যাও পাখি বলো তারে – পর্ব ৭

0
1023

#’যাও পাখি বলো তারে’❤
#’লেখাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা❤
#’পর্বঃ ০৭
.
নাস্তা করা শেষে সবাই মিলে ড্রইংরুমে আড্ডা দিতে লাগলাম। রেয়ান ভাইয়া আর সবুজ ভাইয়া নাস্তা খেয়েই বাহিরে চলে গেছেন। আবদ্ধ ভাইয়াও চলে গেছেন রুমে। বাকি দীঘি ভাবিকে নিজেদের আড্ডায় আটকে রেখেছি আমরা। বড় চাচী বেশ প্রফুল্ল নিয়েই আমাকে বললেন,

—” দেখেছিস মীরু তোর ভাবীকে? একদম মিষ্টি একটা মেয়ে। এখন শুধু আবদ্ধের মতো আব্রাহামের বিয়েটাও তাড়াতাড়ি সেরে যাক! তাহলেই শান্তি!”

আমি কিছু বললাম না। এতে কিই বা বলার আছে আমার? তাই মৃদু হাসলাম। বড় চাচী আবারও বললেন,

—” দীঘি মা? তোমার কি খারাপ লাগছে? রুমে যাবে?”

দীঘি মৃদু স্বরে বলল,

—” না মা। ঠিক আছি আমি। ”

বড় চাচীর মুখে স্পষ্ট খুশির আভা ভেসে উঠল। যেন উনি খুশি হয়েছেন এমন পুত্রবধু পেয়ে। এদিকে ইয়াসিন ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে হেসে বললেন,

—” ভাবি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

দীঘি ইয়াসিন ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

—” বলো। ”

সাথে সাথে মেহেরুন আমার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,

—” দেখিস এই ছেড়া এখন উল্টাপাল্টা কিছু বলবে।”

আমিও ফিসফিসিয়ে বললাম,

—” চুপ থাক। আগে দেখ কি বলে ভাইয়া। ”

ইয়াসিন ভাইয়ার জবাবের আশায় সবাই প্রায় তার দিকে তাকানো। ফুফি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন ইয়াসিন ভাইয়ার দিকে। যেন বলছেন- “আজেবাজে কিছু বললে খবর আছে তোর।” ফুফির এই ভয়ংকর ইশারাকেও অগ্রাহ্য করে ইয়াসিন ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে বললেন,

—” ভাবি আপনার কোনো ছোট বোন আছে? মানে একটু নিজের সেটিং করতাম আর কি।”

কথাটা শুনে আমি পুরো হা হয়ে গেলাম। নতুন ভাবির সাথে কেউ এমন কথা বলে? বড় চাচী, ফুফি, আম্মু আর ছোট চাচী দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলেন রান্নাঘরে। এখানে থাকা এখন তাদের পক্ষে সম্ভব না। ইয়াসিন ভাইয়া যতক্ষণ আছে ততক্ষণ তো না-ই না। ফুফি যাওয়ার আগে ইয়াসিন ভাইয়ার কান মলে দিয়ে গেছেন। কিন্তু এসবের পরোয়া তো ইয়াসিন ভাইয়া করেনই না। জবাবের আশায় এখনও তাকিয়ে আছেন ভাবির দিকে। তাই দীঘি মুচকি হেসে বলল,

—” তোমার দুর্ভাগ্য। আমার কোনো ছোট বোন নেই।”

সাথে সাথে ইয়াসিন ভাইয়া ‘শিট’ বলে শব্দ করে উঠলেন। মেহেরুন হেসে কুটিকুটি হতে হতে বলল,

—” কিরে বলছিলাম না? এই ছেড়া এমনই। ”

আমিও মৃদু হাসলাম এবার। দীঘিও তাই। এরপর আবারও লেগে গেলাম গল্প করতে। গল্পের মূল বিষয় ছিল দীঘির সম্পর্কে জানা!

_________________________

আমাদের আড্ডা শেষ হতে হতে আকাশে প্রায় সকাল গড়িয়ে দুপুর নেমে এলো। তাই যে যার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলাম আমরা। দীঘিও রুমে ফ্রেশ হতে গিয়ে দেখলো আবদ্ধ সোফায় বসে বসে কাজ করছে। দেখে মনে হচ্ছে গোসল করেছে এই মাত্র। সেদিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো দীঘি। না সে কথা বলবে না আবদ্ধের সাথে। দেখবেও না তাকে। আবদ্ধের সাথে অভিমান করেছে সে। পাহাড় সমান অভিমান! কোনোকিছু না বলে আলমারি থেকে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় দীঘি। আবদ্ধও এত পাত্তা দেয় না সেদিকে। কিন্তু ওয়াশরুম থেকে এসে কিছু না বলেই দীঘি যখন রুম থেকে বের হয়ে যায় তখন নিস্পলক সেদিকে তাকিয়ে র‍য় আবদ্ধ। সে ভেবেছিল দীঘি তার সাথে কথা বলবে। কিন্তু না! হয়তো সকালের জন্য তার সাথে রাগ করেছে দীঘি। ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল আবদ্ধ। আবারও কাজে মনোযোগী হবে ঠিক তখনই মেহেরুন রুমে এসে বলল,

