মেঘলা আকাশে রুদ্রই ভরসা
উম্মে হাবিবা তনু
পার্ট:২৭
প্রাণোচ্ছ্বল মেয়েটার যেনো প্রাণটাই হারিয়ে গেছে। বৃষ্টির আভাস পেয়ে আজ আর ছুটে বেরিয়ে যায় না ভিজবে বলে।আজ আর ঘন কুয়াশার মধ্যে খালি পায়ে শিশির ভেজা ঘাসের উপর হাঁটার ইচ্ছে জাগে না।আজ আর মুগ্ধ চোখে শরতের আকাশের ভেসে বেড়ানো শ্বেত শুভ্র মেঘের ভেলা দেখে না।বসন্ত আসে যায়।আমের মুকুল ঝরে যায়।কাচা আমগুলো আজ আর টানে না মেঘলাকে।জীবন থেকে সব রঙ মুছে গেছে।গত দুই বছরে বাইরের জগৎটা কেমন তাই দেখেনি।বারোমাসই এখন একরকম মনে হয়।চার দেয়ালের মাঝেই আটকে গেছে জীবনটা।মেনে নিয়েছে নিজের ভাগ্যকে।
এই দুইবছরে সীমান্ত একবারের জন্যও ওদের দিকে ফিরে তাকায়নি।বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে যায় আর গভীর রাতে ফিরে সাথে করে অবশ্য কাউকে না কাউকে নিয়ে আসে।আবার মাঝে মাঝে ফেরেও না।তবে মানবতার খাতিরে আর না হয় সামান্য করুণা করে মাঝে মাঝে বাজার করে দেয়।এতেই দুবেলা খেয়ে পরে বেচেঁ আছে সাবিবা ও মেঘলা।
বাহিরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে।ঠিক যেনো বর্ষাকাল হয়তো বর্ষাকালই।
আপু এখন কি বর্ষাকাল??
কি জানি মাসের হিসেব কে রাখে!
তাও ঠিক।কখন দিন হয় আর কখন রাত তাই বুঝতে পারি না আর তো মাস….
সবই কপাল আমাদের বুঝলি মেঘলা।
আপু একটা কথা বলি??
অনুমতি নেয়ার কি আছে??বলে ফেল…
রাগ করবে না তো??
তোর কথায় আমি রাগ করব!!হাসালি মেঘলা…বল তো কি বলবি…
মেঘলা কিছুক্ষণ চুপ থেকে আস্তে করে বলল,
তুমি কি করে এই অমানুষের পাল্লায় পড়লে??
সাবিবা হটাৎ এমন প্রশ্ন শুনে খানিক অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
না মানে তুমি কত বুঝ..কত মেচিউর….
……
দেখেছো তুমি রাগ করলে…
কই রাগ করলাম??
এই যে চুপ করে আছো।
চুপ করে ভাবছি তুই ঠিক কি ভাবিস আমাকে..
মানে??
এই যে বললি আমি কত মেচিউর….
তাই তো….
আরে বোকা মেয়ে আমিও তো তোরই মত ছিলাম।ধাক্কা খেয়ে এখন বুঝেছি।
ওহহ..
হুমমম…
আচ্ছা তোমাদের পরিচয় কিভাবে???
সেসব অনেক কথা।পুরনো ময়লা ঘেঁটে দুর্গন্ধ ছড়াতে ইচ্ছা করে না।
আর তোমার পরিবার??
সাবিবা ব্রু কুচকে তাকাল।
আচ্ছা না বললে থাক…
থাকবে কেনো??শোন আজ তোকে সব বলবো..
মেঘলা খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে।
আমার বাবা আর দুইটা ছোট বোন আছে।ছোট বোনটা তোর বয়সী।একটা ভাইও আছে।অনেক ছোট।
আর মা??
মা!!!হ্যাঁ আমার বাবার বউ আছে।তিনি আমার মা কি না জানি না…
মানে??
