বিরহ_ভালোবাসা-১৬,১৭

0
227

#বিরহ_ভালোবাসা-১৬,১৭
#Tahmina_Akhter

১৬.

প্রায় সাতদিন রবিন সাহেব হসপিটালে ছিলেন। ফুড পয়জিনিং সাথে নাকি প্রসাবে ইনফেকশন ধরা পরেছিল রিপোর্টে।

এদিকে আমার পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। মাথায় তখন শুধু পড়াশোনার চাপ। শাদাদ ভাই কিংবা রবিন সাহেব কে তাদের ভেবে অযথা দুশ্চিন্তা করা বাদ দিয়েছি।

পরীক্ষার বদৌলতে হোস্টেলে ফিরতে দেয়নি মা। তাই বাড়িতে বসে পড়াশোনা। সময়মতো গিয়ে পরীক্ষার হলে উপস্থিত হওয়া সবটাই চলছিল নিয়মমাফিক।

পরীক্ষা যখন শেষ হলো তখন নভেম্বর মাস। গা চিমটানো শীত। মৃদু বাতাস গায়ে লাগলে গায়ে কাটা দিয়ে যায়। একদিন হুট করে সকালের নাশতার পর চায়ের পর্ব চলছিল। বড়ো জেঠু চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— বলছিলাম কি তৌহিদ সবাই মিলে আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে ঘুরে এলে কেমন হয়? আমি তো কিছুদিন আগেও ঘুরেফিরে এলাম। কিন্তু তোরা বছরখানিক হলো গ্রামে যাস না। লতার ভার্সিটি বন্ধ। একা একা বাসায় বসে ছুটি উপভোগ করা যায়?

বাবা জেঠুর কথা শুনে কিছুটা সময় নিয়ে কি যেন ভাবলেন। তারপর, আমাকে এবং মাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— ব্যাগ গুছিয়ে ফেলো আজ রাতের ট্রেনে আমরা সবাই গ্রামের বাড়িতে যাবো।

আমি খুশি হয়ে জেঠুকে ধন্যবাদ জানালাম। সেই সাথে বাবাকেও। নিজের ঘরে এসে চার-পাঁচটা থ্রী-পিছ আর পছন্দের ক্যামেরাটা নিয়ে নিলাম। কারণ, গ্রামের প্রাকৃতিক দৃশ্য একমাত্র ছবির মাধ্যমে আঁটকে রাখা যায়। নয়তো, এত সুন্দর দৃশ্য একসময় স্মৃতির পাতায় ঝাপসা হয়ে যায়।

দুপুরে খাওয়ার পর আমার ঘুমানোর অভ্যেস আছে। ঘুমাতে না পারলে বিকালের পর মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে যায়। তাই জানালার পর্দা লাগিয়ে ঘরের লাইট অফ করে পুরো ঘরকে রাতের আঁধার বানিয়ে বালিশে মাথা রেখে শান্তির ঘুম দেয়ার জন্য চোখ বুজে ফেললাম।

লাল সুতির শাড়ি পরে একহাত ঘোমটা দিয়ে নাকের পানি চোখের পানি এক করে কাঁদছে আমাদের লতা। কারণটা হলো গ্রামের আসার পর ওর বাব এবং জেঠু মিলে ওকে বিয়ে দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। শেষমেশ সক্ষম হয়েছেন লতার বিয়ে সম্পন্ন করে।

লতা বাসরঘরে বসে হিচকি তুলছিল এমনসময় ওর স্বামী এসে ওকে দিলো এক রামধমক। একধমকে লতা আঁতকে উঠল। ভয়ে চোখের কান্না শুকিয়ে গেছে। পিটপিট করে নিজের স্বামীর দিকে তাকিয়ে আমাদের লতা ভয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে।

