যখন_দুজনে_একা ৬৭ পর্ব

0
646

#যখন_দুজনে_একা

৬৭ পর্ব

মাহি অবাক হয়ে রুবার চলে যাওয়া পথটার দিকে তাকিয়ে রইল। সে বুঝতে পারছে না আসলে কি হলো ! রুবা কি রাগ করলো, নাকি কোন কাজের কথা মনে হতেই নিচে নেমে গেল।
মাহি দিশাকে বলল,
: তুমি কি আরো থাকবে দিশা এখানে ?
: তুমি চলে যেতে চাচ্ছো ?
: চলো নিচে নামি !
: রুবার না আসার কথা এখানে ?
: ওর কাজের শেষ আছে , ছেলেরা ব্যস্ত করে রেখেছে হয়তো !
: ঠিক আছে চলো নামি নিচে !
ওরা দুজন নিচে নেমে এলো । মাহি তাকিয়ে আশেপাশে রুবার খোঁজ করলো । না কোথাও রুবাকে দেখা যাচ্ছে না ! রুমে আছে মনে হয় ! মাহি নিজেদের বেড রুমের দিকে উঁকি দিয়ে দেখে রুবা সেখানেও নেই। আশ্চর্য এখানেও নেই ! কোথায় ও ?
মাহি রান্না ঘরে গিয়ে দেখে এলো ! রুবা সেখানেও নেই!
ফারিদা কে দেখে মাহি রুবা কোথায় জিজ্ঞাসা করলো ?
: ভাবি তো বাবুদের কাছে !
: না ওখানে তো দেখলাম না !
: আচ্ছা খুঁজে দেখছি ভাইজান !
: না তোমার খুঁজতে হবে না , আমি দেখছি !
মাহি রান্না ঘর থেকে লিভিং রুমে এসে বসলো ! আশ্চর্য রুবা তো বাচ্চাদের কাছে আর কিচেনে ছাড়া কোথায় যায় না ! মাহি মায়ের ঘরে উঁকি দিল মা বসে ফোনে কথা বলছে কারো সঙ্গে, লাইলি বুয়া রাহিল, সাহিল কে নিয়ে বসে আছে ! মাহি দুজনের কাছে এসে বসলো, আমার জান বাচ্চারা কি করে ?
তারপর লাইলি বুয়াকে বলল, বুয়া তোমার ভাবি কোথায় ?
: এই ঘরে আসে নাই ভাইজান!
দুই ছেলেকে কিছুক্ষণ আদর করে
মাহি মায়ের ঘর থেকে বের হয়ে এলো । তার কেমন অস্থির লাগছে ! রুবার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকতে ইচ্ছে করছে ।
মাহি কিছুই করলো না চুপচাপ নিজেদের বেড রুমে গিয়ে সোফায় আধশোয়া হয়ে টিভি দেখা শুরু করলো সে ।
মনে মনে বলল, রুবা আর যাবে কোথায় আসবে একটু পর । মাহি একবার ভাবলো ফোন দিবে মোবাইল এ । তারপর ফোন বের করে মেসেজ দিল শুধু,
” প্রিয় জ্বর আর কিছুদিন থাকো
অন্তত এই বাহানায় আর কিছুদিন সে আসুক
আমার কপাল হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে
সে যদি আমার ভিতরের অসুখ বুঝতে পারে ”
রুদ্র গোস্বামী র কবিতার লাইন লিখে পাঠিয়ে দিল মাহি !
মেসেজ সীন হলো না ! ফোন সঙ্গে আছে তো রুবার ?
সে আবার মেসেজ দিল,
” আমার চোখের শান্তি কোথায় তুমি ? ”

মাহি শুয়ে রুবার জন্য অপেক্ষা করছে।
অপেক্ষা করতে করতে একটা সময় ঘুমিয়ে গেল মাহি !
অসুস্থ হ‌ওয়ার পর থেকে শরীর এত দূর্বল যখন তখন ঘুমিয়ে যায় সে।
ঘুম ভেঙ্গে উঠে দেখে রুবা আর বাচ্চারা ঘুমাচ্ছে। মা বিছানায় নেই !
মাহিকে ঘুমানোর আগে একবার ও ডাক দেয়নি রুবা !
মা কোথায় আজ ?
