গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে – পর্ব ৪

0
422

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪

আকস্মিক কোহিনূরের এমন জড়িয়ে ধরাতে হতবাক হয়ে কোনোরকম কথা ছাড়াই চোখ গোল গোল করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রাগিনী। সকাল সকাল এমন চমক পেয়ে মাথা ঘুরছে তার। সেই সাথে গিজগিজ করছে বেশ কিছু প্রশ্ন! কোহিনূর কি করে তার বাড়ি চিনলো? আর এলোই বা কিভাবে? সব মিলিয়ে রাগিনী কি বলবে বা করবে ভেবে পাচ্ছে না। অন্যদিকে দারোয়ান চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। কখন যেন চোখ দুটো বের হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খাবে তার ঠিক নেই। একটা শুঁকনো ঢক গিলে কোহিনূরকে আলতো ধাক্কা দিয়ে সরে আসার চেষ্টা করল রাগিনী। তবে কোহিনূর তাকে ছাড়তে চাইলে তো? বরং সে নিজের গায়ের জোর দিয়ে এতোটাই শক্ত করে চেপে ধরে যেন রাগিনী হাড় মাংস কখন যেন এক হয়ে যাবে। চোখ দুটো বেরিয়ে আসার উপক্রম রাগিনীর। পিঠের হাড় কখন যেন ভেঙে যায়। এতো জোরে ধরার কি আছে? ব্যথায় হঠাৎ চোখমুখ খিঁচে ফেলে সে। বিরবির করে বলে,
“ইশশ… কোন জন্মের শত্রুতা পালন করছে কে জানে!”

যখন রাগিনীর দম বন্ধ হয়ে আসার পরিক্রম তখনি রাগিনী চিল্লিয়ে বলে ওঠে,
“কোহিনূর, আপনি এটা কি করছেন? এটা কেমন ধরণ জড়িয়ে ধরার? ছাড়ুন আমাকে!”

“না! তোমাকে ছাড়লে তুমি আবার এই বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়বে। আবার আমি একা হয়ে যাব।”

রাগিনীর চোখমুখ অন্ধকার হয়ে আসছে। তবুও সে ক্ষুদ্ধ হলো না কোহিনূরের উপর। আসলে হওয়া যায় না তার উপর ক্ষুদ্ধ। তার শিশুসুলভ কথা ক্রোধকে যেন নিমিষেই গলিয়ে ফেলে। এভাবে কাউকে রাগ দেখানো যায় নাকি? রাগিনী দাঁত চেপে বলে,
“আমি বাড়ির ভেতরে যাব না। আই প্রমিস! কাল যেমন আমাকে বিশ্বাস করেছিলেন। আজকেও তেমন আমাকে বিশ্বাস করে ছেড়ে দিন। আমার শ্বাস নিতেও যে কষ্ট হচ্ছে। আপনার বন্ধুর কষ্ট হক আপনি কি চান?”

কোহিনূর বোধহয় এবার আশ্বস্ত হয়। আস্তে আস্তে হাতের বাঁধন হালকা করে। রাগিনী সরে আসে। মাথা নিচু করে। এই মূহুর্তে তার লজ্জা করছে ভীষণ! কারণ সামনেই তার থেকে বয়সে বেশ বড় লোক দাঁড়িয়ে। দারোয়ানকে মামা বলেই ডাকে সে। তার সামনে একটা অযাচিত পুরুষ তাকে নিমিষেই আবদ্ধ করে দেহের সঙ্গে যে মিশিয়ে নিয়েছিল। দারোয়ান মামার দিকে আর তাকাতে পারছে না সে। তবে তিনি নিজেই বলে ওঠেন,
“এই পোলাডা একটা পাগল। আপনি ভেতরে যান রাগিনী মনি। আমি কয়েকজন লোক ডাইকা এরে বের করার ব্যবস্তা করতেছি। কত্ত বড় সাহস! রাগিনী মনির সাথে এমন ব্যবহার করে।”

রাগিনী এবার কিছুটা বিচলিত হয়। দ্রুত উত্তর দেয়,
“না মামা। এমন কোনো কিছু করার দরকার নেই। এই লোকটাকে আমি চিনি। এমন কিছু করবেন না।”

“রাগিনী! তোমার বাড়িতে নিয়ে যাবে না?”

থতমত খেয়ে কোহিনূরের নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকায় রাগিনী। কোহিনূর এমন একটা করে কথা বলে যে উত্তর দিতে বেশ সময় লেগে যায় তার। বাড়িতে তার বাবা আছে। নিয়ে গেলে হয়ত প্রশ্ন করবেন। তবুও মুখে একটা ছোট্ট হাসি বজায় রেখে রাগিনী পাল্টা প্রশ্ন করে,
“অবশ্যই নিয়ে যাব। তার আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো! ওখান থেকে মানে আপনি যেখানে থাকেন সেখান থেকে কিভাবে আমার বাড়ি চিনে এলেন?”

