ভুল -পর্ব ১৫

0
207

#ভুল ১৫তম পর্ব
#jannat_Nur

সামনে খাবার নিয়ে বসে আছে সিরাত, খেতে ইচ্ছা করছে না! শুধু সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছে এয়ারপোর্ট এর কাছে গিয়ে মাকে যেন খুঁজে পায়। রাতটা যেভাবেই হোক পার করে সকালে সে ঢাকা রওনা দিবে। এমন সময় আমিরুল ইসলাম বাসায় ফিরলেন, ছেলেকে চিন্তিত অবস্থায় খাবার নিয়ে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে তোমার? কয়েকদিন ধরে দেখতেছি তুমি খুব চুপচাপ আমার সাথে আগের মতো কথা বলো না। কি নিয়ে তোমার এত টেনশন তুমি কি রোদের জন্য চিন্তা করো? যে মেয়ে তার নিজের ধর্ম ছেড়ে তোমার কাছে আসতে পারলো না তুমি তার জন্য চিন্তা করে কি করবে।

সিরাত চুপ করে আছে, তার ইচ্ছে করছে না বাবার সাথে কথা বলতে। সিরাতের কোনো উত্তর না পেয়ে আমিরুল ইসলাম আবার জিজ্ঞেস করলেন কথা বলছো না কেন? তুমি আমাকে এভয়েড করে চলছো সেটা আমি বুঝতে পারছি! কারণ কি, তুমি আগের মত কেন আমার সাথে মিশতে পারো না।

এখনো সিরাত চুপ, কেন যে এরকম করছে আমিরুল ইসলাম সেটাই ভাবছেন। ছেলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন আমিরুল ইসলাম।

বাবা তোমার কি হয়েছে আমাকে বল, আমার সাথে শেয়ার করলে তোমার মন হালকা হবে! আমি তোমার পাশে আছি।

পাপা তুমি আমার পাশে নেই, তাই তোমার সাথে আমি এ ব্যাপারে কোন কথা বলতে চাইনা।

কি বলছো তুমি, আমি তোমার পাশে নেই! সারাটা জীবন তোমার পাশে থেকে গেলাম। দ্বিতীয়বার বিয়ে করিনি তোমার কষ্ট হবে বলে, আমার ধারণা ছিল সৎ মা তোমাকে আমার কাছ থেকে আলাদা করে দিবে। আর এই তুমি বলছো আমি তোমার পাশে নেই, এ কথাটা তুমি বলতে পারলে।

তোমার মনে শুধু আমাকে হারানোর ভয় তাই না?
সত্যি সত্যি যদি হারিয়ে ফেলো তখন কেমন হবে পাপা, খুব কষ্ট হবে তোমার?

সিরাত আবোল তাবোল বলবে না মেজাজ কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে! কখনো তোমার গায়ে হাত তুলিনি আর একবার যদি বল তোমাকে আমি হারিয়ে ফেলবো, আজকে প্রথমবার তোমার গায়ে হাত তুলবো।

তোলো হাত, মারো আমাকে, সেটার জন্য আমি ভয় পাইনা। তুমি আমাকে এত কাল যে অন্ধকারে রেখেছিলে সেই অন্ধকার থেকে আমি মুক্তি চাই, আমি মুক্তি চাই। আর থাকতে পারছি না দম বন্ধ হয়ে আসছে এই অন্ধকারে।

আমিরুল ইসলাম বুঝতে পারছে না সিরাত এগুলো কেন বলছে! সিরাতের কথার কোন মানে বের করতে পারছে না সে, আমিনুল ইসলাম ভেবে নিল রোদের জন্যই তার মানসিক সমস্যা হচ্ছে। তাই আবারও ছেলের খুব কাছে এসে মুখে গালে হাত বুলিয়ে বলল বাবা এমন পাগলামি করে না! জীবনে সবকিছুই মেনে নিতে হয়, আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।

