#’যাও পাখি বলো তারে’❤
#’লেখাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা❤
#’পর্বঃ ১২
.
প্রাচীনতায় ঘেরা বাড়িটা নামের মতোই অনেকটা প্রাচীন। বাড়ির বাইরের দেওয়াল গুলো নানা মুর্তির খোদাই করা। আশপাশও গাছগাছালিতে ভরপুর। দোতালার এই বাড়িটার সামনে বড় উঠান আর এর একটু পাশেই একটা ছোট্ট পুকুর। সাথে ছোটখাটো একটা সবজির বাগানও আছে। বড় উঠানটার একপাশে আছে টুকটাক ফুলের গাছ আর মাটির তৈরি হরেক রকমের মাটির পাত্র। সেই পাত্রগুলোতে বিভিন্ন নকশা আঁকা হয়েছে। একরকম শখের হাঁড়ির মতোই দেখতে। এগুলো হয়তো বানিয়ে বানিয়ে বাজারে কিংবা বিভিন্ন মেলায় বিক্রি করেন তারা। পাশাপাশি গরু-ছাগলের খামারও আছে।
আমরা আপাতত খোদাই করা প্রাচীন দেওয়াল গুলো দেখছি। ইয়াসিন ভাইয়া কিছুক্ষণ পরপরই সেলফি নিচ্ছেন নিজের। আমি মুচকি হেসে তাকে বললাম,
—” তো মিস্টার সেলফি কিং! এত সেলফি নিচ্ছিস কেন? বোর হচ্ছিস না?”
ইয়াসিন ভাইয়া মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
—” চুপ থাকো মেয়ে। তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নই আমি।”
আমি ভ্রু নাঁচিয়ে বললাম,
—” কেন? কেন? আমি কি করেছি?”
—” একটা সুন্দরী মেয়ে খুঁজে দিতে বলেছিলাম খুঁজে দিয়েছিলি?”
—” সুন্দরী মেয়ে পাইতে হবে তো! ”
ইয়াসিন ভাইয়া নাক ফুলিয়ে বললেন,
—” ক্যান? পাইতে হবে ক্যান? আশেপাশে কত সুন্দরী চাকমা ঘুড়তাছে। একটাও কি তোর চোখে ধরে নাই?”
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
—” তোর চোখে ধরে নাই? ”
এ কথায় মনে হয় লজ্জা পেলেন ইয়াসিন ভাইয়া। অনেকটা লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে আঙুলে আঙুল নাড়াতে নাড়াতে বলে উঠলেন,
—” আমার তো সবগুলোরেই ভালো লাগছে। কোনটা ছাইড়া কোনটা যে নিমু সেটা ভাবতেই আমি কনফিসড! তাই তো তোরে বলছি।”
তার কথায় হাসি পেল আমার। কিন্তু হাসলাম না। হাসি থামানোর যথেষ্ট চেষ্টা করে মুখে গাম্ভীর্য এঁটে নিলাম। বলে উঠলাম,
—” তোর যে কত ক্রাশ! আচ্ছা নায়িকা কাকে পছন্দ তোর?”
এবারও লজ্জা পেয়ে বললেন ইয়াসিন ভাইয়া,
—” তুই জানিস না? দিপিকা! উহু, আমার দিপিকা।”
আমি প্রচুর আফসোসের সঙ্গে বললাম,
—” উহু, অন্যের দিপিকা। ও মেরেড! তাই আশা ছেড়ে দেয়।”
ইয়াসিন ভাইয়া মুখ কুঁচকে বললেন,
—” এগুলো বলবি না তো। ছ্যাকা খাওয়ার কথা বারবার মনে কইরা দিস তোরা। শালা রানভিররে যদি হাতের কাছে পাইতাম।”
বলতে বলতেই হাত মুচরাতে লাগলেন। যেন হাতের কাছে পেলেই ভর্তা বানিয়ে দিবেন রানভিরকে। আমি বললাম,
—” হ্যাঁ, তুই রানভিররে হাতের কাছে পাইতি আর সে তোকে তার বডিগার্ড দিয়ে ভর্তা বানাই দিতো।”
আমার কথায় ইয়াসিন ভাইয়া বিরক্তিতে মৃদু চেঁচিয়ে উঠলেন,
—” ধুর! দিলি তো মুডটা নষ্ট কইরা! ”
আমি হেসে উঠলাম। ইয়াসিন ভাইয়া মুখ ফুলিয়ে আবারও নিজের সেলফি নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তার থেকে চোখ সরিয়ে পাশে তাকাতেই দেখলাম কিছু দূরে রেয়ান দাঁড়িয়ে আছেন। এক হাত প্যান্টের পকেটে রেখে অন্য হাতে ফোন কানে ধরে ফোনে কথা বলছেন আর আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। যেন আমার উপর তার কত জনমের বিরক্তি! উনার দিকে একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলাম আমি। উনার এই ভ্রু কুঁচকানো বিরক্তিকর দৃষ্টিও ভয়ংকর। ভীষণ ভয়ংকর!
