#তুই_আমার_অঙ্গারাম্লজান
পর্ব_১২
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা
১৪.
রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার পিছনে পাতিহাঁসের মতো লাইন ধরে আরও দুজন দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ হঠাৎ ভাবলে শিউরে ওঠি। আমি বিবাহিত। জামাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। আরও কত কি ভাবনা মাথায় খেলে যায়।
চাঁদনী আমার পিঠে গুঁতো মেরে বললো,
“ভ্রমরার মতো খাড়য় খাড়য় কোমর নাচাইস না। ভেতরে গেলে যা।”
আমি ঘাড় কাত করে বললাম,
“তোরা এখানে কেন। লজ্জা করে না বান্ধবীর সোয়ামীকে ড্যাব ড্যাব করে দেখার জন্য ছুটে এসেছিস?”
তুশিরা আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললো,
“আচ্ছা! এতোক্ষণ দোস্ত আয়, দোস্ত আয়। আর এখন আপা আমাদের যেনো চিনেই না।”
আমি ভেঙচি কাটলাম।
তুশিরা বললো,
“আচ্ছা ঠিক আছে। আমরা চলে যাচ্ছি।”
চাঁদনী কপট রাগান্বিত হয়ে বললো,
“হ, জামাইয়ের লগে হাগাহাগি কইরা সুখবর লইয়া আইস। মিষ্টি নিয়া আবার দেখতে আসমু।”
আমি নাক কুঁচকে বললাম,
“হাগাহাগি মানে? ছিঃ, এতো খারাপ তোর মন!”
চাঁদনী কোমরে হাত রেখে দাঁত খিচিয়ে বললো,
“ওই ছেরি, হাগ চিনোস না হাগ? কোলাকুলি? ঢঙ কইরা তো ঠিকই সারাদিন কও, দোস্ত আয় তোমারে হাগ দেই, আমারে হাগ দাও। তখন কি বুঝাস আমি তোর উপর পায়খানা আর তুই আমার উপর পায়খানা কইরা দিবি? পাতলা-পাতলা ঝোলের মতো পায়খানা?”
আমি বমি করার ভান করে দৌঁড়ে রেস্টুরেন্টের ভেতর প্রবেশ করলাম। সঙ্গে সঙ্গে আবার বের হয়ে হন্তদন্ত হয়ে বললাম,
“দোস্ত প্লিজ যাস না। আমি যাওয়ার দুই মিনিট পরে আয়। নাহলে বিয়ের আগে বিধবা হবি।”
বলেই আমি চলে গেলাম।
ভেতরের সিঁড়ি ভেঙে দুই তলায় উঠে কাঁচের দরজা ঠেলে প্রবেশ করলাম। চতুর্দিকে চোখ বুলালে কাঙ্ক্ষিত মানুষটি দৃষ্টিগোচর হলো। প্রিয়ল! কি মিষ্টি একটা নাম। ফ প্লাস প। মেয়ে বাবু হলে নাম রাখবো প্রিয়ম। আর ছেলে বাবু হলে ফাতিহ, নাভিদ ফাতিহ। আরও দুইয়ের অধিক হলে..
“এই ছেরি সং ধরে খাড়য় আছস কেন? ভিত্তে ঢুক!”
পিছন থেকে চাঁদনীর অমর্ষিত গলা শুনে হুশ এলো। আমি বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে কেন ভাবছি? শরীরটাকে একটা ঝাঁড়া দিলাম।
প্রিয়লের দিকে তাকাতে দেখলাম সে-ও আমার দিকে তাকিয়েছে। মুহূর্তে তার অধরে হাসির রেখা অঙ্কিত হতে দেখা গেলো। হাত দিয়ে ইশারা করে আমাকে কাছে ডাকলো।
আমি ধীর পদে তার দিকে এগিয়ে গেলাম।
উনি মুখে হাসি রেখে ভ্রু কুঞ্চিত করে জিগ্যেস করলেন,
“কি ব্যাপার, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাচ ছিলেন কেন?”
