আরশিযুগল প্রেম # লেখনীতে — নৌশিন আহমেদ রোদেলা #পর্ব – ৫৬

0
1229

# আরশিযুগল প্রেম
# লেখনীতে — নৌশিন আহমেদ রোদেলা
#পর্ব – ৫৬

রেললাইনের পাত আর চাকার ঘর্ষণে অদ্ভুত এক সুর তৈরি হচ্ছে হাওয়ায়। শেষ শরৎ- এর হিম ধরা বাতাস সেই সুরটুকুকে শুষে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলছে খোলা জানালায়। তৈরি করছে একরাশ মায়া, একরাশ ঘোর। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা নির্বীক গাছগুলোও যেন আজ বাঁধনহারা, নৃত্যরত মূর্তি। রেললাইনের পাশের মাঠগুলোতে অবহেলিত আগাছার মাথায় জমাট বাঁধা অন্ধকার। সেই জমাট অন্ধকারেই সবুজ আলো জ্বেলে উড়ে চলেছে একদল নিশাচর সৈনিক। খুদে খুদে শরীর নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে মাঠময়। এমনকি চলতি ট্রেনের জানালার পর্দায়ও তাদের সহজ বিচরণ। কিছু আবার পথভুলে ঢুকে পড়ছে ট্রেনের আলো ঝলমলে কামড়ায়। রাত বাড়ার সাথে সাথেই বাড়ছে হিম ধরা বাতাসের কামড়। শরীরের প্রতিটি লোমকূপ ঠান্ডায় তটস্থ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। সাদাফ হাত বাড়িয়ে জানালা লাগাতে নিতেই তার হাত খামচে ধরলো শুভ্রতা। চোখ রাঙিয়ে ফিসফিস করে বলল,

—-” খবরদার জানালা বন্ধ করবে না। তোমার সাথে যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিলো সেদিনও জানালা বন্ধ করে দিয়েছিলে তুমি। রাগে তোমার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছিলো। তখন অপরিচিত ছিলে বলে পারি নি, এবার কিন্তু সেই চান্স নেই।”

সাদাফ বিস্মিত চোখে তাকাল। হঠাৎ করেই ভীষণ কৌতুক বোধ করলো সে। নিতান্তই ছেলেমানুষীর মতো, সাদাফের প্রতি শুভ্রতার সেদিনকার অনুভূতিগুলো জানার তীব্র ইচ্ছে জাগতে লাগল। কিন্তু, বন্ধুমহলের এই ভারী দলে বউয়ের কাছে প্রথম সাক্ষাৎ- এর অনুভূতি জিগ্যেস করা চলে না। ‘প্রথম অনুভূতি’ শব্দটাই ভীষণ রোমাঞ্চকর। আর রোমাঞ্চকর বিষয়গুলোর জন্য বিশেষ বিশেষ জায়গার প্রয়োজন। সর্বস্তরে এই বিশেষ আলাপ চলে না। সাদাফ মৃদু গলায় বলল,

—-” ঠান্ডা হাওয়া আসছে তো। ঠান্ডা লাগছে খুব।”

শুভ্রতা সরু চোখে তাকালো। সাদাফের পায়ের কাছে রাখা ব্যাগটা দেখিয়ে দিয়ে বলল,

—-” ওই ব্যাগটা আমায় দাও। ওখানে একটা চাদর আছে।”

সাদাফ দীর্ঘশ্বাস গোপন করে ব্যাগের চেইন খুললো। অনেক খুঁজে এক গাদা কাপড়ের নিচ থেকে একটা মোটা চাদর উদ্ধার করল। ব্যাগের চেইন লাগিয়ে শরীরে চাদর জড়ালো। কয়েক সেকেন্ড বাদে কি ভেবে শুভ্রতাকে টেনে নিয়ে চাদরের এক পাশ তুলে দিলো তার কাঁধে। শুভ্রতা মুগ্ধতা আর বিস্ময় নিয়ে সাদাফের দিকে তাকালো। সাদাফ চাদরটা দুজনের গায়ে ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে শুভ্রতার চোখের দিকে তাকালো। শুভ্রতার মুগ্ধ দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে ভ্রু নাচালো। ফিচেল হেসে মৃদু গলায় বলল,

