বিরহ_ভালোবাসা-০১

0
639

#বিরহ_ভালোবাসা-০১
#Tahmina_Akhter

— ঠোঁটে গ্লু এলো কোত্থেকে? তুই তো আর মেয়ে মানুষ না যে লিপস্টিক ভেবে গ্লু লাগিয়ে দিয়েছিস ঠোঁটে ।

কথাটি বলতে বলতে আমার আম্মু ছোটমামার মাথায় দুএকটা থাপ্পড় মেরে দিলেন। নানা-নানী সবাই মামার দিকে বিরক্তিকর চোখে তাকিয়ে আছেন। বিরক্ত হবারই কথা! কারণ, কিছুক্ষণ পরেই মামার বিয়ের বরযাত্রী হিসেবে আমাদের পরিবারের সবার রওনা হবার কথা। কিন্তু, মামার ঠোঁটের গ্লু কান্ড নিয়ে সবাই যারপনাই বিরক্ত।

আমার মাকে থামাতে এগিয়ে গেলেন আমার শান্ত-শিষ্ট বাবা তৌহিদ মাহমুদ। মায়ের হাত ধরে টেনে নিয়ে এলেন একপাশে। আমার মা তো রাগে অন্ধ হয়ে পারছে না ছোট মামাকে আর দু’চারটা থাপ্পড় মারতে। এদিকে ছোট মামা অভিমানী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চাইলেন কিন্তু বলতে পারলেন না। কারণ, ঠোঁটে গ্লু লাগার কারণ আমার বেশি কথা বলা মামা আজ বোবা বনে গেছেন।

নানী সবাইকে মামার ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বললেন। একে একে সবাই বের হয়ে যায়। শুধু আমি আর আমার বাবা ছাড়া কেউই নেই আপাতত মামার ঘরে।

মামা হতাশ হয়ে খাটের ওপর বসে রইলেন। হতাশ হবারই কথা যার কিছু সময় পর বিয়ে। অথচ, গ্লু এর কারণে তার ঠোঁট জোড়া একে অপরের সঙ্গে চেপে আছে। এই অবস্থায় কি আর বিয়ে করা যায়? মামার বিয়ের কবুল কে বলবে? আজ বোধহয় মামার বিয়ের স্বপ্ন ভেঙেচুরে যাবে।

আমি দেখলাম বাবা মামার ড্রয়ার, এটাসেটা খুলে কি যেন খুঁজছেন? অতঃপর, বাবা খুঁজে পেলেন কাঙ্ক্ষিত বস্তু। কেরোসিন তেলের ছোট্ট একটি বোতল নিয়ে মামার সামনে গিয়ে বসলেন। মামা আর আমি বাবার দিকে হাসের ডিমের মতো চোখের আকৃতি নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। তারমানে কি বাবা এখন মামার ঠোঁটে কেরোসিন তেল লাগিয়ে গ্লু ছুটানোর চেষ্টা করবে? আমার তো ভাবতেই মাথাসহ পুরো শরীর গুলিয়ে উঠছে। মামা একবার আমার দিকে তো আরেকবার বাবার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। মামার চোখের দৃষ্টির অর্থ হলো, এই তেল যদি আজ আমার ঠোঁটে লাগে তবে আমি মরে যাব।

বাবা মামার দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পারে। তাইতো মামার হাতে হাত রেখে বললো,

— দেখ মামুন তোর এই জন্মে বিয়ে করার শখ আছে তো?

মামা মাথা নাড়িয়ে বোঝালেন অবশ্যই শখ আছে।

— তাহলে আমাকে চেষ্টা করতে দে। নয়তো তোদের দশবছরের রিলেশনের পর আজ যদি বিয়েটা না হয় তবে আর কোনোদিনও জুঁই তোর হবে না। আর তুই কি দেখতে চাস তোর জুই তোরই চোখের সামনে অন্যকারো হয়ে যাক?

ছোট মামা মাথা নাড়িয়ে বোঝাল কখনোই না। বাবা আঙুলের ডগায় তেল লাগিয়ে মামার ঠোঁটে লাগিয়ে ধীরে ধীরে ঘসে দিচ্ছেলেন। আমার তো মামাকে দেখে হলফ করে বলতে পারি মামা শ্বাস বন্ধ করে প্রাণেপনে কেরোসিনের উটকো গন্ধ থেকে বাঁচার জন্য চেষ্টা করছেন।

প্রায় বিশ মিনিট ধরে চললো অপারেশন “গ্লু অপসারণ”। বাবা তো বেজায় খুশি। আর মামা তো যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। আমি মামাকে কিছু জিজ্ঞেস করব তার আগেই একদৌঁড়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো মামা। কি আর করা তবে মামার ঠোঁট থেকে গ্লু ছুটে গেছে এই খবরটা সবাইকে জানানো প্রয়োজন। আমি বাবাকে রেখে দৌড়ে চলে গেলাম যেখানে সবাই একজোট হয়ে বসে আছে।

