স্বর্নাভ_সুখানুভূতি আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা পর্ব-২১

0
286

#স্বর্নাভ_সুখানুভূতি

আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

পর্ব-২১

প্রাচীন রোমান দার্শনিক,মার্কাস টালিয়াস বলেছেন,
‘যতক্ষণ জীবন আছে, ততক্ষণ আশা আছে।
আল্লাহর উপর ভরসা করে একরাশ আশা নিয়ে কদম বাড়াল মুশরাফা। দরজার কাছে যেতেই ফোনটোন বেজে উঠল। আশারা সব ঝিলিক দিয়ে উঠল। ওর মন বলছে, এই ম্যাসেজেই সমাধান আছে। দ্রুত পায়ে ফিরে গিয়ে ফোন হাতে নিল। জাওয়াদের নাম্বার থেকে ম্যাসেজ,
‘ওপেন দ্যা ডোর।’

জাওয়াদ এসেছে! অবাক হলো মুশরাফা। উনি না দূরে ছিলেন, তবে কিভাবে আসলেন? ওর ভাবনার মাঝে কলিংবেল বেজে উঠল। সঙ্কেত বুঝে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। লুকিং মিররে তাকিয়ে বাইরে কারো অস্তিত্ব খুঁজে পেল না। ওড়নায় মুখ ঢেকে দরজা খুলল। উঁকি দিয়ে বাহিরটায় চোখ বুলাল। জাওয়াদকে চোখে পড়ল না। তবে তাকে বিস্ময়ের চূড়ায় পৌঁছে দিয়ে সিড়ির রেলিঙের উপর রাখা কাপড় চোখে পড়ল।

ছাদে মেলা জাওয়াদের কাপড়! এখানে কিভাবে এলো! সিড়ির নিচের দিকে তাকিয়ে খোঁজার চেষ্টা করল। ফাঁক দিয়ে তৃতীয় তলা বেয়ে নামতে দেখল এক বয়স্ক লোককে। লোকটাকে চিনে মুশরাফা। এ বিল্ডিংয়ের দারোয়ান। এ বাসায় আসার সময় দেখেছিল। লোকটাকে দেখেই দুয়ে দুয়ে চার মিলে গেল। মুখে চওড়া হাসির রেখা ফুটল। মনে আনন্দরা ঝিলিক দিয়ে উঠল।
মুশরাফার পর্দার ব্যাপারে স্বামীর পক্ষ থেকে প্রথম সাপোর্টিভ স্টেপ দেখে আনন্দে আত্মহারা হলো ও। লোকটা ওকে পর্দার ব্যাপারে সাপোর্ট দিতে শুরু করেছে! ভেবেই হাসি চওড়া হলো। কাপড় গুলো হাতে নিয়ে দ্রুত রুমে এলো। উচ্ছ্বসিত হয়ে কল করল জাওয়াদের নাম্বারে। কল বাজল, কিন্তু উঠানো হলো না। দ্বিতীয়বারে কেটেই দিল। যেন অপাশের মানুষটা জানে সে কী বলবে। আর এই কথাগুলো শুনতে সে আগ্রহী নয়।

বিরিয়ানির প্লেট শেষ করে ডেজার্টে চামচ ডুবিয়েছে জাওয়াদ। এর মাঝে ওর ফোন বেজে উঠল। রিসিভ করে কানে দিল। অপাশ থেকে কী বলল শুনা গেল না। জাওয়াদ কৃতজ্ঞতার সুরে বলল,
‘ধন্যবাদ চাচা। আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, মনে কষ্ট নিবেন না। আমি এসেই আপনাকে বকসিস দিব। ‘
পরপরই ফোন রাখল জাওয়াদ। সামনে তাকাতেই দেখলে অনিক তীক্ষ্ম চোখে ওকে পরখ করছে। ওর চোখে বিস্ময়। জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল,
‘এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? আমার রূপ বেয়ে বেয়ে পড়ছে?’