রেয়ান থেকে চোখ সরিয়ে অন্য পাশে তাকাতেই আমি অবাক। মেহেরুন আর সবুজ ভাইয়া হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে হেসে হেসে কথা বলছেন। সাথে সাথে ভ্রু কুঁচকে গেল আমার। বিড়বিড় করে বললাম,
—” এটার মানে কি? ”
পাশ থেকে ইয়াসিন ভাইয়া সেলফি নিতে নিতে বললেন,
—” আরে তুই জানিস না? প্রেম চলের প্রেম!”
—” মানে? ”
—” মানে দুইজন দুইজনকে ভালুবাসা-বাসি করে। টুরু লাভ! বুছিস না? আমার কপাল যে কখন এমন হবে? উফফ!”
ইয়াসিন ভাইয়ার কথায় বিশেষ পাত্তা দিলাম না আমি। মৃদু স্বরে বললাম,
—” আমার অগোচড়ে এত কিছু আর আমিই জানলাম না?”
পরপরই দুষ্টু বুদ্ধি এলো মাথায়। আস্তে আস্তে ওদের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। ওরা তখনও হেসে হেসে কথা বলছিল। আমি একটু কেশে উঠতেই চমকে গিয়ে দুজন দুজনের থেকে দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো। হাতও ছেড়ে দিয়েছেন সবুজ ভাইয়া। আমি মুচকি হেসে তাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
—” এতকিছু? বাহ্ঃ সবুজ ভাইয়া। তো কতদিন ধরে এই ডাইনিকে পছন্দ আপনার?”
সবুজ ভাইয়া মাথা চুলকাতে চুলকাতে মুচকি হাসলেন। মেহেরুন আমার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
—” চুপ থাক ছেড়ি। মানসম্মান তো ডুবাই দিচ্ছিস। যা এখান থেকে।”
আমি মেহেরুনের দিকে তাকিয়ে ভুবন ভুলানো হাসি দিলাম। তখনই চোখ চলে গেল রেয়ানের দিকে। উনি দেওয়ালে হেলান দিয়ে পা আড়াআড়ি ভাবে রেখে বুকে হাত গুঁজে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম তখনই। বুঝতে পারছি না উনি আজকে আমার দিকে এত তাকাচ্ছেন কেন? আবার মনে হলো, এটা হয়তো আমার মনের ভুল। হয়তো উনি সবুজ ভাইয়া আর মেহেরুনকে দেখছিলেন।
আমি সেখান থেকে অন্য পাশে চলে এলাম। ছোট্ট ফুলের বাগানের দিকে! সেখানের ফুলগুলো আলতো আলতো ভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছি তখনই মেজো আর ছোট চাচ্চু, ফুফা সাথে তাদের পরিচিত চাকমা একজন আংকেলও আসলেন এখানে। মূলত আংকেলটারই বাড়ি এটা। উনি আর উনার পরিবার থাকেন এখানে। অবাক করা বিষয় হলো আংকেল চাকমা হলেও স্পষ্ট ভাবে বাংলা বলতে পারেন। একদম আমাদের মতো। উনারা আসতেই আংকেলটা বেশ নম্রভাবে বললেন,
—” কেমন আছো সবাই? জায়গাটা কেমন লাগছে তোমাদের? ”
আমরা একসাথে চিল্লিয়ে বলে উঠলাম- ‘সুন্দর।’ শুধু রেয়ান বাদে! এবার মেজো চাচ্চু বলে উঠলেন,
—” তাহলে এখানে থাকতে তো কারো অসুবিধে নেই তাই না? কয়েকটা দিন এখানে থাকবো বলে ভেবেছি আমি।”
আমরা ‘ইয়াহু’ বলে চিল্লিয়ে উঠলাম। যার অর্থ আমরা সবাই রাজী। এরমধ্যে আবদ্ধ বলল,
—” আমরা তো লাগেজ আনিনি আব্বু। তাহলে?”