মাহি উঠে রুবার কাছে গিয়ে বসলো ! ঘুমাচ্ছে রুবা। রুবার ঠোঁটে আলতো করে চুমু দিল , গভীর ঘুমে অচেতন রুবা।
ছেলেদের ও চুমু খেল মাহি তারপর রুম থেকে বের হয়ে এলো।
রুমের বাহিরে ফরিদা বুয়া র সঙ্গে দেখা ।
: এত রাত হলো বুয়া মা কোথায় ?
: আব্বার শরীর খারাপ আম্মা ঐ ঘরে আসতেছে একটু পর !
: বাবার শরীর খারাপ কখন থেকে ?
মাহি ছুটে বাবা মায়ের ঘরের দিকে গেল।
দরজায় নক করে ভেতরে ঢুকলো মাহি।
: কি হয়েছে বাবা তোমার ?
: তেমন কিছু না প্রেসার টা একটু বেড়ে গেছে ! তোমার মা অস্থির হচ্ছে শুধু শুধু।
: মা আমাকে ডাকলে না কেন ?
: তুমি ঘুমাচ্ছিলে !
: আশ্চর্য মা ঘুমিয়ে ছিলাম বলেই তো ডাকবে, দেখি প্রেসার মেশিন দাও !
: এখন ঠিক আছে মাহি !
: বাবা আমি দেখি আগে তারপর !
প্রেসার মেপে দেখে একটু বেশি এখনো ।
: ঘুমের ওষুধ দিচ্ছি খেয়ে একদম ঘুম দাও !
মা তুমি আজ বাবার এখানে থাকো না হয় ?
: না আমি ঠিক আছি তোমার মা বাচ্চাদের সঙ্গে থাকুক রুবার শরীর খারাপ ও রাতে রাখতে পারবে না !
: মা রুবার শরীর খারাপ আমাকে জানানোর দরকার মনে করলে না কেউ ? মাহি রাগ হয়ে বলল।
: মাথা ব্যথা করছিল রুবার আমি বললাম ঘুমিয়ে যাও ঠিক হয়ে যাবে ! এত অস্থির হ‌ওয়ার কিছু নেই !
: তবুও ডাকতে আমাকে ।
: তুমি এত গভীর ঘুমে ছিলে মাহি ,রুবাই ডাকতে না করলো। এখন যাও দাদির রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ো । রুবাকে ডেকো না ঠিক ভাবে ঘুমাতেও পারে না মেয়েটা।
মাহি নিজের ঘরে রুবার কাছে এসে দাঁড়ালো । সে শিওর রুবা কিছু নিয়ে অভিমান করে আছে । তা না হলে ঘুমাতে যাওয়ার আগে রুবা ওর সঙ্গে কথা বলবে না কখনো এমন ঘটনা ঘটে নি !
মাহির ইচ্ছে করছে রুবাকে ডেকে তুলতে। কিন্তু ওর মাথা ব্যথা ছিল এখন ডেকে তুললে আবার যন্ত্রণা বাড়বে।
মাহি ঘুমন্ত রুবার হাতটা ধরলো । নিজের গালের সঙ্গে স্পর্শ করলো।
তারপর মনে মনে বলল, তুমি আমার উপর রাগ ও করতে পারো রুবা ! কালকে শুনব কি ঘটনা কেন আমার পাগলি আমার উপর রাগ করে আছে।
মাহি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল রুবার দিকে। ওর ইচ্ছে করছে রুবাকে ডেকে নিজের ঘরে নিয়ে যেতে তারপর আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে। কতদিন রুবাকে আদর করা হয় না। মনে মনে হাসলো মাহি।
কিন্তু মা এসে রুবাকে না দেখলে ডাকাডাকি করবে ।
মাহি ঘর থেকে বের হয়ে দাদির রুমে ঢুকলো । বিছানায় শুয়ে চিন্তা করছে কি কারন হতে পারে রুবার রাগের ?