বন্ধুর কথায় অনিকের দৃষ্টি নরম হয়ে এলো। পুরো ব্যাপারটা পরখ করেছে ও। দূরে বসে ও চট করে সমাধান করা ব্যাপারটায় অনেক চমকিয়েছে বেশ। বন্ধুর মাঝে নতুন কাউকে আবিস্কার করেছে যেন সে। আকস্মিক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। কত চিন্তা ছিল এদের নিয়ে! এবার বোধহয় নিশ্চিন্ত হওয়ার সময় এসে গেছে। অনিক বিজয়ী হাসি দিয়ে বলল,
‘ শালা, তুই মানুষই আছিস। হুদাই অমানুষের ভান করে থাকিস।’

জাওয়াদ বিরক্তমাখা গলায় বলল,
‘কাপড়গুলো আমার। নয়তো আমার ঠেকা পড়েনি। ‘

অনিক হাসল,
‘কাপড়ের চেয়ে বড়ো কথা, বউটাও তোর। ঠেকাটা এখানেই।’

জাওয়াদ চোখ রাঙাল, ‘ এক লাইন বেশি বুঝিস তুই।’

অনিক ক্যাটকেট করে হাসল, ‘ বেশি হলে ও ঠিকটাই বুঝি। ‘

জাওয়াদের ফোন বাজল আবার। পর্দায় ‘রাফা’ নামটা ভাসছে। দেখেই কপাল কুঁচকাল । বিরক্তির সাথে বলল,
‘এই মেয়ে আমায় শান্তি দিবে না।’

ফোন কেটে বন্ধ করে রাখল। অনিক ঠোঁট চেপে হাসল। জাওয়াদ ঘুরে ফিরে বাড়ি ফিরল রাত আটটা নাগাদ। বাসায় গিয়ে সোজা মায়ের রুমে গেল। মা সেই যে রুমে ঢুকেছেন, আর বের হননি। মাকে এটা সেটা বলে রুম থেকে বের করল। জিশান বাইরে থেকে আসার সময় সবার জন্য বার্গার নিয়ে এসেছিল। মায়ের সাথে বসে বার্গার খেল। রুমে গেল না। সবার সাথে আড্ডায় বসল। আড্ডার ফাঁকে পানি খেতে ডাইনিংরুমে যেতে গিয়ে চোখ পড়ল রান্নাঘরে ভেতর। মুশরাফাকে দেখা গেল। মুশরাফা অন্যদিকে ফিরে বার্গার খাচ্ছে, বার্গার উপুড় করে দু’হাতে চেপে ধরে। সেদিনের মতো পড়ে যাচ্ছে না এদিক ওদিক। বেশ কায়দা করেই খাচ্ছে। এসব খাওয়ায় যে সে অভ্যস্ত তা বেশ বুঝা যাচ্ছে। জাওয়াদের সেদিনকার ধারণা আবারও ভ্রান্ত প্রমাণ হলো।

ওর তাকানোর মাঝে মুশরাফা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। চোখাচোখি হতেই চমৎকার হাসল। আধখাওয়া বার্গারটা একটু এগিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করল, ‘খাবেন?’

জাওয়াদ চোখ সরাল, হাঁটা ধরল। পানি খেয়ে আবার বসার ঘরে চলে গেল। রাতের খাবার খেয়ে রুমে গেল না। জিশানের সাথে বসে খেলা দেখল। রুমে গেল রাত এগারোটা নাগাদ। মুশরাফা ওকে দেখে হেসে সালাম দিল। জাওয়াদ সালামের উত্তর নিল মনে মনে। ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলল,
‘আমার জন্য এক কাপ কফি আনো।’

মুশরাফার অনেক কিছু বলার ছিল। অনেক কিছু করার ও ছিল। সামনে পেলেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছটাও ছিল প্রবল। কিন্তু এই ক্ষণে এসে মত পাল্টাল। মানুষটা যখন কোন ক্রেডিট নিতে চাচ্ছে না, তখন তাকে জোর করে ক্রেডিট দেয়া ঠিক হবে না। মনভর্তি খুশিমাখা কথাগুলো মনেই চেপে রাখল। হেসে বলল,
‘ নিয়ে আসছি। আর কিছু লাগবে?’