মেজো চাচ্চু বললেন,
—” করিম আর মুন্নিকে বলেছি আমি। রাতের মধ্যে সবার জামা-কাপড় নিয়ে আসবে। বাসায় পৌঁছাতেই ফোন করবে ওরা। তখন কার কি লাগবে বলে দিস। তাছাড়া এখানে ঘোরার অনেক জায়গা আছে। তাই ভাবলাম এখানেই থাকবো। আশা করি তোদের কোনো সমস্যা নেই।”
এ পর্যায়ে আর কিছু বলল না আবদ্ধ। আমি আড়চোখে রেয়ানের দিকে তাকালাম। উনি আগের মতোই দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন মেজো চাচ্চুর দিকে। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম শুধু!
_____________________
আবদ্ধ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দীঘি আবদ্ধের আরেকটু গা ঘেষে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,
— ” শুনছেন? ”
— ” শুনছি! ”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে দীঘি বলল,
—” আপনি এমন কেন? বউয়ের সাথে হেসে হেসে কথা বলবেন, গল্প করবেন তা না! মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার দিকে তাকান তো একটু।”
আবদ্ধ তাকালো না। প্রতিউত্তরেও কিছু বলল না। দীঘি আবারও বলল,
— ” ভালোবাসি। ”
এবারও নিরুত্তর আবদ্ধ। আবদ্ধের এই নিশ্চুপ থাকাটা মোটেও ভালো লাগছে না দীঘির। উল্টো প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার। মুখ ফুলিয়ে সে বলল,
—” শুনছেন না কেন? ভালোবাসি তো। ”
মুখ খুললো আবদ্ধ। বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
—” সবসময় তোমার এসব বাচ্চামি ভালো লাগে না দীঘি। বিরক্ত লাগছে আমার। কোনোমতে এখান থেকে যেতে পারলে বাঁচি। এসব জায়গায় থাকার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই আমার। তারওপর তোমার এই বকবক রেকর্ডার!”
দীঘি ভ্রু কুঁচকে বলল,
—” আমি বকবক করি তা ঠিক। কিন্তু জায়গাটা তো সুন্দর। আপনার এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না কেন?”
দীঘির দিকে তাকিয়ে কঠিন কণ্ঠে আবদ্ধ বলল,
—” প্লিজ চুপ থাকো দীঘি। এসব রোমাঞ্চকর জায়গা ভালো লাগে না আমার। তোমাকেও না। তাই চুপ! একদক চুপ থাকো। আই নিড সাম স্পেস! একটু শান্তি চাই আমি। যা তোমার জন্য পারছি না।”
কথাটা বলেই পেছনের একটা কাঠের বেঞ্চে বসে পড়ল আবদ্ধ। দীঘি নিষ্পলক তাকিয়ে রইল সেদিকে। আচ্ছা, আবদ্ধ কি কখনো বুঝবে বা তাকে? সে যে আবদ্ধের একটু ভালোবাসার জন্য কাতর। একটু ভালোবাসা পাওয়ারও কি সে যোগ্য না? দীর্ঘশ্বাস গুলো বেড়িয়ে এলো। তবে অজানা কথাগুলো আর বলা হলো না।
তুমি বুঝবে না প্রিয়
আমি কষ্টে আছি।
তোমার অবহেলায়
আমি হারিয়ে যাচ্ছি।
তবে জানো কি?
আমি চাই আমি হারিয়ে
যাওয়ার আগে যেন তোমাকে
বলতে পারি
ভালোবাসি প্রিয়…
তুমি কি একটু ভালোবাসবে আমায়?
_____________
চলবে…
(এর চেয়ে বড় লিখা আপাতত সম্ভব না আমার পক্ষে। অসুস্থতা আত্মীয়তা করতে গিয়ে এখন পড়ালেখাও ‘হাই’ ‘হ্যালো’ করতে এসে গেছে। তার জন্য দেড়ি + ছোট হচ্ছে। সবকিছুর জন্য সরি এবং সবার জন্য রইলো ভালোবাসা❤)