বিরহ_ভালোবাসা-১২,১৩

0
180

#বিরহ_ভালোবাসা-১২,১৩
#Tahmima_Akhter

১২.

রুপা আপার বিয়ের আজ একবছর পূর্তী উপলক্ষে বাড়ির সকল মানুষকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে জাভেদ ভাই।

গত সপ্তাহে জাভেদ ভাই আমাকে চিঠিতে দাওয়াত দিয়েছেন। কিন্তু, আমার যাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। আগের মতো সেই চঞ্চলতা আমার মাঝে নেই। হারিয়ে গেছে ঠিক আমার ভালোবাসার মতো। আগে ফ্যামিলির কোনো অকেশান হলে আমি আগে আগে উপস্থিত থাকতাম। ভালো লাগত আনন্দ হৈ-হুল্লোড় করতে। সবাই এক সঙ্গে জোড়ো হবেন মানে শাদাদ ভাইও আসবেন। কিন্তু, এখন আমি নিজেই গা বাঁচিয়ে চলি শাদাদ ভাইয়ের কাছ থেকে। তাকে একপলক দেখা মানেই আমার সঙ্গে আমার নিজের করা প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা। তার নাম শুনলে পৃথিবীর সকল কিছুকে পা ঠেলে দিয়ে মনে হয় তার সামনে গিয়ে দাঁড়াই শুধুমাত্র একটুখানি ভালোবাসা পাওয়ার লোভে। কিন্তু, মায়ের কাছে আমি কথা দিয়েছি, আমি তাকে আমার মনে রাখব না। সেদিনের পর থেকে মনেও রাখি না তাকে। কিন্তু, সে তো আমারই শরীরের একটা অংশ। তাকে আমি মনে না রাখলেও আমার অবচেতন মন ঠিকই শাদাদ ভাইয়ের অস্তিত্বতে নিজের মাঝে ধারণ করে রেখেছে। মাঝে মাঝে ভাবি এই যে জীবনটাকে হাতের মুঠোয় এনে তাকে ভালোবাসার যন্ত্রণায় প্রতিনিয়ত আমি আহত হচ্ছি, সে কি জানে? জানবে কোত্থেকে? তাকে কখনো সাহস করে বলতে পারিনি, শাদাদ ভাই আমার বাকি জীবনটাতে শুধু আপনাকেই চাই, অন্য কাউকে নয়।

—- লতা, তোর বাবা-মা এসেছে। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে তোর জন্য অপেক্ষা করছে।

নীলাদ্রির কথায় আমার ধ্যানভগ্ন হয়। উঠে গিয়ে আমি জানালার কাছে দাঁড়াই। দেখলাম গেটের বাইরে সত্যি সত্যি বাবা-মা দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে গায়ের চাদরটা খুব ভালো করে গায়ে জড়িয়ে হোস্টেলের ছোট্ট ঘর থেকে বের হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছি।

আজ এক বছর হলো পড়াশোনার বাহানায় হোস্টেলে থাকছি। পড়াশোনা তো স্রেফ বাহানা মাত্র। শাদাদ ভাইকে এলপলক দেখার লোভ সামলাতে আমি ঠাঁই নিয়েছি হোস্টেলের ওই ছোট্ট ঘরটায়।

গেটের বাইরে যত অগ্রসর হচ্ছি ঠিক ততই চোখের সামনে দৃশ্যমান হচ্ছে আমার বাবা-মায়ের শুকনো মুখখানা। মা দৌঁড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমিও মাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলাম। আহ্, বহুদিন পর মায়ের ঘ্রাণ পেলাম। হুট করে আমার কেন যেন ভীষন কান্না পাচ্ছে! বাবা এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত রাখলেন। আমি বাবার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

—- বাবা কেমন আছো?