‘ না। খেয়েছো রাতে?’ জাওয়াদের প্রশ্নে মুশরাফা ভীষণ খুশি হলো। লোকটা ওর খোঁজ নিচ্ছে। মুশরাফা ধীর স্বরে বলল,
‘না।।’

মুশরাফার খুশির মাত্রাকে বিনাশ করে জাওয়াদ বলল,
‘রাতের খাবার খেয়ে আসবে। তুমি খাওনি শুনলে বাবা আমাকে বকবেন। তোমার জন্য আমি বাবার বকা শুনতে পারব না। ‘

মুশরাফা বুঝে উঠতে পারল না তার খাওয়া না খাওয়ার সাথে জাওয়াদকে বকার কী সম্পর্ক। সে ভ্রু কুঁচকাল। জাওয়াদ বলল,
‘ খেয়ে আমার জন্য কফি নিয়ে আসো। ‘

জাওয়াদ পাশ কাটল। মুশরাফা প্রশ্নবিদ্ধ মনেই রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল। সেই বিকেলে আকাশ বেয়ে পড়া বৃষ্টির বহার এখনো কমেনি। অবিরত বৃষ্টি ঝরছে। ঝিরিঝিরি শব্দ হচ্ছে। শব্দটা শুনতে ভালো লাগছে মুশরাফার। বৃষ্টি ওর বেশ পছন্দ। কফি বানাতে বানাতে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখল কিছুক্ষণ। হুট করেই মনে এক ইচ্ছে জাগল। কফি নিয়ে রুমে এসে বলল,
‘ছাদে যাবেন?’

জাওয়াদ ল্যাপটপে ফেসবুকিং করছিল। মুশরাফার কথা শুনে বাইরে তাকাল। বৃষ্টির অস্তিত্ব দেখে ভ্রু কুঁচকাল,
‘ এই বৃষ্টির মধ্যে ছাদে কেন যাব?’

‘ আমি বৃষ্টিতে ভিজব।’

জাওয়াদ দায়সারাভাবে বলল, ‘তো আমি কী করব? তুমি কি আমাকে বৃষ্টিতে ভিজতে বলছো? তেমন হলে বলি, আশা ছেড়ে দাও। আমি ওসবে নেই।’

‘আপনি কফি নিয়ে সিড়িঘরে দাঁড়িয়ে থাকবেন, না হয়। আমি ভিজব। চলুন না! আমার ভীষণ ইচ্ছে করছে ভিজার!’ অনুরোধ ঝরে গেল মুশরাফার স্বর থেকে।

জাওয়াদ বিরক্তিমাখা গলায় বলল,
‘সকাল থেকে এই ছাদে না যাওয়ার জন্য কত কী করলে? পর্দার খেলাপ হবে এই সেই। এখন সব কোথায় গেল?’

‘তখন তো দিন ছিল। আলোতে চারদিক থেকে সব দেখা যাচ্ছিল। তাকিয়ে দেখুন এখন বাইরে অন্ধকার। কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমি ছাদে থাকলে কেউ দেখবে না। আর বৃষ্টিতে ভেজা সুন্নত।’

ধীরেই বলল মুশরাফা। জাওয়াদ যেতে রাজি হলো না। মুশরাফা বুদ্ধিমত্তার সাথে চমৎকার এক গুটি চালল,
‘আমি কিন্তু খাইনি। আপনি যদি ছাদে না যান, তবে আমি খাব না। বাবার বকা খাবেন আপনি।’

এতেই কাজ হলো। জাওয়াদ রেগে তাকাল। তারপর যেতে রাজি হলো। মুশরাফা খেয়ে এলে দুজন ছাদে গেল। মুশরাফা খিমারের উপরে অংশ উপরে চাপাল গায়ে। ছাদের সিড়ির ঘরে গিয়ে খুলে ফেলল। অন্ধকারে জাওয়াদকে ও দেখা যাচ্ছে না। মুশরাফা হাতড়ে রেলিঙের উপর রাখল। তারপর সামনের দিকে পা বাড়িয়ে বলল,
‘ বৃষ্টির সময় দোয়া কবুল হয়। আপনি এখানে দাঁড়িয়ে দোয়া করুন। আমি যাই।’

