যাও পাখি বলো তারে – পর্ব ২৯

0
914

#’যাও পাখি বলো তারে’❤
#’লেখাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা❤
#’পর্বঃ ২৯
.
রাত ১০টা বাজতে চলল। আমরা এখনো ড্রইংরুমে বসে গল্প করতে ব্যস্ত। হঠাৎ আমার পাশে এসে বসলেন রেয়ান। তার দিকে তাকাতেই দেখলাম উনি মুখে গম্ভীর্যভাব এঁটে ফোন চাপছেন। আমি একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে আবারো গল্পে মনোযোগ দিলাম। কিছুক্ষণ পর আম্মু আর চাচীজান চলে যান নিজ নিজ রুমে। বড়রা চলে যেতেই সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ান ইয়াসিন ভাইয়া৷ মাত্রাধিক এটেটিউট নিয়ে বলে উঠেন,
— “এটেন্সন পোলাপাইনস্! যেহেতু কালকে চলে যাচ্ছি আমি, সেহেতু এখন বকসিস হিসেবে এই ছোট বা বড় ভাইকে সবার টাকা দিতে হবে।”

বিস্ময়ে সবাই একসাথে বলে উঠলাম,
— “এ্যাঁ?”
ইয়াসিন ভাইয়া মুচকি হেসে বললেন,
— “এ্যাঁ না হ্যাঁ! তো মেহেরুন বোন আমার। টাকা বের করো জলদি। কত দিবা? দশ’হাজার নাকি বিশ’হাজার?”

মেহেরুন রাগী গলায় বলল,
— “তোকে আমি বিষ দিবো, বিষ! বিষ খাবি?”

ইয়াসিন ভাইয়া মাথা ডানে-বামে নাড়ালেন। হাত পেতে বললেন,
— “বিষ খাইতাম না। টাকা দাও তুমি।”
— “তুই কিন্তু ভুলে যাচ্ছিস, তুই একা না আমিও কালকে চলে যাচ্ছি। সো বড় ভাই হিসেবে তুই টাকা দিবি আমাকে। আমি না।”

সবুজ ভাইয়া মেহেরুনের কথায় সায় দিয়ে বললেন,
— “আমিও কিন্তু তোমার সাথে যাচ্ছি ইয়াসিন। তাই কষ্ট করে লাভ নেই। আমার থেকে টাকা নিতে পারবে না।”

ইয়াসিন ভাইয়া করুণ চোখে আমার দিকে তাকালেন। কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন,
— “তুইও দিবি না মীরু?”

আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,
— “না। কারণ আমিও চলে যাচ্ছি। তুই আমার বড়। তুই দেয়।”

ইয়াসিন ভাইয়া বিরক্তিতে মুখ তেঁতো করে ফেললেন। পরপরই রেয়ান আর আবদ্ধের দিকে নজর গেল তার। রেয়ান ভাই থেকে টাকা চাওয়ার দুঃসাহস না থাকলেও আবদ্ধের কাছে চাইতে পারবে সে। দাঁত কেলিয়ে হেসে ইয়াসিন ভাইয়া আবদ্ধকে বললেন,

— “আবদ্ধ, ভাই! তুই তো দিবি, তাই না?”

আবদ্ধ ভ্রু কুঁচকে তাকালো ইয়াসিন ভাইয়ার দিকে। বলল,
— “কি দিবো?”

ইয়াসিন ভাইয়া হাসি প্রস্বস্ত করে বললেন,
— “টাকা।”
— “ভাংটি পয়সা নেই আমার কাছে।”
— “তোকে ভাংটি কে দিতে বলল? হাজার টাকা বের কর।”

আবদ্ধ বলল,
— “আমরা দু’জন তো সমবয়সী তাই না? আগে তুই আমাকে হাজার টাকা দেয় তারপর আমি দেবো।”

ইয়াসিন ভাইয়া মুখ মলিন করে ফেললেন। ধীর গতিতে তাকালেন রেয়ানের দিকে। উনি তখনো ফোন চাপছেন। কিছুক্ষণ মনকে শান্ত করে চরম দুঃসাহসের কাজটা করেই ফেললেন ইয়াসিন ভাইয়া। আমতা আমতা করে বললেন,
— “রেয়ান ভাই?”