—-” এভাবে কি দেখছো? আমি জানি, আমি দেখতে ভালো।”

শুভ্রতা প্রত্যিত্তরে কিছু বলবে তার আগেই পাশ থেকে অনুযোগের সুরে বলে উঠল অর্পন,

—-” এ তো ভারি অন্যায় সাদাফ ভাই। বউয়ের প্রতি এতো আদর, গরম গরম চাদর। আর শালীদের জন্য কি? কিছুই না? আমাদের বুঝি শীত করে না?”

সাদাফ হেসে বলল,

—-” কে বলল শালীদের জন্য কিছুই না? শালীদের জন্য বন্ধুরা। শালীদের ঠান্ডা কমানোর দায়িত্ব বন্ধুদের।”

সাদাফের কথায় ছেলেরা হৈ হৈ করে উঠল। শুভ্রতা ঠোঁট টিপে হাসছে। পুষ্পি নাক ফুলিয়ে বলল,

—-” এটা কিন্তু দুর্নীতি হয়ে গেলো সাদাফ ভাই। আপনার এই…”

পুষ্পিকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আফসোস করে বলে উঠল জাহিদ,

—-” ধুর! আজ বহুত আফসোস হচ্ছে দোস্ত। তুই এমন সুযোগ দিবি জানলে জিন্দেগীতে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করতাম না আমি।”

জাহিদের কথাটা অনেকটা লুফে নিয়ে ফুঁসে ওঠলো তার স্ত্রী বন্যা। কটমটে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

—-” কি বললা তুমি?”

জাহিদ মুখ কাচুমাচু করে বলল,

—-” কই? কিছু না তো।”

—-” ফাইজলামো করো আমার সাথে? সবসময় খালি ছুকছুকানি স্বভাব তাই না?”

জাহিদ ব্যস্ত হয়ে বলল,

—-” আরে, কি বলছ এসব। আমি তো বলছিলাম যে, ধরো তুমি আর আমি যদি অবিবাহিত হতাম। আর তুমি যদি ভাবির বান্ধবীদের মধ্যে একজন হতে তাহলে আজ এই সুন্দর ওয়েদারে প্রেমটা আরো জমে যেত না?”

বন্যা তেঁতে উঠে বলল,

—-” তাই বুঝি? ভার্সিটিতে ক্লাসমেটের সাথে প্রেম করে শখ মিটে নাই তোমার? এখন ট্রেনে বন্ধুর শালীর সাথে প্রেম করতে মন চায়? আজ বাসায় ফিরো, তোমার মনকে প্রেমের সব প্রকার সজ্ঞা শেখাব আমি।”

জাহিদ হালকা কেশে মৃদু গলায় বলল,

—-” ক্লাসমেট বিয়া করলে এই এক ঝামেলা। খাইছে… ”

বন্যা কান খাঁড়া করে বলল,

—-” এই কি বললা তুমি?”

জাহিদ- বন্যার কথায় মুচকি মুচকি হাসছিলো বন্ধুমহল। রাকিব সেই হাসিটাকে আরো খানিকটা প্রসারিত করে গদগদ কন্ঠে বলল,

—-” আহা! বন্ধু হলে আমাদের সাদাফের মতো। লাভ ইউ দোস্ত।”

প্রেমা ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,

—-” এতো এক্সাইটেড হওয়ার কিছু নাই রাকিব ভাই। স্টে কাম, ওকে? এসব আশপাশের কথা বলে শালী পটানো যায় না।”

—-” বেয়াইন সাহেবা? ভাইয়া ডাকার জন্য এখানে হালি হালি মানুষ আছে। কিন্তু দয়া করে আমাকে আর রাফাতকে ভাইয়া ডাকবেন না। এখনও বিয়ে করি নি…. ভাইয়া শুনলে হার্টে ধাক্কা লাগে।”

