শবনম (পর্ব ২৮) সায়লা সুলতানা লাকী

0
625

#শবনম (পর্ব ২৮)
সায়লা সুলতানা লাকী

পারভেজ পেছন পেছন কিছু দূর এসে নাম ধরে ডাকতেই শবনম ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকাল
“কি অইল ভাই হুদাই কামে পিছ লইছেন ক্যা? কিছু কইবেন?”
“না মানে, শবনম আমি বলতে চাইছিলাম কী, যদি তুমি রাজি থাকো তাইলে……”
শবনম আর কথা বাড়তে দিল না। মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে বলল
“ভাইরে বাংলা বুঝেন না? আমি যে কইলাম আমার অসুখ তা শুনেন নাই? আপনের কী মনে লয় আমার এহন আপনের কোন কথা শুননের টাইম আছে? হুদাই ভেদর ভেদর বন্ধ করেনতো! ”
শেষ কথাটা একটু বিরক্ত হয়েই উচ্চ শব্দে বলে আবার হাঁটা শুরু করল। এবার আর পারভেজ পেছনে এল না। ওই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইল।

কয়েক দিনের মধ্যে বাড়ি থেকে কমলা নামের এক মেয়ে নিয়ে শবনমের বাবা ঢাকায় এলেন। মেয়েটার বয়স চৌদ্দ পনের হবে। শবনমের মা ওকে বাসাবাড়ির কাজগুলো ভালোমতো বুঝিয়ে দিতে লাগলেন শবনম কমলাকে দেখে বেশ খুশি হয়ে গেল। মনে মনে ভাবলো এবার ওর সাথে খেলাধুলা করে সময় কাটাতে পারবে ওর মেয়েরা।

এদিকে সবুজের পরীক্ষা শেষ হল। ও আবার অফিসে নিয়মিত হল। ওর মা-ও একটা সময়ের পর আবার বাড়ি ফিরে গেল। এবার বাড়ি যাওয়ার আগে ওর মা পুরোপুরি একটা সবজি বাগান করে দিয়ে গেছেন সামনের খোলা উঠানটার চারপাশে। শবনম অনেক বলে কয়ে মেয়েদের খেলার জন্য একটু খালি জায়গা রেখেছে। বেলা থাকতে থাকতে যখন ফিরে তখন নিজেই সময় দেয় এই বাগানের জন্য। নিজেও কিছু ফুল গাছ লাগিয়েছে শখ করে। কারেন্ট চলে গেলে বদ্ধ ঘরে থাকতে চায় না মেয়েরা তখন এই উঠোনে মাদুর পেতে রাতেও বসে থাকে সবাই। সবুজ সবসময় থাকে না ও মাঝে মাঝে বসে বোন আর বোনের মেয়েদের সাথে। ইদানীং ওর কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ায় তেমন একটা সময় পায় না নিজের জন্য খরচ করার মতো। এই চাকরিটা এখন আর ওর ভালো লাগে না। একটু ভালো কিছু করার তৃষ্ণায় অস্থির সময় কাটায় ভেতরে ভেতরে।
শবনম শুধু ওকে চাকরিটা এই মুহুর্তে ছাড়তে নিষেধ করে।

এদিকে অফিস কেন্টিনের ইনচার্জ কয়দিন ধরেই ওকে ডেকে ফ্রীতে চা সিঙ্গারা খাওয়াচ্ছে। ও টাকা দিতে চাইলেও নেয় না। একদিন খুব আহ্লাদ করে আবদার করে বসল তার সাথে সিনেমা দেখতে যেতে। শবনম তাকে তখনই কোন উত্তর দিল না। রোজা চলে এল বলে খোরশেদের আবদার রাখা আর হয় না।