শুধু শুধু ভাবছি, রাগ অভিমান কিছুই না ওর মাথা ব্যথা ঘুমিয়ে গেছে আমি ঘুমাচ্ছিলাম তাই ডাকেনি । মাহি এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে গেল।

খুব সকালে মাহির ঘুম ভাঙল ডাক্তার রিয়াদ এর ফোনে! রিয়াদের ওয়াইফ ডাক্তার শাহানার ভাই এক্সিডেন্ট করেছে এখনি মাহি কে হসপিটালে আসতে অনুরোধ করলো রিয়াদ ।
মাহি খবর শুনেই তড়িঘড়ি করে রেডি হয়ে বের হয়ে গেল। রিয়াদ আর শাহানার সঙ্গে মাহির সম্পর্ক কলিগ কম বড় ভাই ছোট ভাই বেশি। একেঅপরের আপদে বিপদে সব সময় পাশে আছে।
এত সকালে মাহি ইচ্ছে করেই কাউকে ডাকেনি। বুয়ারাও সামনে ছিল না মাহি কাউকে কিছু না বলে সোজা নিচে নেমে গেল রেডি হয়ে।
যাওয়ার সময় নিচে দিশার সঙ্গে দেখা মাহির!
: এত সকালে কোথায় যাচ্ছো দিশা ?
: আটটার ফ্লাইটে কক্সবাজার যাচ্ছি, বিকালেই ফিরব ! আসি রাতে কথা হবে মাহি!
: তোমার গাড়ি কোথায় ?
: গেটের বাহিরে অপেক্ষা করছে !
: তুমি এত সকালে হসপিটালে যাচ্ছো যে আজ মাহি ?
: আমার কলিগের ভাই এক্সিডেন্ট করেছে তাই যেতে হচ্ছে !
: ও আচ্ছা ।
মাহি আর দিশা বের হয়ে গেল যার যার কাজে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে রুবার মনটা খারাপ লাগছে খুব । শুধু শুধু মাহির উপর মন খারাপ করে আছে সে । রাতে না বলে ঘুমিয়ে গেল ,মাহি নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়েছে ! বাচ্চাদের খাইয়ে সে রুম থেকে বের হয়ে এলো । মাহির কাছে সে এখন থাকবে অনেকক্ষণ। ছেলেরা উঠলে দাদি সামলাতে পারবে। মাহি ঘুমিয়ে থাকলেও ওর বুকে শুয়ে থাকবে সে ।
রুমে ঢুকে অবাক হলো রুবা , সকাল সকাল উঠে গেছে মাহি !
: কোথায় ও ?
: পুরো দোতলায় খুঁজে না পেয়ে মাহিকে, নিচে নেমে এলো রুবা ! নিচে কেয়ার টেকার কুদরত ভাইয়ের সঙ্গে দেখা !
: আপনার ভাইজান কোথায় কুদরত ভাই ?
: ভাবি ভাইজান তো কোন সকালে গেছে একদম সকাল সকাল!
: হসপিটালে?
: জানি না তো। তয় বিদেশি আফা আর ভাইজান এক সাথেই গেছে বাহিরে !
মনে মনে রুবা বলল, মাহি আর দিশা আপু এক সঙ্গে বাহিরে গেছে ! কোথায় গেল , যাওয়ার আগে মাহি ওকে একবার ও বলে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না !
রুবা দৌড়ে দোতলায় উঠে এলো । ওর খুব কান্না পাচ্ছে মাহি কখনো এই কাজ করে না । ওকে না বলে বাসার বাহিরে যাবে না ! দিশা আপুর সঙ্গে যাচ্ছে একবার বলে যেত ও , আমি কি বাঁধা দিতাম !
রুবার খুব কষ্ট হচ্ছে। মনে মনে বলল, যাও যেখানে খুশি যাও আমি জানতেও চাইব না ।
রুবা নিজের রুমে এসে ঢুকলো। ওয়াস রুমে ঢুকে অনেকক্ষণ কাঁদল সে।
কষ্টে, অভিমানে তার বুকটা ভেঙে যাচ্ছে কেন জানি !

সারাদিন রুবা ছেলেদের সঙ্গেই র‌ইল । রুম থেকে বের হলো না ! শ্বাশুড়ি মাহি কোথায় গেছে জানতে চেয়েছে ওর কাছে !
: জানি না মা , আমি তো এই ঘরে ঘুমিয়ে ছিলাম !
: হসপিটালে গেছে , ওর না শরীর খারাপ ?
: মা ভালো লাগছে বলেই গেছে হয়তো ! অভিমান করে বলল রুবা।
সাফিয়া বেগম রুবার দিকে তাকালেন । উনার রুবার মুখটা দেখে অন্যরকম লাগছে । মনে মনে ভাবলেন, রুবার কি কোন কারণে মন খারাপ !
: কি হয়েছে তোমার রুবা ?
: কিছু হয়নি তো মা !
: তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার মন খারাপ !
: না মা আমি ঠিক আছি !