—-” ধাক্কা টাক্কা লাগা শেষ হলে গানটা গান। এবার আপনাদের পালা। পাঁচ পর্যন্ত কাউন্ট করবো। না পারলে বলে দিন, আস্ত একটা লাড্ডু নিয়ে বসে থাকুন। সমস্যা নেই।”

পুষ্পির কথায় চোখ ঘুরিয়ে রাফাতের দিকে তাকাল রাকিব। রাফাত সিটে গা এলিয়ে চুপচাপ বসেছিলো। রাফাতের পেটে কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করলো রাকিব। কপাল কুঁচকে বলল,

—-” মরার মতো বইসা আছিস কেন? গান ধর। ‘দ’ দিয়ে গান।”

কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকার পর সামনের সিট থেকে চেঁচিয়ে বলে উঠলো মাহিম,

—-” ওই রাকিব? ‘দ’ দিয়ে দিল ডোবা…. ”

রাকিব খুশিতে ঝুমঝুম করে উঠে বলল,

—-” সাদাফ তুই গা।”

সাদাফ মুখ ঘুরিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে বলল,

—-” অসম্ভব।”

রাকিব খানিকক্ষণ বিরবির করেই মোটা গলায় গেয়ে উঠলো,

—-” Dil Dooba Dil Dooba,
Neeli Aankhon Mein Yeh Dil Dooba
Mehbooba Mehbooba
Bas Yeh Jaanle Mehbooba.
Aashiq Hoon Deewana Hoon
Tere Liye Kuch Bhi Kar Jaaonga.
Ishq Mein Tere Jeeta Hoon
Tere Liye Hi Mar Jaaonga. ”

রাকিব থেমে শুভ্রতাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

—–” ভাবি গান ধরেন। সিনিয়র দেবরের অনুরোধ, মানা করতে নেই।”

পুষ্পি-অর্পণও রাকিবের সাথে তাল মেলাতেই রিনরিনে কন্ঠে গেয়ে উঠলো শুভ্রতা। সেইসাথে পুষ্পি, অর্পণ আর প্রেমা,

—-“Main Tere Jhase Mein Naa Aaonge O Re Deewane Jaa
Kyon?
Aisi Waisi Bana Ke Baatein Mujhe Naa Tu Uljha ”

রাফাত পাশের টেবিলের উপর হাত বাজাতে শুরু করতেই জমে এলো গানের আসর। ধীরে ধীরে সুরেলা বেসুরা গলা নিয়েই গানের আসরে মন দিলো সবাই। কিন্তু সাদাফ যোগ দিলো না। মৃদু হাসি নিয়ে শুভ্রতার উচ্ছ্বাসমাখা চেহারাটাই দেখতে লাগলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।

______________________

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে। পৃথা নিজের জন্য বরাদ্দকৃত শোবার ঘরটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্রতার বাড়ি পৌঁছে একদম সকালের নাস্তা করেই ঘুমিয়েছিলো সবাই। ঘুমিয়েছিলো পৃথাও। কিন্তু কেন জানি ঘুমটা ভালো হয় নি। ঘুমের মাঝেও মাথায় ভোঁতা এক ধরনের ব্যথা হচ্ছিলো তার। দুপুর পর্যন্ত বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে, বাকিটা সময় অযথায় বসে থেকেছে সে। বসে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়েই শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে পৃথা। নতুন জায়গা আর এমন নিস্তব্ধ ঘুমন্ত পুরীতে করার মতো কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না সে। মনটা অযথায় বিষণ্ন থেকে বিষণ্নতর হয়ে উঠছে। পৃথা কিছুক্ষণ দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে পা টিপে টিপে শুভ্রবের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। ঘরটা আজও অন্ধকার। পৃথা এক পায়ে ভর দিয়ে অন্ধকার ঘরটাই উঁকি দিলো, ভেতরটা দেখা যাচ্ছে না। ভেতরে কোনো প্রাণী আছে কি নেই, সেটাও বুঝা যাচ্ছে না। পৃথা আরেকটু হেলে পড়ে কপাল কুঁচকে তাকাতেই কোথা থেকে বিশাল মানুষটি দরজায় এসে দাঁড়ালো। শুভ্রবের অনাকাঙ্খিত আগমনে ভয়ে শরীরের ব্যালেন্স হারিয়ে ফেললেও নিজেকে যথারীতি সামলে নিলো পৃথা। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে শুভ্রবের দিকে তাকালো। এই মুহুর্তে লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে তার। না জানি শুভ্রব তার সম্পর্কে কি ভাবছে! এই মুহুর্তে, নিজের গালেই কষে একটা চড় বসাতে ইচ্ছে করছে তার। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে হাসার চেষ্টা করলো পৃথা। শুভ্রব ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়লো,