লতার পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে। লতা শোয়া থেকে উঠে বসে। বেডসাইড টেবিল থেকে জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। মাথাটা ঘুরছে। বোধহয় প্রেশারটা ফল করেছে। লতা কোনেরকম বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে যায়। চোখেমুখে পানি দিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসে। খাটের ওপর বসে ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় তাকাতেই নিজেকে আবিস্কার করলো দুপুরের সেই কালো রঙের থ্রী-পিছে। তারমানে এতক্ষণ সে দুঃস্বপ্ন দেখছিল। লতার কারো সাথেই বিয়ে হয়নি।

লতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বালিশে মাথা রেখে চুপটি করে শুয়ে রইলো। একসময় লতার চোখের পানি গড়িয়ে বালিশে পরে।

— শাদাদ ভাই স্বপ্নে নিজের বিয়ে অন্যকারো সাথে হতে দেখে আমি পাগলের মতো কেঁদেছি। যদি বাস্তবে আপনাকে না পাই তবে আমি পাগল হয়ে যাব।

লতার দুচোখের পানি বালিশে গড়িয়ে পড়ছে। না পাওয়ার যন্ত্রনা বড্ড পীড়াদায়ক। না কাউকে মুখ ফুটে বলা যায় আর না সহ্য করা যায়!

——————–

রাত দশটার ট্রেনে খ নাম্বার বগিতে বসে আছে লতার পুরো পরিবার। রুপা আপা এবং উনার স্বামী জাভেদ ভাই আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন। একসপ্তাহ হলো জাভেদ ভাই ছুটিতে বাড়িতে এসেছেন।

আমি জানালার কাছে বসতে চেয়েছিলাম কিন্তু মা আমাকে চোখ রাঙানি দিয়ে বললো কি, জানালার পাশে বসলে চোর এসে গলায় ছুড়ি মেরে চেইন নিয়ে যাবে। মায়ের কথা শুনে সাহস হলো না জানালার কাছে বসার। বাবা এসে জানালার পাশে বসলো।

ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। ধীরে ধীরে ট্রেনে গতি বাড়ছে। ব্যস্ততম শহরের বুক থেকে ধীরে ধীরে বের হয়ে যাচ্ছে আমাদের ট্রেন।

ট্রেন যখন পুরোদমে চলতে শুরু করলো তখন রুপা এসে আমাকে বললো চল আমাদের সীটে গিয়ে বসি তোর জাভেদ ভাই কথা বলবে তোর সাথে। মায়ের কাছ থেকে চোখের ইশারায় অনুমতি পেয়ে রুপা আপাদের সীটে গিয়ে বসলাম। জাভেদ ভাই আমাকে দেখে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো,

— মানুষ চিকন থেকে মোটা হয়। আর তুমি মোটা থেকে চিকন হচ্ছো। ব্যাপারটা কি প্রেমে অসফল হয়ে দেবদাস হলে নাকি?

জাভেদ ভাইয়ের কথা শুনে মনে মনে দীর্ঘশ্বাস চেপে বললাম,

—- আপনার শালার জন্যই তো আজ আমার এই অবস্থা। তাকে না পাওয়ার যন্ত্রণা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আমায়। যদিও অসুরটার এই ব্যাপারে কোনো হেলদোল নেই। দূরে গেলে লতা কে এটাই হয়তো মনে রাখে না। আর কাছে এলে উনার প্রেম বেড়ে যায়। গরম দুধের ন্যায় উতলে পরে নীচে।

— কি শালি সাহেবা কিছু জানতে চেয়েছি আপনার কাছে? আপনি তো আমার প্রশ্ন শোনার আগে কল্পনার জগতে চলে গেলেন।

কথাটি বলে জাভেদ ভাই হাসতে লাগলেন। আপা জাভেদ ভাইয়ের পেটে কনুই দিয়ে গুতো মারে অমনি তার হাসি বন্ধ। জাভেদ ভাই অসহায় চোখে তাকালেন নিজের অর্ধাঙ্গিনীর মাঝে কিন্তু আপা উল্টো চোখ রাঙানি দিয়ে বললো,

— তোমাকে এত কথা বলতে বলেছি আমি। কাজের কথা না বলে ফাও আলাপ শুরু করেছো। শোন লতা?

