শবনম (পর্ব ১৭) সায়লা সুলতানা লাকী

0
162

(পর্ব ১৪, ১৫, ১৬ ফেইসবুক নিচ্ছে না, এরজন্য এতদিন রেস্ট্রিকটেড ছিলাম, তাই আর ওই পর্বগুলো দিতে পারছি না)
#শবনম (পর্ব ১৭)
সায়লা সুলতানা লাকী

গাঙ পাড় দিয়ে হেঁটে শবনম চলে এল লঞ্চ ঘাটে। এখনও সূর্য উঠেনি। তড়িঘড়ি করে ঘাটে ভেড়ানো লঞ্চে উঠে গেল। দোতলায় ছোট কেবিনটায় দেখল এখনও কেউ আসেনি। জলদি করে ঢুকে কাঠের দরজায় খিল আটল। এবার কলসির ভেতর থেকে বের করল ওর বাবার দেওয়া সেই সাদা শাড়ি যা দুলাল নিখোঁজ হওয়ার পর আত্মীয়দের কথায় এনেছিল শবনমকে পরাতে। সেদিন শবনম পরতে চায়নি। কিন্তু আজ সেচ্ছায় এই সাদা থান গায়ে জড়ালো আর নিজের জীবনের সব রং একত্র করে ভাজ করে কলসির ভেতর ভরে ফেলল। কাজটা যত সহজ হবে ভেবেছিল ততটা সহজ হল না। সাদা শাড়ির ভেতর ওর হৃদয় ফেটে চৌচির হয়েগেল। লাল রক্তক্ষরনে ভেসে গেল ওর অন্তর। আজ জীবনের প্রথম ও চু*রি করেছে, নিজের ঘরেই নিজে চু*রি করেছে। জমি বেচার সব টাকা এই কলসির ভেতর রাখা। টাকাটা এবার সাবধানে কোমরে গুঁজে নিল শক্ত করে। আঁচলে শুধু ভাড়াটুকুই গিট্টু দিয়ে রাখল। আগে দশ টাকা হাতে রাখতেই ভয় হত আর আজ হাজার টাকা সাথে নিয়ে নিরুদ্দেশের পথে বের হয়েছে। অথচ এতটুকুও ভয় কাজ করছে না মনে। কেবল ছন্দা আর স্বপ্নার জন্য মনটা থেকে থেকে কেঁদে উঠছে।
দরজায় টোকা পড়তেই শবনম বড় করে ঘোমটা টেনে দরজা খুলে দিল। যাত্রী মহিলারা ওকে ঠেলে ভিতরে ঢুকল আর দরজাটা বন্ধ কেন করে রেখেছিল তার জন্য গা*ল*ম*ন্দ করতে লাগল।

মহিলারা শান্ত হয়ে বসতেই শবনম কলসিটা নিজের কাছে টেনে শক্ত হয়ে বসল। ইচ্ছে করেই তাদের গা*ল*ম*ন্দের কোন উত্তর দিল না। লঞ্চ যখন ছাড়ল তখন ওর মনটা হুহু করে কেঁদে উঠল। মনে হল ওর জীবনের সবচেয়ে দামি কিছু ও ফেলে যাচ্ছে এখানে। অজানার পথে পা বাড়িয়েছে জানে না আবার নিজের মেয়েদের সাথে কখনও এক হতে পারবে কি না? একমন তখনও বলছিল শবনম গাঙে ঝাঁ*প দে? সাঁতরায়ে ফিরে যা ঘাটে। তোর মেয়েরা ঘুম ভেঙে তোকে কাছে না পেয়ে মা মা করে কাঁদবে। আবার আরেক মন বলছে সাবধান, ফিরলেই তুই অন্যের ঘরে চলে যাবি। চিরদিনের জন্য মেয়েদের হারাবি।
একটা সময় কষ্টে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। পাশের মহিলারা কারন জানতে চাইল কিন্তু ও কিছুই বলল না। সারারাত নির্ঘুম থাকার কারনেই হয়ত একটা সময় ও ঘুমিয়ে গেল। মাঝখানে একবার উঠে ভাড়া দিয়েছিল। পাশের মহিলারা কত কী কিনে খাচ্ছিল কিন্তু ওর কিছুই খেতে ইচ্ছে করল না। মনে হল খিদেই মরে গেছে। সামনের দিনগুলোতে কি হবে তা ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে গেল শবনম।