আমি আমতা আমতা করে বললাম,
“কই না তো, আমি তো জামাকপড় ঝাড় ছিলাম।”
আড়চোখে চাঁদনী আর তুশিরার দিকে তাকালাম। সিট খালি না পাওয়ায় দুই বেচারি আমার কাছাকাছি বসতে পারেনি। কোণায় গিয়ে স্থান নিতে হয়েছে।
আমি উনার সামনাসামনি হয়ে বসলাম। উনি তখন উনার জায়গা থেকে উঠে এসে আমার পাশে এসে বসলো।
আমি কি নেব জিগ্যেস করে নিজেই খাবার অর্ডার করলো। আমাকে এটা সেটা জিগ্যেস করতে লাগলো। এমন ভাব যেন আমাদের কত দিনের পরিচয়। আমি একবার পুলকিত হচ্ছি আর একবার আঁতকে ওঠছি। পুলকিতই বেশি হচ্ছি।
হঠাৎ হঠাৎ মনে হচ্ছিল, অজানা একটা ছেলের সঙ্গে এভাবে কথাবার্তা। লোকে কি বলবে। পরে নিজেকেই নিজে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিলাম। অঘটন তো ঘটেই গিয়েছে। এখন লোকে বেশি কিছু হলে সাজেক হানিমুনে পাঠাতে পারে। এর বেশি আর কি করবে?
একটু পর কোমরে সুড়সুড়ি লাগলো। তেলাপোকা ভেবে ভীত হয়ে দ্রুত কোমরে হাত দিলাম। চার-পাঁচটা শুঁড়ের মতো কি যেন হাতে ঠেকলো। মুখ আমার রক্তশূন্য হয়ে ওঠলো। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে যাবো তখন প্রিয়ল আমার মুখে চামচ ঢুকিয়ে দিলো।
“এটা খেয়ে দেখো। এই রেস্টুরেন্টের স্পেশাল মিট বক্স, গোল্ডেন মিট বক্স।” শুঁড়ের নাড়াচাড়া থেমে উষ্ণ হয়ে কোমরে স্থির হলো। আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলাম..ও মাই গড, এটা আমার সোয়ামীর আঙ্গুল!
“কি হয়েছে ফাবলীহা?”
আমি অবাক নয়নে তার দিকে তাকালাম।
আমি মুখের খাবার দ্রুত গলাধঃকরণ করে মুখ খুলে কিছু বলার চেষ্টা করছি। কিন্তু কোনো শব্দ নির্গত হচ্ছে না।
প্রিয়ল গালে হাত দিয়ে মুচকি হেসে আমার চোখে তার নেত্রযুগল স্থির করলো। ঠোঁট গোল করে আমার দিকে এগিয়ে আসতে আমি ঝটকা মেরে তাকে সরিয়ে দিলাম।
“এসব কি অসভ্যতা!”
উনার মুখের হাসি মুছে গেলো। চোখে মুখে কাঠিন্য চলে এলো।
উনি সোজা হয়ে বসে কাটা চামচ দিয়ে ক্রিসপি চিকেন কাটতে কাটতে নিজে নিজে বললেন,
“এক্সেক্টলি। অসভ্য। তার মানে আমি সঠিক পথেই যাচ্ছি।”
আমি দ্বৈধিভাব নিয়ে জিগ্যেস করলাম,
“মানে?”
উনি খুব মনোযোগী হয়ে খেতে খেতে বললেন,
“আমরা এখানে আলোচনার জন্য এসেছি, তাই তো?”