জীবনের প্রথম বোনাস হাতে পেয়ে শবনমের মনের জোর আরও বেড়ে গেল। নিজেই নিজেকে চিনতে পারে না এমনটা মনে হয়। যেদিন বোনাস তুলল সেদিনই খোরশেদের সাথে চলে গেল নিউমার্কেট ঈদের কেনাকাটা করতে। রোযা শুরু হওয়ার পর থেকে ছন্দা আর স্বপ্নার শুরু হয়েছে ঈদের জামাকাপড় নিয়ে নানান পরিকল্পনা। এর আগের ঈদগুলোতে নানা যা দিয়েছে তাতেই সন্তুষ্ট থেকেছে। এবারের ঈদ যেন ওদের জন্য অন্য কিছু। স্কুলের বন্ধু ছাড়াও রোডের বন্ধুদের মধ্যেও এসব নিয়ে প্রতিদিনই জল্পনা কল্পনা চলে। রাতে যখন শবনম বাসায় ফিরে তখন তার আভাস কিছুটা ওর গায়েও লাগে। তাই আজ বোনাস পাওয়ার পর পরই মেয়েদের জন্য কেনাকাটার কথা বলতেই খোরশেদ বলে উঠে,
“চলো আমরা নিউমার্কেট যাই, আমিও বাড়ির জন্য কেনাকাটা করুম। একসাথে দুইজন গেলে দুইজনেরই সুবিধা হবে। ”
শবনম খেয়াল করল ওর কথাটা মিথ্যা না, কথায় যুক্তিও আছে। আর ও একা একা নিউমার্কেট যেতেও পারবে না । তাই রাজি হয়ে যায়।
বাসে পাশাপাশি সীটে বসে গল্পে গল্পে চলে আসে গন্তব্যে ।
মনের আনন্দে মেয়েদের জন্য সাথে মা বাবা জবা সবুজ আর মেঝ ভাইটার জন্যও কাপড়চোপড় কিনে।
বানুর জন্য শাড়ি কিনতে এসে হঠাৎ খেয়াল করে ওর গায়ে একটা লাল শাড়ি জড়িয়ে খোরশেদ মুগ্ধ হয়ে দেখছে। শবনম প্রথমেই কিছু বলে না। ভাব করে এটা স্বাভাবিক। শাড়িটা গা থেকে নামিয়ে জিজ্ঞেস করে
“ভাবির লেইগ্যা নিবা? নাও, সুন্দর শাড়িডা।”
“কেন তোমার লেইগ্যা নেওন যায় না? আমিতো ভাবছি তোমার কথা….”
“হা হ হা, ভাই তুমি যে কী কও না? আমি অইলাম বিধবা মানুষ। যার মনেই এহন রং নাই তার আর শইল্যে রং লাগাইয়া কী লাভ? আমার সাদা রংই ভালো। ”
“আহা, লও না। আমি দিলাম তোমারে। কত আর এমনে থাকবা? মনের রং আইতে কতক্ষণ? ”
“দূরররর ভাই হুদাই সময় নষ্ট কইর না। এইসবে আমার মনে রং ধরে না। কোনো বেডা হালারই মুরোদ নাই যে আমার মনে রং ধরায়। লও লও তোমার কাম শেষ কর। আমারডা শেষ। জলদি কর।”
শবনম আর দাঁড়ায় না নিজের ব্যাগ গুছিয়ে এগিয়ে আসে রাস্তায়।

ঈদের ছুটিতে লঞ্চে চেপে সবাই মিলে বাড়ি আসে ঈদ করতে। এরই মধ্যে একদিন শ্বশুর বাড়িতে যায় দুই মেয়ে নিয়ে ঘুরতে। নিজের ভিটায় এখন অন্যের বসবাস। বুকটা শুধু একটু পুড়ালো। ঘেন্নায় আর ও মুখো হল না। সোজা বানুর ঘরে গেল। ঈদের জন্য কেনা কাপড়টা এগিয়ে দিতেই বানু আনন্দে কেঁদে ফেলল। শবনম ওকে বলে এল কেন সমস্যা হলে জানাতে। যদি দরকার হয় তাহলে ওদের ঢাকার বাসায় চলে যাওয়ার কথা বলে ওরা ফিরে এল ।

