তুই আমার অঙ্গারাম্লজান – পর্ব ৪

0
244

#তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান
পর্ব_৪
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা

৪.
কলেজে গিয়ে দেখি তুশিরা একজনের সঙ্গে ক্যান্টিনে বসে ভেটকা-ভেটকি করছে। হি হি, হে হে করেই যাচ্ছে। আমি কাছে যেতেই তুশিরা হাত তুলে বললো,
“হেই দোস্তো।”
বলেই পাশের ব্যক্তিটির সঙ্গে কোনো কথা নিয়ে হাসিতে মেতে ওঠলো। আমি তাদের হাসি শুনে চোখ গরম করে তাকালাম।
জামার দুটো বোতাম খোলা, গলায় গুন্ডাদের মতো আইডি কার্ড ঝুলানো একটা মেয়ের সঙ্গে তুশিরা রঙ-ঢঙ শুরু করেছে। মেয়েটাকে আগে কখনো নজরে পড়েনি। সোল্ডার ব্যাচে সি সেকশন লেখা। অর্থাৎ আমাদের ক্লাসেরই ছাত্রী। নতুন হবে বোধহয়, তাই-ই আগে দেখিনি। আমার এখন ইচ্ছে করছে তুশিরাকে শূণ্যে তুলে আছাড় মারি। অকৃতজ্ঞ, কা-মহিলা। নতুন মানুষ পেয়ে আমাকে ভুলে গেছে। আমি তাদের থেকে খানিক দূরত্ব বজায় রেখে একটা চেয়ারে গিয়ে বসলাম।
তুশিরা আমাকে ডেকে বললো,
“দোস্ত এই হলো আমার দূর সম্পর্কের কাজিন। কাজিন নাকি আন্টি সঠিক বলতে পারছি না। নাম ধরেই ডাকি। আমাদের কলেজে নতুন এসে ভর্তি হয়েছে।”
মেয়েটা হাত তুলে তুশিরাকে থামিয়ে বললো,
“দাঁড়া, বাকিটা আমি কই। আমার নাম চাঁদনী, দেখতে যদিও কালনী। হোস্টেলে উঠেছি। আর তুই ফাবলীহা আমি জানি। তুই অত্যধিক সুন্দর হওয়া সত্ত্বেও যে তোর চৈত্রের খড়ার কপালে পিড়িত নাই সেটাও আমি জানি। আর কি জানতে চাস ক।”
এক নিশ্বাসে মেয়েটি কথা বলে থামলো। আমার উত্তরের সে এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলো না।
মেয়েটাকে ভালো করে লক্ষ্য করলাম। সে উঠে গিয়ে ছেলেদের বড় করে সালাম দিচ্ছে,
“আসসালামুআলাইকুম ভাই, ভালো আছেন?”
ছেলেরাও আমোদিত হয়ে আহ্লাদিত গলায় জবাব দিচ্ছে। ছোট ক্লাসের গার্ডিয়ানদের সঙ্গেও দেখছি নিমিষেই ভাব জমাচ্ছে। পরিবর্তে পাচ্ছে গাল ভরা চুমু।
ব্যতিক্রম ঘটলো এক জায়গায় গিয়ে। পাশের টেবিলে বসে জিরাফের মতো মাথা উঁচিয়ে হাউ-কাউ করা আন্টি মহলে সে গিয়ে প্রবেশ করলো।
একটা আন্টির কাঁধে হাত রেখে বললো,
“ভালো আছেন কাকী? তো আপনার সাংসারিক কি সমস্যা? কাকা টাকা-পয়সা আপনাকে না দিয়ে বোনদের দেয়? শুনে দুঃখ লাগলো। আপনি এতো অসহায় যে একটা বোরকাও পিনতে পারেন না। ভুড়ি-চর্বি সব বাইর হওয়া মানুষরে হাই দিতাছে।”
মেয়েটি ঝুঁকে ফিসফিসের মত অভিনয় করে গলা ফাটিয়ে বললো,
“আপনাকে বোধহয় আন্ডার পেপারের ট্যাকাও দেয় না। সব দেহা যায়। এই নেন আমি ট্যাকা দিলাম।”
চাঁদনীর গলা ফাটানো কথা বুঝি দূরে অবস্থান করা ছেলেরাও শুনতে পেলো। সবার মাঝে হাসির রোল পড়ে গেলো।
চাঁদনী পায়জামার পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকা বের করে মহিলাটির হাতে গুঁজে দিলো। বললো,
“এই ট্যাকায় নিউ মার্কেটের সামনে ফুটপাতে ভালো মানের পাইবেন।”
পাশে বসা আরেকজন মহিলা রাগান্বিত হয়ে বললো,
“এই বেয়াদব মেয়ে! তোর শিক্ষা দীক্ষা নাই? বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানিস না?”
