শবনম(পর্ব ১৫)

0
173

শবনম(পর্ব ১৫)

নতুন জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের সবকিছু নতুন করে সাজাতে ব্যস্ত দেশবাসী। শবনমও কেনজানি নিজের স্বপ্নকে আবার নতুন উদ্যমে দেখতে শুরু করল। নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে দেখবে সেখানে দুলাল এসে বসে আছে। এতদিন দূরে থেকে থেকে অনেকটা দুর্বল হয়ে গেছে তাই আর শ্বশুর বাড়িতে আসেনি। নিজের ঘরে বসেই বৌ মেয়েদের অপেক্ষা করছে।

শবনমের ছোট চাচাসহ অন্যরা বাড়ি ফিরছে বিজয়ে আনন্দ গায়ে মেখে। চারপাশে কেমন এক উৎসব উৎসব আমেজ। সব আনন্দ ছাপিয়ে এখন শবনমের বাড়ি ফেরার আনন্দটাই উঠে আসে ওর চোখেমুখে । নিজের বক্স পোটলা গোছাতেই সে ব্যস্ত।
এরই মধ্যে বকুলের ঝুলে থাকা বিয়ের সম্মন্ধটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। ছেলে ঢাকায় থাকে। বেশ ভালো ব্যবসা ওখানে। বকুলকে বিয়ের পর ঢাকায় নিয়ে যাবে। ঢাকার কথা শুনে বকুলও খুব খুশি। বিয়ে পাকাপোক্ত হওয়ার খবরে এবার শিউলিও ওর দুই মেয়ে নিয়ে চলে আসে। এমতাবস্থায় আর শবনম নিজের ঘরে ফেরার কথা বলতে পারে না। গতবছরের আয় ব্যয় হিসাব করে শবনমের বাবা বেশ কিছুটা অর্থনৈতিক টানাপোড়নেও পড়েছে। তাই খুব একটা বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারলেন না। দায়সারা গোছের নামমাত্র আয়োজনের মাধ্যমেই বকুলকে তুলে দিলেন তিনি। বিয়ের আয়োজনে শবনম খেয়াল করে ওর প্রতি সবার কেমন জানি এক করুনামাখা দৃষ্টি। গতবার শিউলির বিয়েতে দুলাল ছিল। বিয়েটা শিউলির হলেও সবার আনন্দ ছিল শবনম আর দুলালকে ঘিরেই। সব কাজের কাজীই ছিল যেন দুলাল। আর এবার সেই দৃশ্য পট উলটে গেল। সবার এই করুনামাখা দৃষ্টিগুলো শবনমের সাহস আর শক্তিতে তীব্র আঘাত হানল। ও বুঝল এখানে বেশিদিন থাকলে ওর অপেক্ষা আর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাবে। তাই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতেই অস্থির হয়ে উঠল নিজের সংসারে ফিরে যাওয়ার জন্য।
ওর মা নানা অযুহাতে অযথা সময় ক্ষেপন করছেন বলে একটা সময়ের পর তেমনটাই মনে হল শবনমের কাছে। এই নিয়ে মায়ের সাথে একদিন রাগও করে বসল। ওর মা না পারে মেয়েকে শক্ত গলায় বলতে যে ওখানে তোর কেউ নাই তুই ওখানে একা টিকতে পারবি না।তোর যাওয়ার দরকার নেই আবার এটাও বলতে পারে না যে তুই এখন থেকে এখানেই থাকবি। তোর ঠিকানা এখন থেকে এটাই কারন ওটা যে ছন্দা স্বপ্নার পৈতৃক ঠিকানা।

