তুমি সুখের বৃষ্টি হয়ে ঝড়ো – পর্ব ১৬

0
490

#তুমি_সুখের_বৃষ্টি_হয়ে_ঝড়ো
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ১৬

সবে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় বিছিয়ে দিয়েছিলো ভোর।তখনই মনে হলো খুব ভারি কিছু নিজের শরীরের উপর।চোখ খুলে তাকাতেই নিজের শরীরের উপর ধূসরকে আবিষ্কার করলো।ভোরের দুই হাতটা ধূসরের হাতের ভেতরে বন্দী। খুব শক্ত করেই চেপে ধরেছে ধূসর। ভোরের ক্লান্ত শরীরটা ধূসরের ভারি শরীরের ভার নিতে পারলো না।তাই ভোর মোচড়ামুচড়ি করতে রইলো।কিন্তু ধূসরের ভেতরে তাঁর কোন প্রভাব পড়লো না।সে খুব শক্ত করেই ভোরকে আঁকড়ে আছে।ভোর অনেক কষ্টে নিজেকে ধূসরের থেকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো।

কি হচ্ছে ধূসর আপনার মাথা ঠিক আছে।কথাটা ভোর শেষ করতে পারেনি, তাঁর আগে আবারও ধূসর ভোরকে চেপে ধরলো দেয়ালের সাথে। নরম হাত দু’টো শক্ত দেয়ালের ঘসায় যেন ছিলে রক্ত বেড় হচ্ছে। এমনই কষ্ট হচ্ছে ভোরের।অনেক ধস্তাধস্তি করেও ভোর এক চুলও সরতে পারলো না ধূসরের থেকে।

আমি ব্যথা পাচ্ছি ধূসর আমায় ছারুন।

আপনি ব্যথা পাচ্ছেন তাই না।আমিও পাচ্ছি। দেখুন ঠিক এখানে। বুকের বামপাশটা দেখিয়ে। আপনার ব্যথায় মলম লাগালেই সেরে যাবে।কিন্তু আমার ব্যথায় কোন মলম লাগালে সেরে যাবে বলতে পারেন?ওই হারামিটা আপনার কোথায় কোথায় ছুঁয়েছে দেখি। আমি সে-সব জায়গায় আমার ভালোবাসা দিয়ে মুছে দেবো।

