বিরহ_ভালোবাসা-১৪,১৫

0
203

#বিরহ_ভালোবাসা-১৪,১৫
#Tahmina_Akhter

১৪.

রাতের আঁধার কাটিয়ে ধরনীর বুকে সূর্যের আলোয়ে ভূবন ভরা। জানালার কাছে আমগাছের মগডালে বসে কয়েক জোড়া শালিক পাখি কিচমিচ করছে।

মিষ্টি রোদের স্পর্শে চোখ খুলল লতা। চোখ খোলার পর নিজের অবস্থান আবিষ্কার করলো ঘরের মেঝেতে। দুচোখে জ্বালাপোড়ার অনুভূতি। চোখে হাত দিয়ে স্পর্শ করতেই লতা বুঝতে পারল চোখের পাতা ফুলে গেছে। গতকাল রাতের দৃশ্য আবারও যেন চোখের সামনে একের পর এক দৃশ্য এনে হাজির করেই চলেছে। সর্বশেষ একটি দৃশ্য যখন লতার চোখের সামনে এলো তখন লতা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। শাদাদ ভাইয়ের তপ্ত ঠোঁটের স্পর্শ যেন এখনও লতার ঠোঁটের কোণে লেগে আছে। লতা ডানহাতের তর্জনী এবং বুড়ো আঙুলের সাহায্যে নিজের ঠোঁটে স্পর্শ করে।

লতার আজকের সকালটা কেন যেন অন্যান্য সকালের চেয়েও ভিন্ন মনে হচ্ছে! রোজ হোস্টেলের সেই ছোট্ট বিছানায় ঘুম ভাঙতো নীলাদ্রির ডাকে। কিন্তু, আজ সূর্যের নরম মিষ্টি রোদের স্পর্শ আর শালিক জোড়ার ডাক, কিছু মিষ্টি মূহুর্তের সঙ্গে পুনরায় সাক্ষাৎ। ব্যস, আজকের সকালের মতো এত অবিস্মরণীয় মূহুর্ত পাবে কোথায় লতা?

চট করে উঠে দাঁড়ায় লতা। এলোমেলো শাড়ির কুচিটা হাতে নিয়ে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই আমগাছের ডালে থাকা শালিক জোড়াদের দিকে তাকায় লতা। এক জোড়া ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে আদরে ব্যস্ত। অন্য জোড়া শুধু কিচমিচ করেছে। সর্বশেষ পাখির জোড়াটার একটা শালিক পাখি হুট করে নীল আকাশের দিকে উড়াল দেয়। একা হয়ে যায় গাছের ডালে বসে থাকা পাখিটা।

লতার হুট করে ওর এবং শাদাদ ভাইয়ের জীবনে কি হতে চলেছে বুঝে ফেললো। শেষের পাখির জোড়াটা থেকে যেমন একজন চলে গেছে আর অন্যজন একা হয়ে পরেছে। ঠিক তেমনি হবে হয়তো ওদের পরিণতি।

এমনসময় লতার ঘরে এসে উপস্থিত হয় ওর মা তৃনা। মেয়েকে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু-কুটি করে নিজেও এগিয়ে গেলেন জানালার ধারে। লতা ওর মাকে দেখেও চুপ করে জানালার বাইরে দৃষ্টিপাত করে। তৃনা মেয়েকে প্রশ্ন করে,

— গতকাল কাউকে কিছু না বলে ওভাবে পার্টি থেকে চলে আসাটা কি ঠিক হয়েছে তোর?