— তোকে ছাড়া আমার কখনোই ভালো লাগেনি। তাই বলব আমি ভালো নেই।

লতা ওর বাবার কথার জবাব না দিয়ে ওর মাকে ছেড়ে দিয়ে বললো,

— আজ হুট করে চলে এলে যে?

লতার প্রশ্ন শুনে লতার বাবা-মা একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। লতার মা লতার বামহাত ধরে বললো,

— জাভেদ নাকি তোকে চিঠি পাঠিয়েছে? লতা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বোঝালো।

— আমাদের সবাইকে দাওয়াত দিয়েছে ওদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য। তোকে ছাড়া আমরা যাই কি করে? তাই তোকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে এসেছি।

লতা জানত এমন কিছু হয়তো বলতে এসেছে ওর বাবা-মা। লতা কিছুসময় চুপ থেকে মাথা নিচু করে জিজ্ঞেস করলো মাকে,

— শাদাদ ভাই আসবে, মা?

লতার মা চট করে মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন। মেয়েটার মুখের তাকিয়ে যেন মেয়ের সকল অনুযোগ, পরিবার থেকে দূরে থাকার বাহানা সবটা পরিষ্কার হয়ে গেছে তৃনার কাছে। মেয়েটার দিকে তাকালে বড্ড মায়া হয়। মেয়েটা গরীব ঘরের একটা চাষী ছেলেকে পছন্দ করতো। তাহলে মেয়েকে সেই বিনাবাক্য সেই ছেলের হাতে তুলে দিতো। কিন্তু, পরিবার ছেলের কাছে?

লতার বাবা লতার মাকে চুপ থাকতে দেখে নিজেই লতাকে জবাব দিলেন।

— না শাদাদ আসবে না। কমিশনড অফিসার পদে যোদ দিয়েছে বেশ কদিন হলো। নতুন অবস্থায় এত ঘন ঘন ছুটি পাবে বলে মনে হচ্ছে না।

শাদাদের পদোন্নতি ঘটার কথা শুনে লতা আনন্দিত হলো বেশ। হুট করে লতার মনে হলো ওর খুব খুশি খুশি লাগছে।

— মা, আমি ব্যাগটা গুছিয়ে আসছি। তোমরা সিএনজি ডাকো।

কথাটি বলে তড়িঘড়ি করে আবারও হোস্টেলের ভেতরে চলে যায় লতা। এদিকে লতার বাবা-মা খুশি হলেন। লতার বাবা আরেকটু এগিয়ে যায় মেইন রোডের কাছে সিএনজি ডেকে আনার জন্য।

সবকিছু ঠিকঠাক করে নিজের বাবা-মায়ের সঙ্গে রওনা হয় লতা। আজ বহুদিন পর নিজের আপন ঠিকানায় ফিরে যাচ্ছে লতা।

বাড়ির মেয়ে বাড়িতে ফিরে এসেছে বলে যেন আজ বাড়িতে ঈদের খুশি ফিরে এসেছে। লতার বড়ো জেঠু লতাকে দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

— বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করা যায় না? বাড়ির মেয়ে বাড়িতে থাকবে হাঁটবে, ফিরবে মন চাইলে পড়াশোনা করবে। আর তুই কিনা হোস্টেল গিয়ে পড়ে আছিস। জানিস আমাদের মন কতটা পুড়ে তোর জন্য।

কথাগুলো বলতে বলতে ভারাক্রান্ত হয়ে পরলেন লতার জেঠু। লতা তো নিজেকে নিজে বড্ড গর্ববোধ করছে। ওর অনুপস্থিতিতে ওর পরিবার ওকে মিস করে এটাই তো অনেক। আর কি চাই লতার? চলার পথে পরিবারের সার্পোট থাকলেই চলবে। শাদাদ ভাইয়ের ভালোবাসা ছাড়াও দিব্যি চলা যায় এই রঙের দুনিয়ায়।