— জী আপা।

— তুই চাচির কাছে চলে যা। অযথা, এখানে বসে ওর বিরহ মার্কা কথাবার্তা শোনার দরকার নেই।

এই একটা কথায় অপেক্ষায় ছিলাম। মায়ের কাছে ফিরে এলাম। এসে দেখি মা বসে বসে রবি ঠাকুরের “শেষের কবিতা” বইটি পড়ছেন। আমি বিড়াল ছানার মতন মায়ের কোল ঘেসে বসে পড়লাম। মা একবার আমার দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকায় কিন্তু আমি হাসিমুখ করে কিছু না বলে মায়ের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রইলাম। মা আমাকে কিছু না বলেই আবারও বইয়ে মনোযোগী হলেন

মায়ের কাঁধে মাথা রেখে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি বুঝতেই পারিনি!

ঘুম ভাঙলো রুপা আপার ডাকে। চোখ কচলে ঘুমঘুম চোখে আপার দিকে তাকিয়ে আছি। আপা আমার ব্যাগটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,

— চল এসে পড়েছি আমরা। নাকি ট্রেনে থাকবি?

আমি মাথা নাড়িয়ে চট করে ব্যাগটা হাতে নিয়ে মাথায় খুব ভালো করে ওড়না জরিয়ে রুপা আপার পেছনে পেছনে নেমে এলাম ট্রেন থেকে।

হুট করে শীতল বাতাস এসে আমাকে ছুঁয়ে দিয়ে গেলো। নভেম্বর মাসের শীত শহরে সকালে লাগলেও গ্রামে এর প্রকট দিনভর পাওয়া যায়। এমনসময় বাবা নিজের গায়ের শালটা আমার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বললো,

— খুব ভালো করে শরীরে জড়িয়ে নে নয়তো ঠান্ডা লেগে যাবে।

মা এবং বাবার কান্ড দেখলে আমার মাঝে মাঝে ভীষন অবাক লাগে। তারা আমায় ভুল করলে যেভাবে বকে তার চেয়ে বেশি স্নেহ দিয়ে আগলে রাখেন। এই যে মায়ের কাঁধে মাথা গুঁজে ঘুমালাম মা কিন্তু একটুও উফফ শব্দ করেনি। আর বাবা নিজের ঠান্ডা লাগার চিন্তা না করে আমাকে শালটা দিয়ে দিলেন। হয়তো, বাবা-মায়েরা এমনই সন্তানের অসুবিধা বোধহয় বাবা-মায়ের বেশি বুঝে।

তিনটা রিকশা ডাকা হলো। একটায় বাবা আর জেঠু। অন্যটায় আমি এবং মা। সর্বশেষ জাভেদ ভাই এবং রুপা আপা।

ধীরে ধীরে রিকশা এগিয়ে যাচ্ছে গ্রামের মেঠোপথ ধরে। আঁকাবাঁকা রাস্তা। রাস্তার কোল ঘেসে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বিশাল গাছ। গ্রামের ছোট বড়ো অনেকেই দেখলাম রাস্তার কিনারা দিয়ে হেটে যাচ্ছে নিজ গন্তব্য। কারো হাতে আবার বাজারের ব্যাগ।

এমন সময় রিকশা থামলো মোল্লাবাড়ির সামনে। আমাদের পৈতৃক ভিটা ডালিকান্দিতে। একে একে সবাই নেমে পড়লো। আমি নামলাম সবশেষে। বাবা রিকশা ভাড়া মিটিয়ে ব্যাগ হাতে নিয়ে সর্বপ্রথম বাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন। তারপর, জেঠু, মা আমরা সবাই।