—” ভাইয়া নিচে আসো। খাবার খেতে ডাকছে সবাই।”

আবদ্ধ ছোট্ট করে জবাব দিলো,

—” যা আসছি। ”

মেহেরুন চলে গেল। পরপরই সব গুছিয়ে আবদ্ধও চলে গেল নিচে।

_______________________

দুপুরের খাবার খেয়ে মাত্রই রুমে ঢুকেছে দীঘি। তবে রুমের কোথাও আবদ্ধকে দেখতে পেল না সে। খাবার খাওয়া শেষে দীঘি যখন তার শ্বাশুড়ি মার কাজে সাহায্য করছিল তখন আড়চোখে আবদ্ধর দিকে তাকিয়ে দেখেছিল আবদ্ধ নিজের রুমে যাচ্ছে। তাহলে এখন কোথায় সে? ভাবনার মাঝেই আবদ্ধকে বারান্দা থেকে রুমে ঢুকতে দেখল দীঘি। সাথে সাথে কিছু একটা বিড়বিড় করে উঠল সে। সম্ভবত আবদ্ধকে বকছে। আবদ্ধের সাথে কোনোরুপ কথা তো দূরে থাক তার দিকে একটু তাকায়ও নি দীঘি। তাকে পাশ কাটিয়ে সোজা চলে গেছে বারান্দায়। এতে মনক্ষুণ্ণ হলো আবদ্ধ। ভাবছে দীঘির কাছে মাফ চাবে কি চাবে না! পরক্ষণেই মনে হলো ভালোই তো হয়েছে। দরকার কি রাগ ভাঙ্গানোর? পরে দেখা যাবে আবদ্ধকে বিরক্ত করা যেন আরও দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে দীঘি। এই ভেবে বারান্দার দিকে আর গেলো না আবদ্ধ। ল্যাপ্টপ নিয়ে সোজা বসে পড়ল সোফায়।

এদিকে দীঘি ভেবেছিল আবদ্ধ তার রাগ ভাঙ্গাবে। কিন্তু প্রায় ১০-২০ মিনিট হয়ে যাচ্ছে আবদ্ধ আসছে না। এবার বিরক্ত লাগছে দীঘির। এভাবে বারান্দায় এমন রোদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে আছে? ভ্রু কুঁচকে রুমের ভেতর কয়েকবার উঁকিঝুঁকি দিলো দীঘি। আবদ্ধকে ল্যাপ্টপে কাজ করতে দেখতেই রাগ যেন মাথার ওপর চড়ে বসে তার। দ্রুত আবদ্ধের কাছে গিয়েই তার কোলে বসে পড়ে দীঘি। আবদ্ধকে কোনো সুযোগ না দিয়েই ইচ্ছে মতো কিল-ঘুষি দিতে শুরু করে আবদ্ধের বুকে। এতে বেশ ভালোভাবেই ব্যথা পাচ্ছে আবদ্ধ। এক পর্যায়ে সহ্য করতে না পেরে দীঘির দু’হাত শক্ত করে ধরে ফেলে। ধমক দিয়ে বলে উঠে,

—” সমস্যা কি হ্যাঁ? আমাকে মারছো কেন? আমার ঘুষি খেলে বাঁচবে তুমি? ভয় লাগে না তোমার এসব করতে?”

দীঘি কেঁদে দিলো এবার। বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেললো আবদ্ধ। আরেকবার ধমক দিবে তার আগেই দীঘি কেঁদে কেঁদে নাক টেনে বলে উঠল,

—” আপনি পঁচা। অনেক, অনেক পঁচা! আমি আপনার সঙ্গে রাগ করেছি দেখেও আমার রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করেন নি আপনি। একবার কথা বলার চেষ্টাও করেন নি। আপনি সত্যিই একটা বাজে লোক। পঁচা, পঁচা, পঁচা।”

আবদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শান্ত স্বরে বলল,

—” আমি পঁচা না তুমি? নিজের বরকে কেউ এভাবে মারে? তারওপর তোমার হাতের নখ এত বড় কেন? যেভাবে খামচে ধরেছিলে আর একটু হলেই তো রক্ত বের করে দিতে।”

এবার লজ্জা পেল দীঘি। লজ্জায় মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে তার। তবুও মিনমিনিয়ে নাক টেনে বলল,

—” সরি। ”

আবদ্ধ মুচকি হেসে বলল,

—” ইস্ট ওকে। এখন সরো আমি কাজ করব।”

দীঘি সরলো না। আবদ্ধ ভ্রু কুঁচকে আবারও বলল,

—” কি হলো? ”

