#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩১
জঙ্গলের ভেতরটা পুরোটা অন্ধকার। উপরের সেই চাঁদের আলো গাছের বড় বড় ডালপালা ভেদ করে মাটি স্পর্শ করতে পারছে না। একপ্রকার অন্ধের মতো নিজের সব শক্তি লাগিয়ে ইচ্ছেমতো একদিকে দৌড়ে চলেছে এক মানবী। চোখেমুখে আতঙ্ক স্পষ্ট। হৃদয়ের কম্পন বেড়ে চলেছে ভীতিতে। মাথায় যত্ন করে করা ছোট চুলের খোঁপার অবস্থাও করুন। প্রায় খুলে এসেছে। চুলগুলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। পায়ে ব্যথাও পেয়েছে বেশ। তবুও যে থামা যাবে না। ছুটতে হবে যদি সম্মান বাঁচাতে হয়। তবে বিধি বাম। এই অন্ধকারে মাথা গিয়ে খুব জোরে ঠুকে গেল মেয়েটির। কপালে অসহ্যরকম যন্ত্রণা করে উঠলো। খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ল। মাটিতে বৃষ্টির কারণে জমেছে কাঁদা। সেই সাথে বড় বড় গাছের পাতা। মেয়েটি আশেপাশে পাগলের মতো হাতাতে থাকে। নিজেকে রক্ষা করার মতো কোনো কিছুই পায় না। হঠাৎ সুক্ষ্ম আলোর দেখা মেলে। তড়িঘড়ি করে হামাগুড়ি দিয়ে একটা গাছের পেছনে লুকায় মেয়েটি। আড়াল থেকে দেখতে থাকে তাকে সেই চারজন বখাটে ছেলে গুলো খুঁজে চলেছে। মুখে রয়েছে অশ্রাব্য গালাগাল। এই প্রথম এমন কোনো পরিস্থিতির শিকার হয়েছে সে। জানা ছিল না নিজের সম্মান হারানোর ভয়টা এতো তীব্র। মাথাটা ভনভন করে ওঠে তার। গাছটা শক্ত করে ধরে থাকে। চোখটা বুঁজে গাছের সাথে মাথা লাগিয়ে দেয় সে। মিনিট দুয়েক সেভাবে থেকে সরাসরি যখন চোখে আলো লাগে চোখটা খিঁচে ফেলে সে। নেত্রপল্লব মেলতেও খানিকটা কষ্ট হয়। বুকটা ধক করে ওঠে। তার সামনেই সেই চার জন ছেলে লাইট ধরে হাসাহাসি করছে। উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই তার। বসে থেকে কিছুদূর পিছিয়ে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করল সে। সকলের নিকৃষ্ট হাসি দেখে মনে হচ্ছে এখানেই সব শেষ। না চাইতেও যে চোখ দিয়ে সহজে পানি পড়ে না সেই চোখ দিয়ে পানির ধারা ছুটতে লাগলো। ছেলেদের মধ্যে একজন এগিয়ে বলল,
“আরে মামনি! এভাবে হন্তদন্ত হয়ে কোথায় ছুটছিলে? লাভ আছে কোনো? সেই তো আমাদের কবলেই পড়তে হলো।”
চোখ থেকে অশ্রু বেরিয়ে আসা সেই অপরূপ নারীর দিকে নিচু হয়ে বসে পড়লো ছেলেটি। তার গালে ছেলেটি তার বিশ্রী স্পর্শ ঠেকাতেই তার শরীর জন্য ঘৃণায় রি রি করে উঠলো। শরীরের বাকি শক্তিটুকু দিয়ে নিজের পা উঠিয়ে ছেলেটির বুক বরাবর সজোরে লা’থি মে’রে বসলো। টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে গিয়ে খানিকটা দূরে পড়লো ছেলেটি। বেশ কষ্ট সহ্য করে উঠে দাঁড়ালো সেই মানবী। কোনো কিছুর পরোয়া না করে ছুট লাগালো সে আঘাত লাগা পায়েই। তবে তার মনে হলো সে বেশিক্ষণ নিজেকে বাঁচাতে পারবেনা। কিন্তু শেষ চেষ্টা করতে ক্ষতি কী? বেশিদূর এগোতে পারলো না। পা দুটো অসার হয়ে এলো। যেখানে এসে থামবে সেখানেও প্রশস্ত কিছুর সাথে জোরেশোরে ধা’ক্কা খেলো আবারও। মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে ‘উহ’ শব্দটা বের করলো সে। তৎক্ষনাৎ লাইট তার দিকে ধরা হলো। মেয়েটির মনে ধরা দিল আশঙ্কা। ছেলেদের মধ্যে একজন আবারও তাকে ধরে ফেললো? না চাইতেও তার মুখ দিয়ে মিনতির সুরে বেরিয়ে এলো,
“প্লিজ, আমাকে ছেড়ে দিন! যেতে দিন আমাকে।”
“আরে! আমি আপনাকে ধরলাম কখন?”
