যাও পাখি বলো তারে – পর্ব ২৫

0
574

#’যাও পাখি বলো তারে’❤
#’লেখাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা❤
#’পর্বঃ ২৫
.
যেহেতু মেজো চাচ্চুর বাসায় প্রথম এসেছি, সেহেতু বাড়ির আশপাশটা ঘুড়ে ঘুড়ে দেখছিলাম আমি। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে গার্ডেনের দিকে চলে এসেছি খেয়ালই নেই। তবে একদিকে ভালোই হয়েছে। গার্ডেনের দিকটা অনেক সুন্দর। রাতের আকাশে টিপটিপ করা তারা আর আশেপাশে বাগান থেকে আসা ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ, সবমিলিয়ে সুন্দর একটা পরিবেশ। কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে গার্ডেনের একটা বেঞ্চে বসে পরলাম আমি। খোলা আকাশের পানে মুখ করে চোখ বন্ধ করে রইলাম। এমন সময় কেউ পাশ থেকে আমার ইয়ারফোন এক টানে খুলে ফেলে। ধপ করে বসে পড়ে আমার পাশে। আমি পাশ্ব ফিড়ে তাকাতেই দেখলাম রেয়ান ভাই বসে আছেন। এক মনে ফোন চাপছেন উনি। উনার এহেন কান্ডে রাগ হলো প্রচুর। কটমট করে তার দিকে তাকাতেই সে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

— “ওয়াট? এত রাতে এখানে কি? সোয়েটার কোথায় তোমার? জ্বর-টর বাঁধানোর চিন্তা করছো? চড় খাবে?”

বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে। কোথায় আমার রাগ করা উচিত সেখানে উনি বকছেন আমায়? চড় দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন? রাগে ফুঁসে উঠলাম আমি। উঠে চলে যেতে নিলে উনি অনেকটা ধমকের সুরে বলে উঠলেন,
— “যেতে বলি নি আমি।”

তার দিকে তাকালাম। উনার সম্পূর্ণ মনোযোগ ফোনের দিকে। অথচ কিভাবে ধমকাচ্ছেন আমায়! কটমট কণ্ঠে বললাম,
— “আপনার বলা আর না বলা দিয়ে আমার কি আসে যায়? আপনার কথায় আমি উঠবো, বসবো নাকি?”

উনার কাঠকাঠ জবাব,

— “তাতে সমস্যা কি? বেশি কথা না বলে পাশে বসো। নাহলে নির্ঘাত তোমার গালে আমার হাতের চড় পড়বে।”

— “আপনি কিন্তু..!”

কথা শেষ হবার আগেই উনার ধমক দেওয়া কণ্ঠ,
— “চুপ! বেশি বকবক করো তুমি।”

মুখ ফুলিয়ে ফেললাম আমি। তার পাশে বসতেই উনি আবারো গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

— “আমার জন্য এক কাপ কফি বানিয়ে আনো তো।”

বসতে না বসতেই উনার এমন কথায় বিরক্ত হলাম প্রচুর। যদি কফি খাওয়ারই ইচ্ছে থাকে তাহলে শুধু শুধু এত ধমকা-ধমকি করে আমাকে বসালেন কেন? পরপরই আমার হাতের কফি খাওয়ার কথা মনে পড়তেই সরু দৃষ্টিতে তাকালাম উনার দিকে। উনি ফোন চাপতে ব্যস্ত তখন। অনেকটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললাম,

— “আমার বানানো কফি তো বাজে হয়। একদম বিস্বাদ! আপনি খেতে পারবেন সেটা?”

উনি কিছু বললেন না। তাকালেন না পর্যন্ত। শুধু ভ্রুটা কুঁচকে রেখেছেন। তার এত বিরক্তি যে কোত্থেকে আসে! কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে চলে এলাম বাড়ির ভেতর। উনিও আটকালেন না এবার।

ধীর পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। মা আর চাচীজান রাতের খাবার তৈরি করছিলেন। আমাকে রান্নাঘরে দেখে চাচীজান বললেন,

— “কি ব্যাপার মীরু? এখানে এসেছিস কেন? কিছু লাগবে?”

আমি মিনমিনিয়ে বললাম,
— “চাচীজান, আসলে… মানে রেয়ান ভাইয়া কফি চাইছিলেন।”

আম্মু সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। তবে কিছু বললেন না। চাচীজান মুচকি হেসে বললেন,

— “আচ্ছা, দাঁড়া আমি বানিয়ে দিচ্ছি।”

আমি মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম। নিজে বানানোর কথা উচ্চারণও করলাম না। “রেয়ান ভাই কফি চাইছিলেন” কথাটা বলতেই মা যেভাবে তাকিয়ে ছিলেন, নিজে বানানোর কথা বললে তো নির্ঘাত দৃষ্টি দিয়েই ধ্বংস করে ফেলবেন আমায়। তাই চুপ থাকাটাই আপাতত শ্রেয় মনে করছি আমি!

____________________

কফি হাতে রেয়ান ভাইয়ের পাশে এসে দাঁড়ালাম আমি। কফির মগ উনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম,

— “আপনার কফি।”

আমার দিকে তাকালেন রেয়ান। ফোন রেখে হাত থেকে কফির মগ নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমি একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে চলে যাওয়ার জন্য দু’কদম এগোতেই পেছন থেকে রেয়ান ভাই বলে উঠলেন,

— “কফি তোমাকে বানাতে বলেছিলাম।”

থমকে গেলাম। পেছনে ফিড়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
— “আপনি কিভাবে জানলেন?”

উত্তর দিলেন না রেয়ান। বাঁকা হাসলেন মাত্র। আমি কিছুক্ষণ উত্তরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলাম। উত্তর না পেয়ে যেতে উদ্যোগী হতেই উনি শান্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন,
— “যেও না, থেকে যাও!”

চমকে উঠে উনার দিকে তাকালাম। উনি একহাত প্যান্টের পকেটে রেখে অন্য হাতে কফির মগ ধরে আছেন। সামনের দিকে তাকিয়ে ধোঁয়া ওঠা কফির মগে একটু পরপর চুমুক দিচ্ছেন। লাইটের আলোয় সামনে থাকা বাগান অনেকটাই স্পষ্ট। সেদিকেই তার দৃষ্টি নিবদ্ধ। অদ্ভুদভাবে আমি তার পাশে এসে দাঁড়ালাম এবং নির্বাক দাঁড়িয়েই রইলাম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।

১০.

একরাশ বিরক্তি নিয়ে বিছানায় পা উঠিয়ে বসে আছে দীঘি। দৃষ্টি আবদ্ধের মুখের ওপর। রাত ১২টা বাজতে চলল অথচ আবদ্ধ এখনো ল্যাপটপে গুতাগুতি করতে ব্যস্ত। কি এমন করছে সে? উঠে দাঁড়ালো দীঘি। কোনো দিক-বেদিক না তাকিয়ে সোজা গিয়ে বসে পড়ল আবদ্ধের কোলে। চমকে গেল আবদ্ধ। নিজের কোলে দীঘিকে আবিষ্কার করতেই ধমকে উঠল,

— ‘সমস্যা কি তোমার দীঘি? উঠো এখান থেকে। দেখছো না কাজ করছি?’

দীঘি উল্টো ধমক দিয়ে উঠল,
— “চুপ থাকুন আপনি। রাত ক’টা বাজে খেয়াল আছে? এতক্ষণ কিসের কাজ?”

আবদ্ধ দীঘির কাছ থেকে সরে এসে তার পাশে বসল। স্লান কণ্ঠে বলল,
— “আমি কোনো কাজ করছি না। পড়ছিলাম! এখন সরো, পড়তে দাও আমাকে।”

দীঘি সরলো না। আগ্রহী কণ্ঠে বলল,

— “কি পড়ছিলেন?”
— “উপন্যাস! ইংরেজী উপন্যাস। তুমি বুঝবে না। সরো এখান থেকে।”

জেদ নিয়ে আবদ্ধের গা আরো ঘেঁষে বসলো দীঘি। মুখ মলিন করে বলল,

— “আপনি সবসময় আমার সাথে এমন ব্যবহার করেন কেন আবদ্ধ? আমি আপনার পাশে থাকলে কি এমন হবে?”

— “অনেক কিছু হবে। তুমি আমাকে বিরক্ত করবে যা আমার মোটেও পছন্দ না। তাই প্লীজ নিজের মতো গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আমার কাজ শেষ হওয়া অব্দি আমি এখানেই বসে থাকবো।”

দীঘি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। পরপরই বলল,
— “তাহলে আমিও বসে থাকবো আপনার সাথে।”

মুহুর্তেই কি যেন হতে লাগলো আবদ্ধের। প্রতিদিন দীঘির এসন ন্যাকামো মাত্রাধিক লাগে আবদ্ধের কাছে। আজকে সব সহ্যের বাহিরে চলে গেছে। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল আবদ্ধ,

— “সমস্যা কি হ্যাঁ? একবার বললে বোঝো না? তোমার সঙ্গ আমার বিরক্ত লাগে বোঝো না? বারবার বিরক্ত করতে কেন চলে আসো? তোমার বাবা একটা বড় মেয়ে পালিয়ে যাওয়ায় ছোট মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার কথা বলল। আম্মু-আব্বুও এতে রাজী। আমার মতামত নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না তাদের? তোমার মতো একটা নাবালিকারর সাথে কিভাবে সারাজীবন কাটাবো আমি? পারো তো সারাদিন আমাকে বিরক্ত করতে, জ্বালাতে! একটু শান্তি চাই আমি দীঘি। যা তোমার জন্য সম্ভব হচ্ছে না। সহ্যের সীমা পেরিয়ে যাচ্ছে আমার। প্লীজ দূরে থাকো আমার থেকে দীঘি। প্লীজ!”

এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো আবদ্ধ। এতদিনের রাগ যেন আজকে একবারে ঝেরেছে সে। বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। এদিকে দীঘির চোখ জলে ভড়ে গেছে। একরাশ অভিমান নিয়ে আবদ্ধের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। শান্ত হতেই আবদ্ধ যখন বুঝতে পারলো সবার প্রতি এতদিনের রাগ সে দীঘির উপর ঝেরে দিয়েছে তখন অনুতপ্ত বোধ করল সে। আমতা আমতা করে বলে উঠল,

— “আ..আসলে দীঘি.. আমি.. মানে..!”

কথা শেষ হওয়ার আগেই আবদ্ধকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল দীঘি। ‘হাউমাউ’ করে কেঁদে উঠল। হেঁচকি তুলতে তুলতে বারবার বলে উঠছে সে,
— “আপনি বাজে আবদ্ধ। খুব বাজে!”

দ্বিধান্বিত হাতে দীঘিকে জড়িয়ে ধরে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো আবদ্ধ। কি থেকে কি হচ্ছে তার কিছুই বুঝতে পারছে না সে। হঠাৎ রেগে যাওয়া, দীঘির কান্না, সবকিছু খুব দ্রুত হচ্ছে। এতই দ্রুত যে আবদ্ধের কখন কি করা উচিত সেটাই বুঝতে পারছে না সে। সত্যিই বুঝতে পারছে না!

_______________________

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here