাঝে মাঝে ছানোয়ার বলে। আত্মীয় স্বজনের সামনে দুঃখ প্রকাশ করে। তার হুবহু কপিবাজ তমাল। রিতী বাবার সাথে দুঃখিত হলেও ছুটি মোটেও দুঃখ প্রকাশ করে না। রিতীর উপর ছুটির বড্ড হাসি পায়। বোকা মেয়েটা জানেও না বাবা এসব এমনিতেই মুখের বুলি আওড়ায়। এইযে এতো এতো ছাত্রের ব্যাচ পড়ায়!মাসে পাঁচশ করে জনপ্রতি বেতন পায় এসব কোথায় যায়? সেই হিসেব কি কেউ করে? কেউ না করলেও ছুটি করে।
— তোর চিন্তা নেই তমাল।‌ তোর পেছনে যখন বেশি খরচ হবে তখন দেখবি আপু মস্ত বড় এক চাকরী করছে। তখন বাবাকেও আর তোকে খরচ দিতে হবেনা। তোর জন্য আমরা দুই বোন ই যথেষ্ট।

তিন মাথার খবর এখন পাঁচ মাথায় গিয়ে চেপে বসেছে। সবগুলো একসাথে শিপ্রুদের বাসার ছাদে মিটিং বসিয়েছে। রতন চোখ বন্ধ করে আছে। শিপ্রুও মুখ বাঁকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ঝিমা মলি ছুটিও চুপ। অথচ একটু আগে কার আগে কে কথা বলবে তার ছোট খাটো প্রতিযোগিতাও হয়ে গেছে। তবে এখন পরিবেশ শান্ত। শিপ্রু তো চিৎকার দিয়ে ধপ করে বসে পড়েছিলো গরম খবরটা পাবার সাথে সাথে। রতন ঠোঁট চৌখা করে বলে,
— কি বলিস! ঘটনা এতোদিনের?আমরা কেউ কিছুই জানিনা? বাঁধন ভাই কে বলতে হবে।
ঝিমা রতনের পিঠে হালকা দেয় এক চাপড়।
— ভাইয়া কালকে যে রিয়েক্ট করেছে এই খবর জানতে পারলে তো কেলেঙ্কারি করে ছাড়বে। তুই কি‌ জানিস না ভাইয়ার মাথা কেমন গরম?
মলি ভাব নিয়ে বলে,
— হয় হয়। এরকম মাথা গরম লোক একটু আধটু হতে হয়। নয়লে কি আর পুরো কলোনীর দাদা হওয়া যায়? এই কলোনীর ইয়াং জেনারেশনের মধ্যে সব থেকে বড় হচ্ছে বাঁধন ভাইয়া। আমরা তো সমবয়সী তাছাড়া ছোট বড় মিলিয়ে বাইশ জন বাচ্চাকাচ্চা। সব গুলারে সামলাতে গেলে মাথা গরম তো এমনিতেই হয়ে যায়।মুরুব্বিরাও তো বাঁধন ভাইয়ের কথার দাম দেয়। সেক্ষেত্রে বাঁধন ভাই কে বলাই যায়।
— তারপর কথাটা সোজা বাবার কানে যাক তোরা তাই চাস তাইতো?
ছুটির এই কথাটায় সবাই চুপ হয়ে যায়। আকাশ পাতাল অনেক ভাবনার পর রতন একটা বুদ্ধি বের করে।
— এই শোন। বড়দের কানে দেবার কোন দরকার নেই। যেহেতু ব্যপারটা আমরা জানতে পেরেছি সেহেতু আমরাই সলভ করে ফেলবো। আইডিয়া।
পাঁচ মাথা আবার এক হয়ে যায়। প্ল্যান প্রোগ্ৰাম শেষ করার পর সবার মুখে হাসি ফুটে। গোল চত্ত্বর হয়ে হৈ হৈ করতে করতে ঘুরে ঘুরে একসাথে নাচে। ঝিমা ছুটিকে বলে — তুই যদি আগেই আমাদের সাথে ব্যপারটা ডিসকাস করতি তাহলে কবেই ব্যবস্থা হয়ে যেতো। মাঝখান থেকে আপুকে এতো পেরেশানি হতে হতো না। মলি গালে হাত দিয়ে হতাশা নিয়ে বলে,
— হায়রে! প্রেমের পিরিতি আপু!
সবাই একসাথে খিলখিল করে হেসে ফেলে।
— ঐ ঐ রেডি হ। অপারেশন আজকে রাতে।
— জিও!
______________
রাত তিনটায় সোহাগ হুমুস্থুল করে বাড়িতে ঢুকলো। সোহাগের মা সোহাগী বেগম ছেলের জন্য ইজি চেয়ারে প্রহর গুনছিলেন। ছেলেকে এভাবে ঢুকতে দেখে চেয়ার ছেড়ে দু হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন।
— আব্বা! আব্বা। কি হয়ছে আমার আব্বার! এমন করতাছো কে আব্বা! হায় আল্লাহ। ও সোহাগের বাপ! সোহাগের বাপ! পোলা কেমন করতাছে। তাড়াতাড়ি আসো।