এদিকে শবনমের ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে ওর মা নিজেই কল পাড়ে গেল মেয়ের খোঁজে। ওখানে মেয়েকে না পেয়ে কেন জানি কলিজায় একটা চাপ অনুভব করল। দৌড়ে বাড়ির চারপাশে খুঁজল কিন্তু না মেয়েকে কোথাও দেখতে পেল না।
আস্তে আস্তে সূর্য উঠল।চারপাশ ফকফকা হয়েগেল। শিউলি চুলায় আগুন ধরাল। বড় ডেকচি ভরে ভাত চড়ানো হল। গোমস্তার বৌরা আনাজ তরকারি কাটতে বসল একজন আরেকজন মসলা পিষতে বসল। এদিকে স্বপ্না ঘুম থেকে উঠেই কাঁদতে শুরু করল, ছন্দা ছোট বোনকে কোলে নিয়ে আদর করতে চেষ্টা করল কিন্তু ও কিছুতেই কিছু মানতে চাইল না। গলা ছেড়ে কাঁদতে আরম্ভ করল। এইবার শিউলি একটু রাগ দেখিয়ে বলল
“বুবু তুই কইরে? স্বপ্নায় কান্দে তুই ধরোস না ক্যা? এই বিয়ানকালে এমন পোলাপানের কান্দন শুনতে ভালো লাগে না।”
কিন্তু শবনমের কোন উত্তর পাওয়া গেলনা। এবার শবনমের বাবাও একটু বিরক্ত হয়ে বলল
“শবনমের মা, একটু দেহতো, নাতনি কান্দে ক্যা? শবনম গেল কই? ও শুনে না মাইয়ার কান্দান?”

শবনমের মা কোন কথা বলতে পারছে না। তার হাতেও কোন কাজ উঠছে না। কি দিয়ে শুরু করবেন তাও বুঝতে পারছেন না। হঠাৎ মনে কুডাক দিল কলসির কথা মনে পড়ায়। অমনি চিৎকার করে উঠে বলল
“ও শবনমের বাপ, দেহতো গাঙপাড় গিয়া! ওইহানে তোমার মাইয়ারে পাওনি? একটু দেহ না, আশেপাশে ওর লাশ পাইলেও তুইল্যা আইনো। যাও না, একটু দেহতো মাইয়া ফযরের ওয়াক্তে কলসি লইয়া বাইর অইয়া কই গেল?”

তার কথা শুনে শবনমের বাবার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল। তিনি অবাক চোখে তাকায় বললেন
“কি কও এইগুলা? কি কও তুমি? মাতা ঠিক আছেনি তোমার? শবনম কই? ”
“জানিনাতো? হেই যে ফযরের কালে বাইর অইল এহনও বাড়ি ফিরে নাই। কলসিডা লগে লইয়া বাইর অইছে। আমি ভাবছি পানি আনতে বুঝি কল পাড়ে যায়। এহন দেহি মাইয়া আর ফিরে না। অহনওতো আইলো না মাইয়া আমার।” বলে চিকন সুরে কাঁদতে শুরু করলেন।
শবনমের বাবা আর ওর ভাইয়েরা গোমস্তা কামলা সব মিলে দৌড়ে ছুটল নদীর পাড়ের দিকে।

এক কান দুই কান হতে হতে বেলা বাড়ার সাথে সাথে পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল শবনমের নিখোঁজ সংবাদ। দলে দলে মানুষ এসে ভীর করতে লাগল শবনমদের বাড়িতে। কেউ বলতে লাগল “জোর কইরা বিয়া দিতে চাইছো দেইখ্যা শবনমি নিশ্চয় ঝাঁ*প দিছে গাঙে।” আবার কেউ বলতে লাগল “দেহ খবর লইয়া মাইয়া কার লগে পিরিত কইরা ভাগছে। ভাতার মরছে তিন বছর অইছে, কি আছিল ওর মনে তার কী কোন খবর রাখছোনি তোমরা?”

