যাও পাখি বলো তারে – পর্ব ২৭

0
921

#’যাও পাখি বলো তারে’❤
#’লেখাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা❤
#’পর্বঃ ২৭
.
সাদা বাতির আলোয় চারপাশ চিকচিক করছে। এক অনন্য সৌন্দর্যের মাঝে মন মাতানো আনন্দে মেতে উঠেছি আমরা। দীঘি আর আবদ্ধকে ইতোমধ্যে স্টেজে বসানো হয়েছে। আশেপাশের মানুষ ঘিরে ধরেছে তাদের। সেই সাথে ফটোগ্রাফি তো আছেই। আমি, ইয়াসিন ভাইয়া আর মেহেরুন এসব থেকে দূর এক কোণায় গোল হয়ে বসে গল্প করছি। রেয়ান ভাই আর সবুজ ভাইয়া রিসেপশনের বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে সবুজ ভাইয়া এসে দেখে যাচ্ছেন তার প্রিয়তমা মেহেরুনকে। যা ইয়াসিন ভাইয়ার বিরক্তির প্রধান কারণ। মুখ কুঁচকে অন্যদিকে ফিরে রয়েছেন তিনি। তার এই তেঁতো ভাব যে মেহেরুনকে নিয়ে তা মেহেরুন ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে। ইয়াসিন ভাইয়াকে শুনিয়ে শুনিয়ে মেহেরুন বলে উঠল,

— “বুঝছিস মীরু, অনেক মানুষ আছে যারা নিজে তো কিছু করতে পারে না কিন্তু, অন্যের সুখ দেখলে ঠিকই হিংসে করে। এগুলোর আসলে খায়ে-দায়ে কাজ নেই। হিংসুক একটা!”

ইয়াসিন ভাইয়া চোখ ছোট ছোট করে তাকালেন মেহেরুনের দিকে। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন,
— “এটাকে সুখ বলে না, ন্যাকামো বলে। আর আমার হিংসা না, বিরক্তি লাগছে। তাছাড়া তোদের ভাবী আমি একদিন না একদিন পেয়েই যাবো। তখন তুই চোখ দুইটা গরুর মতো করে চেয়ে চেয়ে দেখবি শুধু। হু!”

ইয়াসিন ভাইয়ার মুখের ভঙ্গি দেখে হেসে দিলাম আমি। খোঁচা মেরে বললাম,
— “সেই একদিনটা কবে আসবে ভাইয়া? আচ্ছা, তুই না বললি কালকে রাতে ট্রেনের মেয়েটাকে ফোন দিবি, দিয়েছিস?”

মুখটা একটুখানি হয়ে গেল ভাইয়ার। করুণ দৃষ্টিতে একবার আমার দিকে তো একবার মেহেরুনের দিকে তাকাচ্ছেন। মেহেরুন ভ্রু কুঁচকে কর্কশ কণ্ঠে বলল,
— “এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? মেয়ে মানুষ তো কম দেখিস নি জীবনে। ভনিতা না করে উত্তর দেয়। আমিও একটু গরুর মতো চোখ বড় বড় করে তোর দিকে তাকাই!”

ইয়াসিন ভাইয়া আমতা আমতা করতে লাগলেন। মেহেরুন ধমক দিতেই মিনমিনিয়ে বললেন,
— “মাইয়া ভুল নাম্বার দিসে। কালকে রাতে অনেক ট্রাই করার পরও ফোনের বেয়াদ্দপ মহিলা তার বেসুরা কণ্ঠে বারবার বলছিল নাম্বারটা নাকি ভুল! কেমনটা লাগে তুইই বল?”

আমি আর মেহেরুন দু’জন দু’জনের দিকে একপলক তাকালাম। পরপরই দম ফাটানো হাসি হেসে দিলাম আমরা। বুকের বা পাশে হাত রেখে একসাথে বলে উঠলাম,
— “হায়য়য়! দিল টুট গায়া!”