—-” আপনি?”

পৃথা থতমত খেয়ে বলল,

—-” আমি আমি পৃথা।”

শুভ্রব কপাল কুঁচকে কিছু একটা ভাবলো। পৃথা খেয়াল করল অফ হোয়াইট ঢোলা টি-শার্ট আর ব্ল্যাক টাওজারে ‘শুভ্রব’ নামক লোকটিকে ভয়ঙ্কর রকম সুন্দর লাগছে। শুভ্রব টাওজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে স্ট্রং হয়ে দাঁড়ালো। গম্ভীর গলায় বলল,

—-” ও, সাদাফ ভাইয়ের বোন। সরি, আপনার ফেইসটা মনে ছিলো না। তাই হঠাৎ ক্যাচ করতে পারি নি। কিছু বলবেন?”

‘আপনার ফেইসটা মনে ছিলো না’ —- কথাটা শুনেই সুপ্ত রাগে ফুঁসে উঠলো পৃথা, কিন্তু প্রকাশ করলো না। একটা জলজ্যান্ত মানুষের ফেইস কি করে ভুলে যেতে পারে একজন পুরুষ মানুষ? এই লোকের কি স্মৃতিশক্তির ব্যামো আছে? নাকি পৃথাকে ইচ্ছেকৃতভাবে অপমান করছে? পৃথার রাগে-দুঃখে কান্না পাচ্ছে। এই লোকটাকে ভয়ানক কিছু গালি দিতে ইচ্ছে করছে। পৃথা সময় নিয়ে শ্বাস নিলো। তারপর শুভ্রবের মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো। অর্থাৎ, সে কিছু বলবে না। শুভ্রব এবার দরজা থেকে খানিকটা সরে গিয়ে বলল,

—-” আপনি কি ভেতরে এসে বসবেন?”

পৃথা ব্যস্ত হয়ে বলল,

—-” না। বসবো না। ইট’স ওকে।”

—-” ও আচ্ছা। আসলে, আমার একটু বাইরে যেতে হবে, তৈরি হবো। ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আপনার সাথে পরে কথা বলি?”

পৃথা জোরপূর্বক হেসে বলল,

—-” নিশ্চয়ই।”