ঈদের আনন্দ শেষে ঢাকায় ফিরে সবাই। সবুজ নতুন বাড়ি কেনার জন্য ওর বাবাকে চাপাচাপি করে। পরে একটা সময় ওর বাবা জমি বিক্রি করে টাকা এনে সবুজকেও একটা বাড়ি কিনে দেয়।
শবনম বুঝে ভাইয়ের এখন বিয়ের সময় হয়েছে। মাকে জানায় মেয়ে দেখার কথা।

একদিন স্কুলের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য শবনম নিজেকে একটু গুছিয়ে নেয়। চোখে কাজল দিতেই দেখতে পেল ছন্দা কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। এরপর মেয়ে কেমন জানি আঠার মতে লেপ্টে থাকল ওর গায়ে অনুষ্ঠান শেষ করে বাড়ি ফেরার আগ পর্যন্ত সময়টাও। শবনম মনে মনে অনেক অবাক হল ওর এমন আচরনে। বাহিরে আর এটা নিয়ে কোন প্রশ্ন করল না। বাসায় ঢুকেই ছন্দাকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করল
“ছন্দা মারে ক’তো দেহি, তোর কী অইছে? তুই আইজকা এমন করতাছোস ক্যা?”
“আম্মা আপনে সাঁজছেন ক্যা? আপনে কী আবার বিয়া বইবেন? আপনে কী আবার আমগো নানির কাছে থুইয়া আইবেন? আমার খালি ভয় লাগতাছে আপনের সাজন দেইখ্যা।”
ছন্দার কথা শুনে শবনম স্তব্ধ হয়ে গেল। ওর একটু সাজগোছ মেয়ের মনে এত বড় আতংকের জন্ম দিল, এটা ভাবতেই নিজেও আঁতকে উঠল মনে মনে।
“তোরে কেডা কইছে যে আমি আবার বিয়া বমু? চোখে একটু কাজল দিলেই কী মায়েরা আবার বিয়া বহেরে পাগল? হুদাই ডরাস ক্যা? তোগোরে কোন জায়গাতেই দিমু না। তোরা আমার লগই থাকবি। ”
“পারভেজ মামু বলে আমার আব্বা অইতে চায়। আমারে রোডের লতায় কইছে।”
“দূর দূর দূর কী কয় মাইয়া। তোর আব্বা একজনই। হেরে ভুইল্যা গেছোস? হেরে থুইয়া আর কেউ তোর আব্বা অইব ক্যা? হেয় মরলে কী অইব, অহনও আমগো লগই আছে বুঝলি?”
“আব্বারে মনে লয় আমি ভুইল্যাই গেছি। আব্বার মুখটা অহন ঠিক মনে করতে পারি না। মাইনষে….”
শবনম ওকে আর কথা বলতে দেয় না ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠে
“নাউজুবিল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ৷ কয় কী মাইয়া? নিজের বাপেরে বলে কেউ ভুলে। দাঁড়া তোরে কোলে লইয়া তোর বাপের একটা ছবি আছে। এইবার গেরাম থেইক্যা ওইডা লইয়া আমু। হেরপর এই ঘরডায় লাগায় রাখুম তাইলে আর তুই, তোরা তোর আব্বার মুখটা ভুলবি না। আর মাইনষেও তারে চিনব। বুদ্ধিডা ক’তো কেমন অইছে? ভালো অইছে না?” বলে ছন্দাকে বুকে জড়িয়ে হিহিহি করে হেসে উঠল শবনম ঠিকই কিন্তু মনের মধ্যে জরো হলো এক গুচ্ছ প্রশ্ন। মাইয়ার মনে ভয়ডার জন্ম কে দিল? পারভেজের নাম এইহানে উঠল কেমনে? এইডাতো এমনি এমনি আহে নাই? একদিনেই এই ডরভয় জমে নাই? ইত্যাদি ইত্যাদি।