সন্ধ্যে হবার আগে সবাই রওনা হলো রুপার শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্য। পৌঁছানোর পর দেখা গেলো মাগরিবের আজান পরছে চারপাশে। তাই বাড়ির পুরুষেরা মিলে নামাজ পরতে চলে যায় মসজিদে।
আর নারীরা ঘরে নামাজ পরে নেয়। লতার পিরিয়ড চলছে বিধায় চুপ করে ড্রইংরুমে বসে। দেয়াল ঘড়িতে সময়টা দেখে নিলো নামাজ শেষের পথে। হয়তো,কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই চলে আসবে।

লতা আজ গোলাপি রঙের শাড়ি পরে এসেছে। লতা শাড়ি পড়তে চায়নি কিন্তু নিজের মায়ের অনুরোধ কি আর ফেলতে পারবে? তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও শাড়ি পরে এসেছে। মাঝে সিঁথি করে চুলগুলো বেনি করে বামপাশের কাঁধে ওপর ফেলে রেখেছে।

মাথা নীচু করে লতা জীবনের সমীকরণ মেলাতে ব্যস্ত তখন। এমনসময় একটি হাত লতার দিকে এগিয়ে আসে। লতা তাকিয়ে দেখলো একটি জিলাপি। হাতের মালিককে দেখার জন্য লতা ওপরে তাকায়। ব্যস, চোখদুটো তখনই স্থীর হয়ে যায় মানুষটার মুখখানা দেখার পর। স্বপ্ন নাকি বাস্তব কোনটা বিশ্বাস করবে লতা? বোকাচোখে তাকিয়ে লতা মানুষটাকে জিজ্ঞেস করে,

— আপনি কি সত্যি আমার চোখের সামনে আছেন, শাদাদ ভাই?

লতার কথায় শাদাদ ভাই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,

— হ্যা তোর চোখের সামনে আছি মধু। নে তো জিলাপিটা ধর। হাত থেকে রস গলিয়ে পরছে।

লতা তখনও বিশ্বাস করতে পারছিল না যে ওর চোখের সামনে শাদাদ ভাই দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে শাদাদ ভাই লতার সামনে জিলাপি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। লতার জিলাপি নেবার নাম গন্ধও নেই। শাদাদ ভাই চট করে নিজের পাঞ্জাবির পকেট থেকে টিস্যু বের করে তাতে জিলাপিটা রেখে টি-টেবিলের ওপরে রেখে দিলো। দূরে গিয়ে বেসিন থেকে হাত ধুয়ে এসে দেখলে লতা নেই, গায়েব।

শাদাদ ভাইয়ের তখন ইচ্ছে করছিল চোখের সামনে যা-কিছু সব ভেঙে চুরমার করে ফেলতে। কিন্তু, বোনের শ্বশুরবাড়ি বলে রাগটা ঢোক গিলে গলার নীচ অব্দি নামিয়ে রাখলো ।

একে একে সব গেস্টরা আসা শুরু করে। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ রুপা এবং ওর স্বামী জাভেদ কেক কাটে নিজের প্রথম বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে। এদিকে লতাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে শাদাদ ভাই। কিন্তু লতার নামগন্ধও নেই এই পার্টিতে। হুট করে শাদাদের মনে হলো, লতা আবার বাড়িতে ফিরে যায়নি তো। কারণ, অদূরে লতার বাবা-মা রুপা আপার শ্বাশুড়ির সঙ্গে দাঁড়িয়ে গল্পসল্প করছেন।

শাদাদ কাউকে না জানিয়ে চট করে এই বাড়ি থেকে বের হয়ে রওনা হলো নিজেদের বাড়ির উদ্দেশ্য।