রুবা উঠে গেল বাচ্চাদের ফিডার হাতে নিয়ে !
সাফিয়া বেগম মনে মনে চিন্তা করলেন ,রুবা তো কখনো তার কাছে কোন কথা এড়িয়ে যায় না ! তবে কি মাহি আর রুবার মাঝে কোন কিছু নিয়ে মনোমালিন্য চলছে ? মাহির রাগ একটু বেশি কিন্তু ওর মন অনেক বড়। রুবাকে সে খুব ভালোবাসে , রুবার সব কিছুতেই খুব খেয়াল তার তাহলে আজ কি হলো !
সাফিয়া বেগমের চিন্তা হচ্ছে একটু , পরোক্ষনেই তিনি ভাবলেন রুবার মন খারাপ মাহি দুই মিনিটেই ঠিক করে দিবে আসুক বাসায়! এক্ষেত্রে মাহির হাতে জাদু আছে !
বিকেলে সাফিয়া বেগম রুবাকে নিজের ঘরে ডাকলেন!
রুমে ঢুকে রুবা বলল, মা আমাকে ডেকেছেন ?
: একটা জিনিস দেখানোর জন্য ডেকেছি, বসো !
সাফিয়া বেগম রুবার হাতে দুইটা ছবি তুলে দিলেন !
: আপনার ছবি মা , কোলে কে ?
: কোলে তোমার মাহি !
রুবা অবাক হয়ে গেল, মা দেখেন পুরো সাহিলের মত !
: হুম ,বলেছি না তোমার ছোটটা একদম বাবার চেহারা পেয়েছে !
: হুম আর স্বভাব ও।
সাফিয়া বেগম হাসলেন! আজ আলমারি থেকে বের করলাম ছবি টা। তখন মাহির বয়স কত জানো , দুই মাস ! ছবির পিছনে তারিখ লিখা আছে দেখো।
: তাই !
: হুম তোমার শ্বশুর নিজে তার ক্যামেরা দিয়ে তুলে দিয়েছে !
রুবা তোমার ছেলেদের তো দুই মাস আজ হয়েই গেল আমি চাই আজ তুমি এভাবে ওদের নিয়ে ছবি তুলো । বাবা আর ছেলেদের এক‌ই বয়সের ছবি থাক! তারপর আমি ছবি গুলো বাঁধিয়ে দেয়ালে টাঙ্গিয়ে রাখব।
: ঠিক আছে মা আজ ছবি তুলে রাখব।
: এভাবে ওভাবে না তুমি আমার এই শাড়িটা পড়বে সুন্দর করে রেডি হয়ে যেভাবে মাহিকে নিয়ে তুলেছি সেভাবে রাহিল, সাহিল কে নিয়ে তুলবে !
: ঠিক আছে মা , শাড়ি টা আছে এখনও আপনার ?
: হুম আছে আমি বের করে রেখেছি !
সাফিয়া বেগম একটা আকাশি রঙের জর্জেট বেনারসী শাড়ি বের করে দিলেন সিলভার জড়ীর কাজের শাড়িটা হাতে নিয়ে রুবা মুগ্ধ হয়ে গেল।
: মা শাড়িটা এখনো কত সুন্দর !
: তোমার শ্বশুর কিনে দিয়েছিল!
: সঙ্গে ডায়মন্ডের জুয়েলারি পড়লে ভালো লাগবে ,তাই না মা ?
: হুম!
: মা আমি নিয়ে যাচ্ছি শাড়ি টা ।
: ঠিক আছে যাও !
রুবা উঠে যাচ্ছে সাফিয়া বেগম আবার ডাকলেন ওকে!
: রুবা একটু শোন
: জ্বি মা !
: মাহি কি তোমার সঙ্গে কোন মিস বিহেভ করেছে ?
: না মা সেরকম কিছু না তো !
: তোমার মনটা মনে হচ্ছে খারাপ !
: না মা আপনার ছেলের সঙ্গে সকালে দেখাই হলো না ও‌ কাউকে না বলে চলে গেল ওর শরীর টাও তো খারাপ তাই চিন্তা হচ্ছে ।
: তুমি চিন্তা করো না বিকাল হয়েছে চলে আসবে এখন ! তুমি যাও রেডি হ‌ও । আর মাহির ক্যামেরা টা বের করো আমি ছবি তুলে দিব!