দীঘি দাঁত কেলিয়ে বলল,

—” সরবো না। এখন কোনো কাজ হবে না। আপনি আর আমি গল্প করব বসে বসে।”

দীঘির কথায় আবদ্ধের বাম হাত আপনা-আপনি চলে গেল মাথায়। মৃদু স্বরে চেঁচিয়ে উঠল সে,

—” ঠিক এই কারণে, এই কারণে আমি তোমার রাগ ভাঙ্গাতে চাই নি। আল্লাহ্! এ মেয়ের থেকে রক্ষা করো আমাকে প্লিজ।”

দীঘি খিলখিল করে হেসে উঠল। যেন আবদ্ধের এমন কথা পৃথিবীর সবচেয়ে হাস্যকর কথার মধ্যে একটি। আবদ্ধ দীঘির হাসি মাখা মুখ দেখে ভাবলো, কে বলবে এই মেয়ে একটু আগেও কাঁদছিল। দেখো কিভাবে খিলখিল করে হাসছে!

_______________________

বিকেলে ঘুম থেকে উঠেই বাগানের দিকে চলে গেলাম আমি। কিছুক্ষণ ফুলগুলো ছুঁয়ে দেখে পাশের একটি বেঞ্চে বসে পড়লাম। আনমনা হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম হঠাৎ পাশে কারো উপস্থিতি টের পেতেই পাশ ফিরে তাকালাম আমি। সাথে সাথে চমকে উঠলাম। কেননা আমার পাশে রেয়ান বসে আছেন। তার দৃষ্টি বরাবর সামনে। সরু দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে থেকেই উনি বলে উঠলেন,

—” একা একা কি করছো মিস? জ্বীন-ভূত কিছু ধরেছে নাকি?”

ভ্রু কুঁচকে উনার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,

—” মানে? ”

রেয়ান বাঁকা হেসে বললেন,

—” ঘুমকারুরে মিস! তুমি কি কানেও কম শোনো নাকি?”

এহেন কথায় রেগে গেলাম আমি। কি পেয়েছেন কি উনি আমাকে? যখন তখন খালি অপমান করেন আমাকে! তার এসব কাজ মোটেও পছন্দ না আমার। বেশ রাগ নিয়েই তাকে বললাম,

—” আপনার কি আর কোনো কাজ নেই? সবসময় আমাকে অপমান করার জন্য হাজির হয়ে যান কেন? নম্রভাবে দু’চারটে কথাও তো বলতে পারেন!”

রেয়ান ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন। বলে উঠলেন,

—” আমি কখন অপমান করলাম মিস? তুমিই তো আমি বলার পরও মানে, মানে করছিলে। এটাকে তো নিশ্চয়ই কালা-ই বলে। আই থিংক কালা শব্দটা ঠিক পছন্দ হয় নি তোমার। নেভার মাইন্ড! আমি তোমাকে ইংরেজীতে ‘ডীফ্’ বলে ডাকবো। নাও হ্যাপি?”

সহ্যের সীমা যেন শেষ হয়ে যাচ্ছে আমার। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
—” আমি কালা হলে আপনি মিস্টার মুডি কিং!”
—” হাঁ? আমি মুডি কিং? লাইক রেইলি মিস?”

বলেই উনি ঘাড় কাত করে তাকালেন আমার দিকে। তার তীক্ষ্ণ চাহনী দেখেই কয়েকটা ঢোক গিললাম আমি। কি থেকে কি বলে ফেলেছি সেটাই মাথায় ডুকছে না আমার। উনি আমাকে এভাবে দেখে বাঁকা হাসলেন। পরপরই শান্ত দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললেন,

—” তুমি এখনও পাল্টাও নি মিস! আগেও ভয় পেতে আমাকে এখনও পাও। আচ্ছা আমি কি ডায়নাসরের মতো দেখতে? নাকি আমার চেহারা ভয়ংকর? না! দুটোর একটাও না। আমার মনে হয় আমি অতটাও খারাপ দেখতে না। সো?”

আমি মাটির দিকে স্থির চেয়ে রইলাম। কণ্ঠস্বর যেন রোধ হয়ে আসছে। কোনো মতে ঢোক গিলে বললাম,

—” জানি না আমি। ”

উনি তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বললেন,
—” তুমি জানোটা কি মিস? যাই হোক, আমার ক্ষুধা লেগেছে। টেবিলের দিকে যাচ্ছি আমি। তুমিও আসো, আমাকে খাবার সার্ভ করে দেবে।”

আমি অবাক হয়ে তাকালাম উনার দিকে। আমি কেন তাকে খাবার সার্ভ করে দেবো? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে কিছু বলল তার আগেই উনি উঠে দাঁড়ালেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

—” এক কথা দু’বার বলতে পছন্দ করি না আমি৷ তাই তাড়াতাড়ি আসবে মেয়ে।”

বলেই উনি চলে গেলেন। আর আমি বিস্ময় নিয়ে উনার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলাম মাত্র!

______________________

চলবে…
Ishanur Tasmia

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here