এবার সিরাত তার বাবার হাত ঝাটকা মেরে সরিয়ে দিয়ে বলল, তোমার কাছে সব ঠিক হয়ে যেতে পারে আস্তে আস্তে! আমার কাছে কিছু ঠিক হবে না। আমার জীবনটাকে তুমি এলোমেলো করে দিয়েছো, আমি আমার মাকে চাই! আমার মাকে এনে দিতে হবে। তুমি আমাকে মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত করেছ তোমার পরিবারের লোকদের কথায়। তুমি আমার মাকে ডিভোর্স দিয়েছো কিন্তু আমাকে কেন রেখে দিলে? আমার মায়ের সঙ্গে কেন দিলে না আমাকে। এতটা বছর ভুল শুনে এসেছি, আমার মা অন্য লোকের সাথে চলে গেছে আমাকে রেখে! এই মিথ্যাটা বলতে তোমার বিবেকে বাধলো না? শুধু তুমি না তোমার পরিবারের প্রত্যেকটা লোক মিথ্যাবাদী। আমার মাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে এ সংসার থেকে তারা তাড়িয়েছে। তুমি কেমন স্বামী নিজের স্ত্রীকে বিশ্বাস করলে না? যার সাথে এত বছর সংসার করেছিলে তার চরিত্র কেমন তোমার জানা ছিল। তোমার ভাইবোন, বোনের জামাই যা বললো তাই সত্যি হয়ে গেল। একটা অসহায় মানুষ এত কান্নাকাটি করলো, তোমার পায়ে ধরল! তুমি তো তার ভালবাসার মানুষ ছিলে, অন্তত তুমি তাকে বিশ্বাস করতে, প্রমাণ করার চেষ্টা করতে ঘটনাটা সত্য নাকি মিথ্যা। তুমি কোনকিছু প্রমাণ করতে চাওনি, রাগের বশবর্তী হয়ে আমার মাকে ডিভোর্স দিয়েছো! আমাকে মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত করে আমার মাকে সন্তানহারা করেছো। শুনেছি আমার মা পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় আমাকে খুঁজে বেরিয়েছে। সে যদি দুশ্চরিত্র হতো, সন্তানের জন্য পাগল হয়ে রাস্তায় ঘুরতো না, তোমার বুঝার উচিত ছিল। এখন তুমি আমার মাকে যেখান থেকে পারো খুঁজে এনে দাও।
নাহলে তোমাকে আমি ছাড়বো না, তোমাকে বাবা বলে কখনো মেনে নেব না, কখনো না। তুমি যে ভয় পেয়েছিলে আমার মা আমাকে তার কাছে নিয়ে যাবে বাংলাদেশে আসলে, তার জন্য এত বছর বাংলাদেশ আসোনি। তুমি কি জানো সত্য কখনো গোপন থাকে না, আল্লাহ সেটা কোন না কোন ভাবে প্রকাশ করে! আমার সামনেও এখন সত্যি প্রকাশ করেছে, তাইতো আমি বাংলাদেশে চলে আসছি। এখন আমার মাকে আমি খুঁজে বের করবো, যদি খুঁজে না পাই দরকার হয় সারাজীবন একা থাকবো! তোমার মত বাবার সাথে আমি থাকবো না। সন্তান হারানোর যন্ত্রণা আমি তোমাকে বুঝাবো, আমি তোমাকে বুঝিয়ে ছাড়বো কতটা কষ্ট লাগে সন্তানহারা হয়ে।

সিরাতের কথা শুনে আমিরুল ইসলামের মুখে কলুপ এটে গেছে। সে বুঝতে পারছে না সিরাতে এগুলো জানলো কিভাবে, তার মাকে খুঁজতে সে বাংলাদেশে চলে আসলো। যে ভয়ে সে এতদিন দেশে আসেনি এই ভয়টায় কি সত্যি হতে চলেছে। তার ছেলে তাকে ছেড়ে চলে যাবে, সুফিয়া কি সত্যি পাগল হয়ে গিয়েছে, সত্যি সে নির্দোষ ছিল! তাহলে আমার ভাইবোন বোনের জামাই যা বলল সবার কথা কি বানোয়াট। কেন কি কারণে তারা আমার সংসার ভেঙে দিতে চাইবে! আমিরুল ইসলাম ভাবতে থাকলো আমার আবার জানতে হবে সবার কাছ থেকে, আমি কাল সকালেই সবাইকে জিজ্ঞেস করবো।

সিরাত খাবার না খেয়ে তার রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো, আমিরুল ইসলাম বারবার সিরাতের দরজার কাছে গিয়ে ডাকলো! কিন্তু সিরাত কোন সাড়াশব্দ দিলো না। সকাল হতেই বাসা থেকে বের হয়ে গেল ঢাকার উদ্দেশ্যে। আমিরুল ইসলাম সবাইকে বলল তার ড্রয়িং রুমে আসতে, সবার সাথে কথা বলবে। আমিরুল ইসলামের তিন ভাই ভাইয়ের বউরা রফিক মিয়া, রুমা আক্তার সবাই একসঙ্গে এসে বসে আছে ড্রয়িংরুমে। আমিরুল ইসলাম সোফায় বসতে বসতে সবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন,

আজকে তোমাদের ডাকা হয়েছে যে কারণে, কারণটা হলো, সিরাত আমাকে অনেকগুলো প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে! তার প্রশ্নের কোন জবাব আমি দিতে পারিনি।

আমিরুল ইসলামের ভাই রবিন জানতে চাইলে সিরাত আপনাকে কিসের প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে! আর তার কারণে আমাদের কেন ডাকা? যদি ক্লিয়ার করে বলতেন।

সেটা বলতেই ডেকেছি, এত বছর পর সিরাত তার মায়ের খোঁজ করতে চাচ্ছে। আমাকে বলেছে যেখান থেকে পারি তার মাকে খুঁজে এনে দিতে হবে! নাহলে সে আমার সাথে থাকবে না। সে বলতেছে আমি তোমাদের কথা শুনে তার মাকে ডিভোর্স দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে মস্ত বড় ভুল করেছি! আর কেন তাকে আমার কাছে রেখে দিয়েছি সে জানতে চেয়েছে।

রফিক মিয়া বললেন, আপনি সিরাতকে বলতে পারলেন না তার মা যে অন্যায় করেছে তারপর তার সাথে আপনার সংসার করার ইচ্ছা ছিল না। তাই থাকে ডিভোর্স দিয়েছেন। আপনি তার বাবা হোন তাই তাকে রেখে দিয়েছেন, তাকে যেভাবে মানুষ করছেন ঐশ্বর্যের মধ্যে তার মা কি পারতো তাকে এভাবে মানুষ করতে।

এগুলো বলার সময় এখন না, আমাকে সে কথায় আটকে ফেলেছে, সিরাত জানতে চায় আমি কি নিজের চোখে দেখেছি তার মায়ের চরিত্র খারাপ।
তার অন্য জনের সাথে অবৈধ সম্পর্ক কি আছে, আর কার সাথে আছে সেটা কি কখনো খোঁজ করে দেখেছি সেই মানুষটা কে। যদি কোন লোকের সাথে তার মায়ের খারাপ সম্পর্ক থাকতো লোকটার খোঁজ খবর ঠিকই বের হতো। সত্যিই তো আমার জানা নেই কার সাথে তার সম্পর্ক ছিল, তোমরাও সেটা বলতে পারো কার সাথে অবৈধ সম্পর্ক ছিল। রফিক মিয়া তুমি সত্যি করে বলবে সেদিন কি সুফিয়ার ঘর থেকে কাউকে বের হতে দেখেছো। এমনও তো হতে পারে বাসার ভেতর চোর ঢুকেছিল, আর তুমি ভুল ভেবেছো। দরজা খুলে বের হতে দেখেছিলে তুমি? সত্যি বলবে।

জ্বি ভাইজান আমি নিজ চোখে দেখেছি দরজা খুলে লোকটা বের হয়েছে। আমার কথা বিশ্বাস করবেন না তার কারণে আপনার বোনকে ডেকে এনেছি, এবং আপনার দুই ভাই সেই লোকটাকে দেখেছে।

শুধু তুমি দেখেছো দরজা খুলে বের হয়েছে কিন্তু আর কেউ তো দেখেনি দরজা খুলে বের হতে। রুমা তুই কি দেখেছিস লোকটাকে দরজা খুলে বের হতে? আমি তোর ভাই এতদিন পরে এসে আমার সাথে মিথ্যা বলবি না, মরার ভয় করিস, মৃত্যুর পর কিন্তু আল্লাহর কাছে হিসাব নিকাশ দিতে হবে।

না ভাইয়া আমি দরজা খুলে বের হতে দেখিনি, আমি দেখেছি গেইটের কাছে লোকটা চলে যাচ্ছে! তখন মেজো ভাই সেজ ভাই তাদেরকে ডাক দেই।

তাহলে শুধু রফিক মিয়া তুমি দেখেছো, তুমি একাই দেখেছো দরজা খুলে লোকটা বের হয়েছে। এই বাড়িতে তোমরা এতগুলো মানুষ কখনো কি কারো চোখে পড়েছে সুফিয়ার অস্বাভাবিক আচরণ। তোমরা যারা মহিলারা আছো দিনের বেলায় কখনো এই বাড়ির আশেপাশে দেখেছো অচেনা কাউকে। সুফিয়ার এমন কোন আচরণ দেখেছো যাতে করে তোমাদের সন্দেহ হয়।

আমিরুল ইসলামের তিন ভাইয়ের বউ এবং রুমা আক্তার এক বাক্যে বলল, না আমরা এরকম কোন কিছু দেখিনি।

যদি এরকম কোন কিছু না দেখো, হঠাৎ করে একটা লোক এসে সুফিয়ার ঘরে ঢুকে যাবে! তার সাথে সম্পর্কে লিপ্ত হবে। এটার খোঁজ খবর বাড়ির একটা মানুষ জানবে না, সেই পুরুষটা কোথা থেকে আসলো। আসমান থেকে পড়েছে এমন তো নয়। আর এটাও না সুফিয়ার কাছে তখন মোবাইল ছিল, মোবাইলে যোগাযোগ করে সে যে কোন লোককে বাসায় ডেকে আনছে।

আমিরুল ইসলামের ছোট ভাই সাব্বির বললেন, ভাইয়া এখন যে বিচার বুদ্ধি দিয়ে তুমি সবাইকে চেপে ধরেছো ২১ বছর আগে কেন এভাবে সবাইকে একসঙ্গে করে কথা বললেন না। হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে ডিভোর্স দিয়ে দিবে, তোমার কিন্তু ভেবেচিন্তে কাজটা করা দরকার ছিল। এতদিন পর আফসোস করে কিছু হবে না, দেখো গিয়ে সুফিয়া ভাবী হয়তো বিয়ে-শাদী করে অন্যের সংসারে ভালোই আছে। এখন আর এগুলো নিয়ে কথা বলে কি হবে।

কেন বলছি সেটা তোমরা বুঝতে পারছো না, আমার ছেলের প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি বলেই আজ তোমাদের নিয়ে এ কথাগুলো বললাম। সে বলেছে তার মা নাকি পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় তাকে খুঁজে বেড়িয়েছে। সে মানুষের কাছ থেকে জানতে পেয়েছে তার মায়ের ব্যাপারে। তার জন্যই তার মাকে খুঁজতে আজ বাসা থেকে বের হয়েছে খুব ভোরবেলা। সিরাত বলেছে সে আমার সঙ্গে থাকবে না, যে ছেলের জন্য আমার জীবনটা পার করে দিলাম সে ছেলে যদি আমার সঙ্গে না থাকে আমি বেঁচে থাকবো কিভাবে। আমি আমার ছেলেকে ছাড়া বাঁচবো না, সে আমার কলিজার টুকরা, তার মুখের দিকে চেয়ে আমি দজীবন কাটিয়ে দিলাম।

ভাইজান আপনি এটা ভুল করেছেন, আপনি যদি দ্বিতীয় বিয়ে করতেন এতদিনে আপনার আরো ছেলে মেয়ে হতো, তখন সিরাতের জন্য এতটা কষ্ট পেতে হতো না আপনাকে, রফিক মিয়া বললেন।

আমি তো ভুল সে প্রথম থেকেই করে এসেছি, বিয়ে না করে ভুল করার জন্য আফসোস নেই। কিন্তু এখন আফসোস হচ্ছে কেন আমি তখন কোনকিছু না ভেবেই এত বড় সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার মাথায় এটা ঢুকেনি তুমি একা দেখেছো লোকটা ঘর থেকে বের হয়েছে, সবার কথা শুনে ভাবছিলাম সবাই দেখেছে। আমি খুব বড় ভুল করে ফেলেছি।

ভাইজান আপনি কি বলতে চাচ্ছেন আমি ভাবীর নামে মিথ্যা কথা বলছি! আমি কেন মিথ্যা কথা বলব।

তুমি কেন মিথ্যা কথা বলবে, বা মিথ্যা কথা বলেছো কিনা সেটা পরে দেখা যাবে। সত্যি একদিন না একদিন সামনে আসবে, সেটার শাস্তি পেতে হবে সবাইকে। তুমি যদি মিথ্যা বলো তোমার শাস্তি পেতে হবে, আর আমি যে ভুল করেছি সেটার শাস্তি এখন আমাকে পেতে হবে! দেখা যাক সিরাত তার মাকে খুঁজে পায় কিনা।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here