রুবা শ্বাশুড়ি র শাড়ি পড়ে ছেলেদের নিয়ে ছবি তুলেছে। মাহিকে নিয়ে সাফিয়া বেগম যেভাবে ছবি তুলেছে সেভাবেই সে তার দুই ছেলেকে নিয়ে ছবি তুলল।
: তুমি শাড়ি চেন্জ করবে না মাহি আসলে ওদের নিয়ে ছবি তুলবে !
: আপনার ছেলে কখন আসবে ঠিক আছে ?
: তারপরও তুমি শাড়িটা পড়ে থাকো।
রুবা মনে মনে ভাবছে দিশা আপুর সঙ্গে ঘুরতে গেছে কখন আসে তার কি ঠিক আছে ! দিশা আপু
চলেই যাবে তাই হয়তো গেছে দুজন ঘুরতে, শপিং করতে। শুধু আমাকে বলে গেলেই হতো আমি না করতাম কি ?
রুবার চোখ ভিজে উঠলো ।
মন জিনিস টা এত বিচিত্র কেন , কেন বুঝেও অবুঝ হয়ে যায়!
সাফিয়া বেগম রুবার মুখটা দেখে খুব চিন্তায় আছেন । কেমন থমথমে হয়ে আছে চোখ মুখ। মাহিকে দুবার ফোন দিলেন তিনি কিন্তু মাহির ফোন বন্ধ।
ছেলেটা কখনো কখনো এমন কাজ করে, রুবা মুখে কিছু জীবনেও বলবে না কিন্তু জানেন খুব মন খারাপ রুবার! ছবি তোলার সময় মন ভালো ছিল মেয়েটার কিন্তু এত রাত হয়েছে এখনও মাহি আসছে না কতক্ষণ অপেক্ষা করবে রুবা !
: মা আমি শাড়ি খুলে ফেলি আপনার ছেলের আসতে আরও দেরি হবে । ছবি তোলার আমার ইচ্ছে করছে না আর ।
: রুবা মা আমার আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো , আমার জন্য প্লিজ!
: প্লিজ বলার দরকার নেই মা, আপনার জন্য আমি শাড়ি পড়েই থাকব!
রাত বারটা বাজার আগে আগে মাহির গাড়ি এসে বাসায় ঢুকলো।
সাফিয়া বেগম এক নাতিকে নিয়ে লিভিং রুমে বসে ছিলেন !
মায়ের কঠিন মুখ দেখেই মাহি আগেই বলে উঠলো ,
: মা আমি বুঝতে পারছি তোমরা অপেক্ষা করে ছিলে সব বলছি কেন দেরি হলো আগে গোসল করে আসি! আমি গোরস্থান থেকে আসলাম!
: কি, কে মারা গেছে মাহি ?
: রিয়াদ ভাইয়ের ওয়াইফ ডাক্তার শাহানার বড় ভাই ! আজ ফজরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে আসার সময় একটা প্রাইভেট কার চাপা দেয় উনাকে। অনেক চেষ্টা করলাম আমরা কিন্তু কিছুই করা গেল না । দাফন কাফন করে আসলাম। মাহি দীর্ঘ শ্বাস ফেলল।
: ও ঠিক আছে যাও আগে গোসল করে আসো , বাচ্চাদের কাছে এসো না।
আর তোমার ফোন বন্ধ ছিল কেন ?
: কখন বন্ধ হয়ে গেছে খেয়াল করিনি মা !
: ঠিক আছে রুমে যাও , ফ্রেশ হ‌ও।

মাহি রুমে ঢুকে দেখে রুবা কি সুন্দর শাড়ি পড়েছে, ছেলেকে কোলে নিয়ে বিছানায় বসে খাওয়াচ্ছে। ও একটু অবাক হলো ,আজ কোন স্প্যাশল ডে ছিল নাকি ও ভুলে গেছে না তো ?
: মাহি রুবাকে দেখে শুধু হাসলো ! তারপর সোজা ওয়াসরুমে ঢুকে গেল!
: রুবা ছেলেদের খাওয়ানোর সময় কখনও অন্যদিকে মনোযোগ দেয় না । যদিও মাহিকে দেখে তার অভিমান আরো বেড়ে গেছে তবুও সে ছেলেকে ঠিক মত খাইয়ে দিল।
সারাদিন ঘুরে বেড়িয়ে আসছে ডাক্তার সাহেব । রুবা ছেলেকে কোলে নিয়ে শ্বাশুড়ি র কাছে গেল।
: মাহির গোসল শেষ হয়েছে রুবা ?