জাওয়াদ বলল,
‘আমি কফি শেষ হলেই কিন্তু চলে যাব।’

মুশরাফা না শোনার ভান করেই ছুটে গেল ছাদে। বৃষ্টিতে উচ্ছল কিশোরীর মতো ভিজতে লাগল। জাওয়াদ দাঁড়িয়ে রইল দরজায়। একবার বিদ্যুৎ চমকাল। খনিক আলোতে দেখল মুশরাফার প্রাণোচ্ছল রূপ। এক নতুন রূপ। কে বলে পর্দা করা মেয়েদের শখ আহ্লাদ নেই? আছে, বোধহয় একটু বেশিই।

আকস্মিক জোরে বজ্রপাত হলো। আওয়াজে জাওয়াদ কেঁপে উঠল। দরজায় দাঁড়িয়ে কড়া স্বরে জানাল,
‘ আমি চলে যাচ্ছি। তুমি যাবে? ‘

জাওয়াদের কথা কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্রই মুশরাফা আকুল আবেদন করল,
‘আর একটু থাকি না!’

জাওয়াদ ধমকে উঠল,
‘তোমার এই বজ্রপাতে স্ট্যাচু হয়ে থাকতে ইচ্ছে হলে থাকো। আমি কি না করেছি? আমি চলে যাচ্ছি।’

জাওয়াদ ফোনের ফ্লাশ জ্বালাল। দেহ ঘুরিয়ে ফেরা ধরল। অগত্যা মুশরাফাকে ও আসতে হলো। ভেজা গায়ে খিমার পরে শরীর ঢাকল। তারপর নিচে নামতে ধরল। ঠান্ডাজনিত ধাত থেকে সিড়ি পথেই হাঁচি শুরু হলো।
জাওয়াদ বলল,
‘বড়োদের বিরক্ত করার আর বেয়াদবি করার শাস্তি দিচ্ছেন আল্লাহ। চমৎকার। আর ভিজবে?’

মুশরাফা দমল না। হাঁচি দিতে দিতে বলল,
‘ মজা লেগেছে আবার ভিজব। ‘

জাওয়াদ আর কিছু বলল না। এই মেয়ের সাথে কথা বলে পারা যায় না। রুমে গিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল মুশরাফা। জাওয়াদ শুয়ে পড়ল। মুশরাফা ফিরেই লাগাতার হাঁচি দিতে লাগল। মাথা নাড়াতেই চুলের পানি গিয়ে পড়ল জাওয়াদের মুখে।

জাওয়াদ ধমকে উঠল,
‘ তোমার নুডলস হেয়ার মুছো, আমার মুখে পানি পড়ছে। আর একদম হাচ্চু হাচ্চু করো না। তোমার জন্য আমার ঘুমে ডিস্টার্ব হচ্ছে। ‘

বিড়বিড় করে বলল, ‘অসভ্য মেয়ে। ‘

মুশরাফা কিছু বলল না। টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে জাওয়াদের রাগ দেখে হাসল। ওর হাসি চওড়া হলো ড্রেসিংটেবিলের উপর ওষুধের বক্সটা দেখে।

ওষুধ খেয়ে ঘুমানোয় জ্বর এলো না। হাঁচি বন্ধ হলো মাঝরাতে। আর সর্দির উৎপত্তি হলো। ঘুম হলো না । ফজরের সময় জাওয়াদকে জাগিয়ে তুলল। আজ বেশি গড়িমসি করল না। বাবার কল পেয়ে অযু করে মসজিদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। বৃষ্টি নেই তখন। বাবা ছেলে নামাজ পড়ে ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশে হাঁটতে বেরুলো। আপন করে বাবা ছেলে একে অপরকে পেল। কত গল্প গুজব হলো!

