যাও পাখি বলো তারে – পর্ব ২৪

0
576

#’যাও পাখি বলো তারে’❤
#’লেখাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা❤
#’পর্বঃ ২৪
.
আকাশটা চিকচিক করা সমুদ্রের মতো লাগছে আমার। যেখানে একরাশ নীল পানির মাঝে উজ্জ্বল হয়ে আছে সূর্য। আশেপাশের সাদা মেঘগুলো বিশাল বড় আকাশের সোভা আরো বাড়িয়ে তুলছে। কি হবে যদি এই সোভা, উজ্জ্বলতা কালো মেঘে ঢেকে যায়? বাজে দেখাবে? উহুঃ! একটা অন্যরকম সৌন্দর্য সৃষ্টি হবে তখন। বিষণ্ণ মুখটা দেখতে যতটা বেদনা দায়ক, মনোমুগ্ধকর, ঠিক তেমনি। আর যদি সেই আকাশটি থেকে প্রবল পানির বর্ষণ হয় তাহলে সেটা হবে একটি বিষণ্ণ চেহারার মায়াবী আঁখি থেকে গড়িয়ে পড়া দু’ফোটা জল। কিন্তু আমি কেন যেন কাঁদছি না। দু’ফোটা জলও গড়িয়ে পড়ছে না আমার আঁখি থেকে। বিষণ্ণ হয়ে শুধু চেয়ে আছি ঐ আকাশটার পানে। একটু যদি সে আমার মতো বিষণ্ণ হয়! একটু যদি আমার বেদনার সাথে ভাগাভাগি করে!

চোখ বন্ধ করে ফেললাম আমি। মুক্ত বাতাসের স্নিগ্ধতা অনুভব করার প্রবল চেষ্টায় ব্যস্ত আছি। আজ দু’দিন হয়ে গেছে। সকালে চাচীজান ফোন করে বলেছেন আজকে বিকেলে রেয়ান আসবেন আমাদের নিতে। আমরা যেন তৈরি থাকি। আমি তৈরিই আছি। ব্যাগ গুছানো অবস্থায় রাখা আছে টেবিলে। পাশের সাউন্ড বক্স থেকে শোনা যাচ্ছে,
‘ আমার ভেতরে-বাহিরে,
অন্তরে অন্তরে আছো তুমি
হৃদয় জুড়ে…’

গানটার প্রত্যেকটা লাইন কানে বারংবার প্রবল ধাক্কা সৃষ্টি করছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখটা খিঁচে বন্ধ করে ফেললাম। হঠাৎ গাড়ির হর্নের শব্দ এলো কানে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলে তাকালাম। কালো রঙের গাড়ি প্রবেশ করছে বিল্ডিংয়ে। খোলা জায়গায় গাড়ি পার্ক করে ড্রাইভিং সীট থেকে বেড়িয়ে এলেন রেয়ান। হাতে কিসের যেন একটা বক্স। সম্ভবত মিষ্টির। পরনে ধুসর রঙের শার্ট। হাতা ফোল্ড করে রেখেছেন। মুখে সবসময়ের মতো বিরক্তি। তাকে দেখে কয়েক সেকেন্ড থমকে গেলাম আমি। নিঃশব্দে রুমে এসে বিছানায় বসে পরলাম। এ মুহুর্তে আমার অনুভূতি কি আমি জানি না। তবে সব কিছু শূণ্য, শূণ্য লাগছে আমার। একদম ফাঁকা!

কিছুক্ষণ পর কলিংবেলের শব্দ এলো কানে। পরপরই আম্মুর গলার স্বর শুনতে পেলাম। আম্মু রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বলে উঠছেন,
— “মীরা, দরজাটা খুলে দেখ তো কে এসেছে। আমার হাত খালি নেই। জলদি যা।”

আমি থম মেরে বসে রইলাম কিছুসময়। আমি জানি কে এসেছেন। তাই হয়তো যেতে ইচ্ছে করছে না। আম্মুর আবারো চেঁচানোতে বাধ্য হয়ে উঠতে হলো। ধীর পায়ে গিয়ে দরজা খুলতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল রেয়ান ভাইয়ের মুখশ্রী। নিষ্পলক তাকিয়ে আছি উনার দিকে। পরপরই যখন মনে হলো আমি উনাকে বাহিরে দাঁড় করিয়ে রেখেছি, তখন দ্রুত দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালাম। মৃদু কণ্ঠে বললাম,

— “ভেতরে আসুন।”

উনি দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই আবারো থমকে দাঁড়ালেন। আমাকে অবাক করে দিয়ে মুচকি হেসে বললেন,

— “কেমন আছো মিস?”
— “ভালো।”

উনি ভ্রু কুঁচকে বললেন,
— “শুধুই ভালো?”

আমি মৃদু ভাবে বললাম,
— “হ্যাঁ!”
— “আমাকে জিজ্ঞেস করবে না?”

চমকে গিয়ে উনার দিকে তাকালাম। তার দৃষ্টি শান্ত। তার এই শান্ত দৃষ্টি যেন অশান্ত করে ফেলছে আমায়। কোনো উত্তর না দিয়েই চলে এলাম রুমে। একবার ফিরেও চাইলাম না পেছনে।

রুমে এসে আবারো হাঁটু গেড়ে বসে পরলাম বিছানায়। রেয়ান ভাই আর আম্মুর কথা কানে এসে বারি খাচ্ছে। হেসে হেসে কথা বলছেন তারা। রেয়ান ভাইয়ের হাসির শব্দ স্পষ্ট শুনতে পারছি আমি। গম্ভীর মানুষটা এভাবেও কারো সাথে হেসে কথা বলতে পারে? বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। একদমই না! কিছুক্ষণ যেতেই হাসির শব্দ কমে এলো। আম্মু রুমে এসে তাড়া দিয়ে বললেন,

— “মীরা, তোর আব্বুকে ফোন দিয়েছি। উনি একটু পরই এসে যাবেন বাসায়। তারপর সবাই তোর মেজো চাচ্চুর বাসায় যাবো। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নেয়। তোর আব্বুর বাসায় আসতে বেশি সময় লাগবে না।”

এতটুকু বলে আম্মু চলে গেলেন। আমি একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালাম। আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। আজকে একটু সাজলে কেমন হয়? না, একটু আগের ইচ্ছেটা চলে গেছে এখন। কোনোমতে রেডি হতে পারলেই বাঁচি।

রেডি হতে হতে আব্বুও চলে এলেন বাসায়। আব্বু কিছুক্ষণ রেস্ট নেওয়ার পর সবাই চললাম গাড়ির উদ্দেশ্যে। আমি আর আম্মু বসেছি পেছনের সীটে আর আব্বু বসেছেন রেয়ান ভাইয়ের পাশের সীট-টায়। সামনের লুকিং গ্লাসটা একদম আমার বরাবর। সেখানে চোখ যেতেই নজর কারলো রেয়ান ভাইয়ের তীক্ষ্ণ চোখ জোড়া। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভিং করছেন উনি। মাঝে মাঝে হেসে আব্বুর সাথে দু’একটা কথা বলছেন। হঠাৎ লুকিং গ্লাসে তাকালেন উনি। আমাকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে চোখ আরো তীক্ষ্ণ করে ডান ভ্রু কুঁচকালেন। হকচকিয়ে গেলাম। চোখ ফিরিয়ে নিলাম তাড়াতাড়ি। মনের ভুলেও ওদিকে তাকালাম না আর।

__________________

ভার্সিটি থেকে এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দেয় আবদ্ধ। আবদ্ধকে আসতে দেখে রান্নাঘর থেকে ধীর পায়ে রুমে আসলো দীঘি। আবদ্ধের পাশে এসে দাঁড়িয়ে রইলো নির্বাক। আবদ্ধ কপালে হাত রেখে শুয়ে ছিলো। কিচ্ছুক্ষণ যেতেই গম্ভীর কণ্ঠে দীঘিকে বলল,
— “কি হয়েছে? দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
— “কিছু না।”

বলেই দীঘি আবারো চুপ। তবে সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সে। আবদ্ধ এবার উঠে বসলো। হাত ঘড়ি খুলতে খুলতে বলল,

— “আমার ভার্সিটির পাশে একটা কলেজ আছে। ওখানে তোমার ভর্তির ব্যাপারে কথা বলেছি। কাল সকালের ভেতর তোমার সব সার্টিফিকেট রেডি করে রেখো। পাসপোর্ট সাইজের ছবি আছে তো সাথে?”

দীঘি বাকরুদ্ধ হয়ে যায় যেন। খুশিতে কাঁদো কাঁদো অবস্থা তার। কোনোমতে মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ জানায় সে। পরপরই বলে,
— “আম্মু, আব্বু কি আমাকে পড়তে দিবেন?”

আবদ্ধ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। বলল,
— “কেনো দিবে না? ওরাই তো তোমাকে পড়ানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। নাহলে তোমার তো ডামিসকে আবার কলেজে ভর্তি করা? জীবনেও না!”

রাগে ফুঁসে উঠল দীঘি। মৃদু চেঁচিয়ে বলল,
— “কি বললেন?”
আবদ্ধ নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
— “আমার জানা মতে তুমি তো ‘কালা’ না। নাকি ‘কালা’ হয়ে গেছো?”

দীঘি কিছু বলতে যাবে তার আগেই মেজো চাচীর ডাক শোনা যায় নিচ থেকে। দীঘিকে ডাকছেন তিনি। আর একটা শব্দও না করে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিচে চলে যায় দীঘি। আবদ্ধও মুচকি হেসে চলে গেলো ফ্রেশ হতে।

০৯.
মেজো চাচ্চুর বাসায় ঢুকেই আম্মু মেজো চাচীকে ডেকে উঠলেন। শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে এলেন চাচীজান। আমাদের দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠল তার। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

— “এসেছিস তাহলে।”

পরপরই আম্মুকে বললেন,
— “ভাবী, আসতে কোনো সমস্যা হয় নি তো?”

আম্মু মুচকি হেসে বললেন,
— “না। রেয়ান ঠিকঠাক ভাবেই এনেছে।”

বলতে বলতেই সবাই সোফায় এসে বসলাম। রেয়ান ভাই গাড়ি পার্ক করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে প্রথমে আমাদের দিকে একপলক তাকালেন। তারপর কিছু না বলেই চলে গেলেন নিজের রুমে। রেয়ান ভাই যেতেই তাকে উদ্দেশ্য করে এবার আম্মু বলে উঠলেন,
— “আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না ভাবী, তোমার ছেলে আমাদের নিতে আদৌ গিয়েছে।”

এ কথায় আব্বুও হেসে বললেন,
— “ঠিকই বলছো। রেয়ানের মতো গম্ভীর ছেলে আমার সাথেও আজকে হেসে হেসে কথা বলেছে। ভাবতে পারছ কত পরিবর্তন হয়েছে ওর!”

এ বিষয়ে চাচীজান কিছু বললেন না। মুচকি হাসলেন মাত্র।

_______________
রাত ৭টা বেজে গেছে। বিছানায় বসে ফোন স্ক্রল করছিলাম আমি। তখন কুহুর কল এলো ফোনে। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কুহু চেঁচিয়ে বলে উঠল,

— “তুই যে আজকে আসবি না সেটা আমাকে বলবি না? আমার একা একা ক্লাস করতে হয়েছে। আর ফোন কোথায় থাকে তোর? সারাদিন কতগুলো ফোন দিয়েছি খেয়াল আছে?”

এক নিশ্বাসে বলে উঠল কুহু। কুহুর প্রবল চেঁচানোতে কান যেন শেষই হয়ে যাবে আমার। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললাম,
— “আরে আস্তে চিল্লা। আজকে মেজো চাচ্চুর বাসায় এসেছে। তাই ব্যস্ত ছিলাম, ফোন ধরা হয়নি।”

এবার কিছুটা শান্ত হলো কুহু। বলল,
— “কতদিন থাকবি?”
— “এই ধর চার-পাঁচ দিন।”

কুহু মন খারাপ করে বলে,
— “এত্ত দিন? এ কয়দিন আমি একা একা ভার্সিটি যেয়ে কি করবো? আরো আগে আসা যায় না?”
— “না যায় না।”

ওপাশ থেকে কুহু আবারো বলল,
— “আংকেলকে কি এতদিন ছুটি দিবে?”
— “না। কিন্তু মেজো চাচ্চুর বাসা থেকে আব্বুর অফিস অতটা দূর না। এখান থেকেই হয়তো অফিসে যাবেন আব্বু।”

কুহু তেঁতো কণ্ঠে বলল,
— “আচ্ছা, তাহলে আরকি? বেড়া ওখানে। আর এখানে আমি গরুর ঘাস কাটি বসে বসে।”

আমি মজা করে বললাম,
— “তোর মতো মেয়ে আর কাজও পারবে না। তবে তুই কাজের মেয়ে হতে পারবি। এই যোগ্যতা তোর আছে। সবাই তোকে এক নামে ডাকবে, ‘কুহেলিকা কাজের বুয়া।’ দারুণ না?”

ওপাশ থেকে কুহু চেঁচিয়ে উঠতেই কলটা কেটে দিলাম আমি। শুধু শুধু ওর গালি শোনার ইচ্ছে নেই আমার। ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে ফোনের স্ক্রিন চালু করার পরপরই আনোন নম্বর থেকে মেসেজ এলো। মেসেজটা দেখতেই ভ্রু কুঁচকে গেলো আমার। অবাকও হয়েছি প্রচুর। সেই আগের অচেনা ব্যক্তিটি অনেকটা থ্রেটের মতো লিখেছে,

‘ তোমার সাহস দেখে আমি হতবাক! আমার ফোন নম্বর ব্লক করেছো? তুমি কি ভেবেছিলে আমার থেকে এত তাড়াতাড়ি পার পেয়ে যাবে? হাউ ফানি! তোমার ভাগ্য ভালো ছিল এতদিন ব্যস্ত থাকায় ব্যাপারটা খেয়াল করি নি আমি। কিন্তু এখন তোমার নিস্তার নেই মেয়ে। শুধু অপেক্ষা করো। তোমাকে শাস্তি দিতে বেশি সময় নষ্ট করব না আমি। আই প্রমিস!

ইতি,
তোমার যম। ‘

__________________

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here