তুই আমার অঙ্গারাম্লজান – পর্ব ২৪

0
211

#তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান
পর্ব_২৪
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা

২৯.
হলদেটে জামা গায়ে চড়িয়ে হলুদ পাখির মতো ঘর জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। সাউন্ড বক্সে বেজে চলছে, ‘আজ কন্যার গায়ে হলুদ, কাইল কন্যার বিয়ে।’
গায়ে হলুদে কন্যার বদলে পুত্র উপস্থিত। আত্নীয়-স্বজন ও কৌতূহল প্রতিবেশীর ভিড়ে ঘর পরিপূর্ণ। সবার হাসিখুশি মুখভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করছি আর মুগ্ধ হয়ে ভাবছি। বিয়ে ব্যাপারটা খুব সুন্দর। সবচেয়ে মুগ্ধকর।

আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। উঠোনে গায়ে হলুদের স্টেজ সাজানো হচ্ছে। নানা নতুন মুখের আগমন দেখতে পাচ্ছি। তাদের সঙ্গে পাশ কাটিয়ে একজন মহিলা ভেতরের দিকে গেলেন। আমি তখন বারান্দা ছেড়ে বাহিরে পা রাখতে যাচ্ছিলাম। মহিলাকে কেমন চেনা-পরিচিত মনে হলো। যেতে যেতে পিছনে মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম। মধ্য বয়সী মহিলাটিকে ভালো মতো পরখ করতেই আমার চলন গতি স্থগিত হয়ে গেলো।
ভিড়েই মাঝেই উনি হাত উঁচিয়ে বলে ওঠলেন,
“পুত্রবধূ!”

সর্বনাশ! এ দেখি আমার শাশুড়ি মা। এখন কি হবে? দিগ্বিদিক দিশা হারিয়ে আমি দৌঁড়ে ছুটলাম। স্টেজের সামনে ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির থালা নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। থতমত খেয়ে ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে স্টেজের পিছনে স্থান নিলাম। পেছনে পাশ ঘেঁষে বাউন্ডারির দেওয়াল। ফলে এখানে আর কেউ নেই।
আমার বুক উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ধক ধক করছে। প্রিয়লের মা যে আসবে তা তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। সবার সম্মুখে উনি বিয়ে সমন্ধীয় কথাবার্তা তুললে কি যে বিগিদিস্তা অবস্থা হবে কে জানে।
উঁকি মেরে আড়াল থেকে দেখার চেষ্টা করছিলাম আমার শাশুড়ি কাছেপিঠে এসেছে কি-না। উনি নজরে পড়লো। চোখের আকৃতি হ্রাস করে তীক্ষ্ণ চোখে চতুর্দিক পর্যবেক্ষণ করে আমাকে খোঁজে চলছেন। আমি পিছন দিকে দৌঁড়ের উদ্দেশ্যে ছুটতেই আবার ধাক্কা খেলাম।
ঘুরে দেখি সামনে মাস্ক পরা লম্বাটে একজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে গেলাম।
আমি আঙ্গুল তুলে বললাম,
“আপনি?”
ছেলেটি কাঁধ ঝাকালো।
আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বললাম,
“আপনাকে চেনা চেনা লাগছে।”
ছেলেটি মাস্ক খুললো।
হেসে বললো,
“এক রাতেই স্মৃতিভ্রষ্ট হওয়ার মতো বউ তো আমার নয়।”
আমি প্রিয়লকে দেখে ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত করি।
প্রিয়ল ভ্রু খানিক তুলে বললো,
“এখানে কাজ চলছে তো। তুমি এখানে বিড়ালের মতো ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে কেন?”
আমি সেসবে জবাব না দিয়ে আবার আওড়ালাম,
“আপনাকে চেনা মনে হচ্ছে।”
প্রিয়ল আমার কপালে মৃদুভাবে টোকা মেরে বললো,
“আমি আপনার হাজব্যান্ড যে তাই।”