মেয়েটি বিগলিত হেসে পাশের মহিলাটির কাছে গেলো। টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে বললো,
“কি ব্যাপার আন্টি? ভিতরে এভাবে কারেন্ট উঠছে কেন? ওই আন্টিরে এভাবে আধা কাপড়ে দেখতে ভালা লাগে? মাইয়া হইয়া মাইয়াগো লগে পরকীয়া করেন?”
“এই মেয়ে..”
আরেকটা আন্টি কিছু বলতে গেলে চাঁদনী ধমকে ওঠলো,
“এই চুপ! কথা শেষ হইছে আমার!”
পূর্ব মহিলাটির দিকে আবার ফিরে বলতে লাগলো,
“তো আন্টি আজকে আপনার কোন ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখতে আসছেন কলেজে? কোনটারে পছন্দ হইছে?”
“এই ছেড়ি!”
মহিলাটি চিৎকার করে দাঁড়াতে গেলে মেয়েটি কাঁধ চেপে বসিয়ে দিতে দিতে বলে,
“কলেজের ছাত্রীদের উপর নজর রেখে ভাড়া করে তুলে নিয়ে যাস শালী! ভাতার রাখিস ভাতার? এইজন্যই তো তোর জামাই অন্য বেডিগো কাছে যায়। কারেন্ট মধ্যমা আঙ্গুল দিয়ে খাওয়ায় দেব ঠিক।”
চাঁদনী ধমকা-ধমকি ঠাহর করে আশেপাশের ছাত্র-ছাত্রী এসে জড়ো হতে লাগলো।
কয়েকটা মেয়েদের দল থেকে একজন বলে ওঠলো,
“এই মহিলাকে আমিও দেখেছি মেয়েদের ধরে ধরে খোঁজখবর নেয়, বাড়ির ফোন-ঠিকানা জোর করে নেয়। আমার একটা বান্ধবীর বাসায় গিয়েও বিয়ে দেওয়ার জন্য হুমকি দিয়ে অনেক ঝামেলা করেছে।”
কয়েকজন বলতে লাগলো,
“ছিঃ, এতো খারাপ এই মহিলা.. মেয়েদের তো কলেজেও কোনো নিরাপত্তা নেই.. কার কার সর্বনাশ করেছে কে জানে…”
চাঁদনী হাত উঁচিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললো,
“তোমরা সবাই ব্যবস্থা নাও। এই মহিলার সঙ্গে এর সাঙ্গো-পাঙ্গোদেরও ধরো।”
আন্টির দল পুরো হতভম্ব।
এই মহিলাকে আগেও আমি দেখেছি ঘটকালি করতে। একজন স্টুডেন্টের মা। কিন্তু কলেজে এসে উনার আত্নীয়-স্বজনদের বংশবৃদ্ধির জন্য উৎস খুঁজে। আজ চাঁদনী না ধরলে আমিই একদিন ধরে ছ্যাঁচা দিতাম।
মেয়েগুলো উঠে ওই মহিলাদের ঘিরে ধরে। ছোটোখাটো একটা জটলা সৃষ্টি হয়ে যায়। কলেজ গেইট থেকে দারোয়ান তা দেখে ক্যান্টিনে দৌঁড়ে আসে।
“এই অসভ্য মহিলাকে সবাই ধরে লাথি-উস্টা মার। সবগুলোকেই মার। আর কখনো যেন এখানে না আসে।”
চাঁদনী বলতেই টানাটানি করে ধরে সবাই প্রিন্সিপালের কাছে গেলো।
আরেকজন মহিলা কাঁদতে কাঁদতে বলছেন,
“আমি এই মহিলার সঙ্গে নাই আম্মুরা। আমি চুপচাপ বসে থাকতাম। ভয়ে কিছু বলতাম না আম্মুরা।”

চাঁদনী তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হাসলো। পাশ দিয়ে একটা ছেলে যাচ্ছিল। চাঁদনী হঠাৎ তাকে খপ করে ধরে বসে।
“এই ছেড়া, কিয়ে পড়ছ তুই?”