পৃথা ‘নিশ্চয়ই’ শব্দটা বলার সাথে সাথেই ঘরের ভেতরে ঢুকে দরজা লক করলো শুভ্রব। প্রচন্ড রাগে পৃথার শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগলো। নিজেকে কি মনে করে এই ছেলে? সে কোথায় যাবে, কি করবে তা কি পৃথা জানতে চেয়েছে? ইচ্ছে থাকলে জাহান্নামের মোড়ে গিয়ে বসে থাকুক, হু কেয়ারস? পৃথা বেশ কয়েকবার জোরে জোরে শ্বাস নিলো। এই বাসায় আর এক মুহূর্ত থাকতে ইচ্ছে করছে না তার। সাদাফ বলেছে আজ রাতেই বনানীতে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে যাবে তারা। আচ্ছা? রাত হতে আর কত ঘন্টা, কত মিনিট বাকি? পৃথা নিজের শোবার ঘরে গিয়ে বালিশে ঠেস দিয়ে বসতেই বিনা নিমন্ত্রণে রাতের সেই বিশ্রী স্বপ্নদৃশ্যটা চোখের সামনে খেলে গেলো। পৃথার রাগটা এবার বহুগুণ বৃদ্ধি পেলো। পাশের রুমের ওই লম্বা করে লোকটিকে যাচ্ছে তাই ভাষায় গালি দেওয়ার সুপ্ত ইচ্ছে জাগতে লাগলো। সেই মানুষটির উপর সব দোষের দায়ভার দিয়ে মনকে জোরপূর্বক বুঝাতে লাগল, এই অসহ্য মানুষটিকে সে একবিন্দুও সহ্য করতে পারে না। একটুও না। নিজের মনের সাথে ঘন্টাখানেক বোঝাপড়া করার পর হঠাৎই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো পৃথা। কেন জানি ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। ভয়ানক কষ্টে বুকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে ৷ বুকজুড়ে শুরু হচ্ছে অদ্ভুত এক তোলপাড়। অথচ, যাকে কেন্দ্র করে এই তোলপাড় সে-ই কত সন্দিহান, নিরাগ্রহ। তার গায়ে এই তোলপাড়ের হাওয়া লাগে না। সে মুহূর্তের জন্যও পৃথাকে ভাবে না। ভাবনার তালে তালে পৃথার রাগ বাড়ে, বাড়ে কষ্টও!

_____________________

শুভ্রতাদের বাসা থেকে ফেরার পর একমাস কেটে গিয়েছে। এই একমাসে শুভ্রতা বেশ খানিকটা সংসারী হয়ে উঠেছে। নিজের ছোট্ট সংসারটাকে গুছিয়ে রাখার কতশত টেকনিক নিজে নিজেই উদ্ভাবন করেছে। সংসার, স্বামী, ভার্সিটি ক্লাস,পড়াশোনা সবকিছু একা হাতে সামলে নিতে শিখে গিয়েছে। যদিও সাদাফ তাকে সাধ্যাতীত সাহায্য করে। তাকে বুঝায়, রাতে আর সকালের সময়টুকু শুধুই তাকে দিতে চেষ্টা করে। ছুটির দিনগুলোতে পৃথা আর শুভ্রতাকে রান্নাঘর থেকে বহিষ্কার করে নিজে হাতে রান্না করে। সব মিলিয়ে সাদাফের এই ছোট্ট দুনিয়ায় শুভ্রতা ভীষণ সুখে আছে। তনয়ার বলা সেই ‘সত্যিকারের সুখ’! শুভ্রতা অর্পণের শোবার ঘরের বিছানায় বসে আছে। ভার্সিটি শেষ করে আন্টির জরুরী তলবে বান্ধবীসহ এখানেই এসেছে তারা। কিন্তু, এখানে এসে সব কেমন উলোটপালোট লাগছে। সিচুয়েশনটা ঠিক ম্যাচ হচ্ছে না। দীর্ঘ সময় চুপ থাকার পর বিরক্ত কন্ঠে বলে উঠল শুভ্রতা,

—-” কাহিনী কি? আন্টি ফোন দিয়ে বলল, তুই নাকি বিয়ের কথা শুনে অবরোধ করছিস? দরজা টরজা লাগিয়ে বিদিগিস্তা অবস্থা করছিস। কিন্তু এখানে তো দেখি সব উল্টো। তুই তো বিয়ের খবরে রীতিমতো নাচছিস অর্পু!”

প্রেমা কনফিউজড হয়ে বলল,

—-” আমিও ঠিক বুঝতাছি না। তুই কি বিয়ের খবর শুনে শক খেয়ে পাগল টাগল হয়ে গিয়েছিস? নাচছিস কেন?”

