যাও পাখি বলো তারে – পর্ব ৩১

0
900

#’যাও পাখি বলো তারে’❤
#’লেখাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা❤
#’পর্বঃ ৩১
.
আমাকে ভার্সিটি দিয়ে এসেই মেজো চাচ্চুর বাসায় চলে আসেন রেয়ান। ড্রইংরুমে কি যেন আলোচনা করছিল মেজো চাচ্চু আর চাচীজান। রেয়ানকে আসতে দেখেই অনেকটা চমকে যান তারা। তৎক্ষণাৎ কথা বলা বন্ধ করে ফেলেন। সন্দেহের দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকান রেয়ান। ভ্রু কুঁচকে বলেন,
— “কিছু কি হয়েছে? চিন্তিত দেখাচ্ছে তোমাদের।”

মেজো চাচ্চু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন। মুখে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করে বলেন,
— “কিছু না। এমনি কথা বলছিলাম তোর মায়ের সাথে।”

মেজো চাচ্চুর কথায় সায় দিয়ে চাচীজানও হাসার চেষ্টা করলেন। কিন্তু সন্দেহ যেন গেল না রেয়ানের। উনি কিছুক্ষণ ওভাবেই তাকিয়ে রইলেন তাদের দিকে। পরক্ষণেই দ্রুত চলে গেলেন নিজের রুমে। মেজো চাচ্চু আর চাচী বড় বড় নিশ্বাস ফেললেন এবার। এতক্ষণ তাদের দম আটকে আসছিল যেন।

_______________

বারান্দায় বসে আছে দীঘি আর আবদ্ধ। হাতে মুখের ভর দিয়ে আবদ্ধের দিকে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দীঘি। আবদ্ধ তার মূল্যবান বই পড়তে ব্যস্ত। দীঘি কয়েকবার উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে আবদ্ধ কি পড়ছে। দীঘির এই উঁকিঝুঁকি দেখে আবদ্ধ বলল,

— “কি হয়েছে?”

দীঘির দ্রুত উত্তর,
— “কথা বলব।”
— “কথাই তো বলছি আমরা।”
— “কোথায়? আপনি বই নিয়ে বসে আছেন। সময় দিচ্ছেন না আমাকে।”

ছোট একটা নিশ্বাস ফেলে বইটা রেখে দিলো আবদ্ধ। দীঘির মুখোমুখি ঘুরে বসলো। শীতল চাহনী নিয়ে বলল,
— “পড়া কেমন চলছে তোমার?”

মুখটা ফুলিয়ে ফেলল দীঘি। তেঁতো মুখে বলল,
— “পড়ালেখার খবরাখবর জিজ্ঞেস করতে বলিনি আমি।”

দীঘির বিরক্তিমাখা চেহারা দেখে আবদ্ধ মুচকি হাসলো। সে হাসি প্রাণভরে দেখলো দীঘি। আনমনেই বলে উঠল,
— “আপনার হাসি অনেক সুন্দর।”

আবদ্ধ এবার একটু শব্দ করে হাসলো। পরক্ষণেই একটা অসহায় ভাব ফুটে উঠল তার মুখে। স্লান কণ্ঠে বলল,

— “জানো দীঘি, আমি আমার স্কুলের সবচেয়ে দুষ্টু প্রকৃতির ছেলে ছিলাম। সবার কাছে হাসোজ্জল একটা পরিচিত মুখ। কয়েকমাস আগেও আমি এমন ছিলাম। কিন্তু আব্বু যখন বললেন আমাকে বিয়ে দিতে চান তখন কেমন যেন গম্ভীর হয়ে উঠি আমি। আমার বয়স এখন মাত্র ২২ বছর। এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করার কোনো চিন্তাই ছিলো না আমার। পড়ার পাশাপাশি আব্বুর বিজনেসের টুকটাক কাজের মাধ্যমে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চেয়েছিলাম। অথচ…”

বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল আবদ্ধ। সামান্য হেসে বলল,
— “আমি তোমাকে প্রথম প্রথম মেনে নিতে না চাইলেও এখন মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। বিশ্বাস করো, অনেক চেষ্টা করছি। কিন্তু এর জন্য আমার একটু সময় লাগবে। আমাকে একটু সময় দেবে প্লীজ? নিজেকে আগের মতো করতে, তোমার আদর্শ বর হতে?”

জলে ভরে আসা দীঘির চোখ চিকচিক করে উঠলো। মুখে একরাশ উজ্জ্বলতা ছেয়ে গেলো। আবদ্ধের হাতে হাত রেখে মুচকি হেসে বলল,

— “আমি আপনার পাশে আছি আবদ্ধ। আপনার যত সময় প্রয়োজন নিঃসন্দেহে নিন।”

_________________

পরেরদিন ভার্সিটি যাওয়ার জন্য রুম থেকে বের হতেই কয়েকদফা চমকে গেলাম। মেজো চাচ্চু আর চাচী বসে আছেন ড্রইংরুমের সোফায়। তারা একা নন, আবদ্ধ, দীঘি, এমনকি ইয়াসিন ভাইয়াও আছেন সাথে। চট্টগ্রাম থেকে এ লোক আসলো কখন? জানালোও তো না আমায়। মুহুর্তের মধ্যেই ‘বিস্ময়’ শব্দটা ঘিরে ধরেছে আমায়। বিস্ফরিত চোখে চেয়ে আছি চাচ্চু আর ইয়াসিন ভাইয়ার দিকে। ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে হাসছেন। এর মাঝে আম্মু বলে উঠলেন,
— “আজকে তোর ভার্সিটি যেতে হবে না মীরু। রুমে যা। আমি আসছি।”

আরেক দফা বিস্মিত হলাম। মেজো চাচ্চুরা এলে কখনোই আম্মু আমাকে ভার্সিটি যেতে নিষেধ করেন না। তাহলে আজকে কেন? মেজো চাচ্চুরাই বা এত সকাল সকাল এলেন কেন? কোনোমতে সালাম দিলাম চাচ্চুদের। তারপর চিন্তিত ভাব নিয়ে ধীর পায়ে চলে এলাম রুমে। এসেই ধপ করে বসে পড়লাম বিছানায়। কিছুক্ষণ পর আম্মু এলেন রুমে। হাতে থাকা একটা নীল রঙের শাড়ি ধরিয়ে দিয়ে তাড়া নিয়ে বললেন,

— “মীরু, তাড়াতাড়ি শাড়ি পড়ে রেডি হয়ে নেয় তো।”

আমার ভ্রু কুঁচকে এলো। শাড়ি পড়ব কেন? কুঞ্চিত ভ্রু নিয়ে বললাম,
— “আম্মু? শাড়ি পড়তে হবে কেন? কারো কি বিয়ের অনুষ্ঠান আছে নাকি?”

আম্মু ব্যস্ত ভঙ্গিতে রুম ত্যাগ করতে করতে বললেন,
— “হ্যাঁ। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নেয়। বেশি সময় নষ্ট করিস না।”

হতভম্ব আমি। কি হচ্ছে এসব? একপলক তাকালাম শাড়িটার দিকে। বেশ সুন্দর দেখতে। নীলের সঙ্গে ধূসর-কালো রঙটা বেশ মানিয়েছে। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেললাম আমি। মায়ের কথায় দ্রুত তৈরি হয়ে নিলাম।

.

তৈরি হওয়ার পরপরই আম্মু আমাকে নিয়ে চলে এলেন ড্রইংরুমে। সবার সামনে সোফার একদম মাঝখানটায় বসালেন। বুঝতে পারছি না কি হচ্ছে আমার সাথে। তবে সবার মুখের হাসি দেখে কিছু হওয়ার পূর্বাভাস পাচ্ছি। হঠাৎ ইয়াসিন ভাইয়া খোঁচা মেরে বলে উঠলেন,
— “মীরু, তোর তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। মীর জাফর! আমাকে একা রেখে তুই বিয়ে করে ফেলছিস? সার্থপর!”

বলতে বলতে ইয়াসিন ভাইয়া ভুলেই গেলেন বড়দের সামনে আছি আমরা। মেজো চাচ্চু আর চাচী চোখ পাকিয়ে তাকাতেই চুপ হয়ে গেলেন তিনি। এদিকে আমি অশান্তিতে ভুগছি। কি বলল ইয়াসিন ভাইয়া? আমার বিয়ে? কার সাথে? আচ্ছা, আজকে কি আমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে? এজন্যই চাচ্চুরা এত সকাল সকাল বাসায় এসেছেন? আমাকে এভাবে শাড়ি পড়ানো হয়েছে? মুহুর্তেই অস্থিরতা বেড়ে গেলো আমার। হাসফাস করছি শুধু। আম্মু পাশেই বসে ছিলেন। ফিসফিসিয়ে করুণ কণ্ঠে আম্মুকে বললাম,
— ” আম্মু? আমাকে কি এখন পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে? তুমি এজন্য সাজিয়েছো আমায়?”

আম্মুর এক কথায় জবাব,
— “হ্যাঁ।”

‘হ্যাঁ’ শব্দটা কানে যেতেই অস্থিরতা তীব্র হতে লাগলো আমার। ইচ্ছে করছে পালিয়ে যেতে। কান্না আসছে প্রচুর। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে ড্রইংরুমে প্রবেশ করলেন রেয়ান। দরজা খোলাই ছিল। তাকে এভাবে ঢুকতে দেখে সবাই তাকালাম উনার দিকে। বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে সবার দিকে একে একে তাকাচ্ছেন উনি। আমার দিকে চোখ পড়তেই স্থির হয়ে গেলেন। আচ্ছা, উনি কি জানেন আমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে? হয়তো জানেন। কিন্তু এতে উনার কি? উনার তো কিছুই যায় আসবে না।

মৃদু কম্পিত গলায় রেয়ান মেজো চাচ্চুকে বললেন,
— “পা.. পাত্রপক্ষ কি দেখে গেছে ওকে? ওদের পছন্দ হয়েছে মীরাকে? তোমরা কি এখনই বিয়ে দিয়ে দিবে ওর?”

জোড়ালো কণ্ঠে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছেন রেয়ান। মেজো চাচ্চু শব্দ করে হেসে বললেন,
— “আগে বয়। তারপর বলছি।”

তড়িৎ গতিতে রেয়ান মেজো চাচ্চুর পাশে বসে পরলেন। তা দেখে মেজো চাচ্চু আবারো হাসলেন। বললেন,

— “তুই আসতে দেড়ি করে ফেললি। পাত্রপাক্ষ এই মাত্র বেড়লো এখান থেকে। ওদের পছন্দও হয়েছে মীরুকে। ছেলেও ভালো। ভাবছি সামনের মাসে বিয়েটা দিয়েই দিবো ওর।”

সামান্য আশা যা ছিল সব যেন নিভে গেল উনার। করুণ মুখে তাকালেন মেজো চাচ্চুর দিকে। পাশাপাশি আমিও তাকালাম বিস্ময়ে। আমাকে তো কেউ দেখতে আসে নি। তাহলে মেজো চাচ্চু এমন বললেন কেন? উত্তর হিসেবে কিছু বলল না কেউ। মেজো চাচ্চু তো অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন নিজ ছেলের পরের কথাটা শোনার জন্য। চাচ্চুর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মৃদু স্বরে কাঁপা কাঁপা গলায় রেয়ান বললেন,
— “বিয়েটা ভেঙ্গে দাও আব্বু। মীরার বিয়েতে আমার মত নেই।”

মেজো চাচ্চু যেন শুনলেনই না রেয়ানের কথা। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
— “তাহলে আরেকটা বিয়ে খাচ্ছি আমরা।”

রেয়ান মাথা নিচু করে ছিলেন। মেজো চাচ্চুর এমন কথায় হুট করে তাকালেন আমার দিকে। তার লাল লাল চোখ দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। কেমন এলোমেলো লাগছে তাকে। মনে হচ্ছে ঘুম থেকে সরাসরি উঠে এসেছেন উনি। চোখ-মুখ ফ্যাকাসে, ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ, চুল অগোছালো, পরনে শুধু একটা টি-শার্ট আর থ্রী-কোয়াটার প্যান্ট। আপনমনে কি যেন বিড়বিড় করছেন উনি। কিছু বলার জন্য মুখ খুলবেন, সে সুযোগ না দিয়ে মেজো চাচ্চু আব্বুকে বললেন,

— “সাদাফ! বিয়েটা পাকা করি তাহলে। ২মাস পর মীরুর পরীক্ষা শেষ হলেই নিজেদের মেয়ে নিজেদের কাছে উঠিয়ে নিবো।”

রেয়ান আর আমি আবারো চমকে তাকালাম মেজো চাচ্চুর দিকে। হচ্ছেটা কি? এসব তো পাত্রপক্ষদের বলার কথা। তাহলে মেজো চাচ্চু বলছেন কেন? আমাদের দু’জনের প্রশ্নের উত্তর হিসেবে আব্বু বলে উঠলেন,
— “কিন্তু ভাইয়া, তোমার ছেলে তো রাজী না। একটু আগেই তো তোমাকে বলল বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে।”

আস্তে আস্তে সব যেন বোধগম্য হতে লাগলো আমাদের। আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে রেয়ান গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
— “তোমরা কি আমার আর মীরার বিয়ের কথা বলছো?”

মেজো চাচ্চু আফসোসের সঙ্গে বললেন,
— “হ্যাঁ। কিন্তু তুই তো বিয়েতে রাজী না।”

তারমানে এতক্ষণ মজা করছিলেন সবাই! রেয়ান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার তাকালেন আমার দিকে। চোখ ফিরিয়ে মেজো চাচ্চুর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে আবারো বললেন,
— “এক্সাক্টলি কি চাচ্ছো তোমরা?”
— “তুই কি মীরাকে বিয়ে করতে চাইছিস? মুখে বল।”

উনি বললেন,
— “নিশ্চয়ই আমার মতামত জানো বিধায় এখানে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছো। তাও আমাকে বলতে বলছো?”

ইয়াসিন ভাইয়া চেঁচিয়ে উঠলেন,
— “অবশ্যই। জনগন জানতে চায়।”

রেয়ান সরু দৃষ্টিতে তাকান ইয়াসিন ভাইয়ার দিকে। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলেন,
— “বিয়ে করব আমি। করিয়ে দাও ওর সাথে।”

সবাই মিটিমিটি হেসে উঠল এবার। মেজো চাচ্চু তো শব্দ করে হেসে উঠলেন। লজ্জা, বিস্ময় ঘিরে ধরল আমায়। কেমন নির্লজ্জ উনি। বড়দের সামনে কেউ এমন ভাবে বলে?

__________________

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here