বকুল শ্বশুর বাড়ি চলে যাওয়ার পর পরই শিউলিও চলে গেল ওর শ্বশুর বাড়িতে। শিউলির বরের সাথে সবুজদের ঠিক একটা বনে না। শিউলির বর শুধু মুখেই বড় বড় ফুটানি মার্কা কথাবার্তা বলে যা ওদের কারো কাছে ভালো লাগে না। তাই সবাই একটু এড়িয়ে চলে। বিধায় শিউলি বেশিদিন থাকতে পারল না। মেহমান চলে গেলেও জবার খুব একটা খারাপ লাগেনি। ছন্দা স্বপ্নাকে পেয়ে ওর দিন ভালোই কাটতে লাগল। তিনটা বাচ্চাই এখন শবনমকে সামলাতে হচ্ছে। বকুল শ্বশুরবাড়িতে চলে যাওয়ায় ওর দাদি জবাকে নিয়ে খুব ভাবছিলেন। কে দেখে রাখবে সেই চিন্তাটা অমূলক না। শবনমের মা গৃহস্থালি কাজে এতটাই ব্যস্ত থাকেন যে জবার খেয়াল রাখতে পারেন না। কিন্তু শবনমকে দেখে তিনিও কিঞ্চিৎ নিশ্চিন্ত ছিলেন। মনে মনে বলতেন ওই বাড়িতে গিয়ে একা একা কী করবে তার নাতিনদের নিয়ে ও তারচেয়ে বরং বাড়ির মেয়ে বাড়িতেই নিরাপদে থাকুক।

এই করে করে সবুজের মেট্রিক পরীক্ষা চলে এল। এই গ্রাম থেকে দুইজন পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিবে। কিন্তু সবার অবস্থা দেখে মনে হল পুরো গ্রামই বুঝি পরীক্ষার্থী।
মাইক চালিয়ে কোন অনুষ্ঠান করা যাবে না। এই সময়ে কোন নৌকা বাইচ কিংবা ফুটবল ম্যাচের আয়োজন হবে না এগুলো মুরব্বিদের আদেশ হয়ে দাঁড়াল। বাড়ির মধ্যে সবাই মিলে দোয়া ইউনুসের খতম পড়া শুরু হল। দিন রাত হুজুরের পড়া পানি ছিটানো যেন দাদির হুকুম যাতে সবুজের পড়ায় মন লাগে সেই জন্য।
এই সবের মধ্যে শবনমও সামিল হল। সবুজকে পড়ার টেবিল থেকে উঠতে দেয় না ওর যা লাগবে তা ও গুছিয়ে সামনে এনে রেডি করে দেয়।
মাস লাগিয়ে পরীক্ষা শেষ হল। এবার আর সবুজের মন গ্রামে টিকল না ও চলে গেল ঢাকা। রেজাল্ট হলে পরে ওখানেই কলেজে ভর্তি হবে। এই কয়দিন কোন কাজকর্ম খোঁজ করবে।