নিজের মায়ের প্রশ্ন শুনে লতা মুখে হাসি ফুটিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

— মাথাব্যাথা করছিল তাই চলে এসেছি। তাছাড়া একসপ্তাহ পর আমার পরীক্ষা। তাই বাড়িতে ফিরে এসেছিলাম পড়াশোনা করব ভেবে। কিন্তু, আসার পর মনে হলো বই তো সব হোস্টেলে।

ঘরের মেঝের দিকে তাকিয়ে একের পর এক মিথ্যে কথা বলে তবেই মায়ের মুখের দিকে তাকালো লতা। তৃনা মেয়ের কথা কিছুটা বিশ্বাস করেছেন। পার্টিতে যখন লতা এবং শাদাদ কেউই উপস্থিত ছিল না তখন তিনি মনে করেছিলেন যে, হয়তো ওরা একসাথে আছে। কিন্তু, বাড়িতে আসার পর যখন দেখলেন লতা ওর ঘরে ঘুমিয়ে আছে। তখন আর সন্দেহ করেননি। কারণ, শাদাদ বাড়িতে ফিরে এসেছিল রাত প্রায় একটার পর।

লতার এত সুন্দর সকালটা হুট করে বিষাদে রূপান্তরিত হয় গেছে শুধুমাত্র একটিমাত্র বাক্যে। খুব কি জরুরি ছিল এই দিনটা এত তাড়াতাড়ি জীবনের আসার?

মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বাকি কথাগুলো শুনছিল লতা। মনে মনে তখন নয় নম্বর বিপদ সংকেত চলছিল।

— রুপার দেবর রবিন ছেলেটা কিন্তু কম্পিউটার ইন্জিনিয়ার। ভালো বেতনের চাকরি পেয়েছে গতমাসে। প্রথম বেতন নাকি চল্লিশ হাজার। ধীরে ধীরে নাকি বেতন আরও বাড়বে। গতকাল রাতে তুই তো চলে এলি। রুপার শ্বাশুড়ি আমার হাত ধরে উনার ছেলের জন্য তোকে চাইলো। আমি পাকা কথা দেয়নি। তবে এটা বলে এসেছি যদি ছেলে-মেয়ে একে অপরকে পছন্দ করে। তবে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আজ বিকেলে রবিনসহ ওদের পরিবার আমাদের বাড়িতে আসবে।
আমি জানি লতা তোর মনে এখন কি চলছে? তবে একটা কথাই বলব, আমি যা কিছু করছি সবটাই তোর ভালোর জন্য করছি। রবিন তোকে শাদাদের থেকেও ভালো রাখবে।

শেষের কথাগুলো লতার গালে হাত রেখে বললেন তৃনা। লতার চিৎকার করে ওর মাকে জবাব দিতে চাইছিল যে,

“মা রবিন কখনোই আমাকে শাদাদ ভাইয়ের থেকেও বেশি ভালো রাখতে পারবে না। কারণ, ভালো থাকাটা আমি শাদাদ ভাইয়ের মাঝে নিয়েছিলাম”

কিন্তু, আফসোস লতার জবাব লতার মনে রয়ে গেছে। লতার মা লতাকে ফ্রেশ হয়ে চটজলদি নাশতা খেয়ে পার্লারে যেতে বলে গেছেন ফেসিয়াল করার জন্য। লতা হাল ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে বসে রইলো। কি করবে সে? শাদাদ ভাই নাহয় বুঝে নিবে লতা ওর বাবা-মায়ের বাধ্য মেয়ে বলে বিয়েতে সম্মতি দিয়েছে। কিন্তু, লতা নিজের মনকে কি বলে বুঝাবে ? লতার বুক ভেঙে কান্না পাচ্ছে। এত কষ্ট আর সহ্য হচ্ছে না!

লতা কোনোরকম গোসল সেড়ে নাশতা খেয়ে বের হয়ে আসে বাড়ি থেকে। যদিও বাড়ির সবাই জানে লতা পার্লারের যাওয়ার উদ্দেশ্য বাড়ি থেকে বের হয়েছে। কিন্তু, লতা পার্লার না গিয়ে ওর এক বান্ধবীর বাড়িতে গিয়ে বসে রইলো। দু-ঘন্টা অতিক্রম হবার পর লতা বেরিয়ে পরে ওর বান্ধবীর বাড়ি থেকে। রিকশা ডেকে রওনা হয় বাড়ির উদ্দেশ্য।

ঘড়িতে সময় তখন দুপুর সোয়া বারোটা। রুপা এসেছে একটু আগে যেন ওর চাচীর সঙ্গে কাজে সাহায্য করতে পারে। শাদাদ সকাল থেকে বাড়িতে ছিল না। কিন্তু, কিছুক্ষণ আগে যখন বাড়িতে ফিরে এলো তখন বাড়ির হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে আজ কোনো অকেশান আছে কিংবা ফ্যামিলি গেট টুগেদার পার্টি।

