যাও পাখি বলো তারে – পর্ব ৩০

0
537

#’যাও পাখি বলো তারে’❤
#’লেখাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা❤
#’পর্বঃ ৩০
.
রোদের দারুণ উত্তপ্ততায় চারপাশ মরুভূমির রুক্ষ আবহাওয়ার মতো রুপান্তরিত হয়ে গেছে। গাড়িতে বসে থাকা দীঘি গরমে হাসফাস করছে। বারবার রুমাল দিয়ে ঘেমে যাওয়া কপাল মুছছে সে। অধৈর্য হয়ে তিক্ত কণ্ঠে পাশে বসে থাকা আবদ্ধকে বলল,
— “এসিটা চালু করুন না আবদ্ধ। গরমে শেষ হয়ে যাচ্ছি আমি।”

দীঘির দিকে আড়চোখে তাকালো আবদ্ধ। সামনে মোড় আসায় ডান পাশে গাড়ি ঘোড়ালো সে। পরপরই নির্বাকভাবে এসি চালু করে দিলো। এসিতেও যেন কাজ হচ্ছে না দীঘির। ব্যাগ থেকে একটা খাতা বের করে নিলো সে। সেটাকে পাখা বানিয়ে বাতাস করতে লাগলো নিজের মুখে। আবদ্ধ এসব কিছু বরাবরই আড়চোখে দেখছে। কিন্তু কিছু বলছে না। দীঘি জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বলে উঠল,

— “আপনার গরম লাগছে না?”

আবদ্ধ ছোট্ট করে জবাব দিলো,
— “না।”

দীঘি অবিশ্বাস্য গলায় বলল,
— “কিভাবে লাগছে না? যেখানে পুরো শহরের মানুষ গরমে প্রায় কান্না করে দিচ্ছে, সেখানে আপনার গরম লাগছে না? মিথ্যা বলছেন আপনি।”
— “জানোই যখন জিজ্ঞেস করছো কেন?”

আবদ্ধর নির্লিপ্ত কণ্ঠ। দীঘির ভ্রু কুঁচকে এলো। এমন কথা দ্বারা আবদ্ধ কি বোঝাতে চাইছে? এটাই যে তার গরম লাগছে কিন্তু সে মিথ্যা বলেছে? কিন্তু কেন বলল? সময় নিয়ে ভাবতে লাগলো দীঘি। পরপরই বুঝতে পারলো, সে বোকামি করেছে ওমন প্রশ্ন করে। কেননা যেখানে পুরো শহরের মানুষের গরমে বেহাল অবস্থা, সেখানে নিশ্চয়ই আবদ্ধেরও গরম লাগছে। শুধু পার্থক্য এটাই সে দীঘির মতো অস্থির হচ্ছে না। কিন্তু একটু ভালোভাবেও তো বলতে পারতো আবদ্ধ। খোঁচা মেরে ‘না’ বলার প্রয়োজনটা কি ছিল?

চোখ ছোট ছোট করে আবদ্ধের দিকে তাকালো দীঘি। বুঝতে পেরে, আবদ্ধ আরো দ্বিগুণভাবে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। তবে তা ক্ষণিকের জন্য। আবারো ড্রাইভিং-এ মনোযোগ দিলো সে। দীঘির ইগোতে লাগলো সেটা। নাম দেখানো ইগো যাকে বলে! সীটে মুখ ফুলিয়ে বসে রইল সে। একটু পর গাড়ি থেমে গেলো। দীঘি আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো তার কলেজ এসে গেছে। বিনা বাক্যে গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে কলেজ গেটের দিকে হাঁটতে লাগলো দীঘি। আবদ্ধ অবাক হলেও পরক্ষণে দীঘির অভিমান বুঝতে পেরে মুচকি হাসলো। ডেকে উঠল দীঘিকে।

পেছন থেকে নিজের নাম শুনে পেছনে ফিড়ে তাকালো দীঘি। আবদ্ধ ড্রাইভিং সীটে বসে জানালা ভেদ করে তাকিয়ে তার দিকে। মুচকি হেসে বলল,
— “ভালো মতো ক্লাস করবে। ছুটি হলে অপেক্ষা করবে। আমি জলদি আসার চেষ্টা করব।”

বলেই সাই করে চলে গেল গাড়িটা। হয়তো পাশের ভার্সিটিতে যাচ্ছে আবদ্ধ। এদিকে দীঘির মুখে বিরাট বড় হাসি লেগে আছে। মন বলছে, আজকের দিনটা ভালো যাবে তার।