এসবের পর শবনম এবার রেডি হল নিজের ঘরে ফিরতে এরই মধ্যে একদিন সকালে প্রচন্ড বুকে ব্যথা অনুভব করে শবনমের দাদি। ব্যথা এই কমে এই বাড়ে। মাঘ মাসের শীতেও তার কপাল জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে। ঢাকায় এনে ডাক্তার দেখাবে এমন সিদ্ধান্ত যখন সবাই নিচ্ছে তখনই তিনি পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলেন। সব আনন্দ যেন কিছু মুহুর্তের জন্য পরবাসী হয়ে গেল। দাদির মৃ*ত্যু শোকে পুরো বাড়ি মৃয়মান হয়ে পড়ল। ওই অবস্থায় শবনমেরও মন টানল না নিজের ঘরে ফেরবার।
এখনতো পুরো বাড়িটাই কেমনজানি ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আর ছন্দাও জবার সান্নিধ্যে আঁটকে যায়। দুজন এক সাথে খায় ঘুমায়। স্বপ্নাকে নিয়েই শবনমের মা থাকে আর শবনম একটু একটু করে গৃহস্থালি কাজে লেগে যায়। কিন্তু সমস্যা হয় তখনই যখন পাড়া প্রতিবেশী আসে বাড়িতে। হেসেডেসে নানান জন নানান কথা বলা শুরু করে। কেউ বলে
“হগো শবনমের মা, তোমার শবনম আসলেই এক কপাল পুড়ো মাইয়্যা অইছেগো, নাইলে পর পর দুইডা মাইয়াইবা অইব ক্যা? স্বামীডা ক্যামনে ক্যামনে মইরা গেল, লা*শটাও পাইলা না। এত্ত সুন্দর সংসার থুইয়া অহন মাইয়াডার জায়গা অইছে তোমার ঘরে। নিজের বাপের ঘরে কাম কইরাতো খাইব ঠিকই তয় তোমার পোলার বৌরা আইলে পরে হেরা জায়গা দিবনি?”
কথাটা শবনমের কানে গেল কতটুকু তা বোঝা গেল না তবে কথাটা যে ওর কলিজায় তীরের মতো বিঁধল তা বোঝা গেল সাথে সাথে ওর চোখের পানি পড়তে লাগল। শবনমের মা খুব করে ওই প্রতিবেশীকে গা*ল*ম*ন্দ করে তাড়িয়ে দিল বাড়ি থেকে কিন্তু শবনমের মনের কষ্ট আর দূর হল না। ও অবিরত কাঁদতেই থাকল। রাতে ওর বাবা বাড়ি ফিরলে পড়ে তার হাতে পায়ে ধরে অনুরোধ করল নিজের ঘরে দিয়ে আসতে। পরবর্তীতে ওর বাবা রাজি হলেন মেয়েকে ওর নিজের সংসারে দিয়ে আসতে।

কয়দিন কাটল শবনমের নিজের বাক্সপোটরা গোছ গাছ করতে। তার সাথে ওর মা নানান মশলা চাল ডাল আনাজ, মুরগীও সাজালেন মেয়ের সাথে দিয়ে দেওয়ার জন্য। সব নওয়ে একদিন ওর বাবা রওয়ানা হলেন মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার জন্য। সারারাস্তায় শবনম মগ্ন থাকল নানান স্বপ্নে। বাড়িতে গিয়ে এই করবে, বাড়িতে গিয়ে ওই করবে ভেবে ভেবে।

পালকি এসে থামল বাড়ির উঠানে। শবনম পালকি থেকে নেমেই এক চিৎকার দিয়ে উঠল
“ও আল্লাহ, আমার ঘর কই? আমার ঘর ভা*ঙ*লো কে? ”
“যার ঘর আছিল হেয় নিজেই ভাঙছে, নিজেই বেইচ্যা খাইছে। তোরে জিগাইয়া করবনি?”
শবনমের শাশুড়ির এমন তিতা কথাতেও যেন শবনম নতুন এক আশার আলো দেখল। যার ঘর মানে কী? তবে কী সত্যি সত্যিই ওর অপেক্ষার প্রহর ফুরিয়েছে? দুলাল কী তবে সত্যি সত্যিই ফিরেছে? আনন্দে ওর চোখ চকচক করে উঠল।
“কই ছন্দার বাপে কই? হেয় ফিরছে কবে? আমারে খবর দেয় নাই ক্যা? ছন্দার বাপ আপনে কই? এই নতুন ঘর কী হেয় বানছেনি? বুঝছি আমার চমকায় দিতেই বুঝি আপনে এই কাম করছেন!”
“কি কয় পোড়াকপালি! তোর কতায়তো গা জ্বইল্যা গেল। দুলাল আইব কইত্তে? ওয় কী বাইচ্যা আছেনি? কবে মইরা ভুত অইছে। আর দুলালের কী এমন মুরদরে! ওয় বানবো এমন চাইরচালা ঘর? আছিলিতে ভা*ঙা ঘরে, আর অহন স্বপন দেহছ তোর লেইগ্যা এমন ঘর বানছে তোর দুলাইল্যা? অহনতো হাসি পাইতাছে আমার।”

