গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে – পর্ব ৩২

0
325

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩২

মূহুর্তের জন্য যেন নিঃশ্বাস কোথাও একটা আঁটকে গেল। এই কথা আগে কখনো মাথা আসেনি রাগিনীর। হুট করেই বলা উর্মিলার এই কথায় যেন তার নেত্রপল্লব চড়কগাছ হলো। দুটো হাত শক্ত করে মুঠো করে কোহিনূরের সাথে দেখা হওয়ার পর প্রতিটা ঘটনা পরপর সাজিয়ে নিলো সে মনে মনে। কোথাও একটা সত্যিই সূক্ষ্ম সন্দেহের রেখা পেতেই পা থেকে মাথা অবধি অদ্ভুত ঝাঁকুনির সৃষ্টি হলো। নিজেকে সামলে সে বলে উঠল,
“কীসব বলছিস! আমার সন্দেহ হচ্ছে ঠিকই তবে এতো বড় ক্রাই’মের সাথে সন্দেহের বশে উনাকে যুক্ত করা ঠিক হবে না। এটা টেরো’রিস্ট কেস উর্মিলা। সাধারণ ক্রা’ইম নয়। যা বলবি ভেবেচিন্তে বল।”

“আরে বাবা এতো হাইপার হচ্ছিস কেন? আচ্ছা আমাকে একটা কথা বল মেন্টাল হসপিটাল কি শখ করে থাকার কোনো জায়গা? যে তোর ইচ্ছে হলো আর তুই চলে গেলি থাকতে? তাও আবার ছদ্মবেশে। এমনটা কারা করে? যারা অপরাধ করে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করে বা যাদের মধ্যে অপরাধ করার প্রবণতা থাকে। কোহিনূর কি এমনি এমনি সেখানে আছে তোর মনে হয়? তোর অতিরিক্ত বিশ্বাসকে একটু মাটিচাপা দিয়ে যতটা পড়াশোনা করেছিস সেই জ্ঞান থেকে। সাইকোলজির স্টুডেন্ট তুই। বুদ্ধি তো তোর বেশি থাকার কথা।”

রাগিনী বিষয়টা যতই এড়িয়ে যেতে চাইছে ততই যেন উর্মিলা কথাগুলো একেবারে তার মস্তিষ্কে গেঁড়ে দিচ্ছে। তার গায়ের লোম শিউরে ওঠে। মনেপ্রাণে চায় এমনটা না হক। তাহলে নিজের মনের মাঝে বুনে রাখা সেই সুন্দর অনুভূতির বীজগুলো আপনাআপনি অবিশ্বাস নামক কীটনাশক ব্যবহারে ধ্বংস হয়ে যাবে। ঢক গিলে নিজের কথাগুলো একের পর এক সাজাতে থাকে রাগিনী। বিরবির করে বলে ওঠে,
“পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার মানে বিচ্ছিন্নকারক বা বহুব্যক্তিত্ব রোগ। এই যে এমন একটি মানসিক রোগ যে দুটি স্বতন্ত্র বা ব্যক্তিত্ব বজায় রাখে। বিভিন্ন কারণে এই রোগের সৃষ্টি হতে পারে। তার মধ্যে প্রধান কিছু কারণ হলো মাদ’কদ্রব্যের সেবন, বিষণ্নতা, খাওয়ার ব্যাধি, এমনকি এমন কিছু অতীত যা মানুষকে ট্রমার মধ্যে ফে’লে দেয়। কোহিনূরের ডিটেলস থেকে আমি যা পেয়েছি সেটা হলো উনার পুরো পরিবার একসাথে কোথাও ট্রাভেল করতে গিয়ে এক্সি’ডেন্ট করে। সেই ট্রমা থেকে উনার এই রোগ। আশ্চর্যের বিষয় হলো প্রথম প্রথম উনার দুটি ব্যক্তিত্ব লক্ষ্য করলেও আস্তে আস্তে উনার একটি ব্যক্তিত্ব স্থায়ী হয়। উনার কথাবার্তায় ম্যাচিউরিটি দেখা যায়। অদ্ভুতভাবে, উনার গাড়ি বা যানবাহন দেখে ভয় পাওয়ার কথা তবে উনি খুব দক্ষতার সাথে একবার গাড়ি কন্ট্রোলও করেছিলেন। সন্দেহের শুরু হয় সেখান থেকেই।”