শাদাদ ড্রইংরুমে বসে জুতো জোড়া খুলে সবে গা এলিয়ে দিয়েছিল। এমনসময় দরজা দিয়ে লতা বাড়িতে প্রবেশ করে। শাদাদ খেয়াল করে দেখলো লতার মুখটা শুকিয়ে আছে। এদিকে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে লতাকে দেখতে পেয়ে ওর মা বললো,

—- ফেসিয়াল করেছিস তো নাকি? মুখটা এমন কালো দেখাচ্ছে কেন?

লতা বিরক্তিকর চোখে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরাতে গিয়ে ড্রইংরুমের সোফায় বসে থাকা শাদাদ ভাইকে দেখতে পেলো। চট করে চোখ ফিরিয়ে ছোট করে ওর মাকে বললো,

— করিয়েছি তো।

কোনোভাবে উত্তরটা দিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যায় লতা। শাদাদ ভাই থুতনিতে হাত রেখে ভাবতে লাগলেন বাড়িতে আসলে কি হতে যাচ্ছে?

রুপা আপা কি মনে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে ডাইনিং টেবিলের ওপর থেকে জগ নিয়ে একগ্লাস পানি ঢেলে খাচ্ছিলো। শাদাদ রুপাকে দেখে অবাক হয় জিজ্ঞেস করলো,

— কি রে আপা তুই এই বাড়িতে কখনো এলি?

রুপা আপা গ্লাসটি টেবিলের ওপর রেখে ভেজা হাতটা ওড়নার কোণায় মুছে শাদাদের সামনে গিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো আছে কিনা? না কেউ নেই। শাদাদের পাশে বসে রুপা আপা ফিসফিসিয়ে বললো,

— আজ লতাকে দেখতে আসবে তুই জানিস না গাঁধা?

“আজ লতাকে দেখতে আসবে তুই জানিস না গাঁধা”

কথাটি যেন শাদাদের কানে বারবার প্রতিধ্বনি তুলছে। শাদাদ রুপা আপার দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছু বলার ভাষা যেন নেই শাদাদের শব্দভান্ডারে। রুপা নিজের ভাইয়ের মনের অবস্থা বুঝতে পারে। শাদাদের হাতের ওপর হাত রেখে রুপা ধীর গলায় বললো,

— দেখ শাদাদ ছোটবেলা থেকে আমরা দুই ভাই-বোন মা ছাড়া বড়ো হয়েছি। কিন্তু, মায়ের অভাববোধ করেনি কারণটা হলেন তৃনা চাচি। আজ পর্যন্ত আগলে রেখেছেন আমাদের নিজের সন্তানের মতো করে।

— তুই কি বলবি আপা সোজাসাপটা বলে ফেল।

যান্ত্রিক গলায় নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে কতাটি বললো শাদাদ।

রুপা নিজের ভাইয়ের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলা শুরু করলো,,

— চাচিকে একবার বলে দেখ তোর মনের কথা। দেখবি চাচি তোর কথা ফেলতে পারবে না। তাছাড়া, রবিনের থেকেও তুই ভালো অবস্থানে আছিস। সবচেয়ে বড়ো কথা তুই লতাকে ভালোবাসিস। টাকা-পয়সায় কি আসে যায়? সংসারে ভালোবাসা থাকা প্রয়োজন। নয়তো, ভালোবাসাহীন সংসার দীর্ঘ জীবনের এই পথচলা বড্ড কঠিন রে শাদাদ ।

রুপা আপা চলে গেলেন রান্নাঘরে। শাদাদ ভাই তখনও চুপচাপ বসে কি যেন ভাবছিলেন!

বিকেলবেলা…

রবিনের পরিবার এসেছে বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে। এরইমাঝে রবিনের মা বারবার তাগাদাদ দিচ্ছেলেন লতাকে নিয়ে আসার জন্য। রুপা চলে গেছে লতাকে নিয়ে আসার জন্য।

বাড়ির দোতলার দুটো ঘরে বিষন্ন মনে বসে আছে দুটো মানব-মানবী। দু’জনের মনে একে অপরকে জিতে নেয়ার কি আকুল আবেদন। বাহ্যিক আচরণ দেখে বলার উপায় নেই তারা একে অপরকে কতটা চায়? একটি দেয়ালের ভেদ করে কেউ কাউকে আপন করে নেয়ার সাহস জুটাতে পারছে না।

শাদাদ ভাই অন্ধকার ঘরটায় বসে আছেন। কি মনে হতেই চট করে দরজা খুলে পাশের ঘরটায় চলে যায়। যেখানে তার মনের একচ্ছত্র রাণী মাধবীলতা থাকে।

ঘরের দরজা খুলে ভেতরে তাকাতেই শাদাদ ভাইয়ের দুটো চোখ স্থির হয়ে যায়। কারণ, নীল শাড়িতে জড়ানো নিজের মনের কল্পনার মধুকে দেখে শাদাদ ভাইয়ের হৃদয়টা বোধহয় দুটো বিট মিস করে বসে আছে। লতা তখনো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রুপা আপা লতার পায়ের কাছে বসে শাড়ির কুচি ঠিক করে দিচ্ছেন। শাড়ির কুচি ঠিক করে উঠে দাঁড়ায় রুপা আপা।

শাদাদ ভাইকে দরজার সামনে দেখে রুপা আপা চমকে যায়। এগিয়ে এসে শাদাদ ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে,

— তুই এখানে এসেছিস কেন?

— আপা তুই একটু বাইরে যাবি? মধুর সাথে আমার কিছু কথা আছে।

শাদাদ ভাই লতার দিকে তাকিয়ে বললো। লতা শাদাদ ভাইয়ের কন্ঠস্বর শুনে মাথা উঁচু করে তাকায়। রুপা আপা লতার মুখের দিকে তাকায় শাদাদ ভাইকে অনুমতি দেয়ার আশায়। কিন্তু, সেই আশায় গুড়ে বালি দিয়ে লতা শাড়ির কুচি উঁচু করে ধরে ধীরপায়ে হেঁটে এসে রুপা আপার সামনে এসে বললো,

—- দেরি হলে মা বকবে। চলো নীচে চলো আপা।

রুপা আপা অসহায় চোখে তাকায় শাদাদ ভাইয়ের দিকে। শাদাদ ভাই এই লতাকে চেনে না। চেনাজানা লতা কখনো এমন নিষ্ঠুরের মতো আচরণ করতে পারে না।

লতাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে রুপা আপা । লতা চলে যেতেই শাদাদ স্বজোড়ে লাথি মেরে বসে দরজায়। দরজায় লাথির শব্দে লতা কেঁপে উঠল। কিন্তু, ফিরে যাওয়ার ইচ্ছেপোষণ করলো না।

#চলবে….

#বিরহ_ভালোবাসা
#Tahmina_Akhter

১৫.

ড্রইংরুমের সোফায় মাথা নীচু করে বসে আছে লতা। পাশে রুপা আপা বসে আছেন। তার ঠিক সামনে রবিন সহ ওর পরিবারের চার সদস্য বসে কথা বলছেন লতার বাবা এবং মায়ের সঙ্গে।

রবিন আড়চোখে কয়েকবার লতার দিকে তাকিয়েছে। লতা রবিনের দৃষ্টি উপেক্ষা করতে পারে না। কারণ, কেউ যখন আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে তখন আমাদের নিউরন সিগনাল করে। সেই সিগনালের বদৌলতে আমাদের লতাও রবিনের দিকে তাকাতে বাধ্য হয়েছেন। যদিও শাদাদ ভাই দোতলায় দাঁড়িয়ে এমন দৃশ্য দেখে হজম করতে পারছেন না।

—- বলছিলাম কি লতা তো আমাদের চেনাজানা মেয়ে। রবিনকে আপনারাও চিনেন। এখন যদি লতার রবিনকে পছন্দ হয় তবে বিয়ের ডেইট ফিক্সড করতে পারলে মন্দ হতো না।

রবিনের বাবা আফতাব সাহেব কথাটি বললেন। লতার বিয়ের ডেইট ফিক্সড শব্দটা শুনে পেটে মোচড় মারছে। লতার বাবা নড়েচড়ে বসলেন তারপর অত্যন্ত বিনয়সহকারে বললেন,

— আসলে হয়েছে কি আমার বড়ো ভাই অর্থাৎ আপনার বেয়াই সাহেব আজ সকালে হুট করে আমাদের গ্রামের বাড়িতে গেছেন। এখন ভাইয়াকে ছাড়া আমি এতবড়ো সিদ্ধান্ত নেই কি করে? তাই বলছিলাম কি ভাইয়া এলে না হয় আমরা এই বিষয়ে কথা বলি? তাছাড়া, লতার কয়েকদিন পর পরীক্ষা। বুঝতেই পারছেন আমি কি বলতে চাচ্ছি?

— জি; জি ; অবশ্যই। বিয়ের ডেইট না হয় ফিক্সড করবো না। কিন্তু, লতাকে আংটি পরিয়ে দিলে তো কোনো প্রবলেম নেই?

রবিনের মা কথাটি বলে ছেলে রবিনের দিকে তাকিয়ে হাসি বিনিময় করলো। লতার বাবা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরলেন। লতা তো বোধহয় মাথা ঘুরে যাবে।

এমন সময় শাদাদ ভাই এলেন ট্রেতে করে শরবতের গ্লাস নিয়ে। ট্রে থেকে একটি গ্লাস নিয়ে রবিনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

— বিয়ের মতো এত কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে। হয়তো একটু পর আংটি পড়াবে। শরবতটা খেয়ে নাও রিল্যাক্স ফিল পাবে।

রবিন মুচকি হাসি দিয়ে গ্লাসটি নিয়ে শরবতের গ্লাসে চুমুক দেয়। তারপর, একে একে সবার হাতে শরবতের গ্লাস এগিয়ে দেয় শাদাদ ভাই। শুধুমাত্র লতাকে শরবত দেয়নি শাদাদ ভাই। লতার যদিও ভীষন পানির তেষ্টা পেয়েছিলো। শরবত খেতে পারলে মন্দ হতো না। লতা শাদাদ ভাইয়ের এমন অস্বাভাবিক আচরণ দেখেও কিছু মনে করলো না। কারণ, শাদাদ ভাই মানুষটাই এমন। কখন কি করেন কোনো কিছুই বোধগম্য হয় না!

শরবত খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই রবিনের মা উনার ব্যাগ থেকে আংটির বক্স বের করে আংটি বের করেন। উঠে গেলেন লতার সামনে। রুপা সরে গিয়ে শ্বাশুড়িকে বসতে জায়গা দিলো। ভদ্রমহিলা লতার বাম হাত ধরে টেনে এনে আংটি পরিয়ে দিবে।

এমন সময় রবিন হড়হড় করে বমি করে দেয়। উপস্থিত সকলে হতভম্ব চোখে তাকিয়ে থাকে রবিনের দিকে। রবিনের মা তো ছেলের অবস্থা দেখে লতার পাশ থেকে উঠে এসে ছেলের মাথা চেপে ধরলেন। লতার পা পানি এনে দিলেন। কিছু সেকেন্ড পর রবিনের বমি কমে আসে। সকলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কিন্তু, এরপরই শুরু হয় মূল ঘটনা। বেচারা রবিনের পেট মোচড় দিয়ে ওঠে। ইর্মাজেন্সি ওয়াশরুমে যাওয়া প্রয়োজন। কোনোরকমে মুখ খুলে প্রথমে লতার মাকে বললো,

— আন্টি নীচ তলায় ওয়াশরুম আছে?

লতার মা হাতের ইশারায় দক্ষিণের বারান্দার দিকে তাকিয়ে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। রবিন উঠে একপ্রকার দৌঁড়ে সেদিকে চলে যায়।

এদিকে সবাই চিন্তিত হয়ে বসে আছে। হুট করে ছেলেটার কি হলো ভেবে?