আজ যে করেই লতার সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। এভাবে লুকোচুরি খেলার মানে কি? এই মেয়ে ওকে নিজের হাতে মেরেই ফেললেই তো পারে। এভাবে গোপনে, আড়ালে থেকে ওকে না দেখার অসুখে রেখে মেরে ফেলার দরকারটা কি? শাদাদ ভাই যতবার কাজের ফাঁকে ছুটিতে এসেছে ক্লান্ত শরীর আর লতার জন্য উদ্বিগ্ন হৃদয়টাকে নিয়ে। ঠিক ততবারই মনে আশা রেখে এসেছে যে, এবার হয়তো বাড়িতে ফিরে গেলে হয়তো লতাকে দেখতে পাবে। কিন্তু, প্রতিবার ফলাফল শূন্য। বাড়িতে ফিরে লতাকে দেখতে পায়নি ক্লান্ত শাদাদ ভাই। কতবার লতার হোস্টেলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল একটিবার ওকে মুখখানা দেখার জন্য। কিন্তু, তিনি তো শাদাদ ভাইয়ের আসার খবর পেলে শরীর খারাপের কিংবা পরীক্ষার অজুহাত দেখিয়ে বের হতেন না। এদিকে গার্লস হোস্টেলে পুরুষদের ভেতরে এলাও করে না। নয়তো, ভেতরে গিয়ে কানের নীচে দুচারটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিতো শাদাদ ভাই

আজ সবকিছুর হিসাব নিবে কড়ায়গণ্ডায়। লতা কি চায় আজ জানতে চাইবে সবটা? নিজের বাইকে চড়ে রওনা হলো শাদাদ ভাই। মনের মাঝে তখন হাজারো উৎকন্ঠা।

#চলবে…

#বিরহ_ভালোবাসা
#Tahmina_Akhter

১৩.

মাথার ওপর সাদা সিলিং ফ্যানটা বিরতিহীনভাবে ঘুরছে। তবু্ও, যেন শরীরের গরমভাব কমছে না উল্টো হাসফাস লাগছে। পরনের শাড়িটা এলোমেলো হয়ে আছে। শাড়ির আঁচল সেই কখন খসে পড়ে আছে খাটের কিনারায়। দুচোখ জ্বালা করছে। না পারছি শান্তি করে চোখ বন্ধ করতে আর না পারছি চোখ খুলে রাখতে। চোখ বন্ধ করলেও নীল এবং পিংক ব্রাশ করা পাঞ্জাবি পরণের শাদাদ ভাইকে দেখতে পারছি। চোখ খুলে রাখলেও একই দৃশ্য দেখছি আমি। আগের থেকে শুকিয়ে গেছেন অনেকটা। তবু্ও, তার সৌন্দর্যের মাঝে যেন কোনো কমতি নেই!

মরুভূমির শুকনো প্রান্তরে হুট করে যেন এক পশলা বৃষ্টির ছিটেফোঁটা আমার চৌচির হৃদয়টাকে একটুখানি প্রশান্তি দিয়ে গেছে। তৃষ্ণার্ত মনটা আজ তৃপ্তি পেলো তাকে এক পলক দেখায়।

কিন্তু, চোরের মতো পালিয়ে এসেছি আমি। পালাবোই বা না কেন? সবার দৃষ্টি থেকে আমি আমার ভেতরটাকে আড়াল রাখতে পারব। কিন্তু, নিজের থেকে কি করে আড়াল করব আমি? শাদাদ ভাইকে দেখে হৃদয়ের মাঝে চেপে রাখা অনুভূতি গুলো ফের মাথা চারা দিয়ে উঠতে চাইছে। পৃথিবীর সকল বাধা’কে উপড়ে ফেলে নিজেকে সমর্পন করে দিতে চাইছে শাদাদ ভাইয়ের চরণে।

কিন্তু, আমি তো চাই না। যদি চাইতাম তবে দীর্ঘ সময়কাল ধরে তার কাছ থেকে নিজেকে কেনই বা আড়ালে রাখলাম? কেন নিজেকে পরিবারের কাছ থেকে দূরে রাখলাম? সব বৃথা হয়ে যাবে।