আমার টিউবলাইট মাথা আচমকা একশো ওয়াটের বাতি জ্বালিয়ে দিলো।
রেস্টুরেন্টে একটা ছেলে আমাকে জিগ্যেস করেছিল। রিজওয়ান আমার বয়ফ্রেন্ড কি-না। ঠিক একই মাস্ক, একই লুক!
আমি কোমরে হাত রেখে জোর গলায় জিগ্যেস করলাম,
“আপনার সঙ্গে আমার রেস্টুরেন্টে কথা হয়েছিল!”
তাকে খানিক বিভ্রান্ত দেখালো।
“মানে?”
আমি প্রিয়লের মাস্কটা তার হাত থেকে আমার হাতে নিয়ে বললাম,
“এটা পরিহিত অবস্থায় আপনার সঙ্গে আমার রেস্টুরেন্টে দেখা হয়েছিল।”
প্রিয়ল দ্বৈধিভাব নিয়ে বললো,
“তোমার সঙ্গে তো আমার রেস্টুরেন্টে কতবারই দেখা হয়েছে। তাতে কি? আর মাস্ক বলছো? একইরকম দেখতে আমি অনেকগুলো কিনেছিলাম। এমন ডিজাইনের আরও আছে। কিন্তু সেসবে কি হয়েছে?”
আমি তার দিকে খানিক এগিয়ে গিয়ে চোখ পাকিয়ে বললাম,
“বিয়ের পূর্বে একদিন রেস্টুরেন্টে আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আপনি আমাকে টিটকারি মেরে জিগ্যেস করেছিলেন সঙ্গের ছেলেটি আমার বয়ফ্রেন্ড কি-না।”
প্রিয়ল হাসার চেষ্টা করে বললো,
“এটা অন্য কেউ হবে জান। এরকম মাস্ক তো..”
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,
“নাহ! আপনার বউ আসলেই একরাতে স্মৃতিভ্রষ্ট হওয়ার মতো মানুষ নয়। সত্যি করে বলুন তো। আপনি আমাকে আগে থেকে চিনতেন?”
প্রিয়ল মাথা চুলকে বললো,
“ওই মানে, হ্যাঁ, চিনতাম আরকি।”
বলেই একটা অপাপবিদ্ধ হাসি দিলো।
“আচ্ছা! এইজন্যই! এইজন্যই বিয়ের সময় আপনি রোবট। নড়ে না, চড়ে না। ড্যাং ড্যাং দামড়া একটা ছেলে মানুষের ধমকে বিয়ে করে ফেলে। মা বলেছেন কাজী ডাকুন, ছেলে পাছা নাড়িয়ে কবুল হে কবুল হে বলেন!”
“জান আসলে..”
আমি চোখ পাকিয়ে বললাম,
“আসলে? এই! আপনিই ভাড়া করে ওই লোকদের ওখানে পাঠাননি তো? নাহলে আমি তো কখনো শুনিনি কোনো চেয়ারম্যানের এতো আজাইরা কাজ থাকে যে মানুষকে ধরে ধরে বিয়ে দেয়। বরং তারা বিয়ে ভাঙে।”
“না, না! তওবা, আমাকে এতো বড় দোষারোপ দিও না জান। ইট ওয়াজ জাস্ট..”
“প্রিয়ল, আপনি যদি আর আধা আধা কথা বলেন তো আপনার মাথা ফাটাবো।”
প্রিয়ল চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নিলো। চোখ খুলে মৃদু হেসে বললো,
“হ্যাঁ, আমি তোমাকে আগে থেকেই চিনতাম। বেশ কয়েকবার গাড়ি থেকে তোমাকে লক্ষ্য করেছিলাম। সেদিন রেস্টুরেন্টে এক মিনিট কথা হওয়ার পর তোমার সম্পর্কে যা যা সম্ভব খবর সংগ্রহ করি।”
আমি অবাকের চরম পর্যায়ে উল্লম্ফন করি।
আমি রেগে বললাম,
“একদম ভেটকাবেন না। এইজন্যই বিয়ের সময় আপনি নির্বিকারচিত্ত। বউ আমি, অথচ উনি নতুন বউয়ের মতো ঘোমটা দিয়ে থম মেরে রইলেন। ভাঁওতাবাজ!”
প্রিয়ল কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গি করে বললো,
“এরকমটা নয় জান।”
আমি অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে তাকালে প্রিয়ল বলে,
“আসলেই এরকমটাই। তোমাকে ওইদিন আমি বউ হিসেবে কল্পনা করে এতো বিধ্বস্ত হয়ে যাই যে বিয়েটা করেই ফেলি।”
আমি দাঁত কিড়মিড় করে মুষ্টিবদ্ধ দুই হাত দুইদিকে ছড়িয়ে দেই। হাতের মুঠোয় খুললেই ওপর থেকে ঝাড়ু এসে ঠেকে।
উপরে তাকিয়ে দেখি বাঁশের মাচার মতো একটা স্থানে একজন ঝুলে আছে।
সেখান থেকে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“আপা ঝাড়ুটা ছুড়ে মারেন। ভুলে পইড়া গেছে। মাফ কইরেন।”

আমি সেই ঝাড়ু সহ প্রিয়লের পিছনে ছুটলাম।
প্রিয়ল থতমত খেয়ে দৌঁড় লাগালো। ছুটতে ছুটতে চাপা গলায় বললো,
“জান, প্লিজ! আ’ম ইউর হাজব্যান্ড!”

দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে আবার ধাক্কা খেয়ে পড়লাম।
“আহ, আম্মু!”
কোমরে হাত রেগে প্রিয়লের দিকে তেড়ে যেতেই দেখি আমার শাশুড়ি মা।
মূলত উনার সঙ্গেই আমি আর প্রিয়ল ধাক্কা খেয়ে পরে যাই। শাশুড়ি একবার তার পুত্রের দিকে আরেকবার তার পুত্রের বধূর দিকে তাকাচ্ছিল।
প্রিয়লের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আবরেশাম..”
আমি আর্তচিৎকার দিয়ে আবার দৌঁড় দেই।
শাশুড়ি মা উঠে আমার পেছন পেছন আসতে লাগলেন।
দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে একটা রুমে গিয়ে আটকা পড়ে যাই।
পিছন থেকে ভেসে এলো,
“পুত্রবধূ! তুমি আমাকে দেখে দৌঁড়ে পালাচ্ছো কেন?”
আমি ঘুরে উনার দিকে ফিরলাম।শাশুড়ির আম্মার চোখের চাহনি দেখে আমার শরীরের রক্ত কমে যায়।
হাসি দেওয়ার চেষ্টা করে বললাম,
“আসলে শাশুমা, আপনাকে দেখে আবেগে আমি আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম। চোখের পানি লুকোতেই ছুটে ছিলাম।”
উনি নরম হলেন না। একই চাহনি বহাল রেখে জিগ্যেস করলেন,
“তুমি এখানে কি করো?”
আমি ঢোঁক গিলে জবাব দিলাম,
“বিয়ে খেতে এসেছি।”
“কেন?”
আমি চমকে ওঠলাম। কেন মানে কি বলবো, পেটে খাবার নেই তাই খেতে এসেছি?
উনি কঠিন গলায় বলে ওঠলেন,
“কি হলো!”
“ফায়াজ ভাইয়ের বাবা আমার বাবার বন্ধু। সেই উপলক্ষে ফুল ফ্যামিলিসহ খেতে এসেছি। মানে বিয়ে বাড়িতে এসেছি।”
উনি তখন নমনীয়তা এনে বললেন,
“ওহ, মোজাম্মেল ভাই তোমার বাবার বন্ধু?”
আমি মাথা নাড়লাম।
উনি নিজে নিজে রাগান্বিত সরে বলতে লাগলেন,
“আবরেশাম এতো বজ্জাত হয়েছে! বউ নিয়ে বিয়ে বাড়িতে ঘুরে, অথচ আমাকে কিছু জানায়নি।”
আমার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন,
“আচ্ছা তোমার মা-বাবা এসেছে?”

ওহ গড। আমার মা-বাবাকে দিয়ে এখন আবার কি করবে? তাদেরকে আবার বলবে না তো, ‘আন্তরিকভাবে দুঃখিত ঝুলন্ত বেয়াইই-বেয়াইন। কিন্তু আপনার ঝাড়ুপ্রিয় কন্যাকে আমি আমার ছেলের বউ গ্রহণ করি না, না!”

আমি ভীত গলায় অতিরিক্ত সম্মান প্রদর্শন করে বললাম,
“না শাশুমা। কেউ নেই।”
উনি তৎক্ষণাৎ খুশি হয়ে গেলেন। বললেন,
“যাক ভালোই হয়েছে। তাহলে এখানেই এনাউন্স করতে পারবো তোমার আর আবরেশামের ব্যাপারে। আজকেই এখানের উপস্থিত সবাইকে তোমাদের বিয়েতে দাওয়াত দেব। পরে ধীরে সুস্থে তোমার মা-বাবার সঙ্গে কথা বলা যাবে।”
শাশুড়ির এই কথা শুনে আমার পেটে ই. কুলাই ব্যকটেরিয়া নাড়া দিয়ে ওঠলো।
আমি হন্তদন্ত হয়ে বললাম,
“আসলে মা-বাবা আছে! বাহিরে কেনাকাটা করতে গিয়েছিল। আমি ভেবেছি আপনি বর্তমানে আছে কি-না জানতে চেয়েছেন।”
শাশুড়ির মুখ খানিক কালো হয়ে গেলো। বিমর্ষ গলায় বললো,
“তাহলে তো সমস্যা।”
“আপনি মা বসে বসে পরিকল্পনা করুন কিভাবে তাদের জানানো যায়। আমি আসি, হ্যাঁ?”
উনি মাথা নাড়লেন।
দরজা ভেজিয়ে ভাবলাম বাহির থেকে তালা মেরে যাই।
পরে ভাবলাম, না। আবার খোলার জন্য চিল্লাপাল্লা করে পুরো বাড়ি এক করবে। মাঝখানে বেচারা আমি অগোচরে মানুষের গালাগালি খাবো।
প্রিয়লটা যে কোথায়!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here