ছেলেটি হতচকিত হয়ে উত্তর দিলো,
“ইলেভেনে।”
চাঁদনী অবাক হয়ে দুই গালে হাত দিয়ে জিগ্যেস করলো,
“কি কইলি? ইলেভেনে?”
ছেলেটির গাল টেনে বললো,
“এই তোরে কেডারে কলেজে উঠতে দিছে। এখনও দেখতে ফিডার খাওয়া ছুইটকাদের মতো। ফিডার খাস তুই?”
“না আপু।”
“এই তুই আমারে আপু কইলি কেরে? ব্যাচ দেখছ না? তোর সমবয়সী। তুই কইরা ডাকবি।”
ছেলেটির মুখ বিস্ময়ে বিহ্বল। উল্টো ঘুরে দৌঁড় লাগাতে যাবে, চাঁদনী তখনও ছোট্ট দেহের বেচারাকে বল ক্যাচ ধরার মতো ধরে ফেললো।
“কই যাস? পছন্দ হয় নাই আমারে? এই আমি কী তোরে বিয়া করতে কইছি যে ডরাস?”
ছেলেটির ছোট্ট দেহটি চাঁদনী বগলদাবা করে দোকানে নিয়ে গেলো। সেখান থেকে দুটো কোক কিনে তাকে নিয়ে খেতে শুরু করলো। আর কি হাসাহাসি! ছেলেটিও এখন হাসছে। আর আমি আবেগে আপ্লুত। এই শুল্কপক্ষের চাঁদ এতোদিন কিসের চিপায় মুখ ডুবিয়ে ছিলো? আগে কেন দেখা হলো না? কি চমৎকার একটা মেয়ে। মুহূর্তে সবাইকে কাচির মতো কাট কাট করে সাইজে নিয়ে আসে। এই মেয়েই পারবে ফাকাদ ও তার পরিবারকে আলুর চাপ বানিয়ে আমাকে রক্ষা করতে।
ছেলেটিকে বিদায় দিয়ে সে এদিকে এগিয়ে আসলে আমি ক্যাঙ্গারুর মতো দুটো লাফ দিয়ে তার বাহুতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। সে-ও আমাকে গলায় ঝুলাতে ঝুলাতে চেয়ারে এসে বসলো।
“তুই এতোদিন কই ছিলি আমার চাঁদ?”
ও লাজুক হেসে জিগ্যেস করলো,
“পছন্দ হয়েছে?”
আমিও লাজুক ভঙ্গিতে বললাম,
“হুম হুম।”
পছন্দ হওয়ার কারণ হিসেবে সে আমার ভাইয়ের কথা জিগ্যেস করলো,
“তোর ভাই কি করে?”
“আপাতত কিছু করে না। শুধু বর্তমানে একটা বউ খুঁজছে রোমান্স করার জন্য।”
“যাহ দুষ্টু।”
বলেই মুখ ঢাকলো।
আমি আর তুশিরা একসঙ্গে খিলখিল করে হেসে ওঠলাম।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here