কথার মাঝে ফাঁকতালে উর্মিলা বেশ ধীর সুরে বলে ওঠে,
“তাহলে তুই নিজেই ভাব তোর সন্দেহ করাটা কি অযৌক্তিক? নাকি আমি যা বলছি তা অযৌক্তিক? মানুষ ছদ্মবেশে থাকে কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে।”

“তবে আজ পর্যন্ত ঊনার দ্বারা তো কোনো ক্ষতি হয়নি।”

“হতেও তো পারে সে প্ল্যানিং সাজাচ্ছে।”

এবার মাথাটা ধরে যায় রাগিনির। চোখটা বন্ধ করে দেয়ালের সাথে ঠেস মেরে বসে। উর্মিলা জিজ্ঞেস করে,
“দেখি দে ফাইল গুলো কোথায়? আমিও একটু দেখি।”

বলার পরে তার খেয়ালে এল তার চোখে কোনো চশমা নেই। আশেপাশে হাতাতে থাকল সে। না পেয়ে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে সে বলল,
“আরে আমার চশমাটা কোথায়? দেখেছিস তুই?”

“না আমি তোর চশমা দেখিনি। তুই তো আমার ঘরে এসেছিলি চশমা ছাড়াই।”

“কী বলিস‌! তাহলে নিশ্চয়ই নিচে ফেলে এসেছি। যাই গিয়ে নিয়ে আসি।”

উর্মিলার চোখে একটু সমস্যা রয়েছে। চশমা ছাড়া ছোট লেখাগুলো অস্পষ্ট দেখে। যার কারণে চশমা ব্যবহার করতে হয়। তাই বিলম্ব না করে চশমা নেওয়ার উদ্দেশ্যে সে রাগিনীর রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

বরাবরের মতো সকলের ঘুমটা একটু দেরিতে ভেঙেছে। মুখে ব্রাশ নিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে হলরুমে পায়চারি করছে অভিরূপ। নোমান সৈয়দের হাতের কফি নিয়ে অভিরূপের কাছে এসে দেখল সে পায়চারি করছে। গতকাল রাতেই তারা রাশেদ সাহেবের বাড়িতে এসে পৌঁছেছিল। তবে অভিরূপের মুখটা গত রাত থেকেই বিষণ্ণ। তা দেখে নোমান কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলে,
“কি হয়েছে এমন বেতালের মতো পায়চারি করছিস কেন?”

অভিরূপ ব্রাশ করতে করতে নোমানের দিকে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বাচ্চাদের মতো বলল,
“ওই মেয়েটা!”

“কোন মেয়েটা? গত রাতে যার জন্য কাঁদায় গড়াগড়ি খেয়েছিলি সেই মেয়েটা?”

“হু! সে এভাবে পালিয়ে গেল কেন? আমি কি বাঘ না ভাল্লুক? নাকি ওকে বিয়ে করতে নিয়ে যেতাম? আরে বাবা আমি তো শুধু ওকে ওর বাড়ি পর্যন্ত ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। আসলে সব তোর দোষ।”

থতমত খেয়ে যায় নোমান। আশ্চর্য হয়ে অভিরূপের দিকে তাকায়। বিস্ফোরিত সুরে বলে ওঠে,
“আমি আবার কী করলাম?”

“তোর সাথে কথা বলতে বলতেই তো মেয়েটা কোথাও যেন হাওয়া হয়ে গেল।”

“তেরে কিসমত মে নেহি হে ও লারকি।”

“আমি তো শুনেছিলাম আঙ্কেলের মেয়ের নামও রাগিনী। সকাল থেকে তো সেই মেয়েটার দেখাই পাচ্ছি না।”

নোমান এবার আর অভিরূপের কথায় পাত্তা দেয় না। ছেলেটা রাগিনী রাগিনী করে সারা রাত জ্বালিয়েছে। আর নামটা শুনতে চাইছে না। কফির কাপ সোফার সামনের টেবিলে রেখে ফট করেই সোফায় বসে পড়ে। একটা উদ্ভট আওয়াজ পায় কানে। কোনো কিছু মটমট করে ভাঙার শব্দ হয়। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রয় নোমান। সে যেখানে বসেছে সেখানেই কিছু ভেঙেছে বুঝতেই হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। পেছন ফিরে সোফার দিকে চাইতেই দেখতে পায় একটা ভেঙে যাওয়া চশমা। চশমার গ্লাস ভেঙে সোফায় মুষড়ে পড়েছে।
“আরে এটা কার চশমা?”

