তুই আমার অঙ্গারাম্লজান – পর্ব ৩

0
271

#তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান
পর্ব_৩
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা

৩.
“আকাশেতে লক্ষ তারা চাঁদ কিন্তু একটারে, ইয়াহ!”
দাঁত খিচিয়ে এমন ইয়াহ বলা শুনে আমি মাথা ঘুরিয়ে তুশিরার দিকে তাকালাম। এখন আমরা কোচিংয়ে আছি। মাত্র এসে বসলাম। স্যার কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবেন। কিন্তু আমার বান্ধবীর মনে রঙ লাগার কারণ উদ্ঘাটন করতে পারছি না।
আমি তুশিরার উদ্দেশ্যে অবাক হওয়ার ভান করে বললাম,
“আকাশে যে একটা চাঁদ তা তো জানতামই না। জানতাম তো দুইটা থাকে। একটা সূর্যের গার্লফ্রেন্ড, আরেকটা আমাদের নাহিয়ান ভাইয়ার সুন্দরী প্রেয়সী।”
তুশিরা খুশি হয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে পাঁচশো চল্লিশ ভোল্ট নিয়ে হাজির হয়ে স্মাইল দিলো।
আমি আমার মাথাটা পিছনে সরিয়ে বললাম,
“আরে, প্রশংসা করছি বলে এভাবে দাঁত দেখাবি? পেঁয়াজের গন্ধ আসছে। ওয়াক ওয়াক।”
তুশিরা হাসি বন্ধ করে চোখ পাকিয়ে আমার ঘাড় চেপে ধরলো।
“তোর মতো গিরগিটির নানী কিভাবে যে আমার বান্ধবী হলো আল্লাহ জানে।”
“তোর মতো চুন্নি বেডি আর কি জানবে?”
আমাদের এই ঝগড়া-ঝাটির মাঝে দরজা ঠেলে রিজওয়ান ভিতরে ঢুকলো। গুন গুন করতে করতে পাশ দিয়ে হেঁটে ছেলেদের সারিতে গিয়ে বসলো।
আমি তুশিরাকে কাঁধ দ্বারা মৃদু ধাক্কা মেরে বললাম,
“দেখছিস? বাদরের লাল নিতম্ব আমাদের পাশে এসেই গুন গুন করছিলো। অসভ্য কোথাকার!”
তুশিরা বিহ্বলতা নিয়ে আমার দিকে তাকালো। জিগ্যেস করলো,
“বাদরের লাল কি? পাছা? এখানে বাদর কই পেলি তুই?”
আমি চুপ হয়ে তুশিরার দিকে তাকালাম। এক বাদরের কথা বলতে গিয়ে আরেক বাদর আবিষ্কার করে ফেলেছি দেখছি। নাহিয়ানের মতো বুদ্ধিমান, গুছানো, শান্তশিষ্ট একটা ছেলে এই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুকে কিভাবে গার্লফ্রেন্ড বানালো? আসলেই বানিয়েছে নাকি জরিনা বেওয়ার পানি পড়া খাইয়ে হয়েছে কে জানে।
তুশিরা সন্দিহান গলায় বললো,
“তুই আমাকে এভাবে কি দেখছিস? মনে মনে গালাগালি করিস নাকি?”
আমি তাকে জিহ্বা দেখিয়ে বললাম,
“চুপ থাক।”
সামনে থেকে ইলা উঠে এলো। আমার কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,
“এই ফাবলীহা, তুই আর রিজওয়ান নাকি পরশু ডেইটে গিয়েছিলি?”
আমি ইলার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালাম। তৎক্ষণাৎ কিছু বললাম না। এ হলো আরেক ছাগলের জাত। পাবনার চাটমোহরের ছাগল। রিজওয়ান আর ইলা অনেক ভালো বন্ধু। দুজনের কোচিংয়ে আসার প্রধান উদ্দেশ্য একে নিয়ে তাকে নিয়ে বিস্তর আলোচনা করা। এতোটাই থার্ড ক্লাস স্বভাব।
আমি মুখের অভিব্যক্তি পরিবর্তন করে জোরেসোরেই বললাম,
“ছিঃ! মানুষের সাথে ডেইট করতে না গিয়ে আমি এই হাতির সাথে ডেইট করতে যাবো? হাতির দাঁত ভেঙে বিক্রি করে বড়লোক হওয়ার আমার কোনো পরিকল্পনা নেই। এই বিশালাকার পাহাড় কোনো অস্ট্রেলিয়ান গরুর সাথেই যায় বুঝলি। আমি কিন্তু আবার কোনো রেসিস্ট না ভাই।”
আমার পিছনের সারির বড় আপুরা আমার কথা শুনে হি হি করে হাসতে থাকলো। তুশিরা তো পারলে চেয়ার থেকে উঠে মেঝেতে গড়াগড়ি করে হাসে।
আমি আসলেই রেসিস্ট না। কিন্তু স্বভাব-চরিত্র খারাপ হলে সে কালো, ভোটকা, বদমাশ এককথায় জঙ্গলের কীটপতঙ্গ।