অর্পণ খুশি খুশি মুখ নিয়ে শুভ্রতার পাশ ঘেঁষে বসলো। শুভ্রতার গায়ের উপর গা এলিয়ে দিয়ে বলল,

—-” আরে ধুর! পাগল হতে যাবো কেন? আমি তো খুশিতে নাচছি। আমার সাথে কার বিয়ের কথা চলছে জানিস?”

অর্পনের কথার প্রত্যুত্তরে তিনজনই একই সুরে প্রশ্ন করল,

—-” কার?”

অর্পণ উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,

—-” আমার সেই ক্রাশ মার্কা কাজিনের। তাও আবার সে নিজে থেকে বিয়ের সম্বন্ধ পাঠিয়েছে, ভাবা যায়? আহা! আমার তো খুশিতে মরে যেতে ইচ্ছে করছে।”

অর্পণের কথায় সামনের চোয়াল ঝুলে পড়ার জোগার পুষ্পির। সে চোখ বড় বড় করে বলল,

—-” তাহলে দরজা লাগিয়ে অবরোধ কেন করছিস? এটা আবার কোন নাটক?”

—-” আরে! আম্মু বিয়ের কথা বলল আর আমি নাচতে নাচতে রাজি হয়ে গেলাম, বিষয়টা কেমন দেখায় না? এরেঞ্জ ম্যারেজ, এরেঞ্জ ম্যারেজ ব্যাপারটা তো আসতে হব, নাকি? তাই একটু ঢং করছি আরকি। নাথিং ইল্স।”

অর্পণের যুক্তিতে তিন বান্ধবীরই চোখ চড়কগাছ। পুষ্পি কোনোরকম নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

—-” ব্রিলিয়ান্ট, দোস্ত।”

বান্ধবীদের আলাপচারিতার মাঝেই রুমে এলেন অর্পণের মা, অঞ্জুমান আরা। আঞ্জুমান আরা ধীর পায়ে মেয়ের বিছানার এক কোণায় বসলেন। আদুরে গলায় বললেন,

—-” বন্ধুদের নিয়ে দুপুরের খাবারটা খেয়ে নে বাবু। তোর বাবার সাথে কথা হয়েছে এবং তোর বাবা ইশানদের পরিবারকে মানা করে দিয়েছে। আমাদের মেয়ে না চাইলে কিসের বিয়ে? এবার খুশি?”

আঞ্জুমান আরার কথায় চোখ বড় বড় করে তাকালো অর্পণ। শুভ্রতা, পুষ্পি একে অপরের দিকে তাকালো। অর্পণ তাড়াহুড়ো করে বলল,

—-” না না আম্মু। মানা করার দরকার নেই। তোমাদের খুশিই আমার খুশি। আমি রাজি মা, সমস্যা নেই।”

আঞ্জুমান আরা দৃঢ় গলায় বললেন,

—-” তোকে ব্যস্ত হতে হবে না বাবু। আমাদের একটা মাত্র মেয়ে। তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিচ্ছু হবে না। আমাদের ইচ্ছেটা তোর ওপর চাপিয়ে দেব কেন? বিয়ে ক্যান্সেল, এবার খেতে আয়। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি।”

কথাটা বলে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন আঞ্জুমান আরা। কিছুক্ষণ ঘরে থমথমে নীরবতা চলার পর পুষ্পি মৃদু গলায় বলল,

—-” এক্চুয়েলি, টু মাচ ব্রিলিয়ান্ট।”

সাথে সাথেই প্রাণখোলা হাসিতে ফেটে পড়লো তিনজন। শুভ্রতা হাসতে হাসতে বিছানায় গড়িয়ে পড়লো। অর্পণ দুঃখী দুঃখী মুখ নিয়ে বলল,

—-” তোরা হাসছিস? আমার কান্না পাচ্ছে। আমার পেরেন্টস তোদের পেরেন্টসের মতো জোর করে বিয়ে দেয় না কেন? হুয়াই ম্যান হুয়াই?”

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here