কোহিনূর চুপ হয়ে যায়। মাটির দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকে। তারপর অগোছালো আর শুষ্ক চুলে হাতে দিয়ে চুলকায়। রাগিনী উৎসুক নয়নে তাকিয়ে থাকে উত্তর শুনতে। তবে তাকে নিরাশ করে দিয়ে কোহিনূর ঠোঁট উল্টিয়ে মিনমিন করে বলে ওঠে,
“মনে নেই।”

রাগিনী হতাশা পূর্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে এক ধ্যানে। কোহিনূর পুরো বড় সাদা সুন্দর বাড়িটা দেখতে থাকে আপনমনে। তারপর নিজ মনেই হেঁসে উঠে বলে,
“তুমি এতো সুন্দর বাড়িতে থাকো? তুমি বলেছো আমাকে নিয়ে যাবে ভেতরে। চলো তাহলে! আমাকে বাড়ি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাবে।”

রাগিনীর উত্তর না নিয়েই কোহিনূর নিজ থেকে বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে কৌতূহলের সঙ্গে প্রবেশ করে। রাগিনী তা দেখে তার পিছু পিছু ছুটে যায়।
“আ…আপনি দাঁড়ান!”

কে শোনে কার কথা? রাগিনীর কথা যেন কোহিনূরের কান অবধি পৌঁছালো না। হলরুমে পা রাখল কোহিনূর। তখনি সিঁড়ি দিয়ে ধীর পায়ে নামছিলেন রাশেদ সাহেব। চশমাটা পড়তে পড়তে উনি কিছুটা জোর সুরেই বলে উঠলেন,
“এতো চেঁচামেচি কীসের হচ্ছিল বাহিরে? সায়েদুল! কোনো ঝামেলা হয়েছে নাকি?”

বাড়ির দারোয়ান সায়েদুলকে ডেকে উঠলেন উনি। তখনো তিনি কোহিনূরকে খেয়াল করেন নি। শেষ সিঁড়িতে নেমে হঠাৎ সোফার কাছে অচেনা মুখ দেখে স্বাভাবিকভাবেই চমকে উঠলেন,
“এই কে তুমি? আমার বাড়িতে কি করছো? সায়েদুল! আমার বাড়িতে কাকে ঢুকতে দিয়েছো অনুমতি ছাড়া?”

পিছু পিছু কিছুটা দৌড়েই এসে কোহিনূরের কাছে দাঁড়ায় রাগিনী। যা ভয় পাচ্ছিল তাই হয়েছে। তার বাবার ঘুম ভেঙে গিয়েছে। রাগিনী রাশেদ সাহেবকে শান্ত করার জন্য বিচলিত সুরে জবাব দেয়,
“বাবা, শান্ত হও। উনি কোহিনূর! মনে আছে? কাল যার কথা বলছিলাম!”

রাশেদ সাহেবের উত্তেজনা কমলো কিছুটা। উনার হার্টের সমস্যা আছে। একটুতেই উত্তেজিত হয়ে পড়েন। এজন্যই রাগিনী ভয় পাচ্ছিল। রাশেদ সাহেব কিছুটা গাম্ভীর্য ধারণ করে বললেন,
“হ্যাঁ মনে আছে। কিন্তু ও এখানে কি করে?”

রাগিনী মাথা নিচু করে মাথা নাড়ায়। অর্থাৎ সে নিজেও জানে না। রাশেদ সাহেব আর কোনো প্রশ্ন করেন না। দৃঢ় দৃষ্টি রাখেন কোহিনূরের দিকে। তবে কোহিনূরের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তাতে। সে বাড়ির আশেপাশের পরিবেশ দেখতে মগ্ন। উপরে বড় ঝাড়বাতি, সোফা, কাঁচের চকচকে জিনিসপত্র বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখছে সে। রাশেদ সাহেব শুধু তার অঙ্গিভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করছেন এবং অপেক্ষায় আছেন রাগিনী কি করে তাকে সামলায় সেটা দেখার জন্য। কারণ সে নিজ থেকে কোহিনূরের সুস্থতার দায়িত্ব নিয়েছে। আর রাশেদ সাহেব নিজেও একজন ডক্টর। তাকে শেখানো হয়েছিল একটা পেশেন্টকে কখনো অবহেলা করা উচিত না। তাই সে কোনোরকম রিয়েক্ট করছে না। কোহিনূর সব দেখে দেখে রাগিনীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে উঠল,
“এতো বড় বাড়িতে তুমি একা থাকো?”

“না। আমার বাবা থাকেন। ওইযে আমার বাবা।”

কোহিনূর এতোক্ষণ খেয়ালই করেনি সামনে থাকা রাশেদ সাহেব কে। দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে দেখে মাথা নাড়ালো সে। তারপর আচমকা সে বলে উঠল,
“আমার অনেক খিদে পেয়েছে। যেহেতু তোমার বাড়ি এসে গেছি! তুমি এখন রান্না করে খাওয়াবে!”

আবারও অবাক হয় রাগিনী। বাবার দিকে তাকায় একবার। রাগিনীর চুপ থাকা দেখে কোহিনূর আবারও বলে,
“তোমার রান্না করা খাবার না খেয়ে কিন্তু আমি যাব না!”