স্যার এসে প্রবেশ করলেন। বড় আপুদের হাসতে দেখে স্যার জিগ্যেস করলেন,
“কি ব্যাপার? একেকজন দেখি হাসতে হাসতে কুপোকাত।”
নায়লা আপু জবাবে বললো,
“স্যার আজকে কোচিংয়ে অস্ট্রেলিয়ান গরু প্রবেশ করেছে তাই হাসছি।”
আপুর কথা শুনে সবাই সশব্দে হেসে ওঠলো। আমি আড়চোখে রিজওয়ানের দিকে তাকালাম। তার কৃষ্ণবর্ণ চেহারাটা অমাবস্যার রূপ ধারণ করেছে। এইবারে যদি এই ছেলের শিক্ষা না হয়, তবে একে আমি জুতো পিটা করে শায়েস্তা করবো। যেমন গরু, তেমন ইনজেকশন। এরমধ্যে আমার নতুন উন্মোচিত প্রেমিকের কথা মনে পড়ে গেলো। তুশিরার সঙ্গে আজকেই তোড়জোড় পরিকল্পনা করতে হবে।

কোচিং শেষে ফুটপাত ধরে হাঁটছি আর তুশিরাকে আমার দুঃখভরা জীবনের উপাখ্যান শুনাচ্ছি।
“তুই জানিস না দোস্ত, দুনিয়ার বাটপার একটা ছেলে। বরিশাইল্লা আর কি হবে। উপরে জোব্বা নিচ দিয়ে পোঁকা ধরা। পুরাই মাকাল ফল।”
তুশিরা মুখে চানাচুর পুরতে পুরতে জানতে চাইলো,
“দেখতে কেমন সেটা বল।”
“আমি কি জানি ওই রাম ছাগল দেখতে কেমন। কেমন ধূর্ত দেখ! বাপ-মাকে বাসায় পাঠিয়ে ওই ছেলে সঙ্গে সঙ্গে এলো না। নীলক্ষেত কি কাজ নাকি আছে। বন্ধুর সঙ্গে দেখা করবে বলেছে। আমি নিশ্চিত, এই ছেলে নিশ্চয়ই ইডেন কলেজের সামনে বোরকা পরে বসে আছে। শালা মেয়েবাজ!”
“আরে, না দেখেই একটা মানুষ সম্পর্কে এভাবে বলবি? হতেও তো পারে তাকে দেখে তোর দেখে পছন্দ হয়ে গেলো, কথাবার্তা বলার পর আগ্রহ কাজ করলো। হতে পারে না?”
তুশিরার কথা শুনে আমি আঁতকে ওঠলাম। ঢাকা ব্যতীত আমি কোথাও বিয়ে বসবো না। ভাঙ্গা-মাওয়া ব্রিজ পাড়ি দিয়ে আমি সুদূর বরিশাল সংসার পাততে পারবো না। আল্লাহ সহায় হও।
তবুও আমি ভাবছিলাম। ছেলে কী এতোই ভালো হতে পারে যার জন্য আমার মতামতই পরিবর্তিত হতে পারে?