মানে উনি আমার নিজের মা না।সৎ মা।
আর তোমার মা??মারা গেছেন??
সাবিবা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।না…
তাহলে???
আমার ছোট বোন হওয়ার পর মাকে তালাক দিয়ে দিয়েছে।
কি???কেনো??
আমার মায়ের অপরাধ ছিল পরপর তিনটা মেয়ে জন্ম দেয়া।তারজন্য তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়।তারপর পরই বাবা আবার বিয়ে করে।নতুন মা আমাদের অযত্ন করেননি আবার যত্নও করেননি।তিন বোন মিলে থাকতাম একসাথে।ছোট বোনটাকে তো আমি লালনপালন করেছি।সব কিছু আমিই করতাম।মেজ বোনটা যে খুব বড় ছিল তা না।মেজ বোনের দেখবালও আমিই করতাম।আবার পড়াশুনাটাও করতাম।
তোমার মা মানে সৎমা খুব অত্যাচার করতো তোমাদের সাথে??
না,উনি তো আমাদের ধারেই আসতেন না।বিয়ের পর কয়েকদিন অল্প অল্প কথা বলতেন ঠিকই কিন্তু ছেলে পেটে আসার পর কথাটাও বলেননি।আর ছোট ভাই হওয়ার পর আমাদের তিন বোনের খোঁজ কেউ রাখতো না।একটা ঘরেই আমরা পরে থাকতাম।বেচেঁ আছি না মরে গেছি সেই খোঁজও কেউ রাখতো না।মাঝে মাঝে বাবা আসত দেখা করতে।আমাদের কিছু দরকার কি না,পড়াশুনার খরচ কি লাগবে না লাগবে…ব্যাস এইটুকুই।এইসবই জেনে চলে যেতেন।
মেঘলার দুচোখ পানি যেনো আসছে।বহু কষ্টে আটকে রাখছে আর মনে মনে ভাবছে,আপুর জীবনে এত কষ্ট??এখনো কষ্টই করে যাচ্ছে।এইভাবে কি আপু সারাজীবন কষ্টই পাবে??
জানিস এই লোকটাকে খুব ভালোবাসতাম।ইউনিভার্সিটি ভর্তির পরই মা আমাকে পড়তে দিবে না জানিয়ে দেয়।জোর করেই ভর্তি হই।তখনই অমানুষটা আমার জীবনে আসে।একদম ঢাল হয়ে দাড়ায় আমার পাশে।খুব ভরসা করেছিলাম।
মেঘলা চোখের পানি মুছে বলল,আচ্ছা আপু তোমাদের পরিচয় কিভাবে??
সাবিবা শুকনো হাসলো।সেটা আরেকটা মজার ঘটনা।
কি ঘটনা??
তখন ইউনিভার্সিটিতে পরি।ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরে দেখি বাড়িতে মেহমান আসছে।আমি সেটা আমলে না নিয়ে নিজের ঘরে চলে যাই।পরে মা বললো আমাকে দেখতে আসছে।রেডী হয়ে যেনো তাদের সামনে যাই।মানা করা সত্বেও জোর করে পাত্রপক্ষের সামনে নিয়ে বসিয়ে দিল।আমিতো পাত্রকে দেখিওনি।সেদিন তারা চলে গেল।তারপর কিছুদিন সব নিরবই ছিল।শুধু জানতাম এই সমন্ধ আমার সৎমা করেছে।তার নাকি ছেলেকে খুব পছন্দ হয়েছে।ছেলে অনেক সুন্দর,ভালো চাকরি করে,অনেক ভালো এইসবই।এরপর হটাৎ একদিন ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পথে একজন আমার পথ আগলে দাড়ায়।আমিতো চিনি না।ইগনোর করে চলে যাচ্ছি তখন আমার সামনে এসে বলে,ইগনোর করছেন কেনো??আমিতো হতভাগ।চিনি না জানি আমি কেনো তাকে ইগনোর করবো না।আমার কথা শুনে সেতো আকাশ থেকে পড়ল।এইতো সেদিন দেখলে আর দুদিন পর বিয়ে এখন চেনো না??তারপর জানলাম এই সীমান্ত।এর সাথেই আমার বিয়ে।তাকে আমি বলি আমি পড়তে চাই,বিয়ে করতে চাই না।তখন সে বলেছিল বিয়ের পর পড়বে আর আমার বোনদের দায়িত্বও নিবে।প্রায়ই দেখা করতে আসত ভার্সিটির সামনে।একসময় তার প্রেমেও পড়ে যাই।জানিস আমি তখন রঙিন স্বপ্ন দেখতাম।কি যে ভালো যাচ্ছিল দিনগুলো!আমি বিয়েতে আর অমত করিনি।কয়েকমাসের মধ্যে বিয়েও হয়ে যায়।
তোমার বাড়ির কেউ জানতো না উনি কেমন??খোজ না নিয়েই বিয়ে দিয়ে দিল??