মুশরাফার শরীর খারাপ লাগলেও বসে রইল না। উঠে নাস্তা বানাল। জাওয়াদের টিফিন রেড়ি করল, ফরমাল ড্রেসাপ বের করে রাখল। যত যাই হোক মুশরাফার দায়িত্ব পালনে নড়বড় নেই। সকাল সবার সামনে মায়মুনা মুশরাফাকে কিছু বললেন না। স্বামী, ছেলেরা অফিসে চলে যেতেই কাল স্বামীর ধমক দেয়া নিয়ে কথা শুনালেন। অপবাদ দিলেন, মুশরাফা তাবিজ করে তার পরিবারের সবাইকে নিজের দিকে করে নিচ্ছে। যার কারণে জয়নাল আবেদীন পুত্রবধুর জন্য স্ত্রীকে বকছেন। সংসারে অশান্তি করছে.. আরও কত অপ্রাসঙ্গিক কথা টেনে আনলেন।
মুশরাফা চুপ রইল। মনে মনে বলল, ‘আল্লাহ উনাকে হেদায়েত দান করো। ‘

বকাঝকা যখন চেঁচানোর পর্যায়ে চলে গেল। তখন মুশরাফা ধীর স্বরে বলল,
‘ বিশ্বাস করুন মা, আমি আপনাদের সবার ভালো চাই, শান্তি চাই। সেই সাথে নিজের ও সুখ চাই। আল্লাহর সন্তুষ্টি চাই। এই চাওয়া থেকেই আমাকে কঠোর হতে হচ্ছে। আর কিছুই নয়।’

মায়মুনা দমলেন না। বখে গেলেন। উছিলা ধরে ধরে বকলেন সারাদিন। এভাবে কাটল কদিন। রুমের বাইরের ঝামেলা কখনো রুমের ভেতর টানে না মুশরাফা। শ্বাশুড়ির কৃতকর্মের জন্য স্বামীর কাছে অভিযোগ করে না। মায়মুনা ও সেদিনের পর ছেলে বা স্বামীর সামনে মুশরাফাকে কিছু বলেন না। তাদের অনুপস্থিতিতেই অপমানের ছুতো খুঁজেন। সে হিসেবে জাওয়াদ ও খুব একটা আঁচ পায়না। স্বাভাবিক চলছে জীবন। বাবা আর বউয়ের ডাকাডাকিতে নামাজ পড়ছে।

একদিন হলো কী? মুশরাফা ওকে পরীক্ষা করতে চাইল যে, ওর নামাজে অভ্যাস হয়েছে কি না। সেদিন নিজে উঠল, জাওয়াদকে জাগাল না। জাওয়াদ উঠতে পারল না। মুশরাফা চাপা শ্বাস ফেলল।
জাওয়াদের নামাজ কাযা হবে ভেবে না শেষ দিকে আর না জাগিয়ে পারল না। জাগাল, উঠল না। জয়নাল আবেদীন ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে একাই নামাজে চলে গেলেন। জাওয়াদ পরীক্ষায় ফেল করল।
মুশরাফা অভিমানে মুখ ফুলাল। সিদ্ধান্ত নিল, আজ সারাদিন জাওয়াদের সাথে কথা বলবে না। যার নামাজের প্রতি টান নেই, তার সাথে কিসের কথা? নিত্যকার নিয়মে সকালে রান্নায় মগ্ন হলো। টিফিন রেডি করল ঠিকই, কিন্তু রুমে দিল না। কিচেনেই রেখে দিল। রুমেই এলো না আর।

