হৈমন্তীকা
৩৮.
ঝড়ের তান্ডবের তীব্রতা বেড়ে গেছে। কারেন্টের খবরাখবর পাওয়া যায় নি এখনো। নিকষকৃষ্ণ আঁধারে তুষারের সান্নিধ্য পেয়ে কেমন নেতিয়ে গেল হৈমন্তী। অধর থেকে অধরের স্পর্শ আলাদা হতেই তুষারের বুকে মাথা গুঁজলো সে। ঘন ঘন শ্বাস নিলো দু’জনেই। ভারি হলো বক্ষস্থলের ওঠা-নামা। শরীর কেঁপে উঠলো শিরশির করে। নেত্র কোণে জল এসে জমলো হৈমন্তীর। কান্না এলো খুব। হঠাৎ তুষারকে দু’হাত মেলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সে। বুকের সঙ্গে যথাসম্ভব মিশিয়ে নিলো নিজেকে। কান্নার দমক তুলে ফুঁপিয়ে উঠল সশব্দে। তুষার ব্যস্ত হয়ে উঠল। আগলে নিয়ে ব্যগ্র কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
—“কি হয়েছে হৈমন্তীকা? কাঁদছেন কেন? আমি ছুঁয়েছি বলে? আর ছঁবো না। কান্না থামান। কান্না থামাচ্ছেন না কেন?”
হৈমন্তী বুকে লেপ্টে থাকা অবস্থায় এদিক ওদিক মাথা নাড়ালো। অর্থাৎ, সে কান্না থামাবে না। তুষার আবার বললো,
—“বলেছি তো, আমি আপনাকে আর ছুঁবো না। তবুও কাঁদছেন কেন?”
হৈমন্তী আবারও মাথা নাড়ায়। জবাব দেয় না। তুষার একটু ঝুঁকে হৈমন্তীর মুখশ্রী দেখবার চেষ্টা করে। মুখের ডান পাশটা অল্প দেখা যাচ্ছে। চোখ, মুখ, নাক, কান লাল হয়ে কি একটা অবস্থা! আগলে রাখার ধরণ আরেকটু দৃঢ় করে তুষার বললো,
—“পরিবারের কথা মনে পরছে হৈমন্তীকা?”
তুষারের পিঠের টি-শার্ট খামচে ধরল হৈমন্তী। সম্মতি সূচক মাথা নাড়িয়ে ভীষণ ক্ষীণ স্বরে বললো,
—“আমার খুব মনে পরছে বাবার কথা, মায়ের কথা, ভাইটার কথা। আমাকে ওদের কাছে নিয়ে চলুন তুষার। প্লিজ নিয়ে চলুন।”
বলতে বলতে আবারও ফুঁফিয়ে উঠলো সে। তুষার নিশ্চুপ রইলো কিছুক্ষণ। কপাল থেকে ছোট্ট চুলগুলো কানে গুঁজে, স্বযত্নে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মোলায়েম স্বরে শুধালো,
—“খুব শীগ্রই আপনাকে নিয়ে যাবো হৈমন্তীকা। ততক্ষণ একটু অপেক্ষা করুন। সকালে ফোন দিয়ে মায়ের সঙ্গে একবার কথা বলে নিবেন। ঠিকাছে?”
হৈমন্তী নাক টেনে উত্তর দিলো,
—“আচ্ছা।”
বেশ সময় নিয়ে হৈমন্তীর ফুঁপানোর শব্দ থামলো। ক্ষীণ শান্ত হলো সে। অশ্রুর স্বচ্ছ জলে তুষারের বুকের বা’পাশটা ভিঁজে একাকার। তুষার ঠোঁট এগিয়ে হৈমন্তীর কপালে ঠেকালো। হঠাৎ দরজায় কারাঘাত করে উঠল কেউ। রহিমা খালা এসেছেন। দরজার ওপাশ থেকে তার উঁচু কণ্ঠ ভেসে আসছে,
—“ভাইজান, ম্যাডামে খাইতে ডাকছে। আইবেন না?”
তুষার প্রথমেই উত্তর দিলো না। হৈমন্তীর গালে হাত রেখে বললো,
—“উঠুন হৈমন্তীকা। খাবেন না? উঠুন।”
হৈমন্তী আরও জেঁকে শুলো যেন,
—“খাবো না। ঘুমাবো।”
—“শরীর খারাপ করবে তো। আসুন, একটু করে খাবেন।”
হৈমন্তী চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
—“না।”
তুষার তপ্ত নিশ্বাস ফেলল। রহিমা খালা আবারও ডাকতেই জবাব দিলো,
—“খাবো না আজকে রহিমা খালা। মা জিজ্ঞেস করলে বলবেন, ঘুমিয়ে পরেছি।”
রহিমা খালা “আইচ্ছা” বলে চলে গেলেন গটগট পায়ে।
_____
চুলায় পানি ওতরাচ্ছে। হৈমন্তী আনমনা হয়ে চপারবোর্ডে সবজি কাটছিল। মনটা বড্ড বিষাদে জড়োসড়ো হয়ে আছে। সকালে রাবেয়ার সঙ্গে কথা বলেছিল সে। মায়ের কান্নায় জর্জরিত গলার আকুলতা শুনে কি ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল তার। হেমন্তর সঙ্গে কথা বলতে পারে নি হৈমন্তী। ও স্কুলে চলে গেছে ততক্ষণে। বোনের জন্য নাকি প্রতিদিন মন খারাপ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। বাবাও নাকি মাঝরাতে আড়ালে আবডালে কাঁদেন। শুনে হৈমন্তীর ভেতরটা হুহু করে উঠে। রাবেয়া যখন জিজ্ঞেস করেছিলেন,
—“কেমন আছিস হৈমন্তী? সুখে আছিস তো মা?”