রবিন ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসে রিল্যাক্স মুডে কিন্তু আবারও পেট মোচড় দিয়ে ওঠে। বেচারা আবারও দৌঁড়ে ঢুকে পরে ওয়াশরুম। এভাবে একবার নয় দুবার নয় দশবার ওয়াশরুমে আসছে আর যাচ্ছে। একসময় রবিন ক্লান্ত হয়ে ওর মাকে ডাক দেয়। রবিনের মা ছেলের কাছে এলে বুঝতে পারেন ছেলের অবস্থা ভালো নয়।

গাড়ি ডেকে এনে রবিনকে হসপিটালে নিয়ে যায় রবিনের বাবা-মা। এদিকে লতার বাবা-মা হুট করে রবিনের অবস্থা দেখে আফসোসের সুরে বলছিলেন,

— ছেলেটার কি হলো আবার? এই তো একটু আগেও বেশ ভালো ছিল।

লতার বাবা-মা অন্য গাড়িতে করে রবিনদের গাড়ির পিছু পিছু রওনা হয়েছে।

বাড়িতে আছে রুপা আপা, শাদাদ ভাই আর লতা। রুপা আপা সন্দিহান হয়ে শাদাদ ভাইকে প্রশ্ন করেন,

— তুই রবিনের শরবতে কিছু মিশিয়ে টিশিয়ে দিস না তো আবার?

শাদাদ ভাই উত্তর দেয় না আয়েশ করে সোফায় পা তুলে বসে। তারপর, লতাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— যেই ছিল দশবার মলত্যাগ করে ক্লান্ত হয়ে যায় সেই ছেলেকে আমাদের লতা বিয়ে করবে! এই ছেলে তো ফার্মের মুরগী সরি মোরগ রে মধু!

কথাগুলো বলে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে শাদাদ ভাই। লতা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায় শাদাদ ভাইয়ের দিকে। কারণ, রবিনের এভাবে হুট করে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পেছনে শাদাদ ভাইয়ের হাত আছে হয়তো। রুপা আপা শাদাদ ভাইয়ের দিকে একটা কুশন বালিশ ছুঁড়ে দিলো। শাদাদ ভাই তা ক্যাচ তুলে কোলের ওপর নিয়ে বসে বসে শিস বাজাচ্ছে।

রুপা লতাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— আমি হসপিটালে যাচ্ছি। সব এই শাদাদের জন্য হয়েছে বুঝলি। মাথার মধ্যে খালি শয়তানি বুদ্ধি কিলবিল করে। শয়তান একটা, বাঁদর।

রুপা আপা শাদাদ ভাইকে বকতে বকতে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন।

লতা আর শাদাদ ভাই তখন সম্পূর্ণ একা। ড্রইংরুমে কেউ নেই। সবকিছু নিশ্চুপ। যেন তারাও চুপ থাকার পণ করেছে। লতা মাথা নিচু করে শাদাদ ভাইকে বললো,

— কাজটা কি ঠিক হলো শাদাদ ভাই? একটা মানুষকে শারীরিকভাবে কষ্ট দেয়া কি আপনাদের রুলসের মধ্যে পরে?

শাদাদ ভাই লতার প্রশ্ন শুনে চট করে উঠে দাঁড়ায়। লতার যেখানে বসে আছে সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়। লতার সামনে উপুড় হয়ে লতার চোখে চোখ রেখে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

— কেন রে কষ্ট হচ্ছে তোর? বিয়ে হতে না হতেই এত মায়া! গ্রেট; কিন্তু তোর এত মায়া ওই বিড়ালটার জন্য দেখে কেন যেন আমার সহ্য হচ্ছে না।

— তুমি আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছো। উত্তর দাও কেন এমন করলে? রবিন সাহেবের দোষটা কোথায়?