ধূসর আপনি ভুলে যাচ্ছেন সে আমায় ভালোবাসে।ভেবে দেখুন আপনি আমাকে কত দিন ধরে ভালোবাসেন। তাই আমাকে অন্য কারো সাথে দেখতে পারছেন না।বুকের ভেতরে জ্বলছে।আর সে-তো আমায় চার বছর ধরে ভালোবাসে। সে কি করে আমায় অন্য কারো সাথে দেখবে? আর আপনি আপনার ভালোবাসার ছোঁয়া দিয়ে তাঁর ছোঁয়া মুছে দিবেন বলছেন।সে যে আমার মনের মধ্যে বিগত চার বছর আগে ছুঁয়ে আছে, তা কিরে মুছবেন।নাকি সেই হৃদয় নামের যন্ত্রটা আপনার রাগ খোপ দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করবেন।ধূসর পাগল কুকুরের সাথে পাগলের মতো আচরণ করলে, সে আমাদের কামড়ে দিবে।তাই পাগল কুকুরকে শান্ত করতে হলে ভালো ব্যবহার করতে হয়।আপনি আফিম ভাইকে কতটা চেনেন।আমি আপনার থেকে হাজার গুন বেশি চিনি।সে তাঁর বাবা-র মতো হলেও সে আমাকে ঠিক আপনার মতোই ভালোবাসে।আপনি জানেন সে আমাকে কতটা ভালোবাসে। জানেন না।আপনি মনে করেন সে আমাকে তাঁর পরিবারের মতো ব্যবহার করছে সম্পত্তির জন্য। সে ততোদিনই আমাকে অবহেলা করেছে, যতোদিন সে নিজের মনের খবর জানতো না।কিন্তু যেদিন থেকে সে মনের খবর জেনেছে,সেদিন থেকে সে আমাকে আগলে রেখেছে।ঠিক আপনি যেমন রাখেন।হাজারবার তাঁর বাবা প্ল্যান করেছে আমাকে মেরে ফেলার। আর সে হাজারবার আমাকে বাঁচিয়েছে।নিজের বাবা-র সাথে সব প্ল্যান করে সে নিজেই সেই প্ল্যান নষ্ট করে আমাকে আগলে রেখেছে। আমি ওই বাড়ি থেকে চলে এসেছি ঠিকি কিন্তু ওই বাড়ির প্রতিটা পদক্ষেপের কথা আমার কানে আসে।আফিম ভাইয়া খারাপ সেটা আমিও জানি।কিন্তু আমার জন্য তাঁর ভালোবাসা মিথ্যা নয়।আবার এটা ভাববেন না,আমি তাঁর জীবনে ফিরে যাবো।ওই কথা গুলো শুধুমাত্র বলেছি তাঁকে শান্ত করতে।আর আমি তো আপনার স্ত্রী তাই-না? তাহলে ধৈর্য সহকারে আপনার উচিত ছিলো আমার উপর ভরসা করা।আরে যদি ভরসাই না করেন তাহলে ভালোবাসার কথা কিভাবে বলেন।আরে আপনি তো আমায় বিশ্বাসই করতে পারেন না।তাহলে ভালোবাসেন কি করে।ভালোবাসার ঘরে বিশ্বাস না থাকলে চলে না।আফিম ভাইয়া খারাপ এটা আমার পরিবার, আপনারা পরিবার সবাই জানে।এমন কি আমিও জানি।কিন্তু আমি এটাও জানি তাঁর থেকে আমার কোন ক্ষতি হবে না।এটা আমার ভালোবাসার থেকে বিশ্বাস তাঁর প্রতি।যেটা সে নিজেই তৈরি করেছে আমার মনে।গাড়িতে ওই প্রশ্নটা করেছিলাম শুধু আপনার মতামত জানার জন্য। কিন্তু আপনি এতটা রিয়াক্ট করলেন মনে হলো।আমি যেন জানতে চেয়েছি আমি ফিরে গেলে সে আমায় ফিরিয়ে নেবে কিনা।আমার ওই বাড়ির প্রতিটা মানুষের প্রতি যে ঘৃণা জন্মেছে তা পৃথিবীর কোন ভালোবাসাই মুছে দিতে পারবে না।সব শেষে একটা কথাই বলি।আফিম ভাই বেশিদিন বাঁচবে না।আল্লাহর দেওয়া তাঁর শরীরকে সে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে যা সে নিজেও জানে না।আমি রিনা আর সাবু ভাই ছাড়া এই বিষটার সাথে কেউ অবগত নয়।আর আজ আপনি জানলেন।যে মানুষটা বেশি দিন বাঁচবেই না। তাঁর সাথে অন্তত আপনার যুদ্ধ মানায় না।আর এই যে আমার শরীরটা দেখছেন।যেখান যেখানে আফিম ভাইয়া ছুঁয়ে দিয়েছে। ওয়াশরুমে গিয়ে ঝরনার নিচে দাঁড়ালেই তা ধুয়েমুছে ছাফ হয়ে যাবে।কিন্তু আপনার ওই অবিশ্বাসে ঘেরা ভালোবাসা দিয়ে আমায় ছুঁয়ে দিলে আমার শরীর থেকে সেই ছোঁয়া মুছতে হবে।তাহলে দেখা যাবে গলা সমান সাগরে নেমে ডুব দিলেও সেই ছোঁয়া মুছতে পারলাম না।মনে রাখবেন ধৈর্যের ফল মিষ্টি হয়।সামনে কি হবে তা দেখতে পাবেন।অন্যায় আমার সাথে আমার বাবা-মায়ের সাথে হয়েছে।তাই প্রতিশোধটাও আমি নিবো।যদি বিশ্বাস নিয়ে আমার সাথে থাকতে পারেন। তাহলে থাকবেন,না হলে প্লিজ আমাকে ভুল বুঝবেন না।এই পৃথিবীতে ভুল বোঝার মানুষের অভাব নেই।নতুন করে না-হয় আপনি সেই খাতায় নাম না লেখালেন।এই ভুল বোঝার জন্য আমার মা’কে তাঁর সারাজীবন দিয়ে মাশুল দিতে হয়েছে। আমি চাই না সেই একি ভুলের মাশুল আমি দেই।তাই ঠিকটা যদি না-ই বোঝেন ভুল বোঝার কোন দরকার নেই।মনে রাখবেন প্রতিটা মানুষের কর্মেরফল তাঁকে পৃথিবী থেকেই দিয়ে যেতে হয়।তেমনি সফিউল মোর্সেদ এবং কুহেলি বেগমকেও দিতে হবে তাঁদের কর্মেরফল।বাকিগুলো তো চুনোপুঁটি। এদের পাওয়া শাস্তি দেখলেই তাঁদের অনুশোচনা হবে।আর ভুলে যাবেন না।অনুশোচনার মতো বড় শাস্তি পৃথিবীতে একটাও নেই।আর আমি যেদিন বুঝবো আমি আপনার জীবনে একটা বোঝা সেদিন আমি নিজেই আপনার জীবন থেকে সরে যাবো।তাঁর আগে আপনি চাইলেও আমি সরে দাঁড়াব না।কারণ যতোদিন আমি অবিবাহিত ছিলাম ততোদিন একটা দিক ছিলো।আজ আমি বিবাহিত। আজ আমার সাথে আপনার জীবনটা জড়িয়ে গেছে। আমি আপনায় ভালোবাসি বা না বাসি।ছেড়ে যাবার কথা কোনদিও উঠবে না।তাই প্লিজ এই ভয়টা আপনার মন থেকে দূরে রাখুন।
একদমে কথা গুলো শেষ করলো ভোর।নিজেকে ধূসরের থেকে ছাড়িয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।আর ধূসর ভোরের প্রতিটা কথা বোঝার চেষ্টা করলো।প্রতিটা কথার মানে বুঝতে পেরে নিজেকে খুব খারাপ ভাবতে ইচ্ছে করছে।সত্যিই তো ভোর যখন গাড়িতে বসে জানতে চাইলো আফিম কেন এমন করছে ? সে কি তাঁকে সত্যি ভালোবাসে।আর ভোর যখন বললো।আপনিও পরুষ আফিমও পুরুষ তাই আপনার কাছে জানতে চাইছি।আসলে ভোর এটাই বোঝাতে চেয়েছে,একজন পুরুষ কখন একটা মেয়ের জন্য এমন পাগলামি করতে পারে।আর ধূসর কিনা ভোরের কথার উল্টো মিন করে কতো গুলো কথা শুনিয়ে দিলো।আফিমকে ভোর-তো তখন একবারও কথা দেয়নি। হ্যা আমি তোমার জীবনে ফিরে যাবো।সে নিজের বুদ্ধি দিয়ে কি সুন্দর করে ম্যানেজ করলো।আর ধূসর কিনা।ইসস নিজের করা ভুলের জন্য ধূসরের খুব আফসোস হতে রইলো।তাঁর উচিত ছিলো একটু ধৈর্য ধরা।তা না করে সে কেমন রিয়াক্ট করে বসলো।ভোরের বেপারটা হয়তো তাঁর বাবা বুঝতে পেরেছিলেন।তাই তো তখন ভোরের সব কিছুতে সে সায় দিয়েছে। রাগে ক্ষোভে সে দেয়ালে বারি দিতে গেলেই। ভোর বললো–