বলেই ফ্লোরে জেদ ধরে বসে পড়ল কোহিনূর। রাগিনী দোটানায় কিছু বলতে পারছেও না আবার সহ্যও করতে পারছে না। বাবার দিকে আবারও অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় সে। রাশেদ সাহেব মেয়ের দৃষ্টি বুঝতে পারেন। আর চোখ বুঁজে ইশারা করে মেয়েকে আশ্বাস দেন। বাবার এমন ইশারা দেখে রাগিনী সাহস পায়। আর তড়তড় করে বলে ওঠে,
“আমি আপনাকে রান্না করে খাওয়াব। কিন্তু এটা তো বসার জায়গা নয়। আপনি উঠুন। সোফায় বসুন। আমি রান্না ঘরে যাই?”

কোহিনূর খুশি হয়। হাসিটা বেড়ে যায়। ঘন চাপ দাড়িপূর্ণ গালে হালকা টোল সৃষ্টি হয়। তার হাসিটা যেন রাগিনীর তার প্রতি করা কাজ করতে বাধ্য করে। তবে কোহিনূর আবারও বলে বসে,
“আমি এখানে না। তোমার ঘরে যাব। নিয়ে চলো। সেখানে চুপচাপ বসে থাকব প্রমিস!”

এবার রাগিনী তাকে মানা করতে গেলেও রাশেদ সাহেব বারণ করেন তাতে। তিনি সৈয়দ অর্থাৎ বাড়ির কর্মরত কাজে সাহায্যকারীকে ডেকে বলেন কোহিনূরকে রাগিনীর ঘরে নিয়ে যেতে বলে। আর কোহিনূরের দিকে চেয়ে বলেন,
“তুমি ওর সাথে যাও। ও রাগিনীর ঘরে নিয়ে যাবে তোমাকে।”

কোহিনূর তাড়াতাড়ি করে সৈয়দের সাথে যেতে প্রস্তুত হয়। সৈয়দের সাথে বেশ আনন্দের সাথে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায়।

কোহিনূর যাবার পরপরই রাগিনী রাশেদ সাহেবকে কিছু বলতে চায়। রাশেদ সাহেব সেটা বুঝে তার কিছু বলার আগে বলতে শুরু করে,
“তার যা কন্ডিশন আমি দেখলাম তার কথা না মানলে বা তাকে শান্ত না রাখলে হিতে বিপরীত হবে। তাকে হ্যান্ডেল করা তোমার পক্ষে সহজ হবে না। তোমার জন্য বিপদ হতে পারে। আমার মনে হয় তোমার এসব থেকে দূরে থাকা উচিত!”

“বাবা আমি এখন থেকেই যদি ভয় পাই তবে কি করে ভবিষ্যতে আমি পেশেন্ট হ্যান্ডেল করব? আমার একটা সুযোগ চাই।”

রাশেদ সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভাবলেশহীন হয়ে পড়েন। অতঃপর শেষে জবাব দেন,
“ঠিক আছে। তবে সাবধানে থাকবে। তুমি যখন এতো করে বলছো তখন চেষ্টা করতে পারো।”

তা শুনে কৃতজ্ঞতা মূলক হাসি দেয় রাগিনী। আর বলে,
“ঠিক আছে। আমি ফ্রেশ হয়ে নিচ্ছি। তারপর তোমাকে কফি বানিয়ে দিচ্ছি।”

সকালের খাবার নিজ হাতে বানাচ্ছে রাগিনী। গায়ে এপ্রোন জড়িয়ে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে খাবার বানাচ্ছে সে। ব্যস্ত হয়ে রান্নাঘরের এদিক ওদিক তোলপাড় করছে। হাত দিয়ে আটা মাখতে মাখতে হাতে আটা লেগে যাওয়ায় বেশ বিরক্ত সে। যেন পৃথিবীর সবচেয়ে বিরক্তিকর কাজ এটা। কোনোমতে আটা মাখানো শেষ করে হাতটা ধুয়ে নিয়ে উদ্যত হয় সে। তৎক্ষনাৎ কোনো ভারি বস্তুর সাথে মাথা ঠুকে গেলে বিরক্তির সীমা পার হয় তার। আটা মাখা হাতে তা ঠেলে দিয়ে বলে,
“ধুর ধুর! এটা আবার কি জিনিস?”

কিছুটা দূরে যেতেই তার মনে হয় এটা একটা প্রশস্ত বুক। মাথা উঁচিয়ে তাকায় সে। কোহিনূরের চেহারা দেখামাত্র ভড়কে দুই পা পিছিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“একি আপনি!”

কোহিনূর এবার হাসে। তার এবারের হাসিতে সেই শিশুসুলভ ভাবটা দেখতে পেল না রাগিনী। ঠোঁট বাকিয়ে হাসছে। তারপর কোহিনূরের শীতল সুর বেজে ওঠে রাগিনীর কানে,
“মে আই হেল্প ইউ, রাগিনী?”

চলবে…

[বি.দ্র. আজকের পর্বটা কিছুটা ছোট হয়েছে। তার জন্য দুঃখিত। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here