শবনমের মা জানে এখন গ্রামবাসী নানান গাছেমাছে কথা ইনিয়েবিনিয়ে শুনাবে আর তা সবই ওদের মুখ বুজে শুনতে হবে। তাই কেউ প্রতুত্তরে কিছুই বলল না।
শিউলি বড় এক গামলায় ভাত নিয়ে মেখে সব বাচ্চা এক সাথে বসিয়ে খাওয়ায় দিল। ছন্দাকে কাছে ডেকে শিউলি কয়েকবার জিজ্ঞেস করল ও কিছু জানে কি না ওর মা সম্পর্কে। ও কিছুই বলতে পারল না।
নদীতে জাল ফেলে, জাল টেনে অনেক খোঁজাখুঁজি করা হল কিন্তু কোন হদিস পাওয়া গেল না। পাত্র পক্ষের মুরুব্বিরা দল বেঁধে এলেন খবরটা শুনে। এখানে বিয়ে নিয়ে তাদের বড় আশা আকাঙ্খা ছিল, এই খবরে সব ধূলিসাৎ হয়ে গেল। তাদের মানহানীর জন্য দুইচার কথাও শুনিয়ে যেতে কেউ ছাড়লেন না।
শবনমের বাবা সেসব কথাও মুখ বুঝে সহ্য করলেন। কারন তাদের মেয়ে তাদের নাক কেটে রেখে গেছে এখন এ সবই তাকে সহ্য করতে হবে
ছন্দা সবার কথা শুনে বুঝল ওর মা আর ফিরবে না। ওর মাও বাবার কাছে চলে গেছে। বাচ্চা মেয়ে মুখ লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে আর একটু পর পর স্বপ্নাকে কোলে নিয়ে বসে থাকে। অবুজ দুইটা শিশুর দিকে তাকিয়ে শবনমের মায়ের বুকটা আর ফেটে যায়। বিলাপ করতে থাকে নাতনিদের কষ্টের কথা ভেবে। ওদের কী হবে তা নিয়ে তার চিন্তা আরও বেড়ে গেল। তখন শবনমের বাবা’ই বলল
“এত চিন্তা কর ক্যা? তুমি না নাতনি নিজে পালবা কইয়া মাইয়ার বিয়া ঠিক করছিলা? অহন মনে কর মাইয়ার বিয়া অইয়া গেছে। তুমি নাতনি পালো, বেশি কইরা পালো। এতিম পাললে ছোয়াব অইব। ছোয়াব কামাও বেশি কইরা।” তার রাগ তার চোখে মুখে ফুটে উঠল।