হলরুমে গিয়ে দেখি আমার একেকটা কাজিন অর্ধেক মেকআপ করে বসে আছে। কারো একচোখে আইলাইনার, তো অন্যকারো মেকাআপ গলে যাচ্ছে। কেউ তো মনের দুঃখ ফেইসবুক স্ট্যাটাসে দিয়ে ফেলেছে। আমাকে দেখে যেন সবার প্রশ্নের জোয়ার এসেছে। একসাথে সবার প্রশ্ন নিতে পারলাম না। তাই জোরে চিৎকার দিয়ে বললাম,

— যাও সবাই গিয়ে মেক-আপ কমপ্লিট করো। মামার গ্লু ছুটে গেছে।

আমার কথাটি শেষ হয়নি তার আগে যে যেভাবে পেরেছে যার যার ঘরে ঢুকে তৈরি হতে শুরু করেছে। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম। কিন্তু, মায়ের ডাক শুনে শান্তশিষ্ট বালিকা সেজে চক্ষুদ্বয় নীচ রেখেই মায়ের আদেশ শোনবার জন্য মুখিয়ে রইলাম।

— আপনি কি ওই বাড়িতে আজ ঝাড়ু দিতে যাবেন???

আমি মায়ের কথায় মাথা নাড়িয়ে না বোঝলাম। আমি ঝাড়ু দিতে যাব না ওই বাড়িতে।

— তাহলে যান ঘরে গিয়ে সুন্দর দেখে একটা শাড়ি পরে তৈরি হয়ে আসেন। আপনাকে নিয়ে যাব সঙ্গে করে। যার সাথে দেখা হবে তাকেই বলব দেখেন আমার একটা মেয়ে বাঁদর আছে।

আমি মায়ের কথা শুনে বুঝতে পারলাম, মায়ের আসকে মন ভালো নেই। তাই মাকে আর রাগানোর সুযোগ না দিয়ে আমার ঘরে এসে দরজা লক করে দিলাম। তারপর, আলমারী খুলে দাঁড়িয়ে রইলাম। কারণ, আলমারিতে অনেকগুলো শাড়ি আছে যার মধ্যে সবগুলোই চমৎকার। কোনটা রেখে কোনটা পরবো মাথায় আসছে না। এমন সময় চোখে পরলো কালো রঙের একটা কাতান শাড়ির দিকে। চওড়া পাড়, ছোট ছোট ফুল তাও আবার সোনালী সুতোর। ব্যস পছন্দ হয়ে গেলো আমার। শাড়িটা চট জলদি নামিয়ে চলে গেলাম আমার জেঠুর মেয়ে রুপা আপার কাছে। আপা তো আমাকে দেখেই বলে ফেললো,

— কি রে আজও কি ফকিন্নি সেজে থাকার পণ করেছিস নাকি?

আপার কথায় আমি ভীষণ কষ্ট পেলাম। কিন্তু, আপাকে বুঝতে দিলাম না। হাসিমুখে আপার আর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে বললাম,

— মা বললো সুন্দর দেখে একটা শাড়ি পরে তৈরি হতে। কিন্তু, আমি তো শাড়ি পরতে পারি না। তুমি শাড়ি পরিয়ে দেবে আমায়?

আপা হাসি দিয়ে আমার থুতনিতে হাত দিয়ে বললো,

— অবশ্যই পরিয়ে দেব। যা শাড়ির সঙ্গে প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো পরে আয়।

আমি ব্লাউজ আর পেটিকোট নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। পরা শেষ হলে রুমে এলে রুপা আপা খুব যত্ন করে আমায় শাড়ি পরিয়ে দিলেন। সেই সাথে উনার জাদুকরি হাতে মেক-আপ করিয়ে দিলেন। আয়নায় তাকিয়ে আমি নিজেই নিজের প্রেমে পরে গেলাম।

— আজ তোর ছোট মামার বিয়ে হলো কি হবে এমন হয় না যেন তোর বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেখান থেকেই শুরু হয়।

আপার কথা শুনে লজ্জা পেয়ে একদৌঁড়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসছিলাম। কিন্তু, দেয়ালের সঙ্গে বাড়ির খেয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পরলাম। চোখেমুখে অন্ধকার দেখছিলাম বেশ।

— কিরে আজ কীসের শোক দিবস? এভাবে কালো কাপড়ে নিজেকে মুড়িয়ে কি তুই অন্ধ হয়ে গেলি না কি, মধু?

শাদাদ ভাইয়ের কথা শুনে আমি আধখোলা চোখে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। বাহ্ কত সুন্দর দেখাচ্ছে!

— কি হলো জবাব দিচ্ছিস না কেন? বুঝি না আমি তোদের গুষ্টিশুদ্ধো সব এক নাকি! তুই দেখছি কানে শুনিস না, আবার ঢুসঢাস বাড়ি খেয়ে কাত হয়ে পরে থাকিস। তোর মামা নিজের বিয়ের দিন ঠোঁটে গ্লু লাগিয়ে বসে থাকে। হচ্ছেটা কি তোদের মধ্যে?