পরদিন অফিস থেকে ফেরার পথে আবার সেই পারভেজ পিছু নিল। আজ শবনম বেশ আগ্রহ নিয়েই ওর সাথে কথা জমাতে শুরু করল
“পারভেজ ভাই, ভাবছি বাড়িডা মাইয়াগো নামে লিইখ্যা দিয়া আমি চাকরি ছাইড়া ঘরে বমু। আর এত কষ্ট করতে ভাল লাগে না। দেহি একটা ভালো কামাই করা পুরুষপোলা পাইনি!”
” হায় হায় এইটা কী কও? এই কাম করবা ক্যা? বাড়ি মাইয়াগো নামে দিবা ক্যা? আর এমন সোনার চাকরি কেউ ছাড়েনি? বেক্কল হইও না।”
“না ভাবছি বিয়া করুম। স্বামীর কামাই খামু। তার বাড়িতেই থাকুম। দেইখ্যেনতো এমন কাউরে পাননি যে আমার লগে আমার দুই মাইয়ার খরচও করব। আর হের বাড়িতই রাখব। পাইলে জানাইয়েন। আর এত কষ্ট সহ্য অয় না। বাড়ি বেইচ্যাও দিতে পারি। হেই টেকায় গেরামে জায়গা কিনুম মাইয়াগো নামে। যদি স্বামীর বাড়ি থাকে তাইলে আর এই বাড়ি দিয়া কী করুম?”
“তোমার মাথা নষ্ট হইয়া গেছে। তুমি তাই আবোল তাবোল বকতাছো। তুমি….”
“কোনডা আবোলতাবোল? বিয়া করুম অইডা? নাকি চাকরি ছাড়ুম, বাড়ি বেচুম এইডা?”
“না মানে, বিয়াতো তুমি করতেই পারো, কতইবা তোমার বয়স? জীবনের সব শখ আহ্লাদইতো অপূর্ণ রইয়া গেছে। এইডা আবোল তাবোল হইব ক্যা?”
“তার মানে চাকরি ছাড়ন আর বাড়ি বেঁচনডা আবোল তাবোল? স্বামীর থাকলে আর আমারডা কী কামে লাগব? দুইডা দিয়া কী করুম?”
“কীযে কও? তোমার স্বামীরতো নাও থাকতে পারে? তোমারডাইতো তার অইতে পারে তাই না?”
“ওরে আল্লাহরে আল্লাহ, এইডা কী কইলেন? যেই বেডার আমারে আর আমার মাইয়াগো পালনের মুরোদ নাই তারে আমার বিয়া করনের কী কাম? হুদাই কামে রাইতে শুয়োনের লেইগ্যা আমি এত বড় পেরেশানি কেল্লেইগ্যা তুলুম। হা*রা*মজা*দার পো হা*রা*ম*জা*দা বৌয়ের বাড়িরে নিজের বাড়ি করব আর আমি তারে চুমামু এমন বেক্কলতো অহনও অইনাই। আপনের কী আমারে অমন বেক্কল মনে হয়?”
হায় হায় তুমি মুখ খারাপ করো ক্যা? তোমার মাইয়াগো একটা বাপের দরকার আছে না?
“দূর বেডা বেক্কল। মনেতো কয় আপনেই একটা বেক্কল। যেই বেডায় বৌয়ের কামাইয়ে চলব হেয় অইব আমার মাইয়াগো বাপ? তওবা তওবা। আমার মাইয়াগো বাপ যে আছিল হেই সত্যিকারেই একটা মরোদ আছিল। ওগো হেই বাপের ছায়াতেই থাকতে দেন৷ আর কোনো শু*য়ে*রের বাচ্চা, আকামারে ওগো বাপ বানাইন্যার চিন্তা কইরেন না। এমন হা*রা*ম*জা*দারে হাতের কাছে পাইলে ওইডার বিয়া করনের জন্মের সাধ মিডাই দিতাম কেইচ্যা।”
শেষ কথাটা শবনম দাঁতে দাঁত চেপে মুখ খিঁচিয়ে বলল পারভেজের মুখের দিকে তাকিয়ে।
পারভেজ ওই সময়তে আর কোন পালটা কথা বলল না। মনে হল বলার সাহসই পেল না।
শবমম এক রাশ শান্তি মনে নিয়ে বাসায় ফিরল।