: না মা !
: বুয়াকে বলো ওর ডিনার দিতে !
: জ্বি মা বলছি , বলে রুবা কিচেনে চলে গেল !
মাহি ডাইনিং এ আসতেই সাফিয়া বেগম রুবাকে ডাকলেন ।
রুবাকে দেখে মাহি ওর কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, এত সুন্দর করে সেজে থেকে লাভ কি তুমি তো সেই তোমার রাজ্যে থাকবে, আমি তেপান্তরের মাঠে পড়ে থাকব । মাঝখানে আমার তো শুধু লোভ বাড়ে আর হতাশা বাড়ে ! মাহি মিটমিট করে হাসলো।
: রুবা শীতল চোখে তাকালো !
: শোন ছেলেরা ঘুমিয়ে গেল একটু এসো তো চুপিচুপি আমার রুমে !
রুবা ঠান্ডা গলায় বলল, ডিনার করো চুপচাপ !
: মাহি তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে রুবার মন কি সত্যি খারাপ। খারাপ থাকলে এত সুন্দর করে সেজে বসে থাকতো না !
: দিশা আপু কোথায় ?
: কেন আসেনি এখনো , চলে আসবে টেনশন করো না !
মাহির খাওয়া শেষ হলে সাফিয়া বেগম বললেন,
মাহি বাচ্চাদের আজ দুই মাস বয়স হলো তুমি আর রুবা ওদের নিয়ে বসো আমি ছবি তুলে দেই !
: তাই তো , আগে জানলে কেক নিয়ে আসতাম !
: এসব করার দরকার নেই তুমি রুবার সঙ্গে ওদের নিয়ে বসো ছবি তুলে দিচ্ছি আমি।
সাফিয়া বেগম খেয়াল করলেন রুবার মুখ তখনো থমথমে । মাহি কিছু বলেনি এখনও ,কেন দেরি করে এসেছে?
তিনি মনে মনে ভাবলেন থাক ওরা ওদের মত বোঝাপড়া করে নিবে।
অনেক দিন হয় বাচ্চাদের জন্য দুজন নিজেদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারে না । এই জন্যই কি দূরত্ব, অভিমান তৈরি হচ্ছে?
তিনি দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন! তারপর রুবাকে বললেন,
: রুবা বলছিলাম কি তোমার শ্বশুর বাবুদের সঙ্গে থাকতে চাইছে আজ রাতে , আমি ওদের নিয়ে আমাদের ঘরে থাকি । কাঁদলে তোমার কাছে দিয়ে আসব । তখন তুমি আর মাহি রাখতে পারবে না ?
: মা বাবার প্রেসার বেশি ছিল না কালকে ওরা ঘুমাতে দিবে না দেখো !
: মাহি ওদের কাছে পেলে এমনিতেই তোমার বাবার প্রেসার কমে যায় ! সাফিয়া বেগম হাসলেন।
মাহি রুবার দিকে তাকালো । মায়ের এক কথায় মাহির পুরো শরীরের প্রতিটি রক্তকণিকা নেচে উঠেছে আনন্দে।
কতদিন পর রুবা আর সে এক সঙ্গে নিজেদের রুমে থাকবে।
মাহির ভাবতেই ভালো লাগছে। কিন্তু সে জানেনা রুবা এক বুক অভিমান পুষে বসে আছে কাল থেকে!