লতা যখন নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে ব্যস্ত। ঠিক সেসময় দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে শাদাদ ভাই। লতা দরজার খোলার শব্দ পেয়ে দরজার দিকে তাকায় কে এসেছে তা দেখার জন্য? কিন্তু, অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখে চুপসে যায়। লতার মনে একটাই আফসোস কেন আল্লাহ তায়ালা মানুষকে ভ্যানিস করে দেয়ার জাদু শেখালেন না! যদি শেখাতো তবে আজ শাদাদ ভাইয়ের সামনে পরার আগেই জাদু দিয়ে নিজেকে ভ্যানিস করে অন্য রাজ্যে চলে যেতো। কিন্তু, আফসোস সেই জাদুর চাবিকাঠি লতার কাছে নেই!

শাদাদ ভাই ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। লতা ভয় পেয়ে শাদাদ ভাইকে বললো,

— দরজা খুলেন বলছি। বাড়ির সবাই দরজা বন্ধ দেখলে কি ভাববে?

— একদম চুপ..প।

শাদাদ ভাইয়ের ধমক শুনে লতা ভয়ে আঁতকে উঠল। মনে হচ্ছে হৃদয়টা এখুনি হাড় ভেঙ্গে বেরিয়ে আসবে।

— নাটক করিস আমার সঙ্গে? তোর নাটক দেখার জন্য আমি পথের দিকে তাকিয়ে থাকি?

শাদাদ ভাই এগিয়ে এসে লতাকে বিছানার সঙ্গে চেপে ধরে বললেন। লতা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়েও করে না। শাদাদ ভাইকে এতখানি কাছে দেখে লতা যেন হিপনোটাইজ হয়ে গেছে। শাদাদ ভাই কি বলছেন তার কিছুই লতার কানে ঢুকছে না।

— কাউকে কিছু না বলেই বাড়িতে চলে এলি কেন?মধু, আমি কি বলছি শুনছিস কিছু? আজ যদি আমি উত্তর না পাই গড সেইক। আমি কি করব আমি নিজেও জানি না।

কথাগুলো বলে লতার কাছ থেকে সরে এসে লতার শখের শো-পিছটা টেবিলের ওপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিলো জানালা দিয়ে। লতার রাগ উঠে গেলো এবার। কারণ, শো-পিছটা লতার খুব পছন্দের একজন টিচারের দেয়া। লতা শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ায়। আঁচলটা খুব ভালো করে গায়ে জড়িয়ে শাদাদ ভাইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। শাদাদ ভাই লতাকে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে গিয়ে থমকে যায়। শক্ত কিছু বললে, নরম মনের লতা সহ্য করতে পারবে তো? এই যে এলেমেলো চুল আর শাড়িতে এই লতাকেই তো কল্পনায় ভাবে শাদাদ। বিয়ের পর যখন দুষ্টমিষ্ট আদর চলবে। সারারাত লতাকে বুকে নিয়ে ঘুমাবে। আর খুব সকালে যখন শাদাদের ঘুম ভাঙবে লতার ডাকে। তখন ঘুম জুড়ানো চোখে এলোমেলো চুল আর শাড়িতে দেখে শাদাদের ঘুম হারিয়ে যাবে। এমনটাই সবসময় ভাবে শাদাদ আর মনের কল্পনায় ডুবে থাকে অবসরে। সেই মূহুর্তটা যেন হুট করে হাতছানি দিয়ে ডাকছে শাদাদকে।

কিন্তু, লতার তিক্ত বাক্য শুনে শাদাদ বেশিক্ষণ নিজেকে মোহাচ্ছন্নতায় ঘিরে থাকতে পারল না।

— আমি যে বড়ো হয়েছি আপনার চোখে পরে না, শাদাদ ভাই? হুটহাট দরজায় নক না করে ঘরে ঢুকে পরছেন। এসে বিছানায় চেপে ধরে উল্টাপাল্টা কথা জিজ্ঞেস করছেন? এগুলো কি কোনো কাজিন তার তার কাজিনদের সঙ্গে করে? এত মানুষের ভীরে আমি কমফোর্ট ফিল করছিলাম না তাই চলে এসেছি। এত ওভার রিয়েক্ট করার কি আছে?