বাড়ির প্রতিবেশীরা এগিয়ে এলেন আমাদের দেখে। সবাইকে হাসিমুখে সালাম দিয়ে বাবা-জেঠু আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন তাদের সাথে।

তারপর, আমরা গেলাম নিজেদের চারবিশিষ্ট চৌচালা ঘরে। টিনের ঘর। মনে মনে উত্তেজনা নিয়ে ঘরে ঢুকলাম। আহ্ আনন্দ হচ্ছে ভীষন।

ঘরে ব্যাগ রেখে কলপাড়ে গিয়ে টিউবওয়েল চেপে হাতমুখ ধুয়ে ফেললাম রুপা আপা, আমি আর জাভেদ ভাই মিলে। ঘরে এসে দেখলাম প্রতিবেশী চাচী আমাদের পিঠা রুটি এবং আলুভাজি দিয়ে গেছেন। বেশ আয়েশ করে আমরা সকলে খেয়ে নিলাম। স্বাদ পেলাম অমৃতের মতো।

এমন সময় অনুভব করলাম আরেকটু ঘুমানের প্রয়োজন। তাই চট করে একটি রুমে ঢুকে কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা শুরু করলাম।

#চলবে

#বিরহ_ভালোবাসা
#Tahmina_Akhter

১৭.

ঘুম থেকে যখন ওঠে যখন বাইরে এলাম তখন সূর্য মামা মাথার ওপর অবস্থান করছেন। ঘরের ভেতর কেউ নেই। মাথায় ওড়না দিয়ে বেরিয়ে পরলাম দেখার জন্য যে, সবাই গেল কোথায়?

উঠোন পেরিয়ে দক্ষিণের দিকে যেতেই দেখি রুপা আপা আর মা মিলে মাটির চুলোয় রান্না বসিয়েছে। পাশেই দুটো টুল বিছিয়ে বসে আছে জাভেদ ভাই এবং বাবা। জেঠু নেই এখানে হয়তো আশেপাশে কোথাও গিয়েছেন।

আমি এগিয়ে গেলাম তাদের কাছে। মা আমাকে দেখে বললো,

— ঘুম ভেঙেছে? সারারাত আমার কাঁধে ঘুমালি, বাড়িতে এসে দুপুর অব্দি ঘুমাচ্ছিস। এত ঘুম নিয়ে পড়াশোনা করিস কি করে?

আমি মায়ের পাশে একটা কাঠের পিঁড়ি টেনে বসে ছুড়ি হাতে নিয়ে টমেটো কাটতে কাটতে বললাম,

— তোমার গায়ের গন্ধে প্রশান্তিনামক টক্সিন আছে বুঝলে মা। যেই আমার নাকে গেলো ওমনি ঘুম পেয়ে গেছে। এখন কষ্ট করে একটু চা খাওয়াবে?

রুপা আপা আমার শেষের কথাটি শুনে ফিক করে হাসি দিয়ে খিচুড়ি নাড়াতে নাড়াতে মাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— চাচি ও আপনাকে এতক্ষণ তেল মারলো শুধুমাত্র চা খাওয়ার জন্য। কোনো টক্সিন বক্সিন না সব লতার ঢং।

রুপা আপার কথা শুনে মা, আমি, জাভেদ ভাই, বাবা একসঙ্গে হাসতে লাগলাম।

গরুর মাংসের পাতিল নামিয়ে মা একটা ছোট্ট হাড়িতে চায়ের পানি বসিয়ে দিলেন। এরই ফাঁকে রুপা আপার খিচুড়ি রান্না শেষ। তাই খালি চুলায় মা মাংসের পাতিল বসিয়ে দিয়ে আমাকে বললো, মাংস গুলো নাড়াচাড়া করতে যেন তলানিতে লেগে না যায়। আর রুপা আপাকে বললেন, জাভেদ ভাইকে সঙ্গে নিয়ে পাশের দিঘিতে গিয়ে গোসল করে আসতে।