এরপর আর পারভেজের চেহারা ও আশেপাশে দেখে নাই কয়েকদিন।
শবনমের এমন আচরন শুধু এই পারভেজের সাথেই না ইদানীং ওর পিছে যে’ই ঘুরঘুর করতে চায় তার সাথেই করে। অশ্লীল ভাষা মুখে আনতে এখন আর লজ্জা পায় না, আট দশজন পুরুষের মতো ওরও মুখের ভাষা এমনই হয়ে গেল। কিন্তু কখন কীভাবে হল তা ও টেরও পেল না।

এরই মধ্যে একদিন দুপুরের লাঞ্চ খেয়ে চা খেতে গেল কেন্টিনে। শবনম ভেবেছিল এই সময়তে ওখানে ওর অন্য সহকর্মীরাও আছে। কিন্তু গিয়ে কাউকে পেল না। অফিসে নতুন নতুন বাতাস বইছে, এখন নানান সংগঠন তৈরী হচ্ছে। আবার সে সব সংগঠনের নেতা নির্বাচনও চলছে। এসব নিয়েই অফিস পাড়া এখন সরগরম। চা চেয়ে একটা চেয়ার টেনে বসতেই খোরশেদ এগিয়ে এসে বসল ওর মুখোমুখি।

“চা খাইয়া শরীর চাঙা করবা আর কয়দিন? সবই বুঝি, যৌবনের টান লুকায় কেমনে? এই টান কী লুকান যায়?”

“তা কী করতে কও খোরশেদ ভাই? কী করলে এই টান আর জ্বালাইব না কওতো শুনি?”

“বিয়া যহন আর করবা না তহন…. কী আর কমু? পুরুষগো যাওনের জায়গারতো আর অভাব নাই। কিন্তু তোমগো মতো মাইয়া মাইনষের জন্য বিশ্বস্ত লোক ছাড়া…..”

“থামলা ক্যা? শেষ করো ভাই, শেষ কর।”

“না মানে সবসময় এত ভাই ভাই করো ক্যা? ভাই ডাকলে কী আর সব কথা বলা যায়?”
“ও আল্লাহ তোমার আবার হেই বুঝও আছে? আল্লাহ খোদা তুমিতো এই বান্দারে পুরো বেক্কল কইরা দেও নাই দেহি।”