হুট করে এক ধা’ক্কা খেয়ে নিজের নির্ধারিত স্থান থেকে সরে যেতে বাধ্য হলো নোমান। এমন রূঢ় ধা’ক্কায় মেজাজ বিগড়ে গেল তার। রাগটা ঝাড়া দরকার। নিশ্চয় ধা’ক্কা দেওয়া ব্যক্তিটি অন্যায় করেছে! এবার মেয়েলি কন্ঠ ভেসে আসে তার কর্ণকুহরে।
“আমার চশমা! আমার এতো সুন্দর চশমাটা ভেঙে দিলেন আপনি? কানা নাকি দেখতে পান না?”

এবার নোমানের চোখে আটকালো ছিপছিপে গড়নের একটা মেয়ে। গায়ে জড়ানো সবুজ রঙের কামিজ। সেই সাথে ওড়নাও সবুজ। সরু চোখ দুটোতে রাগি রাগি ভাব। মুখ চোখাচোখা করে রয়েছে। তবে মেয়েটির কথা শুনে নোমান যেন আরো চোটে গেল। মায়াবী সুন্দরী বলে তো ছেড়ে দেওয়া যায় না! সে কাঠ কাঠ গলায় বলল,
“আপনার মাথায় কি বুদ্ধি নেই? বুদ্ধিভ্রষ্ট? চশমা কেউ বসার জায়গায় রাখে? এমন করলে জায়গায় রাখলে ভাঙবেই। তাতে আমায় কানার উপাধি দেবেন?”

“আশ্চর্য লোক তো আপনি! একে তো নিজে ভুল করেছেন। কোথায় আপনার সরি বলা উচিত। তা না করে আমার সাথে গলাবাজি করছেন? লজ্জা করে না?”

“আমার লজ্জা করবে কেন? আমি চুরি করেছি নাকি ডাকাতি? আর সরি বলব কেন? ভুলটা কি শুধু আমার? চশমা টেবিলে রাখতে পারতেন। সোফায় কেন রেখেছেন? এটা চশমা রাখার জায়গা?”

অভিরূপ এবার দুজনের ঝগড়ায় কিছুটা তটস্থ হয়ে একবার নোমানের দিকে চাইছে তো একবার মেয়েটির দিকে। ব্রাশ করা বন্ধ হয়ে গিয়েছে তার। নোমান ছেলেটা বেশ শান্তশিষ্ট হলেও রাগ করলে ব্যাপারটা সুবিধাজনক আর থাকে না। দুজনের এমন ঝগড়ার মাঝেই অভিরূপের মাথায় প্রশ্ন খেলে যায় একটা। এই মেয়েটা আবার রাশেদ আঙ্কেলের মেয়ে রাগিনী নয় তো? ঢক গিলে আস্তে করে এগিয়ে এসে নোমানের পাশে দাঁড়ায় সে। মুখ ভর্তি পেস্টের ফেনা। তবুও নোমানের কাছে মুখ এগিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলার চেষ্টা করল,
“এই এখানেই থেমে যা। মনে হচ্ছে এই মেয়েটা রাগিনী!”

নোমান এবার একটু নিজেকে সামলায়। গলা খাঁকারি দিয়ে কঠোর দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকায়। উর্মিলা রাগে ফুঁসছে। নিজের হাতে যত্ন করে ভাঙা চশমা তুলে আফসোসের সাথে বলল,
“আমার পছন্দের চশমাটা। কত কষ্ট করে এতো সুন্দর ফ্রেম পেয়েছিলাম। সেটাও ভেঙে গেল।”

ঝগড়ার কথোপকথন রাগিনীর ঘর অবধি এসেছিল। বিশেষ করে উর্মিলার এমন রাগি কন্ঠ শুনে তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ির কাছে চলে এসেছে রাগিনী। দ্রুত বেগে সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতেই দেখতে পেয়ে যায় উর্মিলার সাথে আরো দুটো পুরুষকে। একজনকে দূর থেকে চিনতেও ভুল হয় না এক মূহুর্তও। মুখে ব্রাশ নিয়ে মুখটা ফুলিয়ে রেখেছে সে। এলোমেলো ঝাঁকড়া চুলে কোনোরকম চিরুনি পড়েনি এখনো। গোল গোল চোখ দুটো রাগিনীর দিকে স্থির হয়েছে। রাগিনী নিজেকে সামলে নিল। পায়ের বেগ কমতে লাগলো। ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নামল। নিজের গলায় দলা পাকানো কথাগুলো কোনোরকমে উগড়ে বলল,
“কী হয়েছে, উর্মিলা? উপর থেকে তোর গলা পেলাম!”