রুপা আপা মায়ের কথামতো জাভেদ ভাইকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন দিঘির পাড়ে।

মা চলে গেলেন ঘরে চিনি আর গুঁড়ো দুধের প্যাকেট এবং চায়ের কাপ আনতে। রান্না করার ফাঁকে বাবার কাছ থেকে অজস্র গল্প শুনছিলাম। গল্পের মেইন ক্যারেক্টর হলো আমাদের শাদাদ ভাই। কি করে এত ভালো রেজাল্ট করলেন। সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন, ট্রেনিং শেষ করলেন অথচ পরিবারের কাছে টু শব্দ করেননি। সর্বশেষ, শাদাদ ভাইয়ের এতদিনের কষ্টের ফল হিসেবে ভালো একটা পজিশনে আছেন। সবাই পরিশ্রমের চাবিকাঠি।

—- গরু মাংস রান্না করতে পারিস তুই!

চেনা পরিচিত কন্ঠের স্বর শুনে বাবা এবং আমি পেছনে তাকিয়ে দেখি ব্যাগ কাঁধে, চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শাদাদ ভাই। বাবা উঠে গিয়ে শাদাদ ভাইকে জড়িয়ে ধরলেন। চাচা ভাতিজার যেন বহুদিন পর দেখা হলো। ঢং দেখলে বাঁচি না।

— লতা সব পারে। তুই একবার ওর হাতে আলুভর্তা,বেগুনভর্তা, পাতলা মসুর ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে দেখিস মনে হবে পৃথিবীতে বসে বেহেশতী খাবার খাচ্ছিস।

বাবা বেশ গর্ব নিয়ে কথাগুলো বললেন। আমি উনাদের কথায় কান না দিয়ে মনোযোগ দিলাম রান্নায়। মা ততক্ষণে চলে এসেছেন। শাদাদ ভাইকে দেখে মা হাসিমুখে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলেন। শাদাদ ভাই সবার চোখের আড়ালে আমাকে ভেঙচি কেটে চলে গেলেন ঘরের দিকে। আমি তখন অবাক হয়ে উনার ভেঙচি কাটার মানে খুঁজছিলাম।

গরুর মাংস রান্না শেষ। মা এসে অন্য একটা পাতিলে রান্না করা মাংস ঢেলে ঘরে নিয়ে গেলেন। কারণটা, হলো মাটির চুলায় রান্না করার কারণে পাতিলের তলায় কালি জমে গেছে। এদিকে আমি রান্নাঘরের সবকিছু গুছিয়ে ঝাড়ু নিয়ে রান্নাঘরটা ঝাড়ু দিচ্ছি।

— তোকে দেখে মনে হচ্ছে তুই এই বাড়ির নতুন বৌ। আহ্ কত সুন্দর করে মাথায় ওড়না দিয়ে বাড়িঘর পরিষ্কার করে ফেলছিস রে মধু! তুই যে এত কাজ জানিস আমি তা জানতামই না। ভাগ্যিস এসেছিলাম আজ। নয়তো তোকে অকর্মারঢেকি ভাবতে ভাবতে আমার বাকি জীবন কেটে যেত।

শাদাদ ভাইয়ের কথা শুনে আমি হাতের ঝাড়ুটা রান্নাঘরে রেখে। উনার সামনাসামনি গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। উনার এত কঠিন দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে বললাম,

— এখানে না এলে আমিও জানতাম না আমাদের পরিবারের ওয়ান এন্ড অনলি হ্যান্ডসাম বয় লুঙ্গি পরতে জানে। আপনাকে লুঙ্গিতে দারুণ মানায় শাদাদ ভাই। আপনার বিয়েতে আমি শ’খানেক লুঙ্গী উপহার দিব।

লতার মুখে নিজের বিয়ের কথা শুনে শাদাদ ভাই ভ্রু কুচকে বললো,

—- কেন রে তুই আমার বিয়েতে উপহার দিতে যাবি কেন?