সোহাগী সোহাগকে ছেড়ে পানি আনতে দৌড় দিলো। কাজের মেয়েটাও চিৎকারে জেগে উঠেছে। সোহাগীকে পানি না নিতে দিয়ে নিজেই জগ গ্লাস একসাথে করে আনলো। সোহাগ সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছে। ধর ধর করে ঘামছে। রমিজ উদ্দিন ছেলের অস্বাভাবিক ঘাম দেখে দিক হারা হয়ে যায়। একটা মাত্র ই বংশের বাতি তার। কলিজা ছেড়া ধন। আদরের পুত্র। এই অবস্থা দেখে তাড়াহুড়ো করে পার্সোনাল ডাক্তারকে কল দেয়। সোহাগী কাজের মেয়েটাকে ধমক দিয়ে বলে,
— এইটা কি আনছিস? ফ্রিজের পানি আন। আমার আব্বা ঘামতাছে দেখস না ?
সোহাগ হাঁপাতে থাকে। কোন মতে কথা বলার শক্তি পেয়ে মাকে আস্বস্ত করে,
— আমি ঠিক আছি আম্মা। আপনে শান্ত হন।
— তুই ঠিক নাইরে আব্বা। হাতপা ছাইড়া দিতাছস কেন?ও বাপ!
— আম্মা গোসল করমু। আমার শরীরে ঠান্ডা পানি ঢালো।
রমিজ উদ্দিন ফোনে ডাক্তারকে পেলোনা। বেটা যে বুড়ো বয়সে বউকে নিয়ে মালদ্বীপে হানিমুনে গিয়েছে এটা মনেই ছিলো না। ফোনটা সোফায় ছুড়ে ফেললো। ছেলের কাছে এসে ছেলেকে ধরলো। সোহাগ বললো,
— আব্বা আমারে বাথরুমে নিয়ে চলেন।
রমিজ সোহাগী মিলে বাথরুমে নিয়ে গেলো । বাথটবের পানিতে একগাদা বরফ ঢালা হলো। প্রায় আধ ঘন্টা ঢুবে থেকে সোহাগ বেরিয়ে এলো। রমিজ ছেলেকে বুকে টেনে নিলো।
— সোহাগ! বাপ আমার। ভয় পাইছো?
— হ আব্বা। জনমের তরে ভয় পাইছি। এমন জিনিস কোনদিন দেখিনাই। আজকে তুমি তোমার পোলারে পাইতানা আব্বা।
— আব্বা এসব কথা বলা লাগেনা। কি হয়ছে কও।
সোহাগী মুখের সামনে গরম দুধ ধরে। সোহাগ ঢুক গিলে তার গলা দিয়ে তরল দুধটাও আজ নামবে না। এতো বছর থেকে এলাকায় সারারাত চষে বেড়াচ্ছে কখনো অস্বাভাবিক কিছু দেখেনি। আর আজ! কি দেখলো এটা? চেলাপেলার সাথে আড্ডা শেষ করে যখন বাড়ি ফিরছিলো তখন সে একা। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাস্তায় বাইকের হেড লাইট ই ভরসা। শিষ বাজাতে বাজাতে বাইক চালাচ্ছিলো ।হুট করেই লাইটের আলোয় কি যেনো একটা দেখলো। যত কাছে আসতে লাগলো ততো স্পষ্ট হয়ে উঠলো। সাদা শাড়ি লাল পাড়ে কে যেনো রাস্তায় মাঝখানে এসে হেলছে দুলছে। সোহাগ জোরে জোরে বললো,
— ঐ কে এটা? সরেন। সরেন সামনে থেকে।
তখনি কিটকিটিয়ে হাসির শব্দ পেলো। সোহাগের গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেলো। স্বভাব বশত পকেট থেকে খুরটা বের করে নিলো। একদম কাছে আসতে যা দেখলো তা দেখে খুর ফেলেই আল্লাহ আল্লাহ করে বাইক ঘুরিয়ে উল্টোদিক টান দিলো। কিছুটা যাবার পরে আবারো সামনে সেই সাদা শাড়ি লাল পেড়ে ভয়ঙ্কর ব্যক্তিকে দেখতে পেলো। সোহাগ গাড়ি ঘুরিয়ে আবার টান দিলো। আশ্চার্য বিষয় সেই ব্যক্তিটা আবার সামনে এসে উপস্থিত। সোহাগের আর বুঝতে বাকি রইল না। ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে পড়েছে সে। আজ তার মৃত্যু নিশ্চিত। চোখ বন্ধ করে যতটুকু পারা যায় পাওয়ার বাড়িয়ে বাইকে টান দিলো। বাকি পথ কিভাবে বাড়ি এসেছে সে জানে না।
সবটা শুনে সোহাগী হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ছেলেকে শাসিয়ে বললো,
— তুমি আর দেড়ি করে বাড়ি ফিরবে না। দশটার পর বাইরে থাকবেনা। আব্বা তুমি আমাদের সব। কেনো বুঝো না। তোমার নিরাপত্তা ই একমাত্র আমাদের কাম্য।
রমিজ ও সায় জানালো। সোহাগ চুপ থাকলো। তার শরীর আর চলছে না। বাবার বুকে ঘুম চলে এলো।
চলবে,

লাবিবা_তানহা_এলিজা~

ছবিয়াল: তরু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here