— আহ্ শাদাদ লতাকে বিরক্ত করিস না তো। এই লতা যা তাড়াতাড়ি। দেরি হয়ে গেলে কাকি বকবে তোকে।

বাঁচা গেলো আজ। নয়তো অসুরটার ভাষণ আজ শেষই হতো না। আমার গুষ্ঠির বদনাম করতে আসে নিজে কেমন? নীল রঙের পাঞ্জাবি পরে উনি নিজেকে সবার সামনে উপস্থাপন করতে চাইছেন যে উনি সুদর্শন যুবক। উনি একটা খচ্চর যুবক। যে কি-না আমাকে বিরক্ত করার জন্য কোনো পথই বাদ রাখে না।

কথাগুলো নিজের মনে বলতে বলতে এগিয়ে যায় বাড়ির গেটের কাছে। বরযাত্রীর গাড়িতে সবাই একে একে উঠে বসছে। লতা ওর মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে কিন্তু পাচ্ছে না। দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে কিছু একটা ভাবছিল লতা। কিন্তু, তার আগে কেউ এসে ওর শাড়ির আঁচল টেনে ধরে ফুল দিয়ে সাজানো কারের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

পেছনের সাড়িতে ধাক্কা দিয়ে বসিয়ে দিলো লতাকে। লতা আশি ভোল্টেজের রাগ নিয়ে কিছু বলবে তার আগেই ওই ব্যক্তির মুখ দেখে চুপসে যায়। কারণটা হচ্ছে সেই ব্যক্তি আর কেউ নয় শাদাদ ভাই। লতা রাগে ফোসফাস করতে করতে জানালার পাশে গিয়ে সরে বসলো।

— এই নে ধর কাকি কথা বলবে।

শাদাদ ভাই আমার দিকে মোবাইল বাড়িয়ে দিলেন। ছোঁ মেরে উনার হাত থেকে মোবাইল নিয়ে কানে দিতেই শুনলাম,

— শাদাদের সঙ্গে চলে আসবি। আমি যেন অন্যকারো সঙ্গে তোকে না দেখি। আর শোন শাদাদকে বিরক্ত করবি না।

মায়ের শেষের কথাটি শুনে আমি ভ্রু কুঁচকে শাদাদ নামক খাটাস লোকটার দিকে তাকালাম।

—এ্যাহ্, শাদাদকে বিরক্ত করবি না। মুখ ভেঙচিয়ে কথাটি বলে লতা মনে মনে বলছে,

— এই লোকটাই তো আমাকে বিরক্ত করে ফুরসত পায় না। আমি কখন উনাকে বিরক্ত করতে যাব?
দয়া করি এই খাটাসটার যেন একটা রিনা খানা মার্কা বৌ কপালে জুটে।

— শোন আমাকে যদি বকাঝকা করতে হয় তবে সরাসরি বলবি। এভাবে নাকে প্যানপ্যানি করলে বিরক্ত লাগে।

শাদাদ ভাই কথাটি বলে আমার গা ঘেসে বসলেন। অন্তরে রাগ আর মুখে মেকি হাসি ফুটিয়ে শাদাদ ভাইকে বুঝালাম,

—আপনি কোন ব্যাপারে কথা বললেন বুঝতে পারছি না আমি।

অতঃপর, ছোট মামা মাথায় পাগড়ি চাপিয়ে, লাল শেরওয়ানি পরে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে এলেন। ছোট মামা ড্রাইভারের পাশের সিটে বসলেন। যেহেতু চারসিটের কার বাবা তো এই গাড়িতে করে আসতে পারবে না। তাই বাবা অন্য সবার সঙ্গে বাসে উঠে বসলেন।

— তোর হলো চ্যাপ্টা নাক তুই নাকফুল পরতে গেলি কেন? দেখে তো মনে হচ্ছে কে যেন একদোলা মাটির ওপর কে যেন পাথর বসিয়ে দিয়েছে!

কথাটি বলে যেভাবে শাদাদ ভাই চেহারার আকৃতি করলেন, মনে হলো যেন পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর বস্তু তিনি দেখে আসলেন। রাগে দুঃখে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। মানে এত অপমান কি আর মানা যায়? আমার এত সুন্দর নাককে উনি এরকম মন্তব্য করতে পারলেন! প্রতিবাদ করতে মন চাইলো কিন্তু করলাম না। হুহ্ একবার খালি বিয়ে বাড়িতে যাই তখনি শাদাদের বাচ্চাকে বুঝাবো কার নাক চ্যাপ্টা? এই মাধবীলতাকে একবার যে দেখে সে বারবার দেখতে মরিয়া হয়ে ওঠে।

মনে মনে কথাগুলো বলে অহংকারী হয়ে বসে রইলো লতা।

এদিকে ফ্রন্ট মিরর দিয়ে কেউ যে ওর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে টেরই পেলো না আমাদের লতা।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here