“এইকথাটা কী কইলা?”
“খোরশেদ তুই যে ঢাকা শহরে আজায়গায় কু জায়গায় রাইত কাডাস তা তোর বৌয়ে জানে? ”
“আমার লগে এমনে কথা কস কেন? একটু মিষ্টি কইরা কথা কইতে পারোস না?”
“নাহ পারি না, আমি মুখের সব মিষ্টি আমার স্বামী লগে কইরা লইয়া গেছে। কোনো হা*রা*মজা*দা*র লাইগ্যা এক ফুডাও রাইখ্যা যায় নাই।”
“হ্যে তোর এত্ত বড় সাহস, তুই আমারে গালি দিয়া কথা কস? তুই নিজেরে কী মনে করোস? করোসতো একটা পিয়নের চাকরি তার আবার এত দেমাগ। আজকা তোরে দেহি ধরতে আহে কে।” বলে শবনমের হাতটা খপ করে ধরে বসল খোরশেদ।
শবনম হঠাৎ করেই গগনবিদারী এক চিৎকার দিয়ে উঠল
“শু*য়ো*রের বাচ্চা শু*য়ো*র, আ-জায়গায় মুখ লাগাইতে লাগাইতে জিহবা বড় অইয়া গেছে আইজকা তোর জিহবা যদি আমি টাইন্যা না ছিড়ছি তয় আমিও শবনমই না। হা*রা”মজা*দা তুই মানুষ চিনোস নাই। ” বলেই জোরে হাত ঝাড়া দিয়ে সামনে থাকা পানির গ্লাস হাতে তুলে নিলো ওরে মারার জন্য । আল্লাহরই কুদরত ওই সময়তে ওর সহকর্মীরাও চা খেতে এদিকেই আসছিল, শবনমের চিৎকার শুনে দৌড়ে এল শহিদ সহ অন্যরা।
সবাইকে দেখে খোরশেদ সুর পালটে ফেলল। উলটো সব দোষ শবনমের উপর চাপালো। শবনমই নির্জন দেখে এখন এখানে এসেছিল ওকে কু প্রস্তাব দিতে।
শবনম রাগে থরথর করে কাঁপছিল, কোন কথাই ওর মুখ দিয়ে বের হচ্ছিল না। ওর রণাঙ্গনের ভঙ্গিই যেন অনেক কথা বলে দিল সবাইকে।
খোরশেদ যখন ইনিয়ে বিনিয়ে নানান কথা বলছিল
তখন হঠাৎ করেই শহিদ ওর কলার চেপে ধরল। ওর দেখা দেখি অন্যরা খোরশেদের উপর চড়াও হল।
“শবনম আমাদের বোন, ও এতদিন আমাদের সাথে আছে। ওরে বুঝি আমরা চিনি না? এখন তুই চিনাবি ওরে, ও কেমন? তোর এত্ত বড় সাহস তুই আমাদের বইনের ইজ্জতের হাত দেস। আজকে তোর হাতই ভাইংগা দিমু।” বলতে বলতেই কয়েকজন দুই চার কি*ল আর ঘু*সি বসিয়ে দিল ওর মুখে পিঠে।
শবনম নতুন করে নিজেকে আবিস্কার করল। যাদের উপস্থিতিতে মোটেও সাহস পায়নি এই ভেবে যে ওরা ওর পক্ষে কোন কথা বলবে না। এখন ওদের এতটা প্রশ্রয়ে ওর চোখ ভিজে গেল।
গনিচাচা এগিয়ে এসে শবনমকে টেনে নিয়ে বসালেন পাশে। এরপর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন
“শবনম আমার মেয়ের মতো, ওর চরিত্র নিয়া কেউ কিছু কইলে তার জিব্বা টাই*ন্যা ছি*ড়ু*ম৷ ওর দিকে কুদৃষ্টি দিলে চক্ষু খুই*দ্যা হালামু। ভালো বংশের মাইয়া স্বামী মরনের পর কারো উপর বোঝা না হইয়া নিজে কাম কইরা খায়। তারে কামের একটা সুন্দর পরিবেশই যদি আমরা না দিতে পারি তাইলে হেই লজ্জা রাখুম কই?”
শবনম হঠাৎ করেই ওর নতুন এক পরিবারের ছায়া দেখতে পেল। বাবার ছায়া ভাইয়ের ছায়া সাথে থাকলে আর পেছন ফিরে তাকায় কোন নারী? শবনমের চোখ মুখ আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠল।
এরপর অফিস পাড়ায় শবনমের অবাধ বিচরন চলল এখানে কেউ ওর সাথে উনিশ-বিশ করার সুযোগ পায় না। ও স্বাধীনভাবে নিজের মন লাগিয়ে চাকরি করতে থাকল।

কোরবানি ঈদের ছুটিতে একটু আগে ভাগেই বাড়ি গেল ঈদ করতে। নিজে ওর বাবার সাথে হাঁটে গেল গরু কিনতে। ওর বাবা প্রথমে নিতে অস্বীকৃতি জানালেও পরে ওর তোপের মুখে টিকল না। ওর যুক্তি হল হাটে না গেলে এই বিদ্যা শিখবে কীভাবে? বলাতো যায় না কোনদিন ওকে একাই গরুর হাটে গিয়ে গরু কিনতে হতে পারে।

বেশ আনন্দ নিয়ে হাটে গেলেও সেই আনন্দ ধরে রাখতে পারে না। গঞ্জের পরিচিত জনরা বিষয়টা সহজ চোখে দেখতে পারল না। শ্বশুর বাড়ির পাশের বাড়ির একজন বলে বসল “খান বাড়ির বৌ গরুর হাডে কী করে? ওই মিয়া তুমি মাইয়া লইয়া আডে আইছো ক্যা? মান ইজ্জত কী সব বেইচ্যা খাইছোনি? আমগো গেরামের আর মান ইজ্জত রাখলা না।”