রাগিনীকে দেখেই উর্মিলা প্রায় কেঁদেই ফেলে। কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে দুর্বল সুরে বলে,
“এই অভদ্র ছেলেটা আমার চশমা ভেঙে ফেলেছে।”

বলেই নোমানের দিকে ইশারা করিয়ে দেখিয়ে দেয় উর্মিলা। নোমান হতভম্ব। সামান্য চশমার জন্য এভাবে কেউ কেঁদে ফেলে নাকি? কিন্তু তাতে তার কী? নোমান ক্ষিপ্ত সুরে বলে,
“আবারও আমার দোষ দিচ্ছেন? মস্তিষ্ক তো পুরোটাই ফাঁকা।”

“দেখেছিস দেখেছিস? আমাকে ইন্ডাইরেক্টলি গাধা বলে ইনসাল্ট করছে। আপনি গাধা।”

নোমান বিদ্রুপের হাসি হেঁসে বলে,
“কে গাধা সে নিজে স্বীকার করে নিয়েছে।”

উর্মিলা লাল চোখে তাকায়। কাঁদবে নাকি রাগবে বুঝে উঠতে পারে না। এই মূহুর্তে সবথেকে অসহ্যকর লাগছে সামনে থাকা এই লোকটাকে। দশ তালার ছাঁদ থেকে টুক করে যদি ধা’ক্কা মে’রে ফেলে দিতে পারত তাহলে বোধহয় খুব শান্তি আসতো মনে। রাগিনী ততক্ষণে যা বোঝার বুঝে গেছে। সে উর্মিলার কাঁধে হাত রেখে চুপি চুপি বলে,
“উনারা আমাদের গেস্ট। প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড, উর্মি! তাও যেমন তেমন গেস্ট নয়। সিলেব্রিটি গেস্ট। তোর সামনে কিন্তু অভিরূপ চৌধুরী দাঁড়িয়ে।”

অভিরূপের নামটা শুনেই যেন উর্মিলা আপনা-আপনি শান্ত হলো। উত্তেজনা নামক অনুভূতিটা তড়তড় করে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। তার গান কে না শোনে? কী সুন্দর সুকন্ঠের অধিকারী! ইন্সটাগ্রামের কতশত ফলোয়ার। একটা ছবি আপলোড করলেই মিনিটেই কতগুলো করে রিয়েক্ট পড়ে। তার মারাত্মক হাসিতে তো মেয়েগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আর এখন রাগিনীর কথা শুনে উর্মিলা থরথর করে কাঁপছে। সে খেয়াল করেনি সেখানে আরো একজন উপস্থিত ছিল। এবার না চাইতেও নজর চলে যায় ব্রাশ মুখে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অভিরূপের দিকে। কীভাবে সে দেখছে। নিশ্চয় মনে মনে ভেবে নিয়েছে মেয়েটা পাগল! এবার পা থেকে মাথা অবধি পর্যবেক্ষণ করল উর্মিলা। হ্যাঁ, এ তো সত্যিই অভিরূপ! স্বপ্ন নয়। মাথাটা ভনভনিয়ে ঘুরল। ভালো করে নোমানের দিকে চেয়েও বুঝল একেও সে দেখেছে। অভিরূপের অনেক ইন্টারভিউ আর তার ইন্সটাতেও। দুই বেস্টফ্রেন্ডের একসাথে ফটোশুটও অনেকবার চোখে পড়েছে উর্মিলার! কত বড়সড় ব্যক্তি। তার সঙ্গে গলা উঁচিয়ে ঝগড়া করে ফেলল?