আমি মাথা নাড়ালাম।
“উকিলের সঙ্গে কথা বলার পর উনি জানালেন, সদ্য বিয়ে করা স্বামী-স্ত্রী অনন্ত ছয় মাস আগে একে অপরকে তালাক দিতে পারবে না। তাহলে উভয়পক্ষ হতে পাঁচ পাঁচ করে মোট দশ লাখ টাকা অনাথ আশ্রমে জমা দিতে হবে।”
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম।
উনি বলতে লাগলো,
“আমি তো জানি, আপনি গরীব। আমি বরাবরই গরীবদের প্রতি খুব সহনশীল। উকিল সাহেবকে বললাম, অন্য কোনো পথ আছে? উনি বললেন অবশ্যই আছে। এরপর বললো, আমার স্ত্রী যদি আমার নামে শক্তপোক্ত প্রমাণ সহ কোনো মামলা করে তবে দুই মাসের মধ্যেই সব কাগজপত্র তৈরি হয়ে যাবে। নাহলে এভাবে কাটবে ছয়মাস, কাগজপত্র তৈরি হতে হতে আরও ছয়মাস। এরমধ্যে যদি দুই মাস আমরা সাজেক গিয়ে মধুচন্দ্রিমা অতিবাহিত করি আর দশ মাস পেট থেকে বের হয়ে ক্যাসেট বাজানো বেবি বসের জন্য অপেক্ষা করি, তবে পরিপূর্ণ এক সংসার হয়ে যাবে। এবার আপনি বলুন কোনটা গ্রহণ করবেন।”
“হোয়াট দ্যা হেল! আর কোনো উপায় নেই?”
উনি মাথা নাড়িয়ে বললেন,
“আছে তো। আমার মা-বাবা এবং”
উনি আমার দিকে তাকালেন। থুতনির উপর দুই হাতের আঙ্গুলের ভাঁজ ঠেকিয়ে বললো,
“আপনার মা-বাবাকে একসঙ্গে নিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে হয়ে যাবে।”
গর্দভ! আমার মা-বাবাকে নিয়ে করলে এক সপ্তাহ কেন, এক মিনিটেই কাজ তামাম হয়ে যাবে। আমাকে পাঁচ তালা থেকে টোকা মেরে ফেলবে। তখন শুধু স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ নয়, পৃথিবীর সঙ্গেই ডিভোর্স ঘটিয়ে টাটা বাই বাই হয়ে যাবো। কিন্তু উনি এসব কি বলছেন?
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম,
“এক সেকেন্ড, আমি বুঝতে পারছি না।মামলা করবো ঠিক আছে। এরপর? শক্তপোক্ত কি মামলা?”
“আমি বুঝাচ্ছি। আমি আপনার সঙ্গে দুষ্টু দুষ্টু কাজ করার চেষ্টা করবো। আমি হবো ডিপজল, আপনি হবেন মৌসুমি।চার মাস পর আপনি আমার দ্বারা অত্যাচারিত, নির্যাতিত হওয়ার মামলা ঠুকে দেবেন। এতে আমি জেলে গিয়ে দেবদাস হবো, আর আপনি আমজনতার মতো জীবন অতিবাহিত করবেন।”
উনি আমাকে হেঁচকা টান দিয়ে কাছে আনলো। এরপর বললো,
“সো, এখন থেকে আমি আপনাকে তুমি করে ডাকবো। আর নিষিদ্ধ কর্মকান্ড করতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করবো। মাঝেমধ্যে একটু চুম চুম দেব। গাঢ় চুম চুম।”
উনি আবারও ঠোঁট গোল করলেন। এবার চোখ বন্ধ করে আমার দিকে মুখ বাড়িয়ে দিলেন। আমিও ঠোঁট করে অপেক্ষা করলাম। মামলা ঠুকতে হবে তো।
আমাকে ছেড়ে দিয়ে আবার খাবারের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। বেয়াদপ!
“আপনার উপকারে আমি শুদ্ধ চরিত্রবান হয়েও অসভ্য হতে হচ্ছে যেনো আপনি আমাকে লুচু সাব্যস্ত করতে পারেন। এছাড়া আপনার প্রতি আমার কোনো মোহ-মায়া নেই।”
আমার কান্না পেয়ে গেলো। মোহ-মায়া নেই কেন? হুম, হুম, হুম? ইজ এনিথিং রং ইনসাইড হিম?
(চলবে)