“হ চাচিআম্মা, আপনে একটু হাসেন, নাইলে কী আর উকিল সাবের মায়েরে মানায়নি?” বানু দৌড়ে এসে গলা চড়ায় জবাব দিয়া শবনমরে জড়ায় ধরল।
“ওই ভাবি আমার ঘর কই? ”
“ওই বানু তুই কইলাম এর মধ্যে কোন কতা কইবি না। তোর লেং*ড়া ভাতার অহনও লগে আছে, বেশি বাড়লে কিন্তু জমিরা এক্কেবারে জেলে হান্দায় দিব তহন দেহুমনে গলার জোর কই যায়?”
“করেন করেন চাচিআম্মা, এতিমের হক মাইরা খাইতে থাকেন। আল্লায় সইব না। এক্কেবারে উচিৎ বিচার করব যহন তহন আর মাফ পাইবেন না। দুইন্যার বাদশাহী ছুইট্যা যাইব। ওই পাড়ের হিসাবকিতাব আছে কিন্তু মনে রাইখ্যেন।”

“আম্মাগো, ও আম্মা, আমারে কন। আমার ঘর কই? আপনে যে কইলেন যার ঘর—-”
“অত আম্মা আম্মা করন লাগব না। জামাই কয় না হরি, টিলিগ পাইড়া মরি। আইছে আম্মা আম্মা ফুডাইতে, অইগুলিতে আমি গলি না।
ঘর কী দুলাইল্যার আছিলনি? ঘর আছিল ওর বাপের। হেয় গন্ডগোলের কালে বেইচ্যা খাইছে। অহন যে ঘর দেখতাছোস ওইডা জমিরা তুলছে। ওইহানে হাত দিবি না কইলাম। ”

এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা শবনমের বাবা এবার মুখ খুললেন।
“বিয়াই সাহেবের সাথে একটু কথা বলতে চাই আমি।”
“যান, কতা কন। হেয় গোরস্থানে আছে। যান কব্বরের কাছে দাঁড়াইয়া দুইডা সুখদুঃখের কতা কইয়া আহেন। যত্ত খুশি তত্ত কতা কইয়া আহেন ধইরা রাখছে কেডা?
“ও আল্লাহগো! আব্বা নাই? আব্বায় মইরা গেল কবে?” বলেই শবনম হুহু করে কেঁদে উঠল।
“অইছে অইছে, আর এত মায়া কান্দন দেহান লাগব না। এই সবে আমার মন গলে না।

“আমার জামাইয়ের ভাগের জায়গা দেন৷ ওইহানে আমি আমার মাইয়ারে ঘর তুইল্যা দেই। ওইহানে ও ওর দুই মাইয়্যা লইয়া থাকব।”
“কয় কী ভদ্রলোক? জায়গা পাইব ক্যামনে। দুলালের কী পোলা আছেনি? দুইদিন পর আপনেরা আপনেগো মাইয়ারে বিয়া দিবেন। ওই মাইয়্যা এইহানে থাকব ক্যা? কে দেইখ্যা রাখব। চিল শকুনে টাইন্যা খাইব তহন আবার আমগো দোষ পরব। ”
“হ চিল শকুন যহন কেউ নিজেই পালে? ”
“বানু মুখ লাড়াইছ না কইলাম। কেইস কিন্তু এইবার খাইব শাহআলম।”
“হ, হেই ডর দেহাইয়াইতো সবার মুখে তালা মারছেন। জু*লু*মের বিচার আল্লাহ করব ছাইরা দিব না।”
শবনমের বাবা যা বোঝার তা বুঝে গেলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন
“মারে ল ফিরত যাই, এইহানে দেন দরবার কইরা খুব একটা জুইত অইব না। তুই শান্তি পাইবি না। তোরে অশান্তিতে রাইখ্যা আমরা কেউ শান্তি পামু না। ল ফিরতই যাই।”
“হ তালই সাহেব আপনে ঠিকই কইছেন, এইহানে রাখলে দেখবেন যা আছে তাও শেষ অইব। যদ্দুর আছে তদ্দুরের হেফাজত করনডাই বুদ্ধির কাজ অইব।”
“বড় বিয়াইন সাহেব আছেনি? তার লগে একটু দেহা করুম।”
“বড় চাচিআম্মাও মইরা গেছে। আমার শাশুড়ি হের পোলার কাছে। আহেন আমগো ঘরে আহেন। বলে বানু স্বপ্নারে কোলে নিয়ে ছন্দার হাত ধরে ওর ঘরের দিকে হাটা ধরল।
শবনমকে বুকে জড়িয়ে ধরে ওর বাবাও বানুর পিছু নিল। শবনম কোন কথা বলতে পারছে না অনবরত কাঁদছে।