তুশিরাকে বিদায় দিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে পা চালালাম। বাসার গেইটের থেকে খানিক দূরে থাকতেই হাঁটা থামিয়ে দাঁড়ালাম। হ্যাঙলা পাতলা, শ্যামবর্ণ একটা ছেলে টিশার্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে তার ফোন। পরক্ষণেই কানের সংস্পর্শে এনে কারও সঙ্গে কথা বলতে লাগলো। আমার অন্তর আত্মা অক্ষিগোলক ঘুরিয়ে ছেলেটি পর্যবেক্ষণ করে বললো,
“ফাবলীহারে এটাই তোর ফাকাদ। এবার কাবি খুশি কাবি গামের মতো দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়। তোর ভবিষ্যৎ বলে কথা।”
আমি লিকুইড নেওয়া মনের প্ররোচনায় পা দিয়ে দৌঁড়ে গেলাম না। লিকুইড হলো– আসার সময় লাচ্ছির বোতলে একই স্ট্র দিয়ে আমি আর তুশিরা লাচ্ছি খেয়েছি। এভাবে আমার বান্ধবী আমাদের মধ্যে ভালোবাসার ব্যাকটেরিয়া আদান-প্রদান করায় বিশ্বাসী।
আমি সামনে তাকালাম। এই ছেলেকে তো দিন-রাত গ্যাস দিয়ে ফুলিয়ে প্রাণ অভ্যন্তরে সঞ্চিত রাখতে হবে। আমি একটা পাদ দিলেই তো দুনিয়া ছেড়ে মহাশূন্যে স্যাটেলাইটের মতো ঘুরতে থাকবে। ছেলেটাকে দেখে মায়া লাগলো। আমার যদি কোনো ঢাকাইয়া ছেলের সাথে বিয়ে হয় তাহলে আমি এই ফাকাদকে প্রধান সাক্ষী হিসেবে রাখবো। সঙ্গে এক কার্টুন ভিটামিনের ঔষধ উপহার দেব।

আমি কাউকে চিনি না, কিছু দেখিনি এমন ভাব ধরে স্মৃতিভ্রষ্ট ওমর সানী ও আন্ধা সালমান শাহের মতো গেইটের ভিতরে প্রবেশ করলাম। পিছনে থেকে চিকন গলায় কেউ ডাকলো তখন,
“এই যে শুনছেন।”
তাকিয়ে দেখলাম ওই ছেলেটা, আশা করছি ফাহাদই সে।
আমি স্বাভাবিকভাবে জবাব দিলাম,
“জি, শুনছি।”
ছেলেটি লাজুক হেসে জিগ্যেস করলো,
“আপনি ফাবলীহা তাই না?”
আমি তখন নিশ্চিত হলাম, এই বেডা মানুষটিই তবে আমার বাপের ঠিক করা আমার কিডনির অসুখ। কিন্তু এভাবে লজ্জা পাচ্ছে কেন? কেউ কী চুমা দিয়েছে? দারোয়ান আঙ্কেল তার খুপরির দরজা খুলেই বিছানার উপর ঝিমুচ্ছে। দরজার সামনে বাড়িওয়ালার কুকুরটি আবেদনময়ী ভঙ্গিতে লেজ নাচাচ্ছে, পা নাড়াচ্ছে। এ তো নিশ্চয়ই এই চিকনা পুঁটি মাছের দিকে নজর দেবে না। আমি খানিক মাথা ঝুঁকিয়ে চোখ ছোটো ছোটো করে কুকুরটিকে পর্যবেক্ষণ করলাম। ওহ, আচ্ছা। দিতেও পারে, মেয়ে জেন্ডারই তো।
ফাহাদ এবার চিন্তিত গলায় আমাকে ডেকে ওঠলো,
“আপনি কী আমার সঙ্গে কথা বলতে বিরক্ত বোধ করছেন?”
আহা, কি আলাভোলা উক্তি। আসলেই কি এমন? খুন্তি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে অভ্যন্তরীণ সত্তা বের করতে হবে।
আমি মিষ্টি হেসে বললাম,
“জি, আমি ফাবলীহা। আপনি নিশ্চয়ই বাড়িওয়ালা আন্টির চাচাতো বোনের খালাতো ভাইয়ের নানীর একমাত্র এতিম নাতি? আম্মু কাজের লোকের জন্য আন্টিকে বলেছিলো। আপনি আসুন, পাঁচতলায় আমাদের ফ্ল্যাটে আসুন। যাবতীয় কাজ, বেতন আম্মুর সঙ্গে আলোচনা করুন।”
বলেই আমি হাঁটা দিলাম।
পিছনে তাকিয়ে দেখলাম ফাকাদ ভ্যাবাচ্যাকা মুখভঙ্গি নিয়ে মাথা চুলকাচ্ছে।
আমি তাকে ডাকলাম,
“কি হলো কামলা ভাই, আসুন কামলা ভাই। কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব করবেন না। পুরুষ কাজের লোকদের আমাদের ঘরে ডান্ডা দিয়ে অনেক সম্মান দেওয়া হয়। আসুন কামলা ভাই।”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here