— যাতে আপনার বৌ আপনার এই লুঙ্গি ওয়ালা স্টাইলে দেখে নিজ দায়িত্ব বলতে পারে উনার স্বামী বাংলাদেশের একমাত্র ব্যক্তি যে কিনা লুঙ্গিতে গিট্টু দিয়ে পরে।

লতা কথাটি বলে খিলখিল করে হাসতে থাকে। লতার মনোমুগ্ধকর এমন হাসি কবে দেখেছে শাদাদ ভাই মনে করতে পারছে না। কারণ, যতবারই লতার সঙ্গে দেখা হয়েছে ঠিক ততবারই সিরিয়াস ঝগড়া হয়েছে তাদের মাঝে। এই যে লতা হাসলে ওর চোখদুটো ছোট হয়ে যায় এতে আরও বেশি সুন্দর লাগে ওকে দেখতে।

লতা বহুকষ্টে হাসি থামায়। শাদাদ ভাই লতার একটু কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,

— এই যে আমার লুঙ্গির গিট্টু দেয়া নিয়ে হেসে পাগল হচ্ছিস। আবার এমন না হয়ে যায় আমি তোর ভাগ্যে আছি আর তোর বর লুঙ্গি গিট্টু দিয়ে পরে বলে লোক তোকে নিয়ে হাসাহাসি করছে।

শাদাদ ভাই কথাটি বলে সরে আসেন। লতা একেবারে চুপ হয়ে যায় শাদাদ ভাইয়ের কথা শুনে। কিছুটা সময় নিয়ে ধাতস্থ হয়ে লতা গম্ভীর মুখ করে বললো,

— আপনি আমার বর হবেন ব্যাপারটা আমার কাছে শেষরাতের দুঃস্বপ্নের মতো শাদাদ ভাই ।

কথাটি বলে কারো দিকে না তাকিয়ে একদৌঁড়ে ঘরে চলে যায় লতা। লতার কথার মর্ম বুঝতে পারে না শাদাদ। লতার কি শাদাদ সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারটা সত্যি সত্যি দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়?

দুপুরের খাবারের সময় সবাই একসঙ্গে জড়ো হয়। ঘরের মেঝেতে বড়ো মাদুর পেতে সবাই গোল হয়ে বসে। লতা,রুপা আপা এবং লতার মা মিলে বাড়ির পুরুষদের পাতে গরম গরম খিচুড়ি আর গরু মাংসের তরকারি তুলে দিচ্ছে।

এমনসময় ঘরে প্রবেশ করে লতার বড়ো জেঠু। লতার বাবা নিজের ভাইকে জিজ্ঞেস করলো, এতক্ষণ কোথায় ছিলেন তিনি? উত্তরে লতার বড়ো জেঠু দরজা থেকে একটু সরে দাঁড়ালে একজন ঘরে এসে প্রবেশ করে। লতা সেই মানুষটাকে দেখে স্তব্ধ হয়ে যায়। কারণ, মানুষটা আর কেউ নয় রবিন।

রবিনকে দেখে লতার বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। হাজারো রাতের আঁধার যেন নেমে আসে শাদাদের মুখে। বুকে অজানা ভয়েরা এসে দানা বাঁধতে শুরু করে। এতক্ষণ যেই খাবারগুলো অমৃতের মতো লাগছিল সেই খাবারগুলো এখন বিষের মতো গলায় গিয়ে জ্বলছে। খাবারের প্লেট রেখে এঁটো হাত নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে কলপাড়ে গিয়ে হাত ধুয়ে চুপচাপ উঠোনে রাখা চেয়ারে বসে থাকে শাদাদ।

শাদাদ ভাইয়ের খাবার রেখে চলে যাওয়া সবটা দেখে লতা। কিন্তু, কিছু বলার নেই ওর। লতা নিজের খাবার টুকু কোনোভাবে শেষ করে।

ভেতর থেকে নিজের চাচা-চাচির উচ্ছ্বসিত কন্ঠ শুনতে পাচ্ছে। লতা নিশ্চয়ই খুশি হয়েছে রবিনকে দেখে কিন্তু শাদাদ খুশি হতে পারেনি। যে মানুষটার জন্য নিজের প্রিয়জনকে হারানোর ভয় হৃদয়ে আছে। সেই মানুষটা যদি হুট করে এসে উপস্থিত হয় তবে মনের মাঝে কেমন ব্যথা অনুভব হয়?

