#শুভ্রতায়_নবনীতা
#নবনীতা_নীরু
#পর্ব ঃ ১৪
আজকে আমাকে হাসপাতাল থেকে নিতে এসেছে.।
তুশি আমার ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে।আমি রেডি হয়ে বসে আছি।বারবার স্যারকে ফোন দিচ্ছি কিন্তু উনি রিসিভ করছেন না।সেদিনের পর থেকে উনি আর হাসপাতালে আসেন নি আমাকে দেখতে।কখনো ফোন ও দেননি একটা বারের জন্য,আমি ফোন দিলেও রিসিভ করে না।
তুশিকে ডাকলাম,ডাকার সাথে সাথে তুশী আমার কাছে এলো।
— হ্যাঁ আপা বল,কোন সমস্যা?
— একটা কাজ করবি?
— কি করতে হবে বল আমায়?
— আজকেও কি আবির আসবে নাকি?
— জানি না।
— তুই বাবাকে একটু বল যে আমি আর তুই একটু বের হব,অনেক দিন বের হই না।
— কেন?কোথাও যাবি?
— হ্যাঁ তুই ও আমার সাথে যাবি।
— কোথায়?
— যাব একটা জায়গায়। এত প্রশ্ন করিস কেন বল তো!বাবাকে রাজি করাতে পারলে যা চাইবি তাই পাবি।
— আচ্ছা দেখছি কি করা যায়।
আমার নিহান স্যারের কথা খুব মনে পড়ছে।বিয়ের দিন যত এগিয়ে আসছে ততই কেমন দম বন্ধ লাগছে।নীরুর জন্য খারাপ লাগছে।মনে হচ্ছে দামী জিনিস আমি হারাতে চলেছি।স্যার সম্পর্কে আমি আমার অনুভূতি বলে বোঝাতে পারব না।শুধু মনে হচ্ছে এভাবে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না।আমি মনকে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না।
তিশু বাবার কাছে গিয়ে কি কি যেন বলল,বাবাও ওর কথা শুনে মাথা নাড়াচ্ছে।তার মানে কি সম্মতি প্রকাশ করছে।বাবা আর তুশি আমার দিকে এগিয়ে এলো।
— আচ্ছা মা তাহলে তোরা আয়,আমি বাসায় যাই।বিয়ের অনেক কাজ, সব করতে হবে।
— আচ্ছা বাবা।আপনি যান আমরা কিছুক্ষণ পর আসছি।
বাবা মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ বলে চলে গেল।
— কি বললি রে?
— সেটা কেন তোকে বলব?
— বল বলছি।
— বললাম যে আপার তো পায়ে সমস্যা একটু হাটিয়ে নিয়ে আসি।
— বাহ কি বুদ্ধি!
— এখন বল কোথায় যেতে হবে?
— নিহান স্যারের বাসায়।
— এখন কেন?
— নুরীকে অনেকদিন দেখি না।আর স্যারের সাথে কিছু কথা আছে।
— উনি কিন্তু তোকে ভীষণ ভালোবাসে আপা।
— হঠাৎ এই কথা বলছিস কেন? উনি কেন আমাকে ভালোবাসতে যাবে?
–জানি না তবে উনি তোকে অনেক ভালোবাসে।আমি তোর এক্সিডেন্টের দিন উনাকে দেখেছি পাগলের মত করছিলেন উনি।
— আমাকে যা বলেছিস বলেছিস এটা যেন বাহিরের কেউ না জানে।
— হুম চল এখন।
— হ্যাঁ চল বের হই।
আমি আর তুশি একটা গাড়ি নিয়ে নিহান স্যারের বাসায় গেলাম।গিয়ে দেখি নীরু আর আঙ্কেল বসে গল্প করছে।
— আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।
— ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আরে নবনী মা যে!কেমন আছো?
— এই তো আঙ্কেল।আপনারা সেদিনের পর আর একদিন ও গেলেন না কেন?
–…………..
— নীরু এদিকে আসবে না?মানিকে ভালোবাসা বন্ধ করে দিয়েছো বুঝি.?
— বাবা বলেছে তোমাকে যেন আর না জ্বালাই।তোমাকে বেশি জ্বালাই তার জন্য নাকি তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছো?আচ্ছা মানি আমি কি তোমাকে খুব বিরক্ত করি?আমি যদি ভাল মেয়ে হয়ে থাকি তাও কি তুমি আমাকে রেখে চলে যাবে?আর আসবে না আমাদের বাসায়,আমার সাথে ফোনে কথা বলবে না?
মেয়েটার কথা শুনে খুব খারাপ লাগছে আমার।কত স্বার্থপর হয়ে গেছি আমি।
নীরুকে ডেকে বললাম এদিকে এসো একটা কথা বলি,চুপি চুপি বলতে হবে কাউকে জানানো যাবে না।আমার কথা শুনে নীরু দৌঁড়ে আমার কাছে চলে এলো।আমি ওকে চুপিচুপি কিছু কথা বললাম।সাথে সাথে নীরু খুশি হয়ে ফিক করে হেসে দিলো।
— সত্যি বলছো মানি?
— হুম সত্যি। কাউকে বলা যাবে না কিন্তু,মনে থাকবে?
— হ্যাঁ মনে থাকবে।
— প্রমিস?
— প্রমিস।
— আচ্ছা তুমি আমাকে মানি ডাকো তাই না?ওকে কি বলে ডাকবে বলো তো?(তিশুকে দেখিয়ে)
— তুমি বলে দাও।
— তুমি ওকে…….. মণি বলে ডাকবা কেমন?
— আচ্ছা ঠিক আছে।
— বাবা কোথায়?
— বাবা তো রুমে।
— তুমি এখন একটু মণির সাথে গল্প করো পরিচিত হও আমি একটু বাবার সাথে দেখা করে আসি হ্যাঁ?
— আচ্ছা ঠিক আছে।
— তিশু একটু ওর সাথে গল্প কর ওর সাথে, আঙ্কেল হয়তো কোন কাজে বাহিরে গেল।
— আচ্ছা তুই যা আমি আছি নীরুর সাথে।
তিশু আর নুরীকে রেখে আমি নিহান স্যারের রুমে গেলাম।
কিন্তু রুমে স্যার নেই,কোথায় গেলেন আবার এই সময়ে!!ফোন দিলাম কিন্তু ফোন তো বিছানার ওপর।ওয়াশরুম পানির শব্দ হচ্ছে তার মানে উনি গোসল দিচ্ছেন।আমি একটা চেয়ার টেনে বসলাম।
টেবিলে একটা ডায়েরি দেখতে পেলাম।প্রথম পৃষ্টা খুলতেই দেখতে পেলাম কিছু লেখা।
** আজকে নীরু স্কুল থেকে এসেই উল্লাস নিয়ে বলল তার মায়ের মত নাকি কাউকে দেখেছে।আসলেই কি রনিতার মত কেউ থাকতে পারে!!
পড়েই ডায়েরিটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলাম।কারণ যখন তখন নিহান স্যার বাহিরে বের হতে পারেন।
তার মানে কি স্যার সত্যি সত্যি ভালোবাসেন।আমি এ ক’দিনে বুঝতে পেরেছি আমিও নিহান স্যারের প্রতি অনেক দূর্বল।কিন্তু বিয়ে কিভাবে ভাঙবো?আবির আমাকে ভালবাসে ঠিকই কিন্তু আমি যে উনার জন্য কিছুই অনুভব করি না।স্যার কিছু নিয়ে মন খারাপ করে থাকলে বা আমার সাথে রাগারাগি করলে যতটা খারাপ লাগে আর হেসে কথা বললে নিজেকে পৃথিবীর সেরা সুখী নিজেকে লাগে কই আবিরের সাথে তো আমার এরকম হয় না।আমি আজকেই স্যারের মনের খবরটা নিয়ে বাবাকে জানাবো।আমি ওই বিয়ে করতে পারব না।
ওয়াশরুমের দরজায় শব্দ হতেই তাকালাম,নিহান স্যার ভেজা শরীরে মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলেন।আমি সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিলাম।এর আগে আমি কোন পুরুষকে এভাবে দেখি নি।বেশরম মনটা আবার উনাকে দেখতে চাচ্ছে।আমি জোর করে নিচের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলছি স্যার শার্ট পড়ে নিন তাড়াতাড়ি। এভাবে আপনাকে দেখতে আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে।জানি না স্যার আমার কথা শুনলেন কি না পাশে আলমারি থেকে টি শার্ট পড়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন।
— আপনি এখানে কি করছেন?কারও রুমে নক করে আসতে হয় আপনি জানেন না?এটুকু ভদ্রতা শেখেন নি?দুদিন পর যার বিয়ে সে পর পুরুষের রুমে এসে কি করছে?
— স্যার একটু থামুন। অনেক তো বললেন।আর কত….
— আর কত মানে? এক্ষুনি বেরিয়ে যাবেন আমার রুম থেকে।
— আমার সাথে এরকম আচরণ কেন করছেন স্যার?আমি কি করেছি?
— আপনি কিছুই করেন নি,অন্য একজনের হবু স্ত্রী হয়ে আমার রুমে কি করছেন?আমার সামনে কোন দিন আসবেন না আপনি।এক্ষুনি চলে যান।
— ভালোবাসেন না আমাকে?
— ভালবাসবো আপনাকে?মজা করেন আমার সাথে?
— স্যার প্লিজ বলুন না।আপনার উত্তরের উপর আমার বিয়ে নির্ভর করছে,আমার জীবন বলতে পারেন।
— আপনার কথা আমার সহ্য হয় না,দেখতেই ইচ্ছে হয় না।কেন যে আপনি আমার রনিতার মত দেখতে হয়েছিলেন!
— স্যার….
— কিসের স্যার?আপনার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।
— আপনি যদি আমাকে ভালোই না বাসেন তাহলে আমার অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে যাচ্ছে জন্য বাজে ব্যবহার কেন করছেন?
নিহান স্যার আমার একদম কাছে এসে আমার কনুই এর কাছে হাত ধরে টানতে টানতে বাহিরে নিয়ে যাচ্ছে।আমি জোর করে হাত ছাড়িয়ে নেই।
— এত অসহ্য লাগছে আমাকে?
— হ্যাঁ এতটাই।
আমি কেমন যেন উনার কথার আঘাত সহ্য করতে পারছিলাম না।
আমার আজকে সব ব্যারিকেড ভেঙে উনাকে নিজের করে নিতে হচ্ছিল,আমি বুঝতে পারছিলাম উনাকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি।কিন্তু উনি আমাকে কথা শুনিয়েই যাচ্ছেন।আমি এক পর্যায়ে নিজে স্থির রাখতে না পেরে ছুটে গিয়ে উনাকে জড়িয়ে ধরি। বৈদ্যুতিক শকের মতো উনি আমাকে টেনে আলাদা করে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।
কিছু সময়ের জন্য আমার মাথা ঘুরে যায়।খাটের কোণায় লেগে কপাল কেটে ও যায়,হাত দিয়ে বুঝতে পারি রক্ত ও বেরোচ্ছে।
উঠতে দেরি হচ্ছে দেখে উনি তুলতে আসেন আমাকে।
— আমি উঠতে পারব নিজেই।ফেলে তো অনেকেই দিতে পারে,নিজেকেই উঠে দাড়াতে হয়।
— হয়েছে এবার?বেরিয়ে যান এখান থেকে,এখানে আমার সাথে অন্তত নোংরামি করতে পারবেন না।
— এতটা আঘাত না করলেও পারতেন।আমি আজকে আপনার আসল রুপ দেখে যাচ্ছি।আমার বিয়েতে মন টানছে না,বারবার নিজেকে অসহায় লাগছিল,বুঝতে পারছিলাম না কেন খারাপ লাগছে।ভেবেছিলাম হয়তো আপনি আমাকে……….
আমি কত বড় গাধী এখন বুঝতে পেরেছি।
— ভাল করে কথা বললেই ভালবাসা হয়ে যায় না,আমার টাকা দেখে আপনি মোহে আটকে গেছেন তাই অন্য কাউকে আর বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে না।
— এটাও শুনতে হলো।আমার আর কিছু বলার নেই।
— বলবেনই বা কিভাবে,নিজেকে এত লোভী বানিয়ে ফেলেছেন যে স্যালারিতে হচ্ছে না তাই আমাকে ফাঁসাচ্ছেন।
— থু….
নিজের প্রতি এখন ঘৃণা হচ্ছে আমার,এ আমি কাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম!
আজকের পর থেকে আমার মুখ আর দেখতে হবে না। এই যে আজকে এই বাড়ি থেকে নবনীতা চির বিদায় নিলো।ভালো থাকবেন আপনি।
— এই টাকাটা নিয়ে যান,কপাল কেটে গেছে ডাক্তার দেখিয়ে নিবেন।
— উনার এই জঘন্য কথার কো উত্তর না দিয়ে শুধু দেখে চলে এলাম।
চলবে……
পেইজে ফলো দিয়ে রাখবেন সবাই।