শেষের কথাটায় ভীষন কষ্ট পেয়েছে শাদাদ ভাই। মনে আঘাত লেগেছে। মধু ওর জিজ্ঞেস করাটাকে ওভার রিয়েক্ট ভাবছে? মধু আরও খারাপ কিছু ভাবে হয়তো ওকে নিয়ে। নয়তো, ওর কাছ থেকে দূরে সরে থাকছে কেন মধু?

শাদাদ ভাই আর কিছুই বলার মুখ রইলো না। লতাকে পাশ কাটিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। এদিকে লতা শাদাদ ভাইয়ের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। মানে শাদাদ ভাই কিছু না বলেই চলে যাচ্ছে! আবার কি হলো?

লতা হাফ ছেড়ে বাঁচল। এগিয়ে এসে দরজার সম্মুখে দাঁড়ায় দরজা লক করার জন্য। দরজা বন্ধ করে দিবে তার আগমুহূর্তে শাদাদ ভাই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে লতাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। আকস্মিক ঘটনায় লতার কেমন রিয়াকশন দেয়া উচিত তা হয়তো লতা ভুলেই গেছে। শাদাদ ভাই লতাকে নিজের মাঝে জড়িয়ে রেখে পাগলের ন্যায় বলছে,

— মধু তুই যদি আমাকে না বুঝিস তবে কে বুঝবে বল? বিশ্বাস কর আমি পাগল হয়ে যাব তোর অবহেলা পেলে। আমি পৃথিবী থেকে হাসতে হাসতে বিদায় নিতে রাজি আছি। কিন্তু তোর কাছ থেকে অবহেলা পেতে রাজি না। আমি সহ্য করতে পারি না রে ।

শাদাদ ভাইকে এক ঝটকায় নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিলো লতা। শাদাদ ভাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে লতার দিকে। শাদাদ ভাই আবারও এগিয়ে আসতে চাইলে লতা হাতের ইশারা শাদাদ ভাইকে বারণ করে কাছে আসার জন্য। শাদাদ ভাই সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে।

লতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে। মনে মনে সে কি ঝড়! শাদাদ ভাইয়ের প্রশ্বস্ত এই বুকে নিজেকে নিয়ে কল্পনায় ছবি আঁকত লতা। ওই বুকটায় একটিবার নিজের মাথা রাখতে চেয়েছিল। আজ সেই মনো বাসনা পূর্ণ হয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে। কিন্তু, সে আদরটুকু নিজ হাতে সরিয়ে দিয়েছে লতা। কারণ, লাগাম টেনে ধরার সময় এখন। হাল ছেড়ে দেয়ার নয়৷ শাদাদ ভাই মানুষটা কেমন লতা তা খুব ভালো করেই জানে। কিন্তু, হুট করে কেন সে এমন আচরণ করছে লতার বোধগম্য হচ্ছে না!

— দেখুন শাদাদ ভাই আপনি আমার গুরুজনের মতো। আপনাকে অসম্মান করার আমার কোনো ইচ্ছে নেই। তাই বলছি আপনার এইসব পাগলামি বন্ধ করুন। নিজের ঘরে ফিরে যান। বাড়ির সবাই যখন ফিরে আসবে তখন আমাদের দুজনকে একসঙ্গে দেখলে তারা বিষয়টা খুব ভালোভাবে নিবে বলে মনে হয় না।

লতার এত নীতিময় কথাগুলো শাদাদের সহ্য হচ্ছে না। শাদাদ নিজের চুলগুলো টানছে পাগলের মতো। লতা সবটাই দেখছে। মায়া হচ্ছে ভীষন। কিন্তু, কিছুই করার নেই। একটা সময় শাদাদ ভাই শান্ত হয়। লতার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। লতার মুখটা দুই আজলায় ভরে গভীর চোখে তাকায় ওই ঘাতক চোখজোড়ায় । যেখানে তাকালে শুধুই খুন হয়,শাদাদের হৃদয়ের ভালোবাসাময় খুন।

— তুই কি জানিস আমার কল্পনায় পৃথিবীর নিষিদ্ধময় আদরে আমি কাকে নিয়ে ভাবি?

