ভুল -পর্ব ১৯

0
301

#ভুল ১৯তম পর্ব
#jannat_Nur

চাচা আপনি যে কথাগুলো বললেন এই কথাগুলো একদম সত্যি তো? দেখুন কোন মিথ্যা বলবেন না। কারণ আমি আমি চাই সত্যিটাই সবার সামনে আসুক। আপনি যদি কোন হিংসার বশবর্তী হয়ে রফিক মিয়া নামে অপবাদ দেন সেটা কিন্তু ঠিক হবে না। এখনো ভেবে দেখুন বয়স প্রায় শেষ বাঁচবেন আর কয়েকদিন যা সত্যি তাই প্রকাশ করবেন এর বাহিরে যেন একটা কথা মিথ্যা না হয়।

আমি যত বড়ই পাপী হই আমি এটা উপলব্ধি করতে পেরেছি মিথ্যা বলে পাপ করে কেউ রেহাই পায় না! সেটা থেকে আমিও রেহাই পাচ্ছি না, আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতেছি। তবুও কি আমি মিথ্যা বলব? শেষ বয়সে সত্যিটা বলে মরতে চাই, তাই তোমার পরিচয় পেয়ে আমি তোমার কাছে সত্যিটা বললাম। এখন তুমি যদি বিশ্বাস না করো আমি কি করবো বলো বাবা! কিন্তু এটুকু বিশ্বাস রেখো একজন মরণ পথযাত্রী মানুষ কখনো মিথ্যা বলে না।

ওকে আমি বিশ্বাস করলাম আপনি সত্যি বলছেন তাহলে আমার সাথে নবীনগরে চলেন। সবার সামনে সত্যিটা বলবেন, তার আগে চলেন হসপিটালের ভিতরে যাই আমার মাকে দেখুন! সে মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে চিকিৎসাধীন আছে।

চলো তোমার মাকে দেখব, যে মানুষটার জীবনে আমি সর্বনাশ করেছি তাকে কখনো দেখিনি! না দেখে তার জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছি, এটার ক্ষমা আমি হয়তো পাবো না। তোমার মা তাড়াতাড়ি সুস্থ হোক আল্লাহর কাছে এই দোয়া করি, তিনি সুস্থ হলে তার পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে নেব।

সিরাত ফজল উদ্দিনকে নিয়ে হসপিটালে আসলো! সুফিয়া বেগমকে খাবার খাওয়াছিলেন অবন্তী। সিরাতের সাথে বৃদ্ধ লোকটাকে দেখে অবন্তী জিজ্ঞেস করলেন কে এই লোক? তোমার সাথে এখানে কেন এসেছে।

যার কারণে এত কিছু নাটক হয়েছিল সেই লোকটাই এই লোক। সিরাতের কথা না বুঝতে পেরে লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে অবন্তী। সিরাত আবার বলল তোমার বাবা যাকে আমার মায়ের রুম থেকে বের হতে দেখেছিল সে এই লোক। তার মুখ থেকে শুনো সে কি বলে, তোমার বাবা তাকে দিয়ে কেমন অভিনয় করিয়েছিল।

ফজল উদ্দিনকে অবন্তীর পরিচয় দিয়ে সিরাত বলল, চাচা এর নাম অবন্তী আমার ফুফাতো বোন! আপনার প্রিয় বন্ধু রফিক মিয়ার মেয়ে।

ফজল উদ্দিন জিজ্ঞেস করল তুমি রফিক মিয়ার মেয়ে? তোমার বাবা খুব খারাপ মানুষ, আমি যে ভালো তা নয়। আমিও তার সাথে মিলে নির্দোষ একটা মানুষের জীবন নষ্ট করেছি।

অবন্তীকে সমস্ত ঘটনা বললেন ফজল উদ্দিন। অবন্তী সিরাতকে বলল তুমি এই চাচাকে নিয়ে বাসায় যাও সবার সামনে প্রমাণ কর সুফিয়া মামি নির্দোষ! সমস্ত দোষ আমার বাবার। কি বলবো বলো তাকে বাবা বলতেও লজ্জা বোধ হচ্ছে, জন্ম দিয়েছে বলে নাম ধরে ডাকতে পারছি না, ইচ্ছে করতেছে তাকে নাম ধরে ডাকতে। এত নিলজ্জ মানুষ আমার লাইফে এটাই প্রথম দেখা, শয়তানের শয়তানি হার মানাবে এই লোকটার চক্রান্তের কাছে। কিভাবে নাটক সাজিয়ে মামিকে জালে ফাঁসাতে চেয়েছিল, কিন্তু তার মনস্কামনা পূর্ণ করতে পারেনি। ধিক্কার বাবা নামের এই মানুষটাকে, তুমি এখনই এই চাচাকে নিয়ে নবীনগর যাও।

হসপিটাল থেকে বের হয়ে সিরাত ফজল উদ্দিনকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকলো! দুপুরে খাওয়া হয়নি নামাজের পরেই ফজল উদ্দিনের সাথে দেখা হয়েছে। খাবার অর্ডার করলো দুজনের জন্য, সিরাত ফজল উদ্দিনকে বলল আপনার কি খেতে ইচ্ছা করে ওয়েটারকে বলেন।

বাবা তোমার যা ইচ্ছা আমাকে খাওয়াতে পারো! মানুষের বাড়িতে চেয়ে যা পায় তাই তো খাই।

তবুও আপনার যদি কিছু খেতে ইচ্ছা থাকে বলতে পারেন। ফজল উদ্দিন ওয়েটারকে বলল গরুর মাংস আর ভাত দিতে। তিনি সিরাতকে বললেন, অনেকদিন গরুর মাংস খাইনা মনের ইচ্ছা ছিল তুমি কি ভাববে তাই বলতে চাইনি।

সমস্যা নেই আপনার যা যা খেতে ইচ্ছা হয় আপনি খেয়ে নেন।

দুজনে খাবার খেয়ে ঢাকা থেকে নবীনগরের বাস ধরলেন, সন্ধ্যার আগে সিরাত বাড়িতে আসলো। তখন আমিরুল ইসলাম বাসায় ছিল না, রুমা আক্তার এতদিন পর ভাইয়ের ছেলেকে বাড়িতে ফিরতে দেখে খুশি হলেন। কিন্তু সাথে একজন বৃদ্ধকে দেখে সিরাতকে জিজ্ঞেস করলেন তোমার সাথে এই লোকটাকে চিনতে পারলাম না।

রুমা আক্তার লোকটাকে দেখে বুঝতে পারছে লোকটা অনেক গরিব, সিরাতের সাথে কেন এখানে এসেছে সেটা সে ভাবতেছে। সিরাত রুমা আক্তারকে বলল, এই মানুষটা খুব দরকারী একজন মানুষ। তাই তাকে নিয়ে এসেছি, আঙ্কেল কোথায় তাকে বলবেন সন্ধ্যার পর বাসায় থাকতে।

কেন বাবা সন্ধ্যার পর কি হবে, অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল রুমা আক্তার।

হবে অনেক কিছু, সত্যি আর মিথ্যা প্রমাণ হবে! অপরাধী সবার সামনে আসবে।

সিরাতের কথা রুমা আক্তার কিছুই বুঝতেছেনা। ছেলেটা কি বলছে আবোল তাবোল, মায়ের মত পাগল হলো নাকি! এমন ভাবতে ভাবতে সে তার ছোট ভাইয়ের বউদের কাছে গেলো।
সিরাত রুমে এসে ফ্রেশ হলেন, ফজল উদ্দিনকে বললেন আপনি ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নেন! আমি সবাইকে কল করে বলতেছি বাসায় চলে আসতে।

একে একে সবাইকে কল দিয়ে বাসায় আসতে বলল সিরাত। সবাই জানতে চাইলো কি কারণে সন্ধ্যার পরে বাসায় আসতে হবে, সিরাত কাউকে কিছু বলল না। সিরাতের বড় ফুফি ও বড় ফুফির জামাইকেও আসতে বলা হলো।

সিরাত বাসায় এসেছে এটা শুনে আমিরুল ইসলাম খুশি হলেন! যাক ছেলেটার রাগ তাহলে কমেছে এমনটাই ভেবে তিনি তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আমিরুল ইসলামের তিন ভাই বাসায় আসলেন। সবাই যখন ড্রয়িং রুমে বসে আছে আমিরুল ইসলাম ফজল উদ্দিনকে দেখে সিরাতকে বলল এই লোক এখানে কেন? তুমি এই লোককে কেন নিয়ে আসছো। আমিরুল ইসলাম আগে থেকেই জানে ফজল উদ্দিন তেমন ভালো মানুষ না। সিরাত আগেই তার বাবাকে কিছু বলল না। সবাই ড্রয়িংরুমে বসে অপেক্ষা করলেও রফিক মিয়া এখনো আসেনি, সে তার রুমে। সিরাত রুমা আক্তারকে বলল সবাই চলে আসছে তোমার স্বামী আসে না কেন, তাকে এখনি নিয়ে আসো! তাকে ছাড়া তো আর কথা শুরু করা যাবেনা। রুমা আক্তার রফিক মিয়াকে নিয়ে আসলেন। রফিক মিয়া বুঝতে পারছেন না কি হয়েছে সিরাতের, তার মনে সব সময় ভয় কাজ করে এখনো ভয় পাচ্ছে! রফিক মিয়া এসে বসলে সিরাত ফজল উদ্দিনকে ডাক দেয়। ফজল উদ্দিন যখন রুমের ভিতর প্রবেশ করে সবাই স্বাভাবিক থাকলেও রফিক মিয়ার হার্টবিট বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে, ভাবে আজ বুঝি তার রক্ষা নেই। সিরাত শুধু তার মাকে খুঁজে বের করেনি সাথে ফজলকেও খুঁজে বের করেছে।

সবাইকে উদ্দেশ্য করে সিরাত বলে ২১ বছর আগের ঘটনা আপনারা যা জেনেছেন সেটা আপনাদেরকে ভুল দেখানো হয়েছিল, সত্যটা আজকে জানতে পারবেন।

সিরাতের কথা বলার মাঝখানে এলাকার মেয়র এবং কমিশনার এসে উপস্থিত হলেন। সিরাতের মায়ের বিচারের সময় যে চেয়ারম্যান ছিল সে এখন বেঁচে নেই। এই এলাকার মেয়র মকবুল চৌধুরী তিনি এসেছে এবং ওয়ার্ড কমিশনার সবুজ আহমেদ এসেছে। সিরাতের মায়ের বিচারের সময় যে মেম্বার ছিল সেই মেম্বারের ছেলে সবুজ আহমেদ। সবার সামনে ফজল উদ্দিন রফিক মিয়ার সাজানো নাটক প্রকাশ করলেন, তার মনে কি চক্রান্ত ছিল কি কারণে সিরাতের মায়ের নামে অপবাদ দিয়ে কলঙ্কিত করেছিল সমস্ত কিছু সবার সামনে বললেন। এবং সে নিজেও অপরাধী সেটাও স্বীকার করলেন! সেই নাটকের বিনিময়ে রফিক মিয়া তাকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছিল এটাও বললেন সবার সামনে। এবং সেই পাপের শাস্তি হিসেবে আজকে আল্লাহতালা তাকে এত বড় রোগ দিয়েছেন সেটা বলে কান্না করতে থাকলো ফজল উদ্দিন। রফিক মিয়া ফজল উদ্দিনকে বললেন তুই আমার নামে মিথ্যা কথা বলছিস, আমি তোকে ছাড়বো না! তুই কেন আমার নামে মিথ্যা বলছিস? তোকে আমি মেরে ফেলবো, এটা বলে রফিক মিয়া ফজল উদ্দিনকে মারতে তেড়ে গেলেন। সামনে গিয়ে দাঁড়ালো আমিরুল ইসলাম। রফিক মিয়াকে ধরে ইচ্ছামত মারতে থাকলো আমিরুল ইসলাম।

তোর জন্য আমার সাজানো গোছানো সংসারটা তন্নছন্ন, তুই আমার বোন জামাই হয়ে এত বড় সর্বনাশ করতে পারলি! আমার শিশু বাচ্চাটাকে মা হারা করেছিস, কত কষ্ট করে আমার ছেলেকে আমি মানুষ করেছি। তোর কারণে আমার ছেলে এখন আমাকে ঘৃণা করে, সে মনে করে তার মায়ের সাথে যা হয়েছে তার সবচেয়ে বড় দোষ আমার। হ্যাঁ আমি বড় অপরাধী তোদের কথা বিশ্বাস না করে যদি আমার স্ত্রীকে বিশ্বাস করতাম, আমার জীবনটা এমন হতো না। সুফিয়াকে পাগল হতে হতো না। সবকিছু হয়েছে তোর কারণে, তোকে আমি মেরে ফেলবো। রুমা আক্তার আমিরুল ইসলামের হাত থেকে স্বামীকে ছাড়াতে চাইলেন। আমিরুল ইসলাম বোনকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে বললেন যে আমার সামনে আসবে আজকে তাদেরকে আমি রফিকের মত মেরে শেষ করে ফেলব। মেয়র মকবুল চৌধুরী আমিরুল ইসলামকে বললেন ভাই পাগলামি করলে হবে না, আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েন না। সে যা অন্যায় করেছে তার শাস্তি আইন দিবে, থানায় ফোন করে দিচ্ছি পুলিশ এসে রফিক মিয়াকে ধরে নিয়ে যাবে। ফজল উদ্দিনকেও ধরে নিয়ে যাবে, অপরাধ দুজনেরই সমান। কিন্তু ফজল উদ্দিন সত্যটা বলার কারণে আদালতে তার শাস্তি কম হবে।

ফজল উদ্দিন ভয়ে কান্না করতে থাকলো! সিরাতকে বলল বাবা তুমি তো জানো আমার দুই মাসের মধ্যে অপারেশন না করতে পারলে পায়ে পচন ধরে যাবে। পুলিশ ধরে নিয়ে গেলে আমি তো সেখানেই মারা যাবো।

আপনি ভাববেন না আমি আপনাকে জামিনে ছাড়িয়ে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করব। কিন্তু এখন আপনারা দুজনেই অপরাধী তাই দুজনকে জেলে যেতে হবে।

রুমা আক্তার আমিরুল ইসলামের পায়ে পরার যোগাড়। ভাইয়া তুমি আমার স্বামীকে ক্ষমা করে দাও, সে অপরাধ করেছে এখন তাকে জেলে দিলেই কি সেটা আর ফিরে আসবে। আমিরুল ইসলাম বোনের গালে থাপ্পর মারলেন,

চুপ কর একদম, তোদের মুখ আমি দেখতে চাইনা! তোরা সবাই সেদিন আমাকে বলেছিলি সুফিয়া খারাপ। তোদের জন্য সে এতকিছু করেছে, পরিবারের সব কাজ করতো তবু তোদের মন পায়নি। তোরা নির্দয় মানুষ, আমিও নির্দয় ছিলাম তোদের কথা শুনে, তোদেরকে বিশ্বাস করে। ভাবছিলাম আমার ভাইবোন কখনো মিথ্যা বলতে পারে না! আমার মা বলেছিল সুফিয়া কখনো এমন কাজ করবেনা, আমার মায়ের কথা যদি সেদিন শুনতাম আমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে যেত না। আমিরুল ইসলামের কথা শুনে তার তিন ভাই এবং ভাইয়ের বউয়েরা সবাই রুম থেকে বের হয়ে গেল। তারা জানে সেদিন সুফিয়ার বিরুদ্ধে সবাই কথা বলেছিল, কেউ সুফিয়াকে সাহায্য করেনি।

থানা থেকে এসআই সুমন আহমেদ চারজন কনস্টেবল নিয়ে আমিরুল ইসলামের বাসায় আসছেন। রফিক মিয়াকে এবং ফজল উদ্দিনকে থানায় নিয়ে গেলো। আমিরুল এবং সিরাত দুজনে ই থানায় গেলেন। সিরাত রফিক মিয়াকে বলল আপনি যদি সত্যিটা স্বীকার করেন তাহলে হয়তো কিছুটা মাফ পেতে পারেন, যদি স্বীকার না করেন কিভাবে স্বীকার করানো হবে সেই পদ্ধতি আমার জানা আছে। বাংলাদেশের পুলিশ যেদিকে টাকার জোর থাকে সেদিকেই থাকে সেটা তো বুঝতেই পারছে না। যখন আমার মা অসহায় ছিল আমাকে পাবার জন্য পুলিশের কাছে কান্নাকাটি করে, পুলিশ কিন্তু আমার মাকে সাহায্য করেনি, আমার বাবার টাকা দেখে বাবার পক্ষে নিয়েছিল। নাহলে তিন বছরের বাচ্চাকে বাবা নিয়ে যেতে পারে না, সন্তান যতদিন বড় না হয় আইনত মায়ের কাছে থাকে! আইনও সেদিন টাকার জন্য মিথ্যে হয়ে গিয়েছিল।

প্রথমে রফিক মিয়া স্বীকার করতে চায়নি।
সিরাত এসআই সুমনের সাথে কথা বললে চলে আসলো। এস আই সুমন আহমেদ লকাপের ভেতর যেয়ে রফিক মিয়াকে উত্তম মাধ্যম দিলেন, এই বয়সে বেশি মার সহ্য করতে পারলো না রফিক মিয়া! সে বেহুশ হয়ে গেল। তখন এসআই সুমন আহমেদ কনস্টেবলকে বললেন, পানি নিয়ে আসো মুখে পানি ঝাপটা দিয়ে হুশ ফেরাও। শয়তান ব্যাটার শয়তানি বের করব, এমন খবিশ শয়তানদের জন্যই শত শত মানুষের সংসার ভেঙে যায়।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here