নিজের ভুলের জন্য আফসোস করা ভালো।কিন্তু নিজের শরীরে আঘাত করা ভালো না।যাঁরা শরীরে আঘাত করে তাঁরা কাগজে-কলমে শিক্ষিত হলে কি হবে,আসলে তাঁরা সত্যিকারের মূখ্য। তাই ফ্রেশ হয়ে ফজরের নামাজের প্রস্তুতি নিন।এখনি আজান দিবে।অশান্ত মনটা শান্ত হয়ে যাবে জায়নামাজে দাঁড়ালেই।

————-

ভোরের আলোয় আলোকিত চারিদিক।পাখিরা বাসা ছেড়ে ছুটছে খাবারের খোঁজে। দিনমজুরের দল গুলো তাঁদের সাইকেলের বেল বাজিয়ে চলছে আপন গতিতে। বাগানে ফুটেছে হরেকরকম ফুল।সেখান থেকেই ভেসে আসছে সুগন্ধ।এক কাপ ধোঁয়া উঠা কফি টি-টেবিলে রাখলো ধূসর। সবে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে আফিম।ধূসরকে দেখে কোন হেলদোল নেই আফিমের। নিজেকে একবার আয়নায় দেখে বিছানার কোণে রাখা শার্টটা তুলে নিলো।গায়ে দিতে দিতে ধূসরকে বললো–