লতা জানে শাদাদ ভাইয়ের উত্তরটা কি হবে? শাদাদ ভাইয়ের চোখের গভীর দৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য লতা চোখ বন্ধ করে বলে,

— আমি ওসব জানতে চাই না শাদাদ ভাই। আপনি দয়া করে আমার ঘর থেকে চলে যান।

— আমার কথা আজ তোকে শুনতেই হবে। কারণ, আজ আমার বলতে ইচ্ছে করছে। পৃথিবীতে নাকি কোনো কিছু চাওয়ার থাকলে চেয়ে নিতে হয়। নয়তো পাওয়া যায় না রে। দুধের শিশু যদি না কাঁদে তবে জন্মদায়িনী মা নিজের বাচ্চার মুখে দুধ দেয় না। আর আমি তো একজন প্রেমের কাঙাল। প্রেম ভিক্ষা চাইতে হবে নয়তো প্রেম ভিক্ষা পাব না ।

শাদাদ ভাই কথাগুলো বলতে বলতে নিষিদ্ধ একটি কাজ করে বসলেন। লতা শাদাদ ভাইয়ের তপ্ত ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে চোখ বড়ো করে তাকায়। ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করতে থাকে। শাদাদ ভাইয়ের প্রশ্বস্ত বুকে কিল ঘুসি মারে। কিন্তু, শাদাদ ভাই লতাকে নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয় না।

একটা সময় শাদাদ ভাই লতাকে ছেড়ে দেয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে লতার কপালে দীর্ঘ চুমু খেয়ে লতার কানের কাছে মুখ বাড়িয়ে বললো,

—-নিশ্চয়ই তোকে বলতে হবে না আমার কি চাই? তুই শুধু আমার মধু। তোকে পাওয়ার জন্য যদি আমাকে পৃথিবী জয় করতে হয় তবে তাই করব। তবুও আমার তোকেই চাই।

লতার কানে আরও একটি স্বশব্দে চুমু খেয়ে শাদাদ ভাই বের হয়ে যায় এই ঘর থেকে। শাদাদ ভাই চোখের আড়াল হতেই লতা হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে শাড়ির আঁচল মুখে চেপে ধরে কেঁদে ওঠে।

শাদাদ ভাইয়ের স্পর্শ, ভালোবাসা, প্রেমময়ী বাক্য সবটাই তো নিজের জন্য শুনতে চাইত লতা। কিন্তু, আজ শাদাদ ভাইয়ের কথা, অনুভূতির, ভালোবাসার কোনো দাম যে দিতে পারবে না লতা। চড়া মূল্য দিয়ে দাম পরিশোধ করতে পারবে না সে। মায়ের কাছে যে ওয়াদা বদ্ধ সে।

লতা আজ খুব করে কাঁদছে। চোখের জল আজ দুভাবে বিভক্ত। একদল আজ খুশির কান্না করছে। শাদাদ ভাইয়ের ভালোবাসা তার জন্য বলে। আর অন্য দল কাঁদছে শাদাদ ভাইয়ের ভালোবাসাকে পায়ে ঠেলে সরিয়ে দিতে হবে বলে।

দু’জন দু’জনকে চায়। কিন্তু পরিবারের বাঁধা আজ দুটো ভালোবাসার মানুষের আলাদা হয়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভবিষ্যতে কি হবে কে জানে? তবে বিরহ এবং ভালোবাসার মাঝে কার জিত হবে সময় সঠিক জবাব দেবে।

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here