ইয়াসিন ভাইয়া আমাদের দিকে এমন ভাবে তাকালেন যেন এক্ষুণি চোখ দিয়েই মেরে ফেলবেন আমাদের। পরক্ষণেই বুকে আকাশ-সম কষ্ট নিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠলেন,

— “ভাইয়ের দুঃখে একটুও কষ্ট হয় না। ফাজিল!”

১২.

পাশে বসে থাকা দীঘির দিকে বার বার তাকাচ্ছে আবদ্ধ। মেয়েটা একটুও তাকাচ্ছে না তার দিকে। অথচ সে তাকিয়ে। তারওপর আশেপাশের এত এত লাইটিং! সবমিলিয়ে প্রচুর বিরক্ত লাগছে আবদ্ধের। ফোটোগ্রাফার বললে তো দীঘি আবদ্ধের দিকে তাকাচ্ছে, হাসছে! তাহলে এমনি আবদ্ধের দিকে তাকালে কি দোষ? নিজেকে শান্ত রাখলো আবদ্ধ। ফিসফিসিয়ে বলল,

— “দীঘি? তোমার কি মন খারাপ? আমি কিছু করেছি? কাল থেকে দেখছি তুমি কেমন যেন আচরণ করছো।”

দীঘি নিরুত্তর। দীঘির এমন চুপ করে থাকা রাগিয়ে তুলছে আবদ্ধকে। চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে। লম্বা লম্বা নিশ্বাস ফেললো সে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
— “কিছু বলেছি? শুনতে পারছো না?”

সাথে সাথে দীঘির উত্তর,
— “শুনছি!”
— “তাহলে জবাব দিচ্ছো না কেন? কালকে থেকে দেখছি। এক কথা দু’বার না বললে তুমি যেন শুনতেই পারছো না।”

দীঘি বিরক্তিতে বিরক্তি সূচক আওয়াজ করলো। মৃদু ভাবে কাঠকাঠ কণ্ঠে বলল,
— “দেখছেন না আশেপাশে কত মানুষ! স্টেজে বসে আছি আমরা, এ সময় এত কিসের কথা?”

আবদ্ধ দ্বিগুণ কঠোর কণ্ঠে বলল,
— “তোমাকে তো পাওয়াই যায় না। আবার সময় অসময়!”

দীঘি এবারো নিরুত্তর। ফোটোগ্রাফার হাসতে বললে সে হেসে ছবি তুলছে। আবদ্ধকে বললেও আবদ্ধ হাসছে না। দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করছে মাত্র। সে পারছে না সবকিছু ভেঙ্গে ফেলে এখান থেকে কোথাও চলে যেতে। অসহ্য লাগছে সব!

__________________

অনুষ্ঠানের মাঝামাঝিতে মেহেরুন সবুজ ভাইয়ার সাথে চলে যায় অন্যদিকে। ইয়াসিন ভাইয়ারও ইয়াত্তা পাচ্ছি না আমি। বাধ্য হয়ে একা একা দাঁড়িয়ে আছি একপাশে। দৃষ্টি আবদ্ধ আর দীঘির দিকে নিবদ্ধ। হঠাৎ কেউ পাশে এসে দাঁড়ালো। অচেনা ছেলে! আমাকে দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই বলল,

— “ভাবী ভালো আছেন?”

হকচকিয়ে গেলাম। স্বাভাবিক হতে অনেকটাই সময় লেগে গেল আমার। ছেলেটার মুখে এখনো অবিরাম হাসি লেগে আছে।

সংশয় নিয়ে বললাম,
— “কি বলছেন ভাইয়া? আমি আপনার ভাবী হতে যাবো কেন? আপনি হয়তো ভুল করছেন।”

ছেলেটা ডানে-বামে মাথা নাড়ালো। আবারো একরাশ হাসি নিয়ে বলল,
— “ভাবীকে চিনতে কেউ ভুল করে নাকি? আপনিই আমার ভাবী। ভাইয়ার সাথে কিন্তু আপনাকে হেব্বি মানিয়েছে।”

রাগলাম না। শান্তভাবে বললাম,
— “আপনার ভাইয়া কে? নাম কি?”

ছেলেটা মুখের সামনের দু’পাটি দাঁত দিয়ে জিহ্বা কামড়ে বলল,
— “সেটা তো বলতে পারবো না ভাবী। ভাই মানা করছে। তবে আমার নাম বলতে পারি। আমি সুহাদ। কোনো সমসা হলে আমাকে বলবেন ভাবী। আর হ্যাঁ, আমি বয়সে আপনার ছোট। আমাকে তুমি করে বলবেন। আসি!”

খুব দ্রুত কথাটুকু বলে চলে গেলো ছেলেটা। আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। কি হতে কি হচ্ছে বুঝতে পারছি না মোটেও!

এদিক-ওদিক তাকিয়ে মেহেরুনকে খুঁজে চলছি। মেয়েটা যে কোথায়! একটু দূরে তাকিয়ে দেখলাম রেয়ান ভাই কোনার দেওয়ালে হেলান দিয়ে ডান পা দেওয়ালের সাথে ঠেকিয়ে ফোন চাপছেন। হুট করে আমার দিকে তাকালেন। আমি তখনো তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমার তাকানো দেখে ডান ভ্রু উঁচু করে ‘কি’ ইশারা করতেই তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিলাম আমি। লজ্জা, ভয় নিয়ে দ্রুত অন্যদিকে গিয়ে দাঁড়ালাম। ইসস! কি না কি ভাবছেন উনি! খানিক্ষণ পর উনি এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন। মনের ভুলেও পাশ ফিরে তাকালাম না আমি। না তাকিয়েও বুঝতে পারছি উনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। চলে যেতে নিলে হুট করে আমার হাত ধরে ফেললেন উনি। কোনো কথা না বলে ছাদের দিকে নিয়ে যেতে লাগলেন।

ছাদটা বিভিন্ন ছোট ছোট বাতি দিয়ে সাজানো হলেও গেস্টদের কেউই নেই ছাদে। বাগানের মতো ছাদেও বসার জন্য কয়েকটা বেঞ্চ রাখা হয়েছে। সে বেঞ্চের একটাতে গিয়ে আমাকে বসালেন রেয়ান। কিছুক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে হঠাৎ শুয়ে পড়লেন আমার কোলে। আচমকা এমন হওয়ায় চোখ দুটো বড় বড় হয়ে মুখ ‘হা’ হয়ে গেল আমার। উনি চরম বিরক্তি নিয়ে আমার থুতনি চেপে মুখ বন্ধ করে দিলেন। আমার এক হাত নিজের চুলের মাঝে রেখে বললেন,

— “চুলে হাত বুলিয়ে দাও। একটু ঘুমাবো।”

আমি কাঁপা কণ্ঠে বললাম,
— “মা..নে কি? কেউ এসে যাবে। প্লীজ সরুন। কি করছেন?”

জবাব দিলেন না রেয়ান। চোখ বন্ধ করে ফেললেন। আমি আবারো বললাম,

— “দেখুন, কেউ এসে পড়লে খারাপ হবে। প্লীজ!”
— “কেউ আসবে না। সবুজকে বলেছি।”

গম্ভীর শোনালো তার কণ্ঠ। ‘সবুজকে বলেছি’ কথাটা শুনতেই লজ্জা পেলাম আমি। উনি আর আমি ছাদে এটা সবুজ ভাইয়া জানেন। মানে, মেহেরুন আর ইয়াসিন ভাইয়াও জানবে। উফ! কালকে ওরা আমাকে পঁচিয়ে ছাড়বে নির্ঘাত… ভাবতেই মুখ কালো হয়ে গেল আমার। হতাশা নিয়ে রেয়ানের দিকে তাকালাম। না চাইতেও তার বাদামী চুলগুলোয় হাত চলে গেল আমার। চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। তার এসব আচরণেই মানে অস্পষ্ট আমার জন্য।

__________________

চলবে…
(ছোট হওয়ার জন্য দুঃখীত। বাসায় মেহমান আছে তাই বড় করে দিতে পারি নি। আবারো সরি!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here