শবনমকে পেয়ে ওর মেঝ চাচিআম্মা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বিলাপ করতে করতে বললেন
“এতিমরে যে ঠকায় তাগো উপরে আল্লাহর গজব পড়ব। আমরা এত কইরা কইলাম কিন্তু কেউ আমগো কোন কতা হুনল না। শান্তি বাহিনি করছে অহন কয় মু*ক্তি*যু*দ্ধ করছে, এক একটা হা*রা*মির বা*চ্চা। এডিরে দেখলে জাহান্নামবাসীও ডরে চিক্কুর দিব। আমার পোলারে জেল দেওনের ডর দেহায় কতায় কতায়। ওই হারামজাদারা আমার পোলায় কী তগো মতননিরে? আমার পোলায় যু*দ্ধ করছে। গুলি খাইয়া পঙ্গু অইছে। ওর বড় বৌ নিজেই আরেক বেডার লগে গেছেগা। ওয় নিজের ব্যবসা লইয়া নিজের বাড়ি ফিরছে। আর তুই কতায় কতায় কস পোলার নামে কেইস দিবি। ওর বৌ দাবি করছে ও চু*রি কইরা সব টেকা লইয়া পলায়ছে। ওই হারামজাদা তোরা ওইডাই বিশ্বাস করলি, আমার পোলার কতা একবারও বিশ্বাস করোস না ক্যা? শ*য়*তা*নের আ*ড্ডি শয়*তা*নগু*লি। মরলে দেখবি হাবিয়া দোজখ অপেক্ষা করতাছো তগো লেইগ্যা। ”