ফোন থেকে নজর সরিয়ে মাথা তুললেন রেয়ান। চোখ ছোট ছোট করে ইয়াসিন ভাইয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। সাথে সাথে ঢোক গিললেন ইয়াসিন ভাইয়া। মিনমিনে বললেন,

— “ভাইয়া, তুমিও কি দিবে না?”

রেয়ান ভাইয়ের চাহনী তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণ হচ্ছে। ফলসরুপ ইয়াসিন ভাইয়ার কপালে বিন্দু বিন্দু জল জমে গেছে। অথচ রেয়ান ভাই বেশ শান্ত কণ্ঠে বললেন,
— “কত টাকা লাগবে?”
ইয়াসিন ভাইয়া দ্রুত বললেন,
— “তুমি যত দাও।”

মানিব্যাগ থেকে ২টাকার নোট বের করলেন রেয়ান। ইয়াসিন ভাইয়ার হাতে সেটা ধরিয়ে বললেন,
— “তোর গার্লফ্রেন্ডদের চকলেট কিনে দিস। খুশি হবে।”

ইয়াসিন ভাইয়া কিছু বলতে গিয়েও পারছেন না। ২টাকার নোট নিয়ে মলিন মুখে বসে পড়লেন সোফায়। এদিকে হাসি আটকানো দুস্কর হয়ে যাচ্ছে আমাদের জন্য। শেষে না পেরে আবদ্ধ, দীঘিসহ সবাই এক সাথে হেসে উঠলাম আমরা।

___________________

বেশ রাত হওয়ায় আবদ্ধ আর দীঘি চলে যায় নিজ রুমে। আস্তে আস্তে মেহেরুন, সবুজ ভাইয়া আর ইয়াসিন ভাইয়াও চলে যান। আমিও চলে যেতে নেবো তখনই রেয়ান ধীর গলায় বলে উঠেন,
— “তুমিও চলে যাবে কাল?”

কি যেন ছিল তার কণ্ঠে। থমকে দাঁড়িয়ে তার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকালাম। উনার বিড়ালের মতো চোখজোড়া কেমন অশান্ত সাগরের মতো দেখাচ্ছে। হুট করে উঠে দাঁড়ালেন উনি। হাত টেনে নিয়ে বললেন,

— “চলো।”

ছাদে এনে একটা বেঞ্চে বসিয়ে দিলেন আমায়। নিজে দাঁড়ালেন এর ঠিক পাশে রেলিং ঘেষে। অনেক্ষণ চলে গেল, অথচ সে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে। তার আচরণ কোনোদিক দিয়েই বোধগম্য হচ্ছে না আমার। রিসেপশনের রাত থেকেই উনি পাল্টে গেছেন। গম্ভীর উনার পাশাপাশি এক অন্য উনাকেও উপলব্ধি করতে পারি আমি। অতিরিক্ত চিন্তা আর তার এমন নিশ্চুপ থাকাটা কাঁপিয়ে তুলছে আমায়। সত্যিই কি তার উপস্থিতে এমন থরথর কাঁপছি আমি? নাকি শীতে? এমন সময় রেয়ানের মিহিমিহি কণ্ঠ শোনা গেল।

— “তোমার কি শীত লাগছে? ভালোভাবে চাদর জড়িয়ে নাও।”

মাথা নাড়িয়ে তা-ই করলাম। একটু থেমে উনি আবারো বললেন,
— “তুমি কি কালকে সত্যি চলে যাচ্ছো? আর একটাদিন থেকে যাওয়া যায় না?”

আকুতি ভরা কণ্ঠ তার। উনার এমন আকুতি শুনে চমকে উঠে তাকালাম তার দিকে। উনি শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে। হুট করে আমার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লেন উনি। বিষম খেলাম। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে। উনি প্যান্টের পকেট থেকে এক’জোড়া কানের ঝুমকা বের করলেন। আমার হাতের মাঝে সেগুলো রেখে মাথা নিচু অবস্থায় মৃদু কম্পিত কণ্ঠে বললেন,

— “রাঙামাটির একটা দোকানে ঝুমকাগুলো দেখেছিলাম আমি। আমার মনে হয়েছিল এগুলো তোমাকে মানাবে। তাই কিনেছি। তোমার পছন্দ হয়েছে?”