হৈমন্তী কান্না দমিয়ে রাখতে পারেনি কোনো ভাবেই। সশব্দে কেঁদে দিয়েছিল তুষারের শার্ট মুঠো করে ধরে। সরব হেনার ডাকে চমকে তাকালো হৈমন্তী। অসাবধানতায় ধারালো ছুঁড়িটা গভীর ভাবে গেঁথে গেল বৃদ্ধা আঙুলের ঠিক নিচটায়। ব্যথায় মৃদু চেঁচিয়ে উঠলো সে। হেনা ভড়কে গেলেন। এগিয়ে এসে কলের নিচে চেপে ধরলেন হাত। ধমকের সুরে বললেন,
—“আমি মানা করেছিলাম না? আমার মানাটা একটু শুনলে কি হতো মেয়ে? একদম ভালো হয়েছে। আমি খুশি হয়েছি।”
পরমুহূর্তেই উঁচু গলায় রহিমা খালাকে ডাকলেন তিনি,
—“রহিমা, প্রাথমিক চিকিৎকার বক্সটা নিয়ে আয়। সাথে তুষারকেও ডাকিস। আজকে ওর বউয়ের একটা বিচার করেই ছাড়ব। মেয়েটা একদম আমার কথা শুনে না।”
হৈমন্তীর ব্যথা পাওয়ার কথা শুনে হন্তদন্ত পায়ে রান্নাঘরে উপস্থিত হলো তুষার। চুল বেয়ে তখনো পানি ঝড়ছে। সম্ভবত মাত্রই শাওয়ার নিয়ে এসেছে। হেনাকে বললো,
—” তুমি সরো মা। আমি দেখছি।”
হাত জ্বলছে খুব। টনটন করছে কেমন। হৈমন্তী চোখ খিঁচে আছে। তুষার আলতো করে হাতটা ধরতেই টলমলে নয়নে চাইলো। তুষারের চোয়াল শক্ত। ভ্রু, কপাল কুঁচকে রাখা। সাবধানে হাতটা পরখ করছে সে। হৈমন্তী ফাঁকা গলায় ঢোক গিললো। ধরা গলায় বললো,
—“সরি।”
তুষার জবাবহীন। চেহারায় দারুণ গাম্ভীর্য এঁটে রেখেছে। চুপচাপ ব্যান্ডেজ করে মারাত্বক শান্ত গলায় সে বললো,
—“মা মানা করেছিল না আপনাকে? মাকে সাহায্য করবেন ঠিকাছে। কিন্তু তা যেন রান্নাঘর অব্দি না গড়ায়। নয়তো আমি খুব কঠোর হতে বাধ্য হবো হৈমন্তীকা।”
তুষারের এহেন কথায় প্রচন্ড অবাক হলো হৈমন্তী। কিছু বলবে, তার সুযোগ না দিয়ে অপর হাত শক্ত করে ধরে তাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল তুষার।
আসতাব সাহেব ড্রইংরুমের সোফায় বসে ফোনে কথা বলছিলেন। কিছুক্ষণ পর পর ধমকে উঠছিলেন। আইপিএস-এ কি যেন ঝামেলা হয়েছে। কাল সন্ধ্যে বেলা ঠিক করার কথা বলেছিলেন তিনি। দুপুর হয়ে গেল, অথচ এখনো কাজে হাতই দেয় নি তারা। এ নিয়েই আফতাব সাহেব প্রচন্ড বেজার।
তুষার বাবার দিকে একবার তাকালো। সিঁড়ির একধাপ উপরে উঠতেই ডেকে উঠলেন আফতাব সাহেব। জিজ্ঞেস করলেন,
—“এই মেয়ের কি হয়েছে? রান্নাঘরে এত চেঁচামেচি হচ্ছিল কেন?”
তুষার সহজ ভাবে উত্তর দিলো,
—“হাত কেটে গেছে।”
—“খুব বেশি কেটেছে? ডাক্তার দেখাচ্ছ না কেন এখনো?”