জাওয়াদের ঘুম ভাঙল সাড়ে ন’টার পর। অফিসটাইম পেরিয়ে গেছে। ঘুম ভাঙতেই ঘড়ি দেখে যারপরনাই অবাক হলো। নামাজের আগে অফিসের কথাই মাথায় এলো ওর। তড়িঘড়ি করে উঠে ওয়াশরুমে দৌড় দিল। জাওয়াদের অফিসের ড্রেসাপ মুশরাফা বের করে। সব রেড়ি করা থাকে। আজ সময়ের মতো সব কিছুই এলোমেলো পেল জাওয়াদ। কিছুই ঠিকঠাক নেই। মুশরাফার ও দেখা নেই। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে হুলস্থুল লেগে গেল। শার্ট প্যান্ট পাচ্ছে না, ওয়ালেট পাচ্ছে না, ঘড়ি পাচ্ছে না।
জাওয়াদ দিশেহারা হয়ে মুশরাফাকে ডাকল,
‘মুশরাফা, মুশরাফা! ‘

জবাব এলো না। জাওয়াদে চেঁচিয়ে ডাকল। মুশরাফা সকালের নাস্তা করছে। যে সে জাওয়াদের ডাক শুনেইনি। মায়মুনা বসার ঘরে টিভি দেখছেন। ছেলের ডাকাডাকিতে বেরিয়ে এলেন। মুশরাফাকে খেতে দেখে ধমকালেন,
‘জাওয়াদ ডাকছে, শুনতে পাচ্ছিস না? কানে তুলো দিয়েছিস? তোর খাওয়া তো চলে যাচ্ছে না। ফকিরের মতো সারাদিন খাওয়ার পিছনে ছুটিস। বেয়াদব। যা দেখে আয়, আমার ছেলে কেন ডাকছে।’

মুশরাফা খাওয়া থামিয়ে রুমে গেল। ওকে দেখেই জাওয়াদ ও ধমকে উঠল,
‘ এই মেয়ে থাকো কোথায় তুমি? এতবার ডাকা লাগে কেন? আমার অফিসের সময় পেরিয়ে গেছে, জাগাওনি কেন? অফিসটা মিস হয়ে যাচ্ছে।’

মুশরাফা জাওয়াদের স্বরে অনুতাপের ছায়া খুঁজল, পেল না। লোকটার মনে ও নেই সে যে নামাজ পড়েনি। শুধু অফিস মিস হওয়ার চিন্তায় অস্থির, এদিকে যে নামাজ মিস হয়ে গেছে তার ক্ষীণ চিন্তাও নেই। মুশরাফার অভিমানের মাত্রা বাড়ল। সে উত্তর দিল না। তাকাল ও না। জাওয়াদ আদেশের সুরে বলল,
‘আমার শার্ট প্যান্ট নামিয়ে দাও।’

মুশরাফা চুপচাপ নামিয়ে রাখল। তারপর পাশ কাটিয়ে বারান্দায় চলে গেল। জাওয়াদ ওর নির্লিপ্ত ভাব দেখে ভ্র কুঁচকাল। তবে বিশেষ প্রাধান্য দিল না। তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল। টিফিনটা রয়ে গেল কিচেনে। তাড়াহুড়ায় মনে নেই। প্রতিদিন লাঞ্চ আওয়ারে মুশরাফা কল দিয়ে খবর নেয়, লাঞ্চ করেছে কি না। আজ ফোন দিল না, খোঁজ ও নিল না। টিফিন না নেয়ার ব্যাপারটা তখন টের পেল জাওয়াদ । নিজেই ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘আজ টিফিন দাও নি কেন?’

মুশরাফা উত্তর দিল না । খট করে ফোন রেখে দিল । জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল। হলো কী এই মেয়ের? আবার কল দিল। এবার ধরল না। জাওয়াদ ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে গিয়ে পৌঁছাতে পারল না। তবে মুশরাফার যে কিছু একটা হয়েছে তা আঁচ করতে পারল। বাসায় ফিরেও মুশরাফার আচরণ অদ্ভুতই পেল। তবে এবার কারণটা ঠিক টের পেয়ে গেল। তারপর…

চলবে…

ফুটনোট:
হজরত সাহল বিন সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, দুই সময়ের দোয়া কখনো ফেরত দেওয়া হয় না। আজানের সময় যে দোয়া করা হয় এবং বৃষ্টি চলাকালীন যে দোয়া করা হয় (আবু দাউদ-২৫৪০)।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here