মেয়েদের মনটা এক স্পর্শ কাতর জায়গা । কত কঠিন কিছু তারা অবলিলায় মেনে নেয় কিন্তু কখনো কখনো সহজ, সরল জিনিস ও মানাতে তাদের অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয় ! আর যে পুরুষ হৃদয়ের আবেগ দিয়ে সেই কাঠ খড় পুড়িয়ে মন জয় করতে পারে তার জন্য অভিমানের চেয়েও বেশি বুক ভরা ভালোবাসা জমা রাখে মেয়েরা।

মাহি নিজের রুমে এসে মিউজিক সিস্টেম টা চালু করলো। একটা সময় রুমটা ছিল তার একান্ত ব্যক্তিগত একটা জায়গা। তার হিসেবে প্রতিটি জিনিস সাজিয়ে রাখা থাকতো। তারপর এক রাতে রুবার ঠিকানা হলো এই ঘরে। তার জীবনের সঙ্গে রুবার জীবন বদলে গেল।
রুবার চুড়ি, আংটি, ওড়না থেকে রুবার মাথার ঝড়ে পড়া চুল এক এক করে ওর ঘরের প্রতিটি কোণা থেকে ওর জীবনে জায়গা খুঁজে নিল।
আজ বাচ্চাদের ফিডার, ডাইপার, লোশন, দোলনা সব এই রুমে । এক এক করে জীবন কত রূপে বদলায় । বদলে যায় ঘর মন জানালা ।
মাহি চোখ বন্ধ করে সব কিছু চিন্তা করছে। রুবা এখনো আসেনি ।
ছেলেরা দাদা দাদির সঙ্গে ঘুমাবে। ওদের ঘুম পাড়িয়ে তারপর আসবে হয়তো।
মাহি অপেক্ষা করছে রুবার জন্য। আজ অপেক্ষা করতে এত ভালো লাগছে ওর । অনেক দিন এত আগ্রহ নিয়ে সে কারো জন্য অপেক্ষা করে না !

রুবা রুমে এসে ঢুকলো ! মাহি ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশী রঙের শাড়িতে রুবাকে কি অপূর্ব লাগছে। প্রেগন্যান্সি র কারণে রুবা একটু মোটা হয়েছে কিন্তু তারপরও মাহি ওকে মুগ্ধ হয়ে দেখে। মাতৃত্বের এই পরিবর্তন রুবার সৌন্দর্যের ধার যেন মাহির কাছে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। রুবা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অর্নামেন্টস খুলে রাখছে। মাহি উঠে গিয়ে রুবার কানের দুল গুলো খুলে দিল।
রুবা , অনেক দিন পর তুমি আমি এই রুমে তাই না! আমার তো দারুন এক্সাইটেড লাগছে।‌ মাহি রুবার কানের পাশে চুমু খেলো । ওর ফর্সা পিঠের উপর থেকে চুল সরিয়ে দিল।
রুবা আয়নার দিকে তাকিয়ে মাহিকে দেখছে।
রুবার শাড়ির পিনাআপ খুলে দিচ্ছে মাহি।
: রুবা আমার কি মনে হচ্ছে জানো তুমি নতুন ব‌উ আজ আমাদের বিয়ের রাত ।‌যদিও আমাদের বিয়ের রাতটা এমন ছিল না !
আমার কেমন পাগল পাগল লাগছে বলেই মাহি হো হো করে হাসছে।
হাসতে হাসতে ই মাহি রুবাকে কোলে তুলে নিল !
: ফেলে দিবে প্লিজ ছাড়ো!
: উঁহু আজ তো তোমার কথা শুনব না ! কত যুগ পার হয়েছে তোমার খেয়াল আছে ম্যাডাম , আজ মাহি তার রুবাকে নিয়ে সুখের সমুদ্রে ভেসে যাবে ! তুমি গান শুনতে পছন্দ করো রুবা, আজ তোমাকে গজলের মত ভালোবাসবো । তুমি শুধু অনুভব করবে আমি তোমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে জড়িয়ে যাব ।
বেডে রুবাকে শুয়ে দিয়ে রুবার ঠোঁটে ঠোঁট রাখতেই মাহি টের পেল রুবা একেবারে নির্লিপ্ত হয়ে পড়ে আছে !
যেখানে মাহির সকল রক্ত বিন্দু আন্দোলন করে যাচ্ছে সেখানে রুবা ঠান্ডা শীতল এক বরফ !
: কি হয়েছে রুবা , শরীর খারাপ ?
: না ঠিক আছি ।
: তাহলে?
: তুমি আজ দিশা আপুর সঙ্গে সারাদিন ছিলে , আমাকে বলে গেলে কি আমি বাঁধা দিতাম মাহি ?
মাহি অবাক চোখে রুবার দিকে তাকালো!
তার মনে হচ্ছে সে যা শুনছে সেরকম কিছুই রুবা বলেনি সে ভুল কিছু শুনছে !
রুবার দুই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে । রুবার ঠোঁট কাঁপছে নিঃশ্বাস ঘন ঘন পড়ছে ।‌
মাহি তাকিয়ে দেখছে কতটা অভিমান নিয়ে আজকের রাতটা শুরু হয়েছে !
এই মুহূর্তে তার কি করা উচিত সে চিন্তা করছে ?

( চলবে )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here