যাও পাখি বলো তারে – পর্ব ২৩

0
937

#’যাও পাখি বলো তারে’❤
#’লেখা ঈশানুর তাসমিয়া মীরা❤
#’পর্বঃ ২৩

০৮.
সকালটা স্নিগ্ধময়। জানালা গলিয়ে একফালি রোদ এসে মুখে পড়তেই ঘুম উবে গেলো দীঘির। ঘড়িতে একবার চোখ বুলিয়ে দেখলো সকাল ৬টা বেজে ৩৬মিনিট। আবদ্ধের বুকে থুতনি রেখে জানালার দিকে তাকালো দীঘি। একরাশ হেসে আবদ্ধের দিকে তাকালো এবার। ভ্রু কুঞ্চিত করে ঘুমিয়ে আছে আবদ্ধ। দীঘি বুঝতে পারছে না, ঘুমের মাঝেও মানুষ বিরক্ত হয় কিভাবে? এত এত শান্তির ঘুমে আচ্ছন্ন থেকেও বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে রেখেছে আবদ্ধ। কেন? প্রশ্নটা বেশ ভাবাচ্ছে দীঘিকে। পরপরই আবদ্ধকে জাগিয়ে তোলার ইচ্ছে হলো তার। সে যেহেতু জেগে গেছে আবদ্ধকেও জাগতে হবে। উঠে বসলো দীঘি। আবদ্ধের কানের কাছে ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল,

— “আবদ্ধ, শুনছেন? দেখুন আমাদের বিছানার নিচে সাপ। অনেক বড় সাপ। জানালা দিয়ে এসেছে সে। আমার মনে হয় সেটা কোবরা সাপ। দেখুন তো আপনি। আমার ভয় লাগছে।”

আবদ্ধের কানে গেলো না কথাগুলো। নড়েচড়ে উঠল সে। ঘুমের ঘোড়েই দীঘিকে টেনে নিজের পাশে শোয়ালো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
— “ঘুমাতে দাও দীঘি। তুমিও ঘুমাও।”
— “আরে আপনি বুঝতে পারছেন না। সে যদি কামড়ে দেয়?”

আবদ্ধ বিরক্তি সূচক শব্দ বের করে বলল,
— “সে টা কে? কেন কামড়াবে?”
— “সে টা সাপ! আমাদের বিছানার নিচে কোবরা সাপ।”

আবদ্ধ ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল,
— “ও আচ্ছা…! কিহ্ঃ?”

চেঁচিয়ে উঠে বিছানায় বসে পড়ল আবদ্ধ। বিছানার নিচের আশপাশ ভালোভাবে দেখতে দেখতে অস্থির কণ্ঠে বলল,

— “কোথায়? কোথায় সাপ? কিভাবে আসলো? আমি দেখছি না তো। কোন দিকে গিয়েছে খেয়াল করেছো?”

দীঘির প্রচুর হাসি পেলো। কিন্তু এখন হাসলে চলবে না। কোনোমতে মুখে ভীতু ভাব এনে দীঘি বলল,

— “জানালা দিয়ে এসেছে। কোথায় গিয়েছে দেখি নি। বিছানার নিচেই তো ঢুকতে দেখলাম।”
— “চারপাশ ভালো করে দেখো। সাপটা কোনো ভাবে লুকিয়ে থাকলে..!”

বলতে বলতেই উঠে যাচ্ছিল আবদ্ধ। কথার মাঝপথেই থেমে গেলো সে। বসেও পড়ল সাথে সাথে। সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দীঘির দিকে তাকিয়ে বলল,

— “কি যেন বলেছিলে? আবার বলো।”

গম্ভীর শোনালো আবদ্ধের কণ্ঠ। কোনোভাবে কি সে বুঝে গেছে দীঘি তার সাথে মজা করছে। ফাঁকা ঢোক গিললো দীঘি। আমতা আমতা করে বলল,
— “জানালা দিয়ে এসেছে। কোথায় গিয়েছে দেখি নি। বিছানার নিচেই তো..!”

কথার মাঝেই দীঘিকে থামিয়ে দেয় আবদ্ধ। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দীঘির দিকে তাকিয়ে বলে,
— “এত উপরে সাপ দেওয়াল বেয়ে বেয়ে এসেছে তাই না?”

দীঘি ভুলেই গিয়েছিল সাপ দেওয়ালে উঠতে পারে না। আবদ্ধকে জ্বালাতে গিয়ে ভুলেই গিয়েছিল কথাটা। হাসার চেষ্টা করল দীঘি। তোতলিয়ে বলল,

— “হয়.. হয়তো।”
— “অসহ্য।”

বিরক্তি নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো আবদ্ধ। আবদ্ধের এমন বিরক্তি দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল দীঘি। যেমনই হোক ওর উদ্দেশ্য তো পূরণ হয়েছে। আবদ্ধর ঘুম হারাম করে দিয়েছে সে। এটা ভেবেই দীঘির যতসব আনন্দ!

_____________________

উপন্যাসের বই পড়ায় বেশ রাতে ঘুমিয়েছি আমি। ফলসরুপ ঘুম থেকে উঠতে দেড়ি হয়ে গেছে আমার। দ্রুত রেডি হয়ে ড্রইংরুমে যেতেই দেখলাম আম্মু সোফায় বসে চা খাচ্ছেন। দৃষ্টি তার টিভির পর্দায়। আমাকে রুম থেকে বের হতে দেখে বললেন,

— “টেবিলে খাবার রেখেছি। খেয়ে যা।”

আমি ব্যাগে সবকিছু ঠিক আছে কি-না তা দেখতে দেখতে জবাব দিলাম,
— “সময় নেই আম্মু।”
— “একটু দেড়ি হলে কিচ্ছু হবে।”

কথা বাড়ালাম না। অল্প একটু নাস্তা করে তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পড়লাম। তারপর একটা রিকশা নিয়ে সোজা চলে এলাম ভার্সিটি। ভার্সিটির ভেতর প্রথম পা ফেলতেই মনটা উচ্ছাসে ভরে উঠল আমার। কত দিন পর এসেছি! আস্তে আস্তে সামনে এগিয়ে গেলাম আমি। মাঠের কাছে আসতেই দেখা হয়ে গেলো আমার বেস্টু কুহুর সাথে। আমাকে সাথে সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সে। আনন্দিত কণ্ঠে বলল,

— “দোস্ত, কত দিন পর দেখা। কেমন আছিস? বললিও তো না আজকে আসবি!”

নিজেকে ছাড়িয়ে বললাম,
— “তোকে বলে নিজের মূল্যবান সময়টা নষ্ট করতে চাই নি।”
কুহু মুখ বাঁকিয়ে বলল,
— “কে বলেছে তোকে? সর, সর অন্য দিকে যা। তোকে দেখে বিরক্ত লাগছে আমার।”

কুহুর মুখের ভঙ্গী দেখে হেসে দিলাম আমি। বললাম,
— “চল ক্লাসে যাই।”
— “যামু না তোর সাথে।”

আমি কিছুক্ষণ সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম কুহুর দিকে। তারপর টেনে নিয়ে গেলাম তাকে। ক্লাসে তখনো স্যার আসেন নি। আমি আর কুহু কথা বলতে বলতে এক সাইডের সীটে বসে পড়লাম। বসতে না বসতেই আমার ফোনের ‘টুং টাং’ শব্দ বেজে উঠল। আননোন নম্বর থেকে কে যেন মেসেজ দিয়েছে,
“রাত জেগে থাকবে না। পরেরবার দেখলে নির্ঘাত পুকুরে ফেলে দেবো তোমায়।”

মেসেজটা পড়ে থমকে গেলাম এক মুহুর্তের জন্য। একটু খেয়াল করে দেখলাম কালকের সে-ই আনোন নম্বরটি। সে কিভাবে জানলো আমি রাত জেগে ছিলাম? সে কি আমার আশেপাশের বিল্ডিংয়ে থাকে? মুহুর্তেই রাগ হতে লাগলো আমার। কে না কে! দরকার কি বিরক্ত করার সুযোগ দেওয়ার? সঙ্গে সঙ্গে নম্বরটি ব্লক করে দিলাম আমি। এবার শান্তি, শান্তি লাগছে। ততক্ষণে স্যারও এসে গেছেন। শান্তি মনে ক্লাসও করা যাবে এখন।

________________

ক্লাস শেষে ক্লান্ত পায়ে চলে এলাম বাসায়। গভীর ঘুম দিয়ে উঠতে উঠতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। হাত দিয়ে চুলগুলো ঠিক করে ড্রইংরুমে পা রাখতেই কয়েকদফা চমকে গেলাম আমি। মেজো চাচ্চু আর চাচী সোফায় বসে আম্মু-আব্বুর সাথে গল্প করছেন। কখন এসেছেন উনারা? আমার ভাবনার মাঝেই আমাকে দেখে মিষ্টি হেসে চাচ্চু বললেন,

— “মা, আয় বয় আমাদের সাথে। কালকে আসার পর তো একবার ফোনও দিলি না। দেখ কত ভালোবাসি তোকে, সোজা তোর খবর নিতে চলে এসেছি বাসায়।”

এমন কথায় হাসির রোল পড়ল পুরো ঘরজুড়ে। চাচীজান আমাকে তার পাশে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
— “আবদ্ধের বিয়ে রাঙামাটি হওয়ায় এখনকার কেউ তেমন আসে নি বিয়েতে। তাই ভাবছি ছোটখাটো অনুষ্ঠান করব এখানে। তোদের ভাষায় রিসেপশন করব। ভালো হবে না বল?”

মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালাম। চাচীজান মুচকি হেসে বললেন,

— “তাহলে আরকি? দু’দিন পর চলে আসবি বাসায়। রেয়ানকে পাঠিয়ে দেবো তোদের আনতে।”

শেষের কথাটা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। আচ্ছা, উনি কি আমায় ভুলে গেছেন? একবারো তো ফোন করেন নি আমায়। নিজেকে বিষণ্ণ মনে হলো খুব। চাচীজানের ডাকে হুশ ফিরতেই দ্রুত নিজেকে স্বাভাবিক করলাম। মৃদু হেসে বললাম,
— “রিসেপশন কখন? দু’দিন পরে?”
— “না, আরো চারদিন আছে। তোরা আগে আগে আসবি। পরিবারের মানুষ বলে কথা। সব কাজ তো একসাথেই করবো।”

এবারো মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম আমি। বললাম,
— “চাচীজান, ছোট চাচ্চু আর ফুফিরা আসবেন না?”

মেজো চাচী মন খারাপ করে বললেন,
— “না! ওদের কি যেন কাজ আছে।”
একটু থেমে আবারো বললেন,
— “তবে সবুজ, ইয়াসিন আর মেহেরুন আসবে তিনদিন পর।”

এতটুকু শুনেই খুশিতে নেচে উঠতে মন চাইছে আমার। আমরা আবারো একসাথে হবো। উফ! ভাবতেই ভালো লাগছে। বেশি ভালো হতো যদি কালই সবাই একসাথে চলে আসতাম এখানে।

অনেক্ষণ গল্প করার পর মেজো চাচ্চুরা চলে গেলেন। আমিও রুমে এসে প্রথমেই কনভারেন্স কল করলাম ইয়াসিন ভাইয়া আর মেহেরুনকে। সাথে সাথে রিসিভও করল তারা। ইয়াসিন ভাইয়া প্রথমে বলে উঠলেন,

— “হ্যালো, ফোন দিয়েছিস কেন?”

থমকে গেলাম। এটা কি ধরণের কথা? না কোনো ভালো-মন্দ কিছু জিজ্ঞেস করা আর না নম্র ভাবে কিছু বলা। সোজা কর্কশ কণ্ঠে এমন বলার কারণ কি? রেগে বললাম,

— “তোর মাথা ভাইয়া। ফোন রাখ। তোর সাথে কথা নাই।”
— “আমি ফোন দেই নাই। সো, কাটবো না।”

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
— “ধূর! তুই আসবি না এখানে। এখন থেকে তোকে আমি দু’চোখ দেখতে পারি না।”

ইয়াসিন ভাইয়া ভাব দেখিয়ে বললেন,
— “তাহলে তিন চোখে দেখ। মানা করছে কে? তাছাড়া আমি তোর জন্য ঢাকায় আসছি নাকি যে তুই আমাকে দেখবি? আমি তো মেয়ে পটাতে আসছি। ওই মেহেরুইন্নার সাথে বাজি ধরেছি একটা মেয়ে জোগার করেই ছাড়বো এবার।”

ওপাশ থেকে হাসি শোনা গেলো মেহেরুনের। কিন্তু ইয়াসিন ভাইয়া বুঝতে পারলেন না ব্যাপারটা। তিনি মনে করেছেন আমি হাসছি। তাই ধমক দিয়ে বললেন,

— “হাসবি না মীরু। আই এম সিরিয়াস! ওই মেহেরুন কি করে জানিস? কাপ্তাই থাকতেই রোজ নিয়ম করে তার আর সবুজ ভাইয়ার প্রেম কাহানী শুনাতো আমায়। কালকে তোরা যাওয়ার পর তো সেটা আরো বেড়েছে। ঘুমের থেকে উঠিয়ে ওইসব ফাতরা কাহিনী শুনায় আমায়। তুই-ই বল, আমার মতো সিঙ্গেল নিরিহ মনের মানুষের কষ্ট হবে না এতে? তাই ওই ডাইনির সাথে বাজি ধরেছি আমি! ওর থেকেও সুন্দর মেয়ে পটিয়ে ওর ফাতরা কাহিনী শোনার বদলে নিজের সুন্দর ভালোবাসার কাহিনী শোনাবো ওকে।”

মেহেরুন মনে হয় রেগে গেল। ওপাশ থেকে মেহেরুনের তেজি গলা কানে এলো,
— “কি বললি? আমি ডাইনি? আমি ফাতরা কাহিনী শোনাই? একবার আয় তুই আমার সামনে। এমন দোয়া করব কুমারই ডাকবি সারা জীবন। দেখে নিস!”

ইয়াসিন ভাইয়া ভেবাচেকা খেয়ে গেলেন। পরে যখন বুঝতে পারলেন এটা কনভারেন্স কল ছিলো তখন তিনিও কোমর বেঁধে লেগে গেলেন ঝগড়া করতে। আমিও ‘টুশ’ করে কেটে দিলাম কলের লাইন। নতুবা তাদের তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের কাহিনী শুনতে শুনতে শেষ হয়ে যাবো। যা আপাতত চাচ্ছি না আমি।

______________________

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here