ভীতু চেহারায় আনমনেই মাথা নাঁড়িয়ে হ্যাঁ জানালাম। উনি ঠোঁট কামড়ে হাসলেন। এক হাতে আমার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিলেন। মুচকি হেসে বললেন,
— “ঠান্ডা লেগে যাবে। চলো!”

বাধ্য মেয়ের মতো উনার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলাম আমি।

১৪.

জানুয়ারি মাস শেষ হয়ে ফেব্রুয়ারির আজ প্রথম দিন। বিছানায় শুয়ে থেকে ক্যালেন্ডারের দিকে তাকালাম আমি। মেজো চাচ্চুর বাসা থেকে এসেছি বেশ কয়েকদিন হলো। এর মাঝে রেয়ান নামক অদ্ভুদ মানুষটির সঙ্গে একবারও দেখা কিংবা কথা হয় নি আমার। আমিও অত আগ্রহ প্রকাশ করি নি কখনো!

.

প্রতিদিনকার মতো ভার্সিটি থেকে আমি আর কুহু ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে বাসার দিকে যাচ্ছিলাম। কুহুর বাসা উল্টো দিকে হওয়ায় সামনে মোড় আসতেই সে চলে যায় অন্য দিকে। আমি কিছুদূর একা একা হাঁটলাম। তারপর রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে পরলাম ফুটপাতের একপাশে। হাতে থাকা বাদামের প্যাকেট থেকে একটু পরপর বাদাম নিয়ে চিবুচ্ছি আর রিকশার জন্য অপেক্ষা করছি। হঠাৎ একটা রিকশা এসে থামে আমার সামনে। যেখানে আগে থেকেই বসেছিলেন রেয়ান। উনাকে দেখে এক মুহুর্তের জন্য থমকে গেলাম। বিস্ময়ে চোখ দু’টো বড় বড় হয়ে গেল আমার৷ উনি এখানে কিভাবে? ভাবনার মাঝেই উনি গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন,

— “চোখ খুলে পরে যাবে মরুভূমি।”

হকচকিয়ে গেলাম। দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে বিস্ময় নিয়ে বললাম,
— “আপনি এখানে..?”

আমার কথার পিঠে জবাব দিলেন না উনি। আগের নেয়-ই বললেন,
— “রিকশায় উঠো।”

রেগে গেলাম আমি। সবসময় উনার কথা মানতে হবে নাকি? জেদ নিয়ে বললাম,

— “যাবো না আমি।”

উনি সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। মাত্রাধিক শান্ত কণ্ঠে বললেন,
— “ইউ হেভ থার্টি সেকেন্ডস্ মরুভূমি। এর মধ্যে যদি রিকশায় না উঠো, আই প্রমিস! আজকে তোমাকে হেঁটে হেঁটেই তোমার বাসায় যেতে হবে। এবং তা যে করেই হোক।”

বিরক্ত হলাম প্রচুর। ত্যাড়া কথা বলা ছাড়া উনার দিনই শুরু হয় না যেন! উনার দিকে বিরক্তি নিয়ে একবার তাকিয়ে বসে পরলাম রিকশায়। বাঁকা হাসলেন উনি। রিকশা চলতে শুরু করলেই আমার হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে নিলেন বাদামের প্যাকেট। রাগী চোখে তাকালাম উনার দিকে। বাদামের প্যাকেট নিতে গেলে হাত সরিয়ে ফেললেন উনি। রাগী কণ্ঠে বললাম,
— “সমস্যা কি আপনার? আমার বাদাম দিন!”

উনি মাথা ডানে-বানে নাড়ালেন। অর্থাৎ দিবেন না আমাকে। আমি ‘কেন’ জিজ্ঞেস করতেই বাদাম খেতে খেতে তার জবাব,
— “কারণ তোমাকে জ্বালাতে আমার ভীষণ ভালো লাগে।”

বলেই মুচকি হেসে বাদামের প্যাকেটটা ফেলে দিলেন রাস্তার ওপারে। রাগে-দুঃখে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও থেমে গেলাম। মুখ ফুলিয়ে বসে রইলাম মাত্র। এই মুহুর্তেই প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছি, ‘উনার সাথে কিছুতেই আর কথা বলব না আমি। অসভ্য লোক একটা!’

________________

চলবে…
(ছোট হওয়ার জন্য সরি। একটু ব্যস্ত আছি। ধন্যবাদ❤)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here