শুভ্রতায় নবনীতা – পর্ব ১০

0
357

#শুভ্রতায়_নবনীতা
#নবনীতা_নীরু
পর্ব ঃ ১০

আমি উনাকে ডাকতে থাকলাম।এক পর্যায়ে উনার ঘোর কাটে। ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকাতে শুরু করেন।আমি উনাকে ধরে তুলে বসিয়ে দেই।এখানেই উনার ফ্রেশ হওয়ার ব্যবস্থা করতে চাইলে উনি বলেন উনাকে একটু ধরে ওয়াশরুম পর্যন্তু দিয়ে আসলেই হবে।আমি তাই করি।কিছুক্ষণ পর আবার খাটে এনে বসিয়ে দেই।খাবার সামনে দিতে বলে খাব না।
— ছোট বাচ্চাদের মত কেন করছেন? খাবেন না কেন? ডাক্তার ওষুধ দিয়ে গেছে খাবার খেয়ে ওষুধ খেতে হবে।
অনেক বোঝানোর পর একটু মুখে তুললেন খাবার।খাবার খেয়ে ওষুধ খেয়ে নিলেন।
— তুমি এখন যেতে পারো,আমি ঠিক আছি।
— আমি থাকলে কি আপনার কোন সমস্যা হচ্ছে? আমি আপনাকে এভাবে রেখে বাসায় যাই কিভাবে বলেন!
— একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে মাথাটা খুব ভারি হয়ে আছে।
হঠাৎ যেতে বলে আবার মাথা টিপে চাচ্ছে, কি যে বলছেন উনি জ্বরের ঘোরে।উনি শুয়ে পড়লে আমি উনার মাথা টিপে দেওয়া শুরু করু করি।
এতক্ষণে খেয়াল করি উনি ঘুমালে ভীষণ সুন্দর লাগে।কিন্তু একদিনের অসুখে উনি কতটা অসুস্থ হয়ে গেছেন।কিছুক্ষণ যেতেই দেখি শরীর ঠান্ডা হওয়া শুরু করেছে।আমি যেই উঠে বাহিরে দেখতে যাব নুরী আর আঙ্কেল আসছে কি না ওমনি উনি আমার হাত ধরে বলতে শুরু করেন,”প্লিজ যেও না। আমার যে তোমাকে ছাড়া ভাল লাগে না।তুমি চলে গেলে যে আমি আবার একা হয়ে পড়ব ন………”
ঘুমের মধ্যে উনেকেরই কথা বলার অভ্যাস থাকে।স্যারের ও বোধ হয় আছে।আমি আস্তে করে হাত ছাড়িয়ে বাহিরে চলে আসি দেখতে।কিন্তু নাহ এখনও তারা আসেনি।আমি আবার রুমে চলে আসি।
— “আমি সেদিন থেকেই মনে মনে তোমাকে পছন্দ করতে শুরু করি,তুমি কি দেখো না তোমার জন্য আমি নিজের কতটা পরিবর্তন করেছি।আমি তোমাকে ভালোবাসি নবনীতা। রনিতার মত তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না প্লিজ।তুমি ছেড়ে গেলে এবার আমি এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে নেব।”

স্যারের কথা শুনে আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। কি বলছে স্যার এসব।স্যার আমাকে ভালোবাসে!!

বিকেলে উনি একটু সুস্থ হলে আঙ্কেলকে বলে বাড়ি চলে আসি।
স্যারের কথাটা কিছুতেই আমার মাথা থেকে যাচ্ছে না। তার কথা সবসময় আমার কানে বাজছে,”আমি তোমাকে ভালবাসি নবনীতা ”
উনার কথা মনে করে অনেক ভাল লাগছিল।কেন জানি না উনার প্রতি আমিও কিছু একটা অনুভব করছিলাম।কিন্তু যখনি উনার আগে বলা কথা মনে হলো তখন বুঝলাম এটা আমার ভুল ধারণা। কারণ উনি এখনো উনার স্ত্রীকেই ভালোবাসেন।আর উনি আমাকে যতটা পছন্দ করেন সেটা হয়তো আমি উনার স্ত্রীর মতো দেখতে তাই।

রাতে মা আমার ঘরে এলো,এসে বিছানায় বসলো।
— কি রে নবু অফিস থেকে আসার পর থেকে ঘরে এসে চুপচাপ বসে আছিস কেন?আমি মার কোলে মাথা রেখে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লাম।।
— মন থেকে ভালোবাসলে তাকে পাওয়া যায় না তাই না মা? আর পাওয়া গেলেও তাকে আজীবনের জন্য ধরে রাখা যায় না।
— এটা কেন মনে হলো?
— আমার স্যার উনার স্ত্রীকে ভীষণ ভালবাসত,ভালবাসত বলছি কেন,উনি এখনও ভালোবাসেন অথচ দেখ উনার স্ত্রী উনাকে রেখে আল্লাহর কাছে চলে গেছেন।
— সে বেঁচে থাকলে তোরা তিন বোন হতি।
— কিহ?আমি শুয়ে থাকা থেকে উঠে বসলাম।
— হ্যাঁ রে।
— আমি কিছু বুঝতে পারছি না মা,প্লিজ বুঝিয়ে বলো না।
— আমি বলছি(বাবা)
বাবা বাহিরে থেকে আমার ঘরে ঢুকলেন।এসে টেবিলের সাথে রাখা চেয়ারটা টেনে বসলেন।
— ওটা তোর বোন ছিল রে মা,আমার আরেকটা কলিজার টুকরা…
বলেই বাবা কান্নায় ফেটে পড়লেন।তার মানে এই কথাগুলোই সেদিন বাবা আর মা বলাবলি করছিলেন।
— তোরা যখন জন্মাস তখন আমাদের সংসারে খুব অভাব।কোনভাবেই সংসার চালাতে পারতাম না।আবার সংসারে দুই দুইটা জমজ মেয়ে।
দুইটা মেয়ের দায়িত্ব নেব কিভাবে তাই আমার এক বন্ধু আমাকে কিছু টাকা দেয় আর বলে একটা মেয়ে তাদের দিয়ে দিতে,সে ছিল অনেক ধনী। আমার মেয়ে অনেক ভাল থাকবে জেনে আমি তাকে আমার মেয়েকে দিয়েছিলাম।কিন্তু সে শর্ত দিয়েছিল আমি কখনও আমার মেয়েকে আমার পরিচয় দেব না।তখন আমার রাজি হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না রে মা।আর দেখ না আমার মেয়েটাকে দেখার ভাগ্য হলো না।
বাবা কথাগুলো বলে কেঁদেই চলেছে।আমারও খুব কষ্ট হচ্ছে,রনিতা আমার বোন ছিল!!
আমি নিজের চোখে একবার আমার বোনকে আমি দেখতে পারি নি!একটাবার ছুয়ে দেখতেও পারি নি তাকে।আমার ও খুব কান্না পাচ্ছিলো কথাগুলো ভেবে।মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, নাহ স্যারের প্রতি আর দূর্বল হওয়া যাবে না আমার।সে আমার বোনের বর। কিন্তু নীরুর প্রতি তো আজকে আমার আলাদা অধিকার জন্মালো।সে আমার আপন বোনের মেয়ে,আমার ভাগনী।
বাবা এক পর্যায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান।আমি আর মা আছি বসে,আমার মাথায় বাবার বলা কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে।এমন সময় মার একটা প্রশ্নে আমি তার দিকে তাকাই।
— তুই কি রনিতার বরকে ভালোবাসিস?(মা)
— কি বলছো মা উনি আমার অফিসের স্যার আর এখন তো উনি আমার মৃত বোনের স্বামী।
— আমি তোর মা নবনী,আমি আমার ছোট মেয়ের চেয়ে বড় মেয়েকে বেশি বুঝি।
— না মা এরকম কিছুই না।
— আমাকে তুই বলতে পারিস আমি তোর বাবার সাথে কথা বলব।
— না মা বাদ দাও তো।ভুল বুঝছো তুমি।
— দেখ মা আমি চাই না আমার কোন মেয়ে অসুখী হোক।যেখানে ভাল থাকবে সেখানেই দিব আমার মেয়েদেরকে।
— না মা আমি এই বিয়েতেই রাজি।
— আবিরের বাবা এসেছিলো,আবির নাকি সামনে মাসেই আসছে।
— আরও দেরিতে আসার কথা ছিল না?
— হ্যাঁ তবে, তার কাজ শেষ তাই এখানে চলে আসছে।
— আচ্ছা।
— ঠিক আছে থাক এখন,আমি যাই।
— আচ্ছা মা।

পরপর তিনদিন স্যার অফিসে আসতে পারেন নি।নীরু আর আঙ্কেল অনেকবার ফোন দিয়ে বাসায় যেতে বলেছে কিন্তু আমি নানা অজুহাত দেখিয়ে আর যাই নি।আজকে কেবিনে বসে ছিলাম,মাথাটা খুব ব্যথা করছে দেখে উঠে কফি বানাতে যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছি ওমনি দেখি স্যার অফিসে ঢুকছেন।লোকটার চেহারার কি অবস্থা হয়েছে এই তিন চারদিনে।দেখে মনে হচ্ছে এখনি কেউ ধাক্কা দিলে পড়ে যাবে।স্যার আমার দিকে এক নজর দেখেই নিজের কেবিনে চলে গেল।হয়তো এই কয়েকদিন যাই নি জন্য রাগ করেছেন।কফি বানাতে চলে গেলাম।
দুই কাপ কফি নিয়ে স্যারের কেবিনে ঢুকলাম।স্যার বসেই ছিলেন।
— স্যার আসব?
— হ্যাঁ।
— স্যার এই নিন কফি।
— এখন কফি খেতে ইচ্ছে করছে না।
— খেয়ে দেখুন ভাল লাগবে।
— রাখুন টেবিলে।
— স্যার আপনি আমার সাথে তুমি করে বলতেন।
— এখন আপনি করে বলছি সমস্যা কি?
— না স্যার কিছু না।আপনার শরীর কেমন এখন?
— হুম ভাল।
— আসলে অফিসে একটু ব্যস্ত ছিলাম তাই বাসায় যেতে পারি নি।
— আমার চেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট কি কাজ ছিল নবনীতা?
— স্যার…..
— আপনি আমার মেয়ে আর আমার বাবার ভালবাসাকে উপেক্ষা করেছেন।
— স্যার আসলে…..
— ব্যাপার না আপনার পারসোনাল ম্যাটার থাকতেই পারে।
— স্যরি স্যার।
স্যারের কথাগুলো শুনে আমার সত্যিই খুব খারাপ লাগছে।আসলেই তো আমি ভুল করেছি।যারা আমাকে ভালবাসে তাদের কাছেই না যাওয়ার অজুহাত দেখিয়েছি।আর এতদিন যে কোন কাজে স্যারের পাশে ছিলাম আর তার এত অসুস্থতায় আমি দূরে থাকলাম!কেমন করে পারলাম আমি।আমি তো শুধু ভয়ে ছিলাম স্যারের সেই কথাগুলোর।যদি জ্বরের ঘোরে বলা কথাগুলো সত্যি হয় তাহলে আমি কি করব?
— চোখের পানিটা মুছে নিন,আর এখন আসতে পারেন। (স্যার)

স্যারের কথায় আমার ভাবনার ছেদ ঘটলো।আমি আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে বাহিরে চলে এলাম।
স্যারের এটুকু কথায় তো আমার মন খারাপ করার ও কথা না তাহলে আমি কান্না করছি কেন!!আমি তো আগে এত নরম মনের ছিলাম না,এত সহজে তো চোখে পানি আসতো না।তাহলে এখন কেন এমন হচ্ছে!!

চলবে…..

**যারা পড়বেন দয়া করে একটা করে মন্তব্য করে যাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here