এদিকে বেলা শেষে লঞ্চ এসে ভিরল ঘাটে। লঞ্চের সাইলেনে মুখরিত ঘাটটাকে কেনজানি এই মুহুর্তে বড় আপন বলে মনে হল শবনমের। দাঁড়িয়ে কোন পথে নামবে তা দেখছিল এরই ভীড়ে ধাক্কা খেয়ে পড়ে কলসিটা ভাঙল। পেছনের লোকটা হাত বাড়িয়ে দিল উঠার জন্য। শবনম লাজ লজ্জা ভুলে কলসির ভেতর রাখা শাড়িটা এক হাতে নিয়ে অন্য হাতে লোকটার হাত ধরে উঠে দাঁড়াল। বুঝল এখানে টিকতে হলে মানুষের সাথে পাল্লা দিয়েই টিকতে হবে নইলে এভাবে যেখানে সেখানে ধাক্কা খেয়ে পড়তে হবে। এবার মানুষের স্রোতের সাথে গা ভাসিয়ে ঘাট পার হয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালো। এখানের কাউকেই ও চেনে না। দুলালের খালার বাসার ঠিকানাটাও ওর কাছে নাই। কীভাবে গিয়েছিল সেই স্মৃতি ছাড়া আর কিছু নাই। কিন্তু ঢাকার মানুষ বড় জটিল, দুলাল সবসময় বলত। এদের নাকি বিশ্বাস করা যায় না। এরা নরম পেলেই তাকে ভেজে খায়।একটুও দয়ামায়া করে না।
এই অবস্থা ও কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। কিন্তু ও যে চিনে না তা কাউকে বোঝানো যাবে না। এখন তাহলে কী করবে? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হল হাসপাতালে গেলে কেমন হয়? ওটাতো সবাই চেনে। আর ওখানে গেলে থাকার একটা ব্যবস্থাও হবে। ওখানে থাকা খাওয়া বিনা পয়সায় মিলবে। কিন্তু যাওয়া কীভাবে? ভাবতেই মনে হল মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। আর বিপদে পড়ে মিথ্যা বললে আল্লাহ নিশ্চয় কোনো পাপ ধরবে না। যা ভাবা তাই কাজ রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে জোরে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। ও যখন কোঁকানো শুরু করল তখন আস্তে আস্তে রাস্তায় ভীড় জমে গেল। উৎসুক জনতা জানতে চাইল সমস্যা কী? তখন শবনম জানাল ওর নাকি মরনব্যাধি হয়েছে, এখনই বড় হাসপাতালে যেতে হবে। প্রচন্ড পেট ব্যাথা শুরু হয়েছ। লোকজনের ভীড়ে এক লোক বলে উঠল
“বিধবা মাহিলা এমন একা পথে বের হয়েছো কেন? সাথে কেউ নাই?”
“ও ভাইগো লগে কাউরে আনতে পারি নাই। ভাইয়েরা চাকরি করে। তাগো অপেক্ষা করলে ঘরেই মরতে অইব। হেই ডরে বাইর অইছি, মনে করছি একলাই যাইতে পারুম কিন্তু এমন ব্যাথা শুরু অইব তা কে জানতো?”
পাশের আরেক লোকের খুব মায়া হল। তিনি একটা বেবিট্যাক্সি ডেকে দিয়ে বললেন
“আপা ভাড়া আছেতো আপনার সাথে? ভাড়া দিতে পারবেনতো?”
শবনম হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বেবিট্যাক্সিতে উঠে বসল। ওর হাতে তখনও ওর রঙিন শাড়িটা ভাজ করে ধরা। ট্যাক্সি ড্রাইভার একবার কনফার্ম করল ওর কাছে ভাড়া আছে কি না?
ও কোঁকাতে কোঁকাতে জানাল আছে। এরপর ড্রাইভার স্টার্ট দিল। প্রচন্ড শব্দে কালো হলুদ বেবিট্যাক্সি ছুটে চলল। প্রথম বার যখন এই পরিবহনে চড়েছিল ছন্দাকে পেটে নিয়ে তখন এর গন্ধে বমি করেছিল কিন্তু আজ এর গন্ধটা বেশ ভালো লাগল। কিন্তু এর গতির কারনে শবনমের মাথাটা ঘুরতে লাগল। ইচ্ছে করেই চোখ বন্ধ করে রইল। না খাওয়া শরীর যেন দুলছে ওর।
হঠাৎ করেই ড্রাইভার বলল
“নামেন, হাসপাতালে আইছেনতো! নামেন না ক্যা? ও আল্লাহ যাত্রী কী ঘুমায়, নাকি অজ্ঞান হইছে?”
ড্রাইভারের কথায় এবার শবনম চোখ খুলে তাকায়। “আরে হ, এইডাইতো ওই হাসপাতাল। যেইহানে আমি আগেও আইছে।” মনে মনে কথাটা বলে আস্তে করে নেমে দাঁড়াল। ড্রাইভারকে ভাড়াটা দিয়ে। হাসপাতালের ভিতরে চলে গেল। সারাদিন না খাওয়া কাঁপা শরীরটায় কেন জানি এখন অনেক শান্তি লাগছে পরিচিত একটা জায়গায় আসতে পেরে। একবার ভাবল এখান থেকে রিকশা নিয়ে খালার বাসায় যাবে কি না? আবার ভাবল রিকশা ওয়ালাকে কী বলবে? জায়গা কীভাবে চিনায় নিবে? ভাবতেই দেখল সাদা এপ্রন পরা এক ডাক্তার। এই পোশাক পরেই ওকে কয়েকজন চিকিৎসা করেছে। এরা ভন্ড প্রতারক হবে না। এদের অনেক মায়ার শরীর। ওরা অনেক ভালো, এদেরকে বিশ্বাস করা যায়। ভাবতে ভাবতেই ওই লোক কাছে আসতেই শবনম আবার কোঁকানো শুরু করল পেট চেপে ধরে
“ও ডাক্তার সাব ও ডাক্তার সাব আমারে বাঁচান, আমার পেডে অনেক ব্যতা। আমারে হাসপাতালে ভর্তি নেন। আমার চিকিৎসা করেন। ” বলতে বলতে তার সামনে গিয়ে ধপাস করে বসে পড়ল।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here