________________

রাতের আকাশটা ভীষণ সুন্দর লাগে আমার কাছে। বিশেষ করে যখন আকাশের তারা গুলো টিপটিপ করে হাসে, ভীষণ ভালো লাগে দেখতে। এক কাপ চায়ের সাথে আকাশের সে-ই তারাগুলোর দুষ্টুমি দেখতে ব্যস্ত আমি। এমন প্রিয় মুহুর্তেও অচেনা ব্যক্তিটির মেসেজের কথাটা প্রচুর ভাবাচ্ছে আমাকে। কে সে? এমন মেসেজ দেয় কেন আমায়? তার মেসেজ দেওয়ার পদ্ধতিটাও ভিন্ন। একরাশ অভিমান, রাগ কিংবা কখনো শান্ত মেজাজে এক একেটা বার্তা পাঠাবে সে। এইতো একটু আগেও বলেছিলো আমি নাকি মাথামোটা। শুনে প্রচুর রেগে গিয়েছিলাম আমি। ‘মাথামোটা’ বলার কারণ জিজ্ঞেস করতেই তার জবাব,
— “এই যে এখন এমন বোকা বোকা প্রশ্ন করছো। আশেপাশের কিছু দেখেও এত অবুঝ কেন তুমি?”

অনেক্ষণ ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে বাক্যগুলোর অর্থ বোঝার চেষ্টা করে যখন ব্যর্থ হয়েছি, চুপচাপ ফোনটা বন্ধ করে কড়া লিকারে তৈরি চায়ের সাথে চলে এসেছি বারান্দায়।

বিশাল বড় আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। হঠাৎ বারান্দার দিকে নজর গেল আমার। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ঘোলাটে ভাবে কারো ছায়া দেখতে পারছি আমি। যা আমি তাকানোতে তীব্রভাবে মিলিয়ে যাচ্ছে। এক হাতে চোখ কঁচলে ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করলাম। ততক্ষণে ছায়াটা মিলিয়ে গেছে। দেখা যাচ্ছে না আর। হতাশ হলাম। এক চুমুকে চা টুকু শেষ করে চলে গেলাম রুমে।

১৫.

সকালে ভার্সিটি যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়ে রিকশার খোঁজে লেগে গেলাম আমি। একটা রিকশা পেয়েও গেলাম। কিন্তু যখন উঠতে নিবো তখনই ঘটল বিপত্তি। কালো রঙের একটি গাড়ি রিকশার ঠিক পেছনে এসে দাঁড়ালো। অনবরত হর্ণ বাজাচ্ছে সে। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম সেদিকে। আশ্চর্য! এত হর্ণ বাজাচ্ছে কেন? পাশে কি আর জায়গা নেই? এদিক দিয়েই যেতে হবে কেন? তিক্ত মেজাজে কিছু বলতে যাবো তার আগেই জানালা গলিয়ে ঘার কাত করে তাকালেন রেয়ান। অবাক হলাম। উনি এখানে কেন? তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার আমার দিকে তাকিয়ে রিকশা চালকের দিকে তাকালেন রেয়ান। নম্র হেসে বললেন,

— “চাচা, আপনি চলে যান। ও রিকশায় যাবে না।”

চোখ বড় বড় করে তাকালাম। আমি কখন বললাম আমি যাবো না? রিকশা চালক চলে যেতে নিলেই তাকে থামিয়ে দিলাম আমি। ভ্রু কুঁচকে রেয়ানের দিকে তাকিয়ে বললাম,

— “আমি বলেছি আমি যাবো না?”
— “তুমি বলো নি। কিন্তু আমি বলেছি। কারণ তুমি আমার সাথে যাবে।”

তার কথায় পাত্তা দিলাম না আমি। দৃঢ় ভাবে বললাম,
— “আমি রিকশায়-ই যাবো। আপনার সাথে যাওয়ার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই আমার।”

উনি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
— “মরুভূমি, গাড়িতে এসে বসো।”

আমার স্পষ্ট উত্তর,
— “না।”

কিছু একটা ভেবে বাঁকা হাসলেন রেয়ান। বললেন,
— “তাহলে সেজো চাচীজানকে ডাকতে বলছো তুমি? দেখো তোমার বাসার নিচেই আছি কিন্তু আমরা। ডাকতে সময় লাগবে না বেশি। চাচীজান যদি জানতে পারে, তার প্রিয় জা-এর ছেলের সাথে তুমি বেয়াদবি করেছো, তখন কি হবে?”

তীব্র ক্ষোপ নিয়ে তাকালাম উনার দিকে। উনি ভালো করেই জানেন, আম্মু যদি একবার এ কথা জানে তাহলে আস্ত রাখবে না আমায়। এটারই সুযোগ নিচ্ছেন এই অসভ্যটা। নিজের পাশের সীটের দরজা খুলে দিলেন রেয়ান। আকাশসম রাগ নিয়ে আমিও বসে পরলাম গাড়িতে।

গাড়িতে চুপচাপ মুখ ফুলিয়ে বসে আছি আমি। বেশ কয়েকবার আড়চোখে দেখছি রেয়ানকে। উনি গভীর মনোযোগে ড্রাইভিং করতে ব্যস্ত। এদিকে এতক্ষণ যাবত বিরক্ত হতে হতে এখন বিষণ্ণ, বিষণ্ণ অনুভূতি হচ্ছে আমার। কয়েক মুহুর্তের জন্য নিজের বিষণ্ণতা আর রাগ ভুলে গিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললাম,

— “কোথায় যাচ্ছি আমরা?”

আমার চেয়েও দ্বিগুণ গম্ভীর কণ্ঠে উনার জবাব,
— “এ মুহুর্তে কোথায় যাওয়ার কথা তোমার?”

— “ভার্সিটি। কিন্তু আপনি কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমায়?”

— “তোমার ভার্সিটিতেই যাচ্ছি আমরা।”

ভ্রু কুঁচকে এলো আমার। প্রশ্নের সুরে বললাম,
— “আমার ভার্সিটি কোথায় সেটা আপনি জানেন?”

উনি শান্ত গলায় বললেন,

— “না জানার কি আছে? ওইদিন তোমার ভার্সিটি থেকে রিকশায় করে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিলাম। ভুলে গেছো?”
— “আমি তো ভেবেছিলাম আপনার সাথে কাকতালীয় ভাবে দেখা হয়েছে।”

উনি বিড়বিড় করে উঠলেন,
— “জ্ঞান বুদ্ধীহীন মানুষেরা এগুলোই ভাবে।”

ঠিক শুনতে পেলাম না কথাটা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম তার দিকে। বললাম,
— “কি বলেছেন?”
— “কিছু না।”

তারপর নিরবতা চলল আমাদের মাঝে। জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে হঠাৎ-ই প্রশ্ন করলাম রেয়ানকে।
— “আপনার কি গার্লফ্রেন্ড আছে রেয়ান ভাই?”

তৎক্ষণাৎ গাড়ি থেমে গেলো। ঘাড় কাত করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাকালেন রেয়ান। যেন প্রশ্নটা করে বড় ধরণের ভুল করে ফেলেছি আমি। তার তাকানো মোটেও ভালো লাগছে না আমার। বকা খাওয়ার পূর্ব মুহুর্ত মনে হচ্ছে। একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম,
— “না মানে, গার্লফ্রেন্ড তো থাকতেই পারে তাই না? তাই জিজ্ঞেস করলাম আরকি। আপনার আছে?”

নিরুত্তর উনি। আগের মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। শুধু চোখটা আরেকটু ছোট ছোট হয়ে গেছে তার। শুকনো ঢোক গিললাম। সামান্য তোতলিয়ে বললাম,

— “এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? আমার দেড়ি হচ্ছে।”

এবারো কিছু বললেন না। কপাল দু’আঙ্গুলে ঘঁষে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। পরক্ষণেই দু’হাতের শার্টের হাতা আরেক ধাপ বটে গাড়ি চালাতে মন দিলেন। নিশ্বাস যেন এতক্ষণ আটকে গিয়েছিল আমার। এখন শান্তি, শান্তি লাগছে। উনার দিকে আড়চোখে একবার তাকালাম। স্বাভাবিক লাগছে দেখতে। এবার দুষ্টুমি ভর করল আমার মাথায়। আবারো বললাম,
— “গার্লফ্রেন্ড আছে কিনা সেটা জানতে চাওয়ায় এত রেগে যাওয়ার কি আছে? গার্লফ্রেন্ড তো থাকতেই পারে।”

এতক্ষণ পর রেয়ান এবার নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন,
— “গার্লফ্রেন্ড মানে মেয়ে বন্ধু। অনেকেই আছে আমার।”

বলতে বলতেই গাড়ি থেমে গেলো। ভার্সিটি চলে এসেছে আমার। উনার কথার প্রতিউত্তর দেওয়া হলো না আর। আড়চোখে একবার তাকিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পরলাম। ধীর পায়ে সামনে এগোতে নিলে উনি শান্ত কণ্ঠে বললেন,

— “মরুভূমি, নিজের খেয়াল রাখবে। আসছি আমি।”

_________________

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here