এই চিকন কন্ঠস্বরে যেন কোনোরকম জটিলতা নেই। সেখানে মেয়েটি পেলো না কোনো নিকৃষ্টতা। বরং কোথাও একটা ভরসার আশা জমা হলো। পিটপিট করে চোখ খুলল সে। অচেনা হয়েও চেনা লাগলো সেই মুখ। সেই দৃষ্টির মাঝে রয়েছে বিস্ময়। অর্থাৎ লোকটাও তাকে দেখে অবাক। এবার লোকটির মুখ ফুরে বেরিয়ে এলো একটা নাম।
“রাগিনী!”
চোখ গোল গোল করে তাকালো মেয়েটি পোশাক ভর্তি কাঁদা লেগে আছে। ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। মনে একটাই প্রশ্ন! সে রাগিনী নামটা জানলো কী করে? হঠাৎ কানে এলো ছেলেগুলোর বাজে কথাবার্তা। মেয়েটির মনে জানান দিলো বাঁচতে হলে হয়তবা এই লোকটাই একমাত্র ভরসা! হাত-পা অনবরত কাঁপতে থাকলো তার। কি করে সাহায্য চাইবে সেটাও বুঝে উঠতে পারলো না সে। উপরন্ত মাথা ঘুরছে। টলমল করতে করতে হঠাৎ যখন সেই পুরুষালী হাতটা তাকে স্পর্শ করলো পুরো শরীরে বয়ে গেল এক আলাদাই কম্পন। অভিরূপ তাকে টেনে নিয়ে গভীর আবেশে এক হাতে ধরে বলল,
“আর ইউ ওকে? আমি ভেবেছিলাম আপনি স্ট্রং গার্ল! আমার ধারণা পাল্টে দিচ্ছেন আপনি।”
ঘোলা চোখে তাকালো সে একপলক। এবার মনে হচ্ছে সে মানুষটাকে চেনে। কোথাও দেখেছে! নিউজে? নাকি পেপারে? হ্যাঁ! এইতো সেই অভিরূপ চৌধুরী অভি। যাকে শে’ষ করার তাড়নায় সে প্রতিদিন তড়পে যাচ্ছে। যার প্রা’ণটা ছিনিয়ে নেওয়ার তার এতো আকাঙ্ক্ষা আজ সে-ই কিনা তার সম্মান বাঁচাতে ব্যাকুল? এসব আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে মেয়েটি ঢলে পড়ল এবার। সেই সঙ্গে অভিরূপের শার্ট প্যান্টেও লেগে গেল কাঁদা। শরীরে এই মেয়েলি স্পর্শ লাগায় হৃদকম্পনকে যেন ঘোড়া মনে হলো অভিরূপের। এতো জোরে জোরে ছোটে নাকি? অন্যদিকে তার বুঝতে কমতি নেই ছেলেগুলো পেলে তাকে সহ রাগিনীকেও পিস পিস করে কে’টে ফ্রাই করে খাবে। বিরবির করে অসহায় সুরে অভিরূপ বলে উঠল,
“ওহ গড! আমাকে এমন সিচুয়েশনের মধ্যে ফেলো কেন তুমি? একদিকে এতো সুন্দর ফিলিং নিতেও পারছি না। অন্যদিকে এই ছেলেগুলো পেলে না জানি কি করে! বুঝিনা এই মেয়েটার সঙ্গে দেখা হলেই কি বিপদও ফ্রীতে মিলে যায় নাকি বিপদের সঙ্গে মেয়েটাও ফ্রী?”
অতি যত্নে তার দেখা রাগিনীকে পাজ কোলে তুলে ছুটতে থাকলো অভিরূপ। তবে ভাগ্য বোধহয় সাথ দেয়নি। অতিরিক্ত কাঁদায় সেও ধ’পাস করেই পড়লো মেয়েটি সমেত। হুঁশ ফিরে রাগিনীর। নড়েচড়ে তড়িঘড়ি করে পিছলে যায় অন্যদিকে। ছেলেগুলো তাদের সামনেই এসে পড়েছে। এবার অভিরূপ উঠে দাঁড়ায়। রাগিনীর দিকে ছেলেগুলো তেড়ে যেতেই অভিরূপ তাদের বাঁধা দিয়ে বলে,
“আরে ভাই! এতো তাড়া কীসের? আমাকে চেনো না তোমরা? অভিরূপ চৌধুরী আমি। একটু কথা তো বলো! এদেশে দেখি আমার মতো মানুষদের দামই দাও না তোমরা। সবাই লাইনে দাঁড়াও দেখি। একটু অটোগ্রাফ দিই। গান শুনতে চাইলে ফ্রীতে শোনাবো। তাও এতো তাড়াহুড়ো করবেন না। রিল্যাক্স!”
ছেলেগুলো এবার হতভম্ব হয়ে দাঁড়ালো। একজন অন্যজনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আরে এতো সত্যিই অভিরূপ চৌধুরী! দ্যা ফেমাস সিঙ্গার ওফ ইন্ডিয়া। সে এখানে কী করে?”
“আরে ভাই, আপনাদের জন্যই তো এসেছি। আপনাদের গান শোনাবো।”
বলেই একটা মিষ্টি হাসি দিল অভিরূপ। কী ভোলাভালা সেই হাসি! কিন্তু কে জানে সেই হাসির পেছনে কূটবুদ্ধি লুকিয়ে? হাতে ধরে রাখা একগাদা কাঁদা পালা করে ছেলেগুলোর চোখেমুখে ছুঁড়ে মারলো অভিরূপ। আর দেরি নয়। দ্রুত রাগিনীর হাতটা ধরে তাড়াহুড়ো করে বলল,
“আর সময় নেই। বাঁচতে চাইলে পালাই চলুন।”
রাগিনী থেমেই থামে। সরু চোখে তাকিয়ে থাকে অভিরূপের দিকে। তার এই চাহনি লক্ষ্য করে অভিরূপ আবারও তার হাত টেনে বলে,
“আরে আপনাকে নিয়ে বিয়ে করতে পালাচ্ছি না। আপনাকে বাঁচাচ্ছি।”
এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নেয় রাগিনী। অভিরূপ খেয়াল করে তার বাম হাতে একটা শক্ত গাছের বড় ডাল ধরে আছে। এবার সেটা ধরেই ছেলেগুলোর নিকটে যায় সে। অভিরূপের চোখ তখন কপালে! এই মেয়েই না একটু আগে জ্ঞান হারালো? ভয়ে কুঁকড়ে ছিল? এখনি তার চোখ দেখে মনে হচ্ছে তার চোখ দিয়ে আগুনের লাভা বেরিয়ে আসছে। বেশ ইন্টারেস্টিং তো! ছেলেগুলোকে এবার কৌশলে একের পর এক পিটিয়ে যাচ্ছে রাগিনী। আর জোরে জোরে বলছে,
“সুযোগ পেলে তোদের একটার ঘাড়েও মাথা থাকতো না। আজকে আমি নিরুপায় ছিলাম বলেই বেঁচে গেলি। জানো’য়ার! হাতের কাছে কিছু ছিল না বলে আমার উপর ভালোই জোর দেখিয়েছিস। এখন কোথায় যাবি?”
ছেলেদের মা’র খাবার পর একেকটা আর্তনাদ শুনেই অভিরূপের শিরদাঁড়া শিরশির করে উঠলো। মেয়েটাকে সে যতটা ভীতু ভেবেছিলো সে ততটাও না। বেশ ডেঞ্জারাস লেভেলের! একসময় মে’রে ক্লান্ত হয়ে সেই রক্তিম আঁখি দ্বারা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে অভিরূপের দিকে। অভিরূপ ঢক গিলে একটা ক্যাবলা হাসি দেয়। আর বলে,
“যাওয়া যাক? এভাবে তাকাবেন না। আর হাত ধরে টানাটানি করব না। সো ম্যাডাম, ক্যান উই গো নাউ?”
রাত প্রায় বারোটা পেরিয়েছে। প্রকৃতিতে নেমে এসেছে পিনপতন নীরবতা। ঝিঁঝি পোকার শব্দ সেই নিস্তব্ধতাকে কমিয়ে দিলেও খুব একটা বেশি পারছে না। ‘শাহ্ মানসিক হাসপাতাল কেন্দ্র’ অর্থাৎ মেন্টাল হসপিটালের পেছনদিকের বড় দরজায় তালা খোলার শব্দ তীব্র হচ্ছে ধীরে ধীরে। পেছনদিকে মানুষ চলাচল করার জন্য নয়। এদিক দিয়ে বড় বড় গাড়ি আর সেইসব এম্বুলেন্স ঢুকানো হয়। আজিম বড় তালা খুলে দিয়ে গেট ফাঁক করে দিয়ে একটা স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে কোহিনূরের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“আসেন স্যার! অনেক ক্লান্ত হইছেন না? কিছু খাইতে দিব?”
কোহিনূর প্যান্টের পকেটে দুহাত গুঁজে ঘাড় এদিক ওদিক কাঁত করে বলল,
“নো নিড। খেয়ে এসেছি বাহিরে থেকে।”
“আচ্ছা তাইলে ভেতরে আসেন। কেউ দেইখা নিলে আবার বিপদ!”
“রিল্যাক্স। এতো রাতে কে আর আসবে! তুমি যে এসেছো এটাই আমার ভাগ্য। সিরিয়াসলি আজিম! এতো রাতে তোমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে জ্বালিয়ে দরজা খুলে নিচ্ছি। বিরক্ত হয়ে যাও খুব তাই না?”
“কী যে বলেন স্যার! আপনে তো এর বদলে আমাকেও কিছু হাত খরচ দেন নাকি?”
কোহিনূর মুচকি হাসে। নিজের ঘাড়ে একটা হাত রেখে শক্ত করে মোচড় দেয়। ঘাড় ব্যথা করছে। যতক্ষণ ধরে মিটিং হয়েছে আর তাকে কথা বলতে হয়েছে যে এখন কথাও বলতে ইচ্ছে করছে না। ভাগ্যিস এর মাঝে রাগিনী আর আসেনি! নাহলে তাকে না পেয়ে নিশ্চিত মেয়েটা সন্দেহ করতো? অতঃপর সে শান্ত গলায় বলে,
“এইতো আর কিছুদিন। তারপর এই জ্বালাতন সহ্য করতে হবে না তোমায়।”
“তা আপনাগো তদন্ত শেষ হইতেছে?”
“শেষ আর কোথায় হলো আজিম? কিছুই তো খুঁজে পাচ্ছিনা। তবে এটা নিশ্চিত রাগিনী মেয়েটাকে অযথা সন্দেহের খাতায় ফেলেছি। এখন নিজেই নিজের দিকে তাকাতে পারছি না।”
আজিম কোহিনূরকে আশ্বাস দিয়ে বলে ওঠে,
“আপনাদের কাজই তো সন্দেহ করা। কারণ আছিল বলেই সন্দেহ করছিলেন। এখন তো বুঝছেন। সমস্যা নাই।”
কোহিনূর কিছুক্ষণ নীরব থেকে গেট দিয়ে প্রবেশ করতে চাইলো। তবে কিছুটা দূরে একটা মেয়েলি অবয়ব আঁটকে দিলো তাকে। ঘাড় ঘুরিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো মেয়েটা এতো রাতে এই জনমানবহীন রাস্তায় হাঁটছে কেন? কোনো বিপদ হয়নি তো? আস্তে আস্তে যখন মেয়েটা এগিয়ে এলো তখন যেন কোহিনূরের পায়ের নিচের মাটির ভিত নড়ে উঠল। পা দুটো অবশ হয়ে এলো। মেয়েটির চোখমুখ তো তারই মনের অভ্যন্তরে তাকা। হ্যাঁ, সে তো রাগিনী। এতো রাতে রাগিনী? তাও এই বিধ্বস্ত অবস্থায়? সারা গায়ে কাঁদা আর কপাল ফোলা। কোহিনূরকে দেখে তার থেকে কিছুটা দূরত্বেই থেমে গেছে রাগিনী। থমকে গেছে তার চোখ। কোহিনূর এবার নিজের দিকে তাকালো। নিজের পা থেকে মাথা অবধি তাকালো। তার পরনে সিক্রেট অফিসারের ইউনিফর্ম। কালো লং কোট। পায়ে দামি বোট জুতো। মেয়েটা কি তবে সব ধরে ফেলল? কোহিনূর কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে রাগিনীর দিকে একধাপ এগিয়ে গিয়ে ধীর সুরে কম্পন ধরানো কন্ঠে বলল,
“রাগিনী!”
কোহিনূরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি উপলব্ধি করল অন্যকিছু। মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা বুঝে ফেলল সে। দৃষ্টি শক্ত হলো তার। হাত নামিয়ে নিল। মাথাটা এপাশ ওপাশ নাড়ালো। আর বিরবির করে বলল,
“না। রাগিনী না!”
হয়ত এই মেয়েটিও বুঝে নিয়েছে অনেক কিছুই। তাই সে ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাচ্ছে। কোহিনূরের মাথায় যেন র’ক্ত চড়ে বসলো। দাঁত কটমট করে তেড়ে যেতেই মেয়েটা দৌড় লাগালো। কোহিনূরও দমে গেলো না। এবার পেয়েছে সে মেয়েটাকে। ছাড়া যাবে না এতো সহজে। সেও পিছু ছুটলো মেয়েটার। পেছন থেকে আজিম হতভম্ব হয়ে গেলো! কী হলো টা কী? কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।
মেয়েটার পায়ের বেগ আছে মানতে হবে। অনেকটা দূরে ছুটেছে কোহিনূর। রি’ভলবার বের করে বেশ কয়েকবার ওয়ার্নিং করেছে। তবে ফলাফল হয়নি। সে লক্ষ্য করেছিল মেয়েটা খুঁড়িয়ে হাঁটছিল। অথচ তার দৌড়ানোর বেগ অসামান্য! অবশ্য অপরাধীরা এসব বিষয়ে পারদর্শীই হয়। তার খোঁজ না পেয়ে কংক্রিটের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে পাশের গাছে জোরে লা’থি মার’লো কোহিনূর। মাথা যেন আগুনের দাবানলে পরিণত হয়েছে। নিজেকে কোনোরকম সংযত করে শান্তভাবে দ্রুত ফোনটা বের করে কোহিনূর। মেহরাজের নম্বর ডায়াল করে কল দিয়ে ফোনটা কানে ধরে। দৌড়ে গরম লাগছে ভীষণ। হাঁপিয়ে উঠেছে একেবারে। কোটের বোতাম একহাতে খুলতে খুলতে বিরক্তির সুরে বলে,
“দরকারের সময় ইডিয়টের ফোনে কল দিলে পাওয়ায় যায় না।”
পুনরায় কল করতে হলো কোহিনূরকে। এবার কিছুক্ষণ প্রতীক্ষার পরেই ওপাশ থেকে মেহরাজের ঘুম জড়ানো গলা শোনা গেল।
“আরে ভাই! এতো ভোর ভোর ফোন দেওয়ার কী আছে? কী সমস্যা? রাখ তো।”
মেজাজটা আরো চড়ে যায় কোহিনূরের। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“আমি তোমার ভাই নয়, মেহরাজ!”
এবার যেন ওপাশের মেহরাজের টনক নড়ে। তড়িঘড়ি করে বলে,
“সরি স্যার, সরি। এতো রাতে ঘুমাচ্ছিলাম স্যার তাই…”
“তোমার বাড়তি কথা রাখো। দ্রুত অফিস যাও। রাগিনীর লোকেশন চেক করো। আর পুলিশ ডিপার্টমেন্টে জানাও শাহ্ মানসিক হাসপাতাল কেন্দ্রের আশেপাশে সবখানে চেক পোস্ট দিতে। রাগিনী তাজরীনের মতো কাউকে দেখতে পেলেই তাকে যেন আটক করা হয়। গট ইট?”
“ওকে স্যার। বাট…”
কোহিনূর ফোনটা কেটে দিলো। মেহরাজের সব কথা বলেও বলা হলো না।
সকাল সকাল আজ রাগিনীর বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে উর্মিলা। এর আগে বেশ কয়েকবার রাগিনীর বাড়ি এলেও ব্যস্ততা এবং তেমন যোগাযোগ না থাকার কারণে মাঝখানে আর আসাই হয়নি। আসার সাথে সাথেই সৈয়দ তাকে হলরুমের সোফায় বসতে দিয়েছে। বসে বসে হলরুমের চারিদিকটা দেখতে দেখতে বেশ মুগ্ধ হয় উর্মিলা। সবটাই পরিপাটি করে সাজানো। দামি দামি শোপিচে ময়লাও জমেনি। নিশ্চয় প্রতিদিন পরিষ্কার করা হয়! পরক্ষণেই নিজের পরনের চশমাটা খুলে নিলো উর্মিলা। ওড়না দিয়ে হালকা করে মুছে রেখে দিল তারই পাশে। তখনই সৈয়দ উপর থেকে নেমে এলো। উর্মিলার উদ্দেশ্যে বেশ নম্র সুরে বলল,
“আপনেরে রাগিনী মামনি উপরে যাইতে বললো। সে নিজের ঘরেই আছে। উপরে গিয়া ডান দিকের প্রথম ঘরটাই তার।”
উর্মিলা হালকা হেঁসে উঠে দাঁড়িয়ে সিঁড়ির দিকে ধাবিত হয়। সোফায় ফেলে যায় তার চশমা।
দরজায় টোকা পড়তেই রাগিনীর বুঝতে দেরি হয় না দরজার ওপাশে কে। তাই রিও কে ব্যস্তরত রাগিনী কিছুটা জোরেই বলে ওঠে,
“ভেতরে আয়।”
উর্মিলা ধীর পায়ে রাগিনীর ঘরে প্রবেশ করে। বেডে বসে থেকে একটা বিড়াল ছানাকে খাইয়ে দিচ্ছে রাগিনী। উর্মিলা বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে দ্রুত বিছানার কাছে গিয়ে বলে,
“ওয়াও! সো কিউট কিটি! নাম কী রে ওর?”
“রিও।”
“নামটাও মিলিয়ে রেখেছিস! দারুণ তো। তোর মতোই কিউট গোলুমোলু দেখতে।”
রাগিনী এক ঝলক হাসে। তারপর রিও কে কোলে নিয়ে শান্ত গলায় বলে,
“দাঁড়িয়ে আছিস যে! বস।”
উর্মিলা রাগিনীর পাশ ঘেঁষে বসে পড়ে ধপ করে। তারপর জিজ্ঞেস করে,
“তারপর বল! সব ফাইলস্, ডিটেইলস ঘেঁটে দেখলি? কী মনে হচ্ছে এখন তোর?”
“সবই ঘেঁটে দেখেছি উর্মিলা। আর যত পড়েছি তত সন্দেহ আর তীব্র হয়েছে। কোহিনূরের মাঝে কোনোরকম লক্ষণ দেখতে পাইনি আমি। সবটা গুলিয়ে গিয়েছে আমার।”
তপ্ত শ্বাস ফেলল রাগিনী। উর্মিলা কিছু ভেবে বলল,
“উমম…সেদিন আমাকে যা যা বলেছিলি আমারও ঠিক এটাই মনে হয়েছিল। ওই কোহিনূর একদম সুস্থ। অসুস্থ হবার ভান ধরেছে।”
রাগিনীর জবাব এলো না এবার। সে গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত। যেন অন্য জগতে হারিয়েছে। উর্মিলার মাথায় ফট করেই একটা বিষয় ঘুরপাক খেতেই তড়িঘড়ি করে সে রাগিনীর হাতটা চেপে ধরে বলল,
“আচ্ছা! সে যদি সুস্থ হয় আর এমন ভান করে থাকে তাহলে নিশ্চয় তার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য আছে? এখন তো কয়েকদিন ধরে টে’রোরিস্ট হাম’লার বিষয়টা চলছেই। এমন নয় তো? যে ওই কোহিনূর কোনোভাবে টে’রোরিস্ট টিমের সাথে যুক্ত?”
চলবে…
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গতকাল আমি একটু টাইপিং মিস্টেক করেছিলাম। আই উইটনেস না লিখে আই উইকনেস হয়ে গিয়েছে। পাঠকরা ধরিয়ে দিয়েছে তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]