— দোষটা রবিনের। কারণ, ও তোকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে।

লতা যে সোফায় বসে ছিল সেই সোফায় লাথি মেরে কথাটি বলে লতাকে চেপে ধরে শাদাদ ভাই। লতা শাদাদ ভাইয়ের এমন আক্রমণাত্মক আচরণ দেখে লতা আঁতকে উঠল ভয়ে। শাদাদ ভাই শান্ত গলায় লতার কাঁপাকাপা চোখের পাতায় নিজের দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বললো,

— যেদিন থেকে বুঝতে পারলাম তুই আমার বিশেষ কেউ। সেদিন থেকে বিরহের আগুনে দগ্ধ আমি। আজও সেই পোড়া ঘা নিয়ে ঘুরছি এই আশায় তোকে একদিন না একদিন আমি জয় করব। কিন্তু, সেই আশায় গুড়ে বালি দিয়ে অন্যকেউ এসে তোকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে তা হতে দেয়া যায় না। বিরহ ভালো লাগছে না আমার; একটুখানি ভালোবাসা চাই আমার। তাও তোর ভালোবাসা চাই আমার। তোর আর আমার ভালোবাসা মাঝে যে আসবে তাকে এত সহজে ছেড়ে দেই কি করে?

কথাটি বলে লতার বন্ধ চোখের পাতায় চুমু খেয়ে সরে আসে শাদাদ ভাই। লতা তখনও বসে আছে। নড়াচড়ার করার জন্যেও যেন ওর শরীরে কোনো শক্তি অবশিষ্ট নেই। সবটা শুষে নিয়েছে শাদাদ ভাই।

শাদাদ ভাই লতার অবস্থা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এগিয়ে এসে লতাকে কোলে তুলে নেয়। লতা শাদাদ ভাইয়ের হুটহাট আচরণ দেখলে অবাক হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। এখনও হলো তাই।

— নামান আমাকে। ইদানীং অসভ্য হয়ে গেছেন আপনি। যখন তখন উল্টাপাল্টা কাজ করছেন।

লতা কথাগুলো বলছে আর নামার জন্য জোরাজুরি করছে। কিন্তু, শাদাদ লতার কোনো কথায় কান না দিয়ে নিজ মনে এগিয়ে যাচ্ছে দোতলায়। শাদাদ ভাইয়ের কোনো ভাবান্তর না দেখে একসময় লতা শান্ত হয়ে যায়। শাদাদ ভাই লতাকে শান্ত হতে দেখে এবার মুখ খুললো,

— এই যে তুই বললি ইদানীং আমি অসভ্য হয়ে গেছি। অসভ্য কার জন্য হলাম? তোর জন্য। কারণ, তোকে দেখলে আমার অনেক কিছু করতে ইচ্ছে। যেমন ধর ঠাস করে দরজা বন্ধ করে ঠুসঠাস দুয়েকটা চুমু খেতে ইচ্ছে করে তোর এই টমেটোর মতো গালে। এই যে তোকে কোলে নিলাম মনে হচ্ছে তোকে কোল থেকে না নামিয়ে সোজা কাজি অফিসে চলে যাই। বিয়ে করে তোকে বৌ বানিয়ে একবারে বাসর ঘরে ঢুকে পরি। তারপর, তোর আদরে আদরে মরব আমি । তোর আদরে ফের জাগ্রত হবো আমি ।

কথাগুলো বলতে বলতে শাদাদ ভাই লতাকে একটু উঁচুতে ধরে লতার থুতনির দেবে খাঁজে শব্দ করে চুমু খেয়ে লতাকে ওর ঘরের দরজার সামনে নামিয়ে দেয়। লতা তো ছাড়া পেয়ে ঘরে ঢুকে দরজা আঁটকে দেয়। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে লতার। লোকটা এমন কেন? বুকে কাঁপন ধরে যায় তার দেয়া স্পর্শ আর কথাগুলো শুনলে। তার কাছ থেকে এমন ভালোবাসা পেলে তাকে ছেড়ে অন্য কারো সঙ্গে ঘর বাঁধবে কি করে ?

দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে শাদাদ ভাই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চলে যাচ্ছে। ভাবছে কি করে নিজের মনের কথাগুলো পরিবারকে জানানো যায়? সবাই যখন জানবে তখন কি উনারা মানতে চাইবে?

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here