কথাটা যেন এক অস্বাভাবিক বাক্য। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না তুষার। ভ্রু উঁচু করে তীক্ষ্ণ নয়নে তাকালো। ছেলের এমন দৃষ্টিতে হকচকালেন তিনি। কোনোমতে কানে ফোন রেখে অন্যদিকে চলে গেলেন।
_____
আজ আকাশে বৃষ্টি নেই। চাঁদের আলোয় মুখরিত সব। পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে সুদূর হতে। হৈমন্তী রেলিংয়ে থাকা হাতটায় একবার তাকালো। সাদা ব্যান্ডেজ করা। ক্ষত স্থানটা জ্বলছে একটু। হৈমন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে পেছন ফিরে তাকায়। তুষারকে দেখে ম্লান হাসে। জিজ্ঞেস করে,
—“আপনি কি এখনো রেগে আছেন তুষার?”
সে এগিয়ে আসতে আসতে উত্তর দেয়,
—“আপনার সঙ্গে রাগ করতে আমার ভালো লাগে না। তাই রেগেও থাকি না।”
বলে হৈমন্তীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল সে। মাথায় থুতনি ঠেকালো। প্রশ্ন করলো,
—“আমি আপনাকে কখন ভালোবেসেছিলাম, তা কি জানেন হৈমন্তীকা?”
হৈমন্তী মাথা নাড়ালো,
—“না।”
তুষার হাসলো। সেই দূর্বোধ্য, বিস্তর হাসি।
—“আমার একটা প্রেমিকা ছিল ক্লাস ফাইবে। ওর নাম রুবিনা ছিল। আমি সারাদিন রুবিনা, রুবিনা বলে ডাকতাম ওকে। বাবার পছন্দ ছিল না সেটা। মিডেলক্লাস ছিল যে। আমার খাবার থেকে শুরু করে কাপড়, গেমস্, টিভি চ্যালেন সব বাবার কথা মতো করতে হতো। এমনকি নিজের বন্ধু নির্বাচন করার অধিকারও আমার ছিল না। এক রওনক ছাড়া। ও বড়লোক দেখে বাবা কিছু বলতো না। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত কারো সাথে মেশা একেবারে নিষিদ্ধ ছিল প্রায়। বাবার মতে ওদের আচার-আচরণ ভালো না, ব্যবহার ভালো না, ওরা লোভী হয়। আমি যদি ওমন হয়ে যাই? ওই মেয়েটাও মিডেলক্লাস ছিল বিধায় বাবা ওকে কড়া ভাবে বলে দেন আমার সঙ্গে না মিশতে। রুবিনাও মেশা বন্ধ করে দেয়। ঠিক তখন থেকেই বাবার প্রতি দূরত্বটা তৈরি হয়ে ছিল আমার। নিজের জীবনের প্রতি নিজেই উদাসীন ছিলাম। সারাদিন চুপচাপ বসে থাকতাম। রওনকের সাথে মেলামেশা হতো না অত।
তারপর একদিন হুট করেই আপনি চলে এলেন। আমার সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলতেন। আমি অভ্যস্ত ছিলাম না এতে। তাই চুপ হয়ে আপনার কথা শুনতাম। আপনাকে হৈমন্তী বলে কেন ডাকতাম না, সেটার কারণ সত্যি বলতে আমি জানি না। তবে প্রথম থেকেই আপনার প্রতি মুগ্ধ ছিলাম আমি। হয়তো সে জন্যেই নিজস্ব একটা ডাক দিয়েছিলাম আপনাকে। আমার ব্যক্তিগত ডাক।
আমি আপনাকে হুট করেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম হৈমন্তী। অজান্তেই।”
থেমে গেল সে। হৈমন্তী অপেক্ষা করতে লাগলো তুষারের পরের কথা শোনার জন্য। কিন্তু আশানুরূপ তুষার কিছুই বললো না আর। কোমড় স্পর্শ করে গলায় মুখ গুঁজে দিলো হঠাৎ। অধর ছোঁয়ালো। নিশ্বাসের গতি বাড়ালো। অত:পর মৃদু কণ্ঠে ডাকলো,
—“হৈমন্তীকা?”
হৈমন্তী কিছু বলে না। একটু থেমে তুষার আবার ডাকে,
—“হৈমন্তীকা? আমি– আমি আপনাকে একটু গভীর ভাবে ছুঁই?”
ব্যাকুল আবেদনে সিক্ত হয়ে উঠলো হৈমন্তী। কণ্ঠস্বর কাঁপছে খুব। উত্তর কিভাবে দেবে?
উত্তর না পেয়ে তুষার তপ্ত নিশ্বাস ফেলল। সরে যেতে নিলেই তাকে বাঁধা দিলো হৈমন্তী। হাত আঁকড়ে ধরল নখের ধারালো আঘাতে। তুষারের মুখে হাসি ফুটলো। হুট করে হৈমন্তীকে কোলে তুলে নিলো সে। কপালে কপাল ঠেকিয়ে রুমে এগোলো।
অপেক্ষার অবসান বুঝি শেষ হলো? পূর্ণতার আবেশে আকাশ, বাতাস, বিশ্ব মুখরিত হলো স্নিগ্ধতায়।
_________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা