যাও পাখি বলো তারে – পর্ব ২৬

0
560

#’যাও পাখি বলো তারে’❤
#’লেখাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা❤
#’পর্বঃ ২৬
.
পরেরদিন বিকালে ইয়াসিন, সবুজ ভাইয়া এবং মেহেরুনের আগমন গঠল মেজো চাচ্চুর বাসায়। আমরা সবাই সোফায় বসে কালকের রিসেপশন নিয়ে কথা বলছিলাম৷ এমন সময় তাদের আগমনে উৎসব মূখর পরিবেশটা যেন আরো দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। ক্লান্তিতে সবাই এসেই প্রথমে সোফায় ধপ করে বসে পড়ল। মিনু আন্টি তাদের সবার জন্য পানি আনতেই সবাই যেখানে আরাম করে পানি পান করতে ব্যস্ত, সেখানে আমার পাশে বসে থাকা ইয়াসিন ভাইয়া আজকে কি কি ঘটনা ঘটেছে তার সঙ্গে সে কাহিনী বলতে ব্যস্ত। বেশ উৎফুল্লতার সঙ্গে তিনি আমায় বলে উঠলেন,

— “জানিস মীরু আজকে কি হয়েছে?”

আমি চোখ ছোট ছোট করে বললাম,
— “তুই না বললে কিভাবে জানবো ভাইয়া?”

নিত্যান্তই তাকে খোঁচা দিয়ে কথাটা বলেছি আমি। কিন্তু সেদিকে মোটেও পাত্তা নেই তার। সে নিজের মতোই আবার বললেন,
— “ট্রেনে একটা সুন্দরী মেয়ের সাথে দেখা হয়েছে আমার। উফ! কি সুন্দর তার চাল, কি সুন্দর তার কথা বলার ধরণ! আমি তো সেখানেই ফিদা। নিজের হিরো লুকিং ফেস নিয়ে তাকে প্রপোজ করতেই মেয়েও রাজী। নাম্বারও এনেছি জানিস।”

বলেই ফোনের ডায়ালিস্টের একটা নম্বর দেখিয়ে বললেন,
— “আজকে রাতেই ফোন দিবো মেয়েটাকে। দোয়া করিস যেন পোটে যায়। ইনশাল্লাহ.. কয়েকদিন পরই তোরা তোদের ভাবী পেয়ে যাবি।”

পাশ থেকে মেহেরুন ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,
— “পাগলের কথায় কান দিস না মীরু। কিছু কিছু কথা ছাড়া সব বানিয়ে বানিয়ে বলেছে এই বান্দর। নাম্বারের জন্য আর একটু হলেই পা ধরতো মেয়েটার। নেহায়েত মেয়েটা বোকা, সোকা ছিল আর সাথেও কেউ ছিল না। তাই নাম্বার দিয়ে দিয়েছে। নাহলের জেনেবুঝে মাকড়সার জালে কে পা দেয়?”

সবুজ ভাইয়াও সায় দিলেন মেহেরুনের কথায়। আমি এবার সরু দৃষ্টিতে তাকালাম ইয়াসিন ভাইয়ার দিকে। কেমন বানিয়ে বানিয়ে কথা বলে ভাইয়া। নাটকবাজ একটা!

কথা বলার মাঝে মেজো চাচী সিড়ির দিকে ইশারা করে বলে উঠলেন,
— “ওইতো রেয়ানও এসে গেছে।”

সবাই একসাথে তাকালাম সিড়ির দিকে। কালো শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে সিড়ি দিয়ে নেমে আসছেন রেয়ান। এসেই আমার পাশে দাঁড়ালেন। সবুজ ভাইয়ার মাথায় টোকা মেরে চোখের ইশারায় কিছু একটা বললেন। সাথে সাথে সবুজ ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে হেসে দিলেন। এদিকে ইয়াসিন ভাইয়া মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলেন,

— “কেমন আছো আব্রাহাম ভাই? আমার সাথে মানাবে এমন কোনো মেয়ে আছে তোমার চেনা?”

রেয়ান ভাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন ইয়াসিন ভাইয়ার দিকে। অথচ শান্ত কণ্ঠে বললেন,
— “তোর কি মনে হয় না তুই দিন দিন কালো হচ্ছিস, ইয়াসিন? সারাদিন বাইরে বাইরে মেয়েদের পেছনে ঘুরিস নাকি?”

ইয়াসিন ভাইয়ার হাসোজ্জল চেহারা মিইয়ে গেলো। মুখ ফুলিয়ে নিলেন তিনি। রেয়ান ভাই চেচীজানকে ‘আসি’ বলে বেড়িয়ে গেলেন বাইরে। সেদিকে তাকিয়ে ইয়াসিন ভাইয়া নিজের মুখে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে করুণ কণ্ঠে বললেন,

— “সত্যিই কি কালো হয়ে গেছি আমি মেহেরুন? রোজই তো ‘ফেয়ার এন্ড লাভলি’ লাগাই, তবুও কালো হইলাম কেমতে?”

এ কথায় কেউ জবাব দিতে পারলান না৷ এক দম ফাটানো হাসি হেসে দিলাম আমি, মেহেরুন আর সবুজ ভাইয়া।

_______________

রিসিপশনের দিন সকালে আবদ্ধের পাশেই বসে বসে টিভি দেখছিল দীঘি। তখন বই পড়তে পড়তে আবদ্ধ বলল,
— “কফি খাবো। একটু কফি বানিয়ে আনো তো দীঘি।”

দীঘি কোনো ভাবগতি প্রকাশ করল না। মনোযোগ সহকারে টিভি দেখছে সে। আবদ্ধ এবার তাকালো তার দিকে। দীঘির এমন নির্লিপ্ত ভাব দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,

— “কি বলেছি দীঘি?”

দীঘি এবারো নিরুত্তর। তবে রুম থেকে চলে গেছে সে। দীঘির আচরণ কিছু বুঝতে পারছে না আবদ্ধ। কালকে থেকেই দীঘি এমন করছে তার সাথে। না পারতে কথা বলছে, যা স্পষ্ট ‘ইগনোর’ বোঝায়। ‘ইগনোর’ শব্দটা মাথায় আসতেই ভ্রু আরো কুঞ্চিত হলো আবদ্ধের। বই রেখে হাঁটুতে হাত ভর করে বসল সে। দীঘির আসার অপেক্ষা করতে লাগলো।

কিছুক্ষণ পরই দীঘির দেখা মেললো। এসেই কফির মগটা আবদ্ধের সামনে টেবিলে রাখলো সে। পরপরই ব্যস্ত হয়ে পড়ল টিভি দেখতে। কেউ যে তাকে সূক্ষ্ণভাবে দেখছে, সেদিকেও খেয়াল নেই তার। দীঘির এমন আচরণে ক্রমশই রেগে যাচ্ছে আবদ্ধ। যখন, তখন রেগে যায় না সে। তবে রেগে গেলে নিজেকে শান্ত রাখার অসীম ক্ষমতা আছে তার। যা ক্ষণিকের জন্য হলেও যথেষ্ট। আপাতত আবদ্ধ সেটাই করছে। কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করল আবদ্ধ। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

— “দীঘি, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

জবাব দিলো না দীঘি। আবদ্ধ এবার অনেকটা জোড় গলায় বলল,
— “কিছু বলেছি তোমাকে?”

দীঘি টিভির চ্যানেল পাল্টাচ্ছিল। না তাকিয়েই শান্ত স্বরে বলল,
— “বলুন, শুনছি।”

আবদ্ধ ভারী কণ্ঠ,
— “আমার দিকে তাকাও।”

বিরক্তি মাখা চেহারায় তাকালো দীঘি। দীঘির এমন চাহনী ভালো লাগছে না আবদ্ধের। তার নির্লিপ্ত ভাব অসহ্য লাগছে প্রচুর। লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে কিছু বলবে তার আগেই দরজায় টোকা পড়ল। দীঘি দরজা খুলতেই দেখলো মেহেরুন এসেছে। মুচকি হেসে বলল,

— “কিছু দরকার?”

মেহেরুনও হেসে বলল,

— “ভাবী, পার্লারের মেয়েরা এসে গেছেন। তাই আপনাকে ডাকতে পাঠালেন চাচী।”
— “আচ্ছা, চলো।”

কথাটা বলে দীঘি এক পলক তাকালো আবদ্ধের দিকে। পরপরই চলে গেলো মেহেরুনের সাথে। আবদ্ধ দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছে সব। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে কফির মগ হাতে নিয়ে চলে যায় বারান্দায়। এই মুহুর্তে এ কফিটা বড্ড প্রয়োজন তার।

১১.

বিকাল হতে চলল। একটু পরেই রিসেপশন শুরু হবে। এখন সবাই চারপাশ সাজাতে ব্যস্ত। কনুই এর একটু নিচ পর্যন্ত হাতে মেজেদী লাগিয়ে আমি ইয়াসিন ভাইয়াকে নিয়ে বাড়ির এপাশ থেকে ওপাশ হাঁটছি। মূলত রিসেপশনিস্টদের কাজের ধরণ দেখছি বলা যায়। স্টেজের কাছে আসতেই খেয়াল হলো স্টেজের উপরের এক প্রান্তে ফুল কয়েকটা বেশি আছে এবং অপর প্রান্তেরটা কম। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের একটু পাশেই একজন লোক ছোট্ট একটা টুলে দাঁড়িয়ে ফুল লাগাতে ব্যস্ত। লোকটাকে ডেকে বললাম,

— “আংকেল, স্টেজের এক প্রান্তে ফুল কম হয়েছে। ওগুলো ঠিক করুন।”

লোকটা একবার আমাদের দিকে তাকালো। ভুল করলে নিজের ভুলের জন্য মানুষ যেভাবে হাসে, উনিও ঠিক সেভাবে হেসে স্টেজের অপর প্রান্তে ফুল লাগাতে লাগলেন। ইয়াসিন ভাইয়া খুব সূক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেখতে লাগলেন আংকেলটার কাজ। দেখতে দেখতে আমার কাঁধে কনুই ভর করে দাঁড়ালেন। তার এমন কাজ বরাবরই বিরক্ত লাগে আমার। এবারো বিরক্তি নিয়ে তাকালাম তার দিকে। কিন্তু সে আছেন তার গভীর ভাবনা নিয়ে। সাথে সাথে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালাম আমি। ফলে ভাইয়া তার হাতের নিয়ন্ত্রণ না রাখতে পেরে পরে যেতে নিলেন। কিন্তু পরপরই নিজেকে আবার সামলে নিলেন। আমার দিকে চোখ পাকিয়ে বললেন,
— “এটা কোনো কথা? বেয়াদবি করছিস কেন? দেখেছিস না আমি একটা জরুরি ভাবনায় ব্যস্ত ছিলাম?”

আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম,
— “তুই আর তোর জরুরি ভাবনা! এসব ফালতু ভাবনা বাদ দিয়ে আশেপাশের সব ঠিক আছে কি-না সেটা দেখ।”
— “দেখবো না। কি করবি?”

আমি চোখ ছোট ছোট করে তাকালাম ইয়াসিন ভাইয়ার দিকে। হাতের মেহেদী দেখিয়ে বললাম,
— “এই যে মেহেদী দেখছিস না? একদম মুখে মেখে দেবো। তাই সাবধান!”

ইয়াসিন ভাইয়া মুখ বাঁকালেন। ফোন বের করে কাকে যেন কল করে কথা বলতে বলতে চলে গেলেন অন্যদিকে। পাত্তাই দিলেন না আমায়। এ ছেলে আসলেই ঘাড়ত্যাড়া। যত্তসব!

ইয়াসিন ভাইয়া চলে যাওয়ায় একা আমাকেই আশপাশটা দেখতে হচ্ছে এখন। আধাঘন্টা এদিক-ওদিক হেঁটে তারপর মেহেদী তোলার জন্য সিড়ির দিকে এগোচ্ছিলাম। হাতের মেহেদী দেখতে দেখতে হাঁটার কারণে বেখেয়ালি ভাবে কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে গেলাম আমি। ভ্রু কুঁচকে মাথা উঁচু করে তাকাতেই দেখলাম রেয়ান দাঁড়িয়ে আছেন। ভ্রু নাঁচিয়ে আমাকে বললেন,
— “চোখ কি সত্যিই হাতে নিয়ে হাঁটো?”

আমি তেজি গলায় বললাম,
— “আপনার চোখ কোথায় ছিল? আমি আসছিলাম দেখেন নি?”

উনি মাথা এপাশ-ওপাশ নাঁড়িয়ে বললেন,
— “উহু!”
— “কি উহু?”

উনি আবারো বললেন,
— “উহু মানে উহু।”

অধৈর্য হয়ে উঠলাম আমি। সাথে রেগেও গেলাম। নাক ফুলিয়ে বললাম,
— “আপনি আমার সাথে মজা করছেন?”

উনি ইনোসেন্ট ভাব নিয়ে বললেন,
— “উহু!”

ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল যেন৷ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম,
— “আবারো!”

উনি কিছু বললেন না। বাঁকা হেসে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। রাগে গা জ্বলে উঠল। কত বড় ফাজিল সে! আমার রাগিয়ে আবার বাঁকা হাসছেন! অসভ্য!

_______________

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here