শবনমের বাবা পুরো বিষয়টা কিছুটা আন্দাজ করতে চেষ্টা করলেন কিন্তু বিশেষ কোন কূল পেলেন না। অবশেষে শাহআলম নিজ থেকেই সবটা বুঝিয়ে বললেন
“আসসালামু আলাইকুম তালাই সাহেব, আসেন বসেন। আমি শাহআলম, দুলালের চাচাতো ভাই। তালই আপনের লগে কতা কওনের কোন মুখ নাই আমার। আমরা বড়ই সরমিন্দা। আপনের মাইয়ার দেখভাল করনের কোন হিম্মত দেহাইতে পারি নাই। দুলালের মাইয়া দুইডার হক চাইয়াও আদায় করতে পারি নাই। আমগো চোখের সামনে কাকায় ভেন্ডারের কতায় সব জমিরাগো নামে লেইখ্যা দিল। দুলালের দুই মাইয়া অওনে ওগো এক রত্তিও সম্পত্তি দিল না। কাকায় মইরাও এই বেইনসাবির লেইগ্যা শান্তি পাইব না। ভেন্ডারে কইল দুলালের বৌয়ের বিয়া অইব। মাইয়া দুইডারও বিয়া অইব তহন এই বাড়ি কার অইব?
আমগো কারো কতাই কাকায় হুনল না। ন্যয্য বিচারডা করল না। ঘরডাও বেইচ্যা দিল জমিরার পাল্লায় পইড়া। চোক্ষের সামনেই সব দেখলাম কিছুই করতে পারলাম না।”
“বিয়াই, নিজে সব লেইখ্যা দিছে সজ্ঞানে? ”
“হ তালাই কাকা নিজেই লেইখ্যা দিছে।”
“না দিয়া উপায় কী? আমার দেওরের কী কোন রাও আছিলনি ওই শয়তানগো ভীড়ে? জমিরার শ্বশুর শাশুড়ির চাপে পইড়া আমার দেওরে এডি করছে বেয়াই সাহেব। আমগো লগে দেওরেরে ঘেঁষতেও দেয় নাই।”
মেঝ চাচিআম্মা কাঁদতে কাঁদতেই কথাগুলো বললেন। বানু, সেমাই শরবত এনে সামনে দিল। কিন্তু কারোরিই গলা ভেজাতে পারল না সেই শরবত। বানু ছন্দা আর স্বপ্নাকে কোলে নিয়ে বসে ওদেরকে শরবত খাওয়ালো আর ছন্দাকে জিজ্ঞেস করল
“ও মা, তুমি কী আমারে ভুইল্যা গেছো? আমার বুকে লাইগ্যা থাকত সারাডা সময়। অহন দেহি আমারে চিনোই না।”
ছন্দা কোন কথা বলল না শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখল বানুকে। ওর চোখও ছলছল করছে। এখানে আসার পর থেকে নিজের মা’কে শুধু কাঁদতেই দেখছে তাই হয়ত ওর ভালো লাগছে না। একটা সময় পর শবনমের বাবা বলে উঠলেন
“ল মা এইবার বাড়ি ফিরি। বেয়াই যদি নিজের ইচ্ছাতেই লেইখ্যা দিয়া থাকে তাইলে আর তোর এইহানে থাকনের কোন উপায় নাই। এহনও তোর বাপ বাইচ্যা আছে, তোর থাকনের চিন্তা করন লাগব না। যে যার কর্মফল ভোগ করব। আমার নাতনী দুইডার হক মাইরা কেউ কোনদিন কুডিপতি অইব না। আল্লার উপরে ভরসা রাখ আল্লায় বিচার কঠিন বিচার। এইহানে কারো কু*প*রা*ম*র্শ কামে লাগব না। ল বাড়ি ফিরি। এই হানে আর থাকন ঠিক অইব না। মানুষ চিন্যা গেলাম। এরা যে এমন ছোডলোক তা বুঝিনাই।”

সবার সব কথাই কানে যাচ্ছে, কিন্তু কিছুই মন মানতে চাচ্ছে না। এই বাড়ি ওর অন্তরে গেঁথে গেছে। এখানে ওর দুলালের সাথে সুখ স্মৃতিগুলো মিশে আছে। দুলাল ওর প্রথম প্রেম প্রথম ভালোবাসা, তাকে ছেড়ে যেতে বললেই কী অত সহজেই যাওয়া যায়? শবনমও তা সহ্য করতে পারল না, যখন ওর বাবা জোর দিলেন চলে যাওয়ার জন্য তখন ও গগনবিদারী আ*র্ত*চিৎ*কার করে উঠল। তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না, জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ল মাটিতে। আর তা দেখে ছন্দাও শব্দ করে কেঁদে উঠল। স্বপ্না ছোট বাচ্চা কিন্তু ও ওর বোনের কান্না দেখে হয়ত না বুঝেই বোনের সাথে কাঁদতে শুরু করল। শবনমের বাবা দিশেহারা হয়ে গেলেন কিছু মুহুর্তের জন্য নিজেকে নিরুপায় হিসেবে আবিস্কার করলেন। বানু ধরাধরি করে শবনমের মাথাটা কোলে তুলল। মেজ চাচিআম্মা জগে করে পানি এনে শবনমের চোখেমুখে ছিটাতে লাগল। কিছুক্ষণ পর বানু চিৎকার করে উঠল শবনমের মুখে হাত দিয়ে
“ও আম্মাগো, ওরতো দাতে দাত লাইগ্যা গেছে, জলদি একটা চামুচ আনেন। ”
পরবর্তীতে চামচ দিয়ে চাপ দিয়েই দাঁত খুললেন চাচিআম্মা।
শবনমের বাবা দুই নাতনীকে কোলে নিয়ে দর্শকের মতো সব দেখতে লাগলেন।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here