শুভ্রতায় নবনীতা – অন্তিম পর্ব

0
666

#শুভ্রতায়_নবনীতা
#নবনীতা_নীরু
#পর্ব ঃ ২১
#অন্তিমপর্ব

আমি উনার দিকে তাকাতেই হাত ছেড়ে দিয়ে অন্যদিকে মুখ করে চোখের পানি মুছে নিলেন।
আমার আসলে কি করা উচিৎ আমি নিজেই বুঝতে পারছি না।
— তুমি হয়তো এখনও ভাবতে পারো যে তুমি আমার মৃত ওয়াইফ এর মত দেখতে তাই ওর শূন্যতা পূরণ করতে আমি এরকম করছি,কিন্তু দয়া করে এরকম টা ভেবো না।হ্যাঁ প্রথম প্রথম রণিতার জন্যই তোমার ওপর কেমন যেন অনুভব হতো কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে যখন তোমার সাথে মিশতে শুরু করলাম, তখন বুঝলাম তুমি আর রণিতা পুরোপুরি আলাদা।আমি তখন তোমার আর তোমার ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়লাম।তুমি জানো তুমি যখন আমার আশেপাশে থাকো তখন মনে হয় আমিই যে একমাত্র সুখী মানুষ এই পৃথিবীতে।লুকিয়ে লুকিয়ে তোমাকে দেখতে আর ধরা পড়ে যাওয়ার অনুভূতিটা ঠিক বোঝাতে পারব না।
— রণিতা আমার জমজ বোন ছিলো।
— কি???

আমার কথা শুনে যেন নিহান স্যার আকাশ থেকে মাটিতে পড়লেন।দারুণ একটা শক খেয়েছেন উনি।

— র রণিতা তোমার জমজ বোন মানে?ওর বাবা তো অন্যকেউ?কি বলছেন আমি বুঝতে পারছি না।
— রণিতা আর আমি জমজ বোন, রণিতার বাবা বলে যাকে জানেন উনি বাবার বন্ধু বা ভাই যাই বলেন উনার সন্তান ছিল না তাই আমাদের দুজনের মধ্যে থেকে রণিতাকে নিয়ে গেছে।
— মানে সত্যি বলছো?
— জ্বী।
— তাহলে……….
— তাহলে কি?আপনি নীরুকে আমার কাছে রেখে দিবেন,আমি ওর খালামণি হই,এখন তো কোন সমস্যা নেই তাই না?
— মানি হয়েই থাকো না প্লিজ?
— আমি আপনাকে বিয়ে করব না মানে করব না।
— আমার আর শক্তি নেই তোমাকে বুঝানোর আমি সত্যিই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি তোমাকে বুঝাতে বুঝাতে।একটা ভুলের জন্য আমার জীবনটা একদম শেষ হয়ে যাচ্ছে।
— এখন তো আবার জীবন নষ্ট হওয়ার জন্য ও আমাকেই দায়ী করবেন তাই না??

কেন জানি না উনার কথা শুনে আমার খুব খারাপ লাগছে,মনে হচ্ছে এবার আমিই অপরাধ করছি।আমিও যদি উনার মত করি তাহলে উনার সাথে আমার পার্থক্য কোথায় রইলো!!

আমি শুধু নীরুর সাথে থাকতে চাই,ওর মায়ের অভাব পূরণ করতে চাই,কিন্তু এটার জন্য আসলেই একটা সমাজ স্বীকৃত সম্পর্কের প্রয়োজন।

— যান বাহিরে গিয়ে বলেন আমি নীরুর মানি হতে রাজি,কিন্তু আপনি আমার ওপর স্বামীর অধিকার খাটাতে পারবেন না।
— আমি তাতেই রাজি নবনীতা।তুমি যতদিন না চাইবে আমি তোমার কাছাকাছি আসব না।তুমি আমাকে ঘৃণা করতেই পারো কিন্তু আমার মেয়েটাকে ভালোবেসো।আমি কখনো তোমার ওপর স্বামীর অধিকার নিয়ে আসব না।
— এবার বাহিরে যান।

আমার কথা শুনে উনি বেরিয়ে গেলেন।আমি রুমেই বসে রইলাম। বসে বসে উনার ডায়েরি দেখছিলাম।হঠাৎ মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।

— কি হয়েছে মা?
— আমি জানতাম তুই রাজি হবি,আমাদের কথা তুই কিছুতেই ফেলতে পারবি না।তুই ওখানে খুব সুখী হবি দেখে নিস।তোরা দুই বোন ভাল থাকলে আমাদের শান্তি।
মেয়েরা ভালো থাকলেই মা-বাবা ভালো থাকে।
— হুম
— আচ্ছা মা তুই রুমেই থাক ওদিকে গিয়ে দেখি কি অবস্থা।
— আচ্ছা ঠিক আছে যাও।
মা রুম থেকে বেড়িয়ে গেলে কয়েকজন রুমে ঢুকলো,আমাদের প্রতিবেশী।
— কি রে নবু,শেষে কি না একটা বিয়ে হওয়া ছেলেকে বিয়ে করছিস?তাও আবার মেয়ে আছে!
— ভাগ্যে থাকলে আর কি করব চাচি!
— তা শুনলাম ছেলেটা নাকি তোর অফিসের বস?
— হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন চাচি।উনি আমার অফিসের বস।
— তোর বিয়ে ভেঙে তুশির বিয়ে হলো জন্যই কি উনি তোকে বিয়ে করছে?
— উনার মেয়ে আমাকে খুব ভালোবাসে আর উনার বাবাও,তাই হয়তো এরকমটা হচ্ছে।আমি ঠিক বলতে পারব না।
— যেটাই হোক,ভালো থাকলেই হলো।সারাজীবন তো কষ্টই করলি এখন বিয়ের পর যদি একটু ভালো থাকতে পারিস।
— এখানেও ভালো ছিলাম চাচি,দোয়া করবেন আমার জন্য।
— দোয়া করি মা,সুখী হ।
ধীরে ধীরে সবাই চলে গেল রুম থেকে।রাত অনেক হয়ে যাচ্ছে,কিন্তু কোন কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না।
এমন সময় মা দৌড়ে আমার কাছে এলো।
— নবু, নিহানকে তো পাওয়া যাচ্ছে না।
— কি বলো!কোথায় যাবেন উনি এখন?
— কি জানি আমি বুঝতে পারছি না।
— উনার কি এখন কোথাও যাওয়ার কথা?
— তুই একটু ফোন দিয়ে দেখ,আমি বাহিরে দেখছি।

মা যাওয়ার পর মাথায় এলো উনি কি বিয়ের কথা বলে কোনভাবে আমাকে এখানে অপেক্ষায় রেখে পালালেন?কিন্তু এমনটা কেন করবেন উনি?আমি তো নিজেই বিয়েতে রাজি ছিলাম না।উনিই তো কত মিনতি, কান্নাকাটি, রিকুয়েষ্ট করে বিয়ের ব্যাপারটা এগিয়ে নিলেন,তাহলে এখন উনি কি চাইছেন?

আমি উনাকে কল দেওয়ার জন্য ফোন হাতে নিয়েছি এমন সময় দেখি উনিই আমাকে কল দিয়েছেন।আমি তাড়াতাড়ি কল রিসিভ করি।

— আমি তোমার জন্য লাল টকটকে একটা শাড়ি কিনেছি,বিয়েতে লাল শাড়ি ছাড়া বউ বউ লাগে বলো?
চুড়িও নিয়েছি,এখন বলো খোপায় বাধার জন্য কোন ফুলের মালা নিয়ে আসবো?কাঠগোলাপ /বেলী নাকি বকুল?
— পাগল হয়ে গেছেন নাকি?আপনি কাউকে না জানিয়ে এসব করতে গিয়েছেন কেন?বাড়ির সবাই চিন্তায় পড়ে গেছে।
— তুমিও??
— মানে?এসব রংতামাশা করা বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি বাসায় আসেন,নইলে কিন্তু আমি বিয়ে করব না।
— কথায় কথায় বিয়ে না করার হুমকি দাও কেন?
— দেখুন আমি নীরুর মা হওয়ার জন্য বিয়েটা করছি,আপনার শখ আহ্লাদ পূরণ করার জন্য না।
— আচ্ছা,আমি বলছিলাম কি…….
— বেশি কথা না বলে তাড়াতাড়ি চলে আসুন।
— আচ্ছা ঠিক আছে আসছি আমি।

লোকটা এত পাজি কেন?কাউকে না বলে শাড়ি চুড়ি কিনতে চলে গেল!!আবার জিজ্ঞেস করছে খোপায় বাধার জন্য কাওন ফুলের মালা নিয়ে আসবে!

রাত দশটার দিকে উনার নিয়ে আসা শাড়ি,চুড়ি,খোপায় ফুল পড়ে বসে আছি,চাচাতো বোনেরা সাজিয়ে দিয়েছে।

কিছুক্ষণ পর সবাই রুমে এলো,এতরাতে বাহিরের কেউ নেই,শুধু বাড়ির সবাই।
নিহান স্যারকেও রুমে নিয়ে আসা হলো।সবাই কথা বলছে,আমি চুপচাপ বসে আছি।মা আমার পাশে এসে বসলো।
— মা নীরুকে দেখছি না যে?
— নীরু তো ঘুমিয়েছে।পাশের রুমে আছে।
— আচ্ছা ঠিক আছে।তিশু কি কল দিয়েছিলো?
— হ্যাঁ, ও বাড়িতে অনেক মানুষ। তাই সেরকম কথা বলতে পারলো না।তোর বিয়ের কথাও বললাম।
— কি বলল তিশু?
— তিশু তো খুব খুশি।তোর সাথে কথা বলতে চাইলো।
— এখন কি ফোন দিব?
— কথা বললে দে,এখনও তো বিয়ের কাজ শুরু হয় নি।

আমি মার কথা শুনে তিশুকে ফোন দিলাম।ফোন দুইবার রিং হয়ে কেটে গেল।দুই মিনিট পর তিশু নিজেই কল দেয়।
— হ্যালো তিশু?
— হ্যাঁ আপা কেমন আছিস?
— আমি তো ভালো,তোর কি খবর?বাড়ির সবাই কেমন ব্যবহার করছে?
— এখানে সবাই তো খুব ভালো।
— আবির?
— সবাই তো দাদিমার রুমে আমাকে নিয়ে গল্প করছিলো,অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে তাই উনিই আমাকে রুমে নিয়ে এলেন।
— ভালো ব্যবহার করছে তো তাই না?
— হ্যাঁ আপা তুই এসব নিয়ে চিন্তা করিস না।আমি জানি উনার একটু সময় লাগবে সবকিছু ঠিক করে নিতে।আর আমি তো উনার সামনে মুখ আটকে গিয়েছি,আমাকে তো দেখে নি,আমি ভাবছি আজকে সব বলে দিব।
— তুই এত আনরোমান্টিক কেন বল তো?
— কেন,আমি আবার কি করলাম?
— তোর কেন সবকিছু বলে দিতে হবে?সময় নিবি,আর ধীরে ধীরে বুঝিয়ে দিবি।
— আচ্ছা ঠিক আছে,তোদের বিয়ে কত দূর?ইশ আমি থাকলে কত মজা করতে পারতাম!
— আবিরকে নিয়ে চলে আয়।
— যেতে পারলে তো হতোই।
— আবির কোথায় এখন?
— কি জানি কোথায় যেন গেলো,আমাকে রুমে রেখে বাহিরে থেকে দরজা লাগিয়ে গেল।
— আচ্ছা, চলে আসবে।তুই খেয়েছিস কিছু ওখানে গিয়ে?
— হ্যাঁ, আম্মা খাইয়ে দিয়েছে।
— বাবাহ!! আচ্ছা বোন থাক পরে কথা বলব এখন সবাই চলে এসেছে।
— আচ্ছা ঠিক আছে আপা।শোন শোন আপা..
— হ্যাঁ বল

সবকিছু ঠিকঠাক করে আমাদের বিয়ের কাজ শুরু করা হলো।
উনি বারবার আমার দিকে তাকিয়ে দেখছেন,কখনও দেখেন নি নাকি আজব,এত দেখার কি আছে!
আমি শুধু দেখি যাচ্ছি উনি কাজি সাহেবের বলার সাথে সাথে ঠিক কিভাবে আলহামদুলিল্লাহ কবুল বলছেন!মানে যতরাজ্যের কাজ বোধ হয় উনার আছে,তাড়াতাড়ি এই শেষ করে চলে যেতে হবে।

তীর এবার আমার দিকে এলে আমি চুপ করে বসে আছি,এখনও ভেবে যাচ্ছি বিয়ে করাটা কি আসলেই ঠিক হচ্ছে,বিয়ের আগেই যেরকম করেছেন আমার সাথে বিয়ের পর না জানি কি কি করে এই ভদ্রলোক।
আমাকে চুপ থাকা দেখে মা আমাকে বলেই যাচ্ছে নবু মা চুপ করে আছিস কেন কবুল বল,এত দেরি করিস না মা।
কাজী সাহেব বারবার আমাকে ফোর্স করেই যাচ্ছে।অতঃপর আমিও তিনটা শব্দ উনার জন্য বলেই দিলাম।আমার বলা দেখে নিহান স্যার যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন,উনার মুখে খুশির আভা দেখা দিলো।

প্রায় মাঝরাত,আঙ্কেল নীরুকে নিয়ে একটা গাড়িতে চলে গেছেন,আরেকটা গাড়িতে নিহান স্যার আর আমি আমাদের বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে রওয়ানা দিলাম উনার বাসায়।নতুন পরিচয়,নতুন বাড়ি,নতুন সম্পর্ক, নতুন জীবন শুরু হলো আজ থেকে আমার।

উনি ড্রাইভ করছেন আর বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছেন,আমি যেন দেখেও উনাকে দেখছি না।
গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে একমনে তাকিয়ে রইলাম,নির্জন রাস্তা, নিয়ন আলো,শহরের রাস্তার একপাশে মরিচবাতি জ্বলছে সবমিলিয়ে ভালোই লাগছে।
— নবনীতা?
— হুম…?(বাহিরে তাকিয়েই প্রকৃতির স্বাদ নিচ্ছি)
— আমাকে মাফ করতে পারো নি এখনও?
— না…
— রেগে থাকো যা ইচ্ছে তাই করো কিন্তু প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না।প্লিজ আমার আর নীরুর আপনজন হয়েই থেকো।আমি সত্যি তোমাকে অনেক ভালোবাসি,অনেক।
— আপনি এত আনরোমান্টিক কেন বলেন তো যা হবে তা দেখা যাবে, আপনি আপাতত গান ছাড়ুন।

উনি একটা গান ছাড়লেন,এক দিকে গান বাজছে আর একদিকে আমার মন বলছে আপনাকে আমি ছাড়বো না নিহান স্যার,আমি অতীত ভুলি না,একে একে সবগুলো কথা আর অপমানের প্রতিশোধ আমি নেব,খুব ভালো ভাবেই নেব।ভালোবাসার পরিবর্তে ভালোবাসা পাবেন তবে তার জন্য আপনাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। অন্যায়ের শাস্তি তো আপনাকে পেতেই হবে,পালানোর রাস্তা পাবেন না।
ভাববেন না নিহান স্যার এই নবনীতা এত তাড়াতাড়ি আপনার কাছে ধরা দিবে না।তবে একসময় জানিয়ে দেব,নবনীতা নামের মেয়েটা আপনাকে ভীষণভাবে ভালোবাসে!!!

আপনাদের থেকে আজকে #শুভ্রতায়_নবনীতা বিদায় নিলো।
অবশ্যই জানাবেন লেখাটা আপনাদের কাছে কেমন লেগেছে।
নতুন গল্প আসতে কিছুদিন দেরি হবে।খুব বেশি সময় নেবো না।
ভালো থাকবেন সবাই,নিজের খেয়াল রাখবেন।❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here