বাবা খোঁজ নিতে চেয়েছিল কিন্তু মা দেয়নি।মা নাকি সব খোঁজ নিয়েই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।তাই আর কেউ কিছু বলেনি।
তারা এখনো জানে না??
হুমমম সব জানে।বিয়ের কয়েকমাসের মধ্যেই সব জানতে পারি আমি।বাসায়ও জানিয়েছি।
তাহলে তুমি ফিরে যাওনি কেনো??
বাবা এসেছিল নিয়ে যেতে।কিন্তু মা আমাকে আলাদা করে নিয়ে বলে,পুরুষ মানুষের এমন দোষ থাকেই।তুই মানাইয়া নে।কয়দিন পর ঠিক হয়ে যাবে।আর তুই ফিরা গেলে তোর দুইবোনের বিয়া হইবো না।আর তোর বোঝাও আমরা টানতে পারমু না।সেদিন আমার নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল।চেয়েও পারিনি ফিরে যেতে।বাবাকে অনেক কিছু বলে চলে যেতে বলি।বাবা রাগ করে বেরিয়ে গেলেন।সেই যে গেলেন এখন পর্যন্ত কারো কোনো খোঁজই আমি জানি না।
মেঘলা সাবিবাকে দেখছে।ওর চোখে কোনো পানি নেই।শুধু আছে স্পষ্ট কিছু অভিমান আর অভিযোগ।কিন্তু মেঘলার চোখে বইছে নোনা জলের স্রোত।কোনোভাবেই চোখের পানিকে আটকে রাখতে পারছে না।হুট করেই সাবিবাকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে উঠলো।
মেঘলার এই কান্নার মানে সাবিবা জানে।তবু থামাতে চাইলো।
এই পাগলী কাদছিস কেনো???
…..
পাগলী বোন আমার,কাদে না।উঠতো…
আপু আমি আর তোমাকে কষ্ট পেতে দিবো না।ঠিক কিছু না কিছু করবোই।
ঠিক আছে করিস।এখন কান্না থামা।তোর কান্না আমার একদম ভালো লাগে না।
মেঘলা আরেকটু শক্ত করে সাবিবাকে জড়িয়ে ধরলো।কিন্তু সেই একি ভাবে কেঁদেই চলেছে।
চলবে………..
(প্রিয় পাঠক পাঠিকা বৃন্দ, আস্সালামুআলাইকুম।একটি গল্প লিখা হয় আপনাদের ভালো লাগার জন্য।সে গল্প পরে যখন আপনাদের সাড়া পাওয়া যায় না তখন লিখার উৎসাহটাই নষ্ট হয়ে যায়।আপনারা যত উৎসাহ দিবেন গল্প লিখায় তত আগ্রহ বাড়বে এবং গল্প তত সুন্দর হবে।তাই গল্প যদি আপনাদের ভাল লাগে এবং পরবর্তী পর্ব পেতে চান তবে অবশ্যই গঠনমূলক মন্তব্য করে পাশে থাকার অনুরোধ রইলো।ধন্যবাদ।)