কিছু বলবেন ধূসর সাহেব।

হুম

বলুন

প্লিজ আপনি এখানে আর আসবেন না।

আমাকে কিন্তু ভোর অনুমতি দিয়েছে তাঁকে ফোন করার।

জানি

তাহলে,আমি না এলেও ভোর কিন্তু আমার কাছে যাবে।

দেখুন আমি চাই না সে আপনাদের কারো সাথে কোনরকম যোগাযোগ রাখুক।

দুদিনের ভালোবাসায় এতো কষ্ট হচ্ছে। তাহলে ভাবুন আমার কেমন লাগছে।আপনি আর আমি দু’জন দু’জনার শত্রু। ভালোবাসার শত্রু।এটা জানেন তো ভালোবাসার শত্রু বড় ভয়ংকর।

কফি খাবেন?

খাওয়াই যায়

তারপর দুজনে কফি খাওয়ায় মন দিলো।

ভোরকে আমি খুব কম জানতাম। এক বাড়িতে থাকা সত্বেও ওর সাথে আমার দিনে একটা কথাও হতো না।কিন্তু যখন ও কাঁদত আমার বুকেব্যথা হতো।কেন হতো আমি জানি না।ছোট্ট মেয়েটার যখন জন্ম তখন থেকেই দেখতাম ওকে কেউ পছন্দ করে না।বাবা ওকে কখনোই পছন্দ করতো না।ওকে খুব কম হাসতে দেখেছি।কিন্তু যখন হেঁসে দিতো।আমার কাছে মনে হতো পৃথিবীর সব সৌন্দর্য ওর ওই ঠোঁটে মিশে আছে।কাকিমা যেদিন ওকে কলেজে পৌঁছে দেওয়ার কথা বললো। তখন আমি ওকে খুব কাছ থেকে অনুভব করেছি।ভেতর থেকে ওর সাথে মিশে গেছি।আমার ভিতরের মনটা যখন জানান দিলো আমি ওকে ভালোবাসি। তখন কেন জানি ইচ্ছে করেনি সেই ভালোবাসা লুকিয়ে রাখি।তাই বলে দিয়েছিলাম।আমার মতো জানোয়ারও যে কোনদিন কাউকে ভালোবাসতে পারে তা কখনো বুঝতে পারিনি।ততোদিনে ভোরের কিশোরী মনও আমাকে ভালোবেসে ফেলে।আমি ওকে নিজের করে নিতে চেয়েছি।নিজেকে করতে চেয়েছি পরিবর্তন। কিন্তু যখন পরিবারের সবাই এই বিষয়টা জেনে যায়। তখন ভোরের থেকেও বেশি চাপ আসে আমার উপর। এক সময় ভাবলাম ওকে নিয়ে পালিয়ে যাব।কিন্তু বাবা ধরে ফেললেন।তিনি ওকে বিয়ে করতে বললেন। যাতে আমি ওর নামে লেখা সম্পত্তি নিজের করে নিতে পারি।আমি রাজি না হওয়ায় মা ওকে প্রচুর মারধর করে।কিন্তু ভোর জানে আমার আর ওর সম্পর্কের বিষটা জানাজানি হওয়ায় ওকে মেরেছে। কিন্তু আসল কারণ ছিলো এটা, আমি কেন ওকে বিয়ে করবো না।বাবা যদি শুধুমাত্র সম্পত্তির জন্য ওকে বিয়ে করার কথা বলতো। তাহলে আমি ঠিক ওকে বিয়ে করে নিতাম। কারণ আমি জানি কাকিমা বা ভোরের কোন লোভ নেই ওই বাড়ির সম্পত্তির উপর।কিন্তু বাবা ভোরকে মেরে ফেলার প্ল্যান করে। একবার যদি সম্পত্তি বাবা নিজের করে নিতে পারে তাহলে কোনদিনও ভোরকে বাঁচিয়ে রাখতো না।আর ভোর আমায় বিয়ে করলে সেই সম্পত্তি নেওয়া সহজ হয়ে যেত,আর ওকে খুন করা-ও।

চলবে,,,

একটু পরেই যদি সবটা বোঝা যেত তাহলে তো হতোই। যাইহোক যাঁরা যাঁরা ভোরকে আফিমকে চড় থাপ্পড় দিতে চেয়েছো তাঁরা সরি বলো।না হলে কিন্তু ভোর অভিমান করবে।আফিমের রহস্য আরো আছে।এখানেই শেষ নয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here