দীপ্ত গোধূলি – পর্ব ১৫

0
634

#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে -স্বর্ণালী তালুকদার
#পর্ব -১৫

– তোরা দুই ভাই এইভাবে হাঁসছিস কেন?কি হয়েছে?

আহসান সাহেব কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে বললো। ইহান মেকি হেসে বললো,

– কই,কিছু হয় নি আব্বু!

আহসান সাহেব ছেলেদের দিকে কয়েক সেকেন্ড সন্দিহান চোখে তাকিয়ে থেকে চলে যান।

– আহান!

দীপ্তের ডাকে আহান দীপ্তের দিকে তাকায়।দীপ্ত ছুটে এসে আহানকে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে বললো,

– থ্যাংক্স ইয়ার!তুই না থাকলে আজ আমার যে কি হতো।আমি তো আজ মরেই যেতাম।

আহান দীপ্তকে ছেড়ে দিয়ে স্মিত হেসে বললো,

– আরে ইয়ার,তুই এইভাবে বলিছস কেন?আর এতে থ্যাংক্স দেওয়ারই কি আছে?আচ্ছা একটা কথা বল তো,আমার জায়গায় তুই থাকলে কি করতি?

দীপ্ত আবার আহানকে শক্ত জড়িয়ে ধরে।আহানকে এতটাই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে যেন ছেড়ে দিলে এক্ষুনি পালিয়ে যাবে!আহান চাপা স্বরে বললো,

– চেপে ধরে আমাকে মেরে ফেলার প্ল্যান করেছিস নাকি?

– সরি!

দীপ্ত আহানকে ছেড়ে দিয়ে স্মিত হেসে ফের বললো,

– তুই এখন বাসা যা আহান।বাসায় গিয়ে শার্টটা চেঞ্জ করে ফ্রেশ হও গিয়ে।আর তোর তো এখন না আসলেও চলবে।আমরা সবাই তো রয়েছেই এখানে।প্রায় ভোর হয়ে এলো বলে,তুই বরং বাসায় গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে একটা ঘুম দিয়ে তারপর বিকালে আসিস।

– তোর এত না ভাবলেও চলবে।আমি বাসায় যাচ্ছি শুধু শাওয়ার নিবো বলে।তারপর চলে আসবো।তুইও বরং আমার সাথে চল।নিজের দিকে তাকিয়ে দেখেছিস শরীরের কি হাল বানিয়েছিস?

– না আমি এখন যাবো না!আচ্ছা রায়ান ভাইয়া আর আঙ্কেল আন্টি কি চলে গেছেন?অনেক খেটেছেন তারা।

কৃতজ্ঞচিত্তে বললো দীপ্ত।আহান নরম গলায় বললো,

– হুম,তাঁরা আমাদেকে নিজেদের পরিবারের বাইরে চিন্তা করে না।আঙ্কেল আন্টি খুব সৎ মনের মানুষ।

আহান পরমুহূর্তেই গলার স্বর উঁচু করে বললো,

– কথা শুনার ছেলে তো তুই না!বললাম আমার সাথে চল তা তো যাবি না।আমি গেলাম তাহলে!

রাতের শেষ ভাগে আযানের প্রতিধ্বনি ভেসে আসছে চারদিক থেকে।আহসান,সাজ্জাদ, ইমরুল সাহেব আর ইহান মসজিদে নামাজ আদায় করতে গেছে।দীপ্ত যায় নি!হাসপাতালেই নামাজটা পড়ে নিলো দীপ্ত।আস্তে আস্তে ভোরের আলো ফুটছে তার সাথে কারো কারো প্রতিক্ষার প্রহরও শেষ হচ্ছে!পাখিদের কিচিরমিচিরের শব্দ শুনা যাচ্ছে।এখানো পুরোপুরি অন্ধকার কাটেনি।
নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে সবাই চলে এসেছে।ভোরের দিকে গোধূলিকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে।সবাই গোধূলির কেবিনেই অবস্থান করছে।জ্ঞান ফিরে এলে কাউকে দেখতে না পেয়ে যদি ভয় পায়!তাই সবাই ওর পাশেই রয়েছে। ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক!যে মেয়ে ইঞ্জেকশন এর সুচের ভয়ে সারাবাড়ি মাথায় করে নেয়! জ্ঞান ফিরে এলে সে যদি দেখতে পায় তার হাতে এত মোটা ক্যানুলা দিয়ে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে তাহলে পুরো হাসপাতাল চিল্লিয়ে মাথায় তুলবে!

ঘড়ির ঘন্টার কাঁটাটা ঠিক সাতটার ঘর ছুঁইছুঁই।এখনো গোধূলির জ্ঞান ফেরে নি।দীপ্ত রুমের পূর্ব দিকে জানালার পাশের দেয়ালটালে এক পা ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে হাতগুলো আঁড়াআঁড়িভাবে ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে।ওইখান থেকে গোধূলির গতিবিধির লক্ষ্য রাখছে।দীপ্ত একধ্যানে তাকিয়ে ছিল গোধূলির দিকে। হঠাৎই ওর মনে হলো গোধূলির আঙ্গুলগুলো হালকা নড়েচড়ে উঠেছে।দীপ্তের ইচ্ছে করছে দৌঁড়ে গিয়ে গোধূলিকে জড়িয়ে ধরতে কিন্তু এখন তা করার সময় বা পরিস্থিতি কোনোটাই সঠিক নয়।সোজা হয়ে দাঁড়ায় দীপ্ত।উৎকন্ঠিত স্বরে বলে উঠলো,

– গোধূলির জ্ঞান ফিরছে!

সবার দৃষ্টি গোধূলির উপর।মিটমিটিয়ে চোখ খোলার চেষ্টা করছে গোধূলি।যতবারই চেষ্টা করছে ততবারই ব্যর্থ হচ্ছে।অতিরিক্ত কান্নাকাটি করলে এমনিতেই চোখ ফুলে গিয়ে চোখের পাতা ভারী হয়ে যায়। তারউপর যদি অপারেশনের রোগী হয়ে থাকে তাহলে তো কোনো কথাই নেই।তবে গোধূলির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন!ও তো কপালে আঘাত পেয়েছে আর আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে অস্ত্রোপচারও হয়েছে যার ফলে সারা মুখই ফুলে আছে।মিনিট পাঁচেক পর পুরোপুরি চোখ খুলতে সক্ষম হয় গোধূলি।পুরো রুমটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলো গোধূলি।চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।কিছু বলার চেষ্টা করছে কিন্তু বলতে পারছে না।কেউ কিছু বুঝতে না পারলেও দীপ্ত ঠিকই বুঝতে পেরেছে!দীপ্ত ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি টেনে জানালার পর্দাটা সড়িয়ে দেয়।

পর্দা সড়াতেই বাহিরের আলো রুমের ভিতরে হুড়মুড়িয়ে ঢুকছে!এতক্ষণ মনে হয় ওরা এইটারই অপেক্ষায় ছিল!সূর্য উদয় দেখা ছাড়া যে গোধূলির দিন শুরু হয় না এটা আর কেউ না জানলেও দীপ্ত ঠিকই জানে!এই জন্যই তো পূর্ব পাশের কেবিনটায় গোধূলিকে রাখার ব্যবস্থা করেছে দীপ্ত। তবে সেটার কারণ সবার অজানা।সবাইকে বুঝিয়েছিল ওই রুমটাতে বেশি আলো থাকে!আর পূবালী বাতাসও পাওয়া যাবে।

গোধূলি মাথাটা আস্তে করে হালকা ঘুরিয়েছে সূর্য উদয় দেখবে বলে।জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে স্পষ্ট দেখা না গেলেও গোধূলির চিনতে অসুবিধে হয় নি।আজ সূর্যটা বেশ ক্ষানিকটা উপরে উঠে গেছে গোধূলি ভাবছে হয়তো আজকে তার ঘুম ভাঙ্গতে দেরি হয়ে গেছে!পরক্ষনেই মনে পড়ে, সবাই ওর রুমে কি করছে?হাতে ভারী কিছুর উপস্থিতি টের পেয়ে উপরে তাকিয়ে দেখে স্যালাইন!গোধূলি আরেকবার পