শুভ্রতায় নবনীতা – পর্ব ১১

0
264

#শুভ্রতায়_নবনীতা
#নবনীতা_নীরু
#পর্ব ঃ১১

আজকে একটু কাজের চাপ ছিল তাই অফিস থেকে বের হতে হতে আটটা বেজে গেছে।গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে আছি।
— আরে নবনীতা নাকি?
— ওহ শ্যামল ভাইয়া আপনি?
— হ্যাঁ, আজকে এত দেরি কেন?
— একটু চাপ ছিল কাজের।
— তো চলো আমি নামিয়ে দেই বাসায়।
— না ভাইয়া লাগবে না,রিকশা চলে আসবে। আপনি যান।
— দেখা যেহেতু হয়েই গেলো এখন আর একা রেখে কিভাবে যাই! সবচেয়ে ভাল হয় তুমি আমার বাইকে ওঠো।কিছুক্ষণেরই তো ব্যাপার।
অনেক জোর জবরদস্তির পর বাইকে উঠে বসলাম।কিছুক্ষণের মধ্যে শ্যামল ভাইয়া আমাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়।

আমিও বাড়ির ভেতরে চলে গেলাম।মার জন্য ওষুধ এনেছিলাম সেগুলো দিতে মার ঘরে গেলাম।
— এত দেরি হলো কেন আজকে?
— আজকে অনেক প্রেশার ছিল কাজের।এই নাও তোমার ওষুধ।
— রাখ ওখানে।
— আচ্ছা।
— বস এখানে।দেখতো গহনাগুলো পছন্দ হয় কি না।
— এগুলো কার জন্য?
— তোকে যেহেতু দেখতে বলছি তাই এগুলো তোরই।
— এত টাকা কোথায় পেলে?
— তোর টাকাই এগুলো।এখন আর কোন কথা না,নে দেখ।
— মা এগুলো করার কি দরকার ছিল?
— আমার মেয়ের বিয়েতে আমি তাকে সাজিয়ে দিব না?
— মা বিয়ে না দিলে হয় না?ওরা কি খুব ঝামেলা করবে?
— এতদিন পর এসে এ কথা কেন?
— আমার তোমাদের ছেড়ে যেতে মন টানছে না মা।
— বাড়ি তো কাছেই রে নবু,নাকি অন্য কোন কারণ আছে বল আমাকে?
— অন্য কি কারণ থাকবে মা?এটাই কারণ।
— এভাবে তো বিয়ে ভাঙা যায় না নবু,আর তাছাড়া ছেলে আর সপ্তাহ খানেক পর আসছে,এ মাসের আর হাতে গোণা দুই তিন দিন আছে।
— আচ্ছা থাকো আমি ফ্রেশ হব।

বলেই রুম থেকে চলে এলাম।আমার কেন এমন হচ্ছে?যার সাথে আমার বিয়ে উনি তো আমাকে খুব ভালোবাসে,বড় বাড়ি, তাহলে আমার আর কিসের এত সমস্যা!কেন আমি বিয়েতে মন বসাতে পারছি না?বাবা তো বলল উনি বিদেশ থেকে আসলেই বিয়ের কাজ শুরু হয়ে যাবে তাহলে তো বেশি দিন নেই এখনো কেন মন বসছে না বিয়েতে?

ফ্রেশ হয়ে এসে মনটা কেমন যেন করছিল।তুশি ও বাড়িতে নেই নানা বাড়ি বেড়াতে গেছে।সময় কাটছিল না।তার ওপর স্যারের বলা কথাগুলো মনে পড়ছে,নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে।নীরুর সাথেও কথা হয় নি।তাই নীরুকে ফোন দিলাম।ওর সাথে কথা বললে একটু ভাল লাগবে।

— হ্যালো নীরু?
— নীরু ঘুমাচ্ছে।
— স্যার?
— হ্যাঁ।
— স্যার আপনার শরীর কেমন এখন?
— ভাল।
— আপনি কি এখনও আমার ওপর রেগে আছেন?
— আপনার ওপর কেন রেগে থাকব?
— ওই আপনার অসুস্থতার সময় আমি যাই নি।
— আসতে না ই পারেন।
— স্যার একটা কথা ছিল।
— হ্যাঁ বলুন।
——–
— কি হলো বলুন?
— না স্যার কিছু না।
— এরকম কথাবার্তা আমার কিন্তু পছন্দ না।
— স্যার কালকে অফিসে বলব।
— এখন কি সমস্যা?
— না মানে স্যার…
— মানে মানে না করে বলুন কি বলবেন?
— স্যার আ আপনি ক কি আ আমাকে….
— ক্লিয়ারলি বলুন তোতলাচ্ছেন কেন?
— স্যার মা ডাকছে পরে কথা হবে।
বলেই ফোনটা রেখে মনে হলো হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।কি যে বিপদে পড়তে যাচ্ছিলাম আমি,নিজেই নিজেকে বিপদে ফেলতে যাচ্ছিলাম আগ বাড়িয়ে।
উনি জ্বরের ঘোরে কি বলেছে না বলেছে সেটা নিয়ে পড়ে আছি আমি।
কিন্তু উনার ব্যবহারেও তো মাঝে মাঝে বুঝি যে উনি আমাকে পছন্দ করেন।
আমি কি বেশি বুঝি নাকি ঠিক বুঝি সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না।কিন্তু আমি তো কাউকে ভালবাসি না বা পছন্দ করি না তাহলে বিয়েতে মন কেন বসছে না আমার।বাহিরে থেকে খবর আসলে হয়তো কিছু দিনের মধ্যে বাড়িতে মেহমানরাও আসা শুরু করবে।

মা খাওয়ার জন্য ডাকছিল তাই খেতে চলে গেলাম।মা,আর বাবার সাথেই আজ খেতে বসেছি,তুশি তো আজকে নেই।আমি খাওয়া শেষ করে বিছানায় গিয়ে বসলাম।ইদানীং স্যারের কথা কেমন যেন একটু বেশিই মনে পড়ছে।বারবার মনে হচ্ছে নিহান স্যারের সাথে আমি অন্যায় করে ফেলেছি।আমি উনার খারাপ সময়ে পাশে থাকতে পারি নি।উনি কি আদৌ আমায় মন থেকে ক্ষমা করতে পারবেন!
বাবার ডাকে ভাবনার ছেদ ঘটলো।বাবা খাওয়া শেষ করে বললেন
— বিয়েতে কাকে কাকে দাওয়াত দেওয়ার আছে তোর মা?
— আমার আর কাকে দাওয়াত দেওয়ার থাকতে পারে বাবা?তেমন তো কেউ নেই,অফিসের কয়েকজনকে দাওয়াত দিলেই হবে।তাও আসবে কি না জানি না।দিয়ে রাখব তবুও।

— কতজন হতে পারে?
— বাবা এখনি এসব কেন?
— আবির বাবা তো খুব তাড়াতাড়ি চলে আসছে।আগে থেকে লিস্ট করে রাখতে হবে।আবির চলে আসলেই তো তোদের বিয়ে।
— আপনি অন্যদেরটা দেখুন,আমি আমার টা লিস্ট করে দিব।
— আচ্ছা ঠিক আছে।
–আমি এখন রুমে গেলাম।ঘুমোবো খুব ক্লান্ত লাগছে আজকে।

রুমে এসে দেখি স্যার দুবার কল দিয়েছিলেন।স্যার কি কিছু সন্দেহ করেছেন আমার কথা শুনে??স্যারকে কি কল ব্যাক করা উচিৎ? আমার তো সাহসই হচ্ছে না স্যারকে কথাটা জিজ্ঞেস করার।অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম নাহ আমি আর আজকে কল করব না,কালকে একদম সাহস সঞ্চয় করে চোখ বন্ধ করে কথাগুলো বলে দিব।
আমি আর কলব্যাক করলাম না,কারণ কি না কি বলে ফেলব আবার।ফোন সাইলেন্ট করে ঘুমিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম।

সকালে উঠে মাকে কাজে সাহায্য করছিলাম।এখন মার সাথে কথা বলতে আর একটুও ভয় লাগে না।এখন মার সাথে চাইলেই সব কথা শেয়ার করতে পারি।বসে বসে মাকে সাহায্য করছিলাম আর বসে বসে গল্প করছিলাম এমন সময় তুশি ফোন দেয়।
— হ্যালো আপা,কেমন আছিস?
— ভালো রে তোর শরীর কেমন?
— আমি তো বিন্দাস আছি।
— তার জন্যেই বাড়িতে আসতে ইচ্ছে করছে না?
— আজকেই যাব তো,তোকে খুব মিস করছি।
— তাড়াতাড়ি চলে আসবি,আমি যেন অফিস থেকে এসে দেখি তুই বাড়িতে।মনে থাকবে?
— হ্যাঁ আপা মনে থাকবে।
তুশি মায়ের সাথেও অনেকক্ষণ কথা বলল।তারপর আবার আমার সাথে কথা বলতে চাইলে মা আমাকে ফোনটা ধরিয়ে দেয়।
— হ্যাঁ তিশুবাবু বলো
— আপা জানিস কি হয়েছে?
— জানি না তো!কেন কি হয়েছে?
— এখানে একটা ছেলে প্রতিদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে আমাকে দেখে,বিকেলে হাটতে বের হলে আমাদের পিছনে দেখা যায়।কালকে আমার সাথে কথা বলেছে,ফোন নম্বর ও দিয়েছে।মামিকে বলতেই মামি বলল ছেলে নাকি এলাকার ধনী পরিবারের ছেলে তাই তো ফোন দিতে ইচ্ছে করছে না।
— আচ্ছা বাড়ি আয় আগে,পরে দেখা যাবে।
তুশির সাথে কথা বলে ফোন রেখে দিয়ে কাজে হাত লাগালাম। কাজ শেষ করে রুমে গেলাম।
কিছুক্ষণ পর বাহিরে এসে দেখি পাশের বাড়ির কাকি, মায়ের সাথে গল্প করছে।আমাকে দেখে বলল,
— আমাদের নবু তাহলে সংসার করবে ওত বড় বাড়িতে?দেখিস বাবা সাবধানে থাকিস ও বাড়িতে নাকি কি সব আছে।ওখানে তো আবার তোর শশুড়ের ছোট ভাইয়ের বৌ বাসর রাতে আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিল। আরও কি কি সব নাকি আছে,সাবধানে থাকিস মা।
— কাকি কি সব বলতে নিশ্চয়ই ভূত প্রেতকে বুঝাচ্ছো?ওগুলো আসলে কিছুই হয় না।আর আগুনে পুড়ে যাওয়া নিশচয়ই কোন দূর্ঘটনা ছিল।
— কি জানি বাবা!ওত কিছু জানি না,তুই মেয়ের মত তাই বললাম।

মা আমাকে ইশারা করে ঘরে যেতে বলল।
— আচ্ছা কাকি তুমি মায়ের সাথে গল্প করো আমার অফিসে যেতে হবে রেডি হই।
— ও বাড়িতে গেলে বিয়ের পর আবার চাকরি করতে দেবে তো?কত বড়লোক বাড়ি…
ওরা কি চাইবে তাদের বাড়ির বউ চাকরি করুক?
— সেটা পরে দেখা যাবে কাকি।এখন থাকো আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।

সকাল থেকে ভাবছি আজকে অফিসে যাওয়ার পর স্যারকে জিজ্ঞেস করতেই হবে।নাকি বিষয়টা নিয়ে না ভাবাই ভাল?কিন্তু একটা পরিক্ষা তো করা যেতেই পারে।
আজকে তুশির বাড়ি আসার কথা।মেয়েটা অনেকদিন বাড়িতে নেই খুব মিস করছি ওকে। ও আমার থেকে একটা ফোন চেয়েছে আজকেই কিনে দেব অফিস থেকে ফিরে।
মাকে বলে অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে অফিসের জন্য বের হলাম।
রিকশা নিয়ে যাচ্ছিলাম,এমন সময় খেয়াল করলাম সামনে কোন কারণে মিছিল হচ্ছিল।
— মামা সাবধানে এদের পার করে বেরিয়ে যান তো।আমার কিন্তু ভয় লাগছে।
— ভয় পাইয়েন না, আমি আছি তো,ঠিক বের করে নিয়ে চলে যাব।
বেশিরভাগ জনসমাবেশে বা মিছিলে দূর্ঘটনা ঘটে, আমি এসবে ভীষণ ভয় পাই।রিকশা চালককে পাশের রাস্তা দিয়ে ঢুকতে বললে সে আমার কথা না শুনে সোজা রাস্তা দিয়েই যায়।আমি বোরখা ঠিক করে বসি।আমি কিছু কিছু জিনিসে একটু বেশিই ভয় পায়।আমি চুপচাপ মাথানিচু করে বসে আছি রিকশায়।
চারপাশে মানুষের গলার আওয়াজ বেড়েই চলেছে।আমি মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়েই যাচ্ছি। আজকে কেমন যেন মনে হচ্ছে মাকে আরেকটু ভাল করে দেখে এলে ভাল হতো।বোনটাও তো বাড়িতে নেই, ওর সাথে দেখা হলে ভাল হতো।বাবা তো আগেই থেকে বেরিয়ে গেছিল।
সবার কথা খুব করে মনে পড়ছিল।আজকে হঠাৎ এমন মনে হচ্ছে কেন,অতিরিক্ত ভয় পাওয়ার জন্য হয়তো এমন হচ্ছে।

হঠাৎ চিল্লাপাল্লাতে বুঝলাম পিছন থেকে একদল ছুটে আসছে,আমি তাড়াতাড়ি করে রিকশা চালককে থামিয়ে নেমে পড়ি আমি সাথে সাথে দৌড়ে রাস্তা পার হতে যায়,আশেপাশে কোন কিছু যেন দেখার সময় নেই আমার।আমি শুধু দৌড়াচ্ছি।প্রায় অফিসের সামনে চলে এসেছি এমন সময় কিছু একটা এসে আমাকে জোরে আঘাত করলো।টাল সামলাতে না পেরে রাস্তায় পড়ে গেলাম।চারপাশের কোন আওয়াজ আর আমার কানে আসছে না,চোখ দুটো বন্ধ হওয়ার আগে ঝাপসা দেখতে পেলাম অনেকে ছুটে আসছিল আমার দিকে।
তারপর….
তারপর আমার আর কিছু মনে নেই।

চলবে…….

অনেক অনেক কমেন্ট চাই🥰

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here