“ও মিয়া ভাই, মাইয়া অহন নিজে চাকরি কইরা খায়। নিজের তাগদে চলে। ওর জামাই নাই, পোলাও হয়নাই। ওর কাম কইরা দিব কেডা? ওর কামতো ওরই কইরা খাইতে অইব। হের লেইগ্যা মাইয়ারে লইয়া আইছি টেরনিং দিতে। আর আপনেগো ইজ্জতের কতা কইলেন মনে অয়? কই আছিল ইজ্জত যহন আমার মাইয়াডারে খালি আতে বিদাই দিলেন গেরাম থেইক্যা। আমার নাতনিডির হক লইয়া দেহি একজনও খাড়াইলেন না। তহন কই আছিল আপনেগো এত ঠমগ? হুদাই কামে আর ভেজাল বাড়াইয়েন না। আমার মাইয়া একলাই দুইন্যা চইড়া খাইব কারো দয়া লাগব না। যান যান আর কতা কইয়েন না। চিনা আছে হগ্গোল বেডাগো। কে কদ্দূর বেডা, হেইডা আমি জানি।”

শবনমের বাবার কথায় শবনমের মনের জ্বালা কমে এল যা এতক্ষণ জ্বলছিল।

এই প্রথম নিজের টাকায় নিজের নামে কোরবানী দিতে পেরে শবনমের আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। গ্রামবাসীরা একেকজন আসে ওর সাথে দেখা করতে নানান প্রয়োজনে। ও অবাক হয় সবার দৃষ্টি ভঙ্গির এমন পরিবর্তন দেখে, এখন আর কেউ ওর দিকে করুনার দৃষ্টি ক্ষেপণ করে না। আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করে মনে মনে নিজের এই অবস্থানের জন্য।
ছুটি শেষে ঢাকায় ফেরার পথে শবনমের বাবা এগিয়ে দিতে এসে লঞ্চে ওদের বসিয়ে শবনমের হাতদুটো ধরে বললেন
“যা মা তুই নিজের দুইন্যা নিজে বানায় নে। যেমনে তোর শান্তি লাগে তেমনেই থাক। তয় মনে রাখিস তোর বাপ অহনও বাইচ্যা আছে যে যহন তোর দরকার অইব তহনই তোর লগে গিয়া দাঁড়াইব। জীবনে কহনও নিজেরে একলা ভাবিস না। জীবন যুদ্ধ ভীতুগো লেইগ্যা বড় কঠিন তয় তোর মতো মাইনষের লেইগ্যা অত কঠিন না। তুই যা, আমি আছি তোর লগে মরনের আগ পর্যন্ত। ”
লঞ্চ ছেড়ে দিল, ওর বাবা নেমে গেল। শবনমের মনটা আজ বড় ভালো। দুচোখ ছলছল করছে আনন্দ অশ্রুতে কিন্তু মুছে ফেলছে না। অশ্রু নিজ থেকেই গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। নিজের আমূল পরিবর্তনকে একবার চোখ বন্ধ করে দেখল। গ্রামের নাজুক এক বৌ হয়ে বাবার বাড়ি ছেড়েছিল প্রথম বার দুলালের হাত ধরে। আর আজ এক শক্ত সামর্থ্য নিজের পায়ে দাঁড়ানো লৌহমানবী হয়ে আরেকবার বাবার বাড়ি ছাড়ল দুলালের ছবিটা বুকে চেপে ধরে ওর দুই মেয়েকে সাথে নিয়ে সুন্দর এক আগামীর প্রত্যাশায়। ওর বিশ্বাস ও পারবে, ওকে যে পারতেই হবে–নিজের জন্য, নিজের মেয়েদের জন্য যা ও পেয়েছে ভালোবাসার উপহার সরূপ দুলালের কাছ থেকে।

সমাপ্ত।।।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here