———————

বিকেল বেলা…

লতা সবে ঘর থেকে বের হয়ে উঠোনে গিয়ে বসে যেখানটায় আগে থেকে সবাই উপস্থিত ছিলো। রবিন লতাকে দেখে হাসি বিনিময় করে। লতার পক্ষ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে রবিন চুপচাপ বসে থাকে। শাদাদ ভাই সবার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে পাশের বাড়ির এক ছেলের সঙ্গে যে কিনা শাদাদ ভাইয়ের সমবয়সী।

বড়ো জেঠু মায়ের হাতে বানানো পান মুখে দিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে চেয়ারে হেলান দিয়ে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— তৌহিদ??

— জি; ভাইয়া?

— মনে আছে মা মরার আগে কি বলেছিলেন?

জেঠুর কথা বাবাকে ভাবনায় ফেললেন। কিছু সময় পর বাবা বললেন,

— জি ভাইয়া ; মনে আছে।

— মনে থাকলে ভালো। রবিন ছেলেটা নিশ্চয়ই অনেক ভালো তাই হয়তো এখনও আমাদের লতার জন্য অপেক্ষা করছে। নয়তো, ওর মতো ছেলের বিয়ের পাত্রীর অভাব হবে না। যেহেতু, লতা এখন অবসরে আছে। আমরা সবাই উপস্থিত আছি। সবচেয়ে বড়ো কথা রবিনের বড়ো ভাই জাভেদ এখানে উপস্থিত আছে। তবে রবিনের আর লতার বিয়েটা আজই আমাদের পৈতৃক ভিটায় সম্পন্ন করা হোক। কি বলিস তুই?

অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা শাদাদ ভাই কান খাঁড়া করে নিজের বাবার কথা শুনছিলেন। সবটা শোনার পর শাদাদের মনে হচ্ছে, ওর জন্মদাতা পিতা ওর সবচেয়ে বড়ো শত্রু।

লতার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ঝাপসা নয়নে একটিবার শাদাদ ভাইয়ের মুখের দিকে। পরিষ্কার বোঝা যায় না তার মুখটা। তবুও তাকে এক পলক দেখার তৃষ্ণা মেটাতে লতার কি আকুল চেষ্টা!

— আপনি যেটা বলবেন সেটাই আমার সিদ্ধান্ত ভাইয়া। আপনি বিয়ের ব্যবস্থা করুন। আজই লতা আর রবিনের বিয়ে সম্পন্ন করা হবে। রুপা লতাকে নিয়ে ঘরে যাও। আমরা বাজার থেকে বিয়ের কিছু কেনাকাটা করে আসি।

লতাকে নিয়ে ঘরের দিকে চলে যাচ্ছে রুপা। লতার বাবা, লতার বড়ো জেঠু এবং রবিনকে সঙ্গে নিয়ে রওনা হলেন পাশের বাজারের উদ্দেশ্য। উঠোনে একা রয়ে যায় শাদাদ ভাই। দেখলে মনে হবে সে একেবারে মূল্যহীন। যার জীবনের কোনো কিছু চাওয়া-পাওয়ার দাম নেই। যা আছে শুধু হারিয়ে ফেলার অধিকার। আজ তো জীবনের আকাঙ্ক্ষিত মানুষটা এবং তাকে ভালোবাসার অধিকার হারাতে চলছে শাদাদ।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here