এতক্ষণ যেন নিজের ভুল ভেবেই উড়িয়ে দিচ্ছিল অভিরূপ। মনে হয়েছিল সকালের ঘুমটা এখনো কাটেনি। এমনি সেই সাহসী নেত্রপল্লব দিনে-রাতে, ঘুমিয়ে না ঘুমিয়েও দেখতে পায়। তাই সামনে থাকা স্বয়ং রাগিনীকেও নিজের ভ্রম ভাবছিল সে। কিন্তু এখন বুঝেছে এইতো সে! নিজের উত্তেজনা সামলে রাখতে না পেরে নোমানের কাঁধ ধরে বড়সড় লাফ দিয়ে উঠে আনন্দের সহিত চিৎকার দিয়ে উঠল সে। সকলে চমকে গেলেও উর্মিলা টলে পড়ল। তার আগে বিরবির করে বলল,
“এখন আমার কী হবে!”

রাগিনী কোনোরকমে উর্মিলাকে ধরতে গিয়ে হিমশিম খেতে হলো। না পেরে সাহায্য করতে এলো নোমান। একটু অস্বস্তি হলেও সাহায্যের উদ্দেশ্যে মেয়েটির ঠান্ডা হাত স্পর্শ করল। সেও বিরবির করে বলে উঠল,
“নির্ঘাত মেয়েটার মাথায় সমস্যা! নয়ত অযথা কেউ সেন্স হারায়? অভিরূপ কি কম ছিল যে এই মেন্টাল মেয়েটাও এসে জুটলো?”

বদ্ধ ঘরে সৃষ্টি হয়েছিল এক গুমোট পরিস্থিতি। অসহ্যকর এক গন্ধ আর ধোঁয়াশা ভরা ঘরটাকে একটু নিস্তার দেওয়া প্রয়োজন। তাই বড় জানালার পর্দা সরিয়ে থাই গ্লাসটা খুলে দিল এক পুরুষ। চোখেমুখে আলো পড়তেই চোখমুখ কুঁচকে এলো তার। সহ্য হয় না তার এতো আলো। অন্ধকার বেশ ভালোবাসে সে। নিস্তব্ধ পরিবেশে সে শান্তি খুঁজে পায়। সেকারণেই তো পুরো শহরটাকে নিস্তব্ধ বানাতে উঠেপড়ে লেগেছে। কলিংবেল বাজলো বাহিরের দরজায়। ঘাড় ঘুরিয়ে সে তাকাল। এলোমেলো পায়ে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাহিরের ছোট ড্রয়িং রুমটার শেষ মাথায় থাকা দরজার লকটা খুলতেই বাড়িতে হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করল এক নারীজন। চোখেমুখে আতঙ্ক। কপাল ভর্তি ঘাম! রীতিমতো হাঁপিয়ে চলেছে। ঘরে ঢুকেই মূহুর্ত অপেক্ষা না করে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে দরজায় ঠেস মেরে মাস্ক খুলে বড় বড় শ্বাস নিতে থাকল সে। তাতে মানবটির কোনো ভ্রুক্ষেপ হলো না। সে নিজের প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক রেখে লম্বা ডিভানের কাছে গিয়ে তার পাশে শোপিসের মতোই সাজিয়ে রাখা বড় কাঁচের বোতলটা নিলো। পাশেই ছিল ছোট কাঁচের দুটো গ্লাস। বোতলের মুখ খুলে গ্লাসে ঢেলে নিলো তরল পদার্থ। ছেয়ে গেল ঘরটা এক বাজে গন্ধে। একটা গ্লাস সে নিজে নিয়ে চুমুক দিয়ে আরেকটা সেই নারীর দিকে বাড়িয়ে বলল,
“হাঁপিয়ে গেছো বুঝি? টেক ইট। ঠান্ডা করো নিজেকে।”

মেয়েটি লম্বা শ্বাস নিতেই ব্যস্ত। তবে এতোকিছুর মাঝেও যে তার সামনে থাকা লোকটা কী করে শান্ত থাকে খুঁজে পায় না সে। এখন সে রিল্যাক্স ফিল করছে? মেয়েটি শুধু গ্লাসটা হাত দিয়ে নিলো। তবে মুখ দিল না। ঢক গিলে কিছু বলতেই তার আগেই ডার্ক ম্যাক্স বলে ফেলল,
“তোকে বার বার এখানে যখন তখন আসবি না। সন্দেহ করবে আশেপাশের লোক। লেডি বস! তোর থেকে এতো বোকামি আশা করা যায় না।”

“আমি ইচ্ছে করে এখানে আসিনি। উপায় ছিল না। অনেক কথা ছিল। ইম্পরট্যান্ট কথা। যেটা না বললে হবে না। গতরাতে অনেক কিছু ঘটে গিয়েছে।”

“কী এমন ঘটল আবার?”

লেডি বস এবার বড় শ্বাস নিয়ে বলা শুরু করল,
“গতরাত কিছু কাজে আমি বের হই। নিজের কাছে কোনোরকম অ’স্ত্র রাখিনি। কারণ পুলিশের চেকপোস্ট দিন দিন বাড়ছে। কয়েকজন ছেলে আমাকে তাড়া করে। আমি নিজেকে বাঁচাতে জঙ্গলে যাই আর ভাগ্যক্রমে অভিরূপ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় আমার।”

ডার্কের এবার টনক নড়ে। সরু চোখে তাকায়। এবার বেশ মনোযোগের সহিত বলে,
“তারপর?”

“সে আমাকে বাঁচায়।”

ডার্ক কিছুক্ষণ নীরব থেকে হঠাৎ ফিচেল হেসে মুখে গ্লাস ঠেকিয়ে সবটা পান করে। তারপর শব্দ করে হেঁসে বলে,
“ওহ ওয়াও! ইট ইজ লাইক সিনেমা ওর ড্রামা! হিরো হিরোইনকে বাঁচিয়ে নিল? কিন্তু তুই তো হিরোইন না। ভিলেন!”

“কথা সেটা নয় ডার্ক ম্যাক্স। সে আমাকে রাগিনী বলে সম্মোধন করেছে। আর আজ কবীর খবর দেয়, রাগিনীর বাবার সাথে নাকি অভিরূপের বাবার ভালো সম্পর্ক হওয়ায় অভিরূপ হোটেল ছেড়ে রাগিনী তাজরীনের বাড়িতে উঠেছে।”

কথাটা কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্রই যেন ডার্কের স্বচ্ছ সাদা পর্দার মাঝে মার্বেলের মতো চোখের মণি দুটো চকচক করে উঠল। ঘাড় কাঁত করে বলল,
“রিয়েলি! এটা তো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। তোকে সে রাগিনী বলে বিশ্বাস করেছে। আর রাগিনীর বাড়িতে সে উঠেছে। আমাদের পক্ষে তো রাস্তা আরো সোজা হয়ে গেল।”

মুখটা কাঁচুমাচু করে থাকে লেডি বস। চোখটা নামিয়ে নেয়। জড়তা কাটিয়ে আবারও বলে,
“কিন্তু খারাপ খবরও আছে একটা।”

ডার্কের নয়নে নেমে এলো আবারও তীব্র ক্ষিপ্রতা। ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করল বিষয়টা জানাতে। গলা শুঁকিয়ে এলো মেয়েটার। ঠোঁট ভিজিয়ে কোনোরকমে বলল,
“আমরা রাগিনীর ব্যাপারে সব নিয়ে যা জেনেছি গত বেশ কয়েকদিনে রাগিনী কোহিনূর নামক একটা মেন্টাল পেশেন্টের সঙ্গে বেশি সময় কাটাচ্ছে। গতকাল রাতে অভিরূপের কোনোরকম সন্দেহ হওয়ার আগে একরকম পালিয়ে আসতে সেই মেন্টাল হসপিটাল অতিক্রম করতে হয় আমায়। পেছনের রাস্তা দিয়ে যেতে আমি ওই কোহিনূরকে দেখতে পাই।”

কথার মাঝে থামে লেডি বস। চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে আসে তার। ঘাম যেন বেশিই ঝরতে থাকে। সেই সময় ডার্কের গম্ভীর গলা পেয়ে ভয়ে যেন কাঁপুনিও ধরে যায়।
“তো? কী এমন হলো? সে তো একটা পাগলই। পাগল তোকে পেলেও ভুলেও যাবে। আর…”

ডার্কের কথার মাঝে সে বাগড়া দিয়ে তড়িঘড়ি করে বলে,
“না। সে মেন্টাল পেশেন্ট হতেই পারে না। সে পুলিশের লোক। আমার যতদূর মনে হলো সে কোনো সিক্রেট টিমের মেম্বার। সে রাগিনীকে সন্দেহ করে পাগলের বেশে সেখানে রয়েছে।”

ডার্কের চোখেমুখে এবার উচ্ছ্বাস ফুটে ওঠে। ঝলমলে হাসি দিয়ে ডিভানে একটা থাবা দিয়ে বলে,
“এ তো গুড নিউজ। তার মানে আমাদের প্ল্যানিংটা সাকসেসফুল হয়েছে। পুলিশের লোক রাগিনীকে সন্দেহ করে এগোচ্ছে। আর এদিকে ওদের এমন ভুল ধারণাকে কেন্দ্র করে এই গোটা শহরে ধ্বংসলীলা চালানো সহজ হবে! ও মাই গড! আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে!”

ডার্ক ম্যাক্সের আনন্দ বেশিক্ষণ টিকলো না। আনন্দে পানি ঢেলে দিয়ে লেডি বস বলল,
“না ডার্ক ম্যাক্স। এতোটা বোকা পুলিশের লোক হয়নি এখনো। তারা ধরতে পেরেছে রাগিনীর মতো অন্যকেউ আছে। কাল প্রথমে ওই কোহিনূর আমায় রাগিনী ভেবে ভুল করলেও এক মূহুর্তেই চিনে ফেলে আমি সে নই। সে আমাকে ধাওয়া করেছে অনেক পথ। আমি ভাগ্যক্রমে বাঁচি। তারা বুঝে গেছে রাগিনী তাজরীন ফাঁসানো হচ্ছে।”

ডার্কের চোখে নেমে এলো অন্ধকার। সঙ্গে সঙ্গে হাতে থাকা গ্লাসটা চেপে প্রচন্ড ক্রোধের সহিত ফ্লোরে ছুঁড়ে মা’রল সেই গ্লাস। বিকট শব্দে চমকে উঠল লেডি বস। ডার্কের দপদপ করতে থাকা কপালের রগটা যেন বেরিয়ে আসবে যেকোনো মূহুর্তে। কিছুক্ষণ চলল নীরবতা। ডার্ক গভীর ভাবনায় ডুব দিয়েছিল যেন। কিছুটা সময় নিয়ে হঠাৎ লেডি বসের দিকে তাকাতেই চোখমুখ আপনাআপনি শুঁকিয়ে এলো তার। ধীর পায়ে যেন ডার্ক এগিয়ে এলো কম্পন বেড়ে গেল তার। কিছু বলতে চাইতেও পিছিয়ে এলো। ডার্ক তার এক হাত ধরে কাঁধের জামা টেনে ধরে বলে,
“এসব স্টাইলিশ পোশাক বাদ দে। রাগিনী তাজরীন কীসব যেন পড়ে? কামিজ, লং ড্রেসগুলো। যেগুলোর অভ্যেস যত দ্রুত করবি ততই ভালো।”

বলার পরপরই ডার্ক ম্যাক্স বেশ রূঢ় ভাবে মেয়েটির চুলের মুঠি টেনে ধরে। চোখ খিঁচে সে কুঁকড়ে উঠতেই ডার্ক থেমে থেমে বলে,
“একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ, তোকে এখানে রূপাঞ্জনা হিসেবে আনি নি। এনেছি রাগিনী তাজরীন হিসেবে। তাই রাগিনীর সম্পূর্ণ রূপ তোকে ধারণ করতে হবে। তোর নাম যে কখনো রূপাঞ্জনা ছিল সেটা ভুলে যা। আর রাগিনীর ওই অপরূপ রূপটাই ওই কোহিনূরকেও শে’ষ করবে সেই সাথে দ্যা ফেমাস অভিরূপ চৌধুরীকেও। রাগিনী তাজরীন নিজেও জানে না সে ডার্ক ম্যাক্সের তুরুপের তাস!”

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। একটু ব্যস্ততা থাকায় দিতে দেরি হলো গল্প। আজকে নিশ্চয় রাগিনীর মতো দেখতে সেই নারীকে নিয়ে ডাউট থাকবে না! যারা দ্রুত জট খুলতে বলেছিলেন তাদের জন্যই এটা। বাকিটা আমি আমার থিম অনুযায়ী খুলব। আর যারা কোহিনূর এবং রাগিনীকে একসঙ্গে মিস করছেন তারা একটু অপেক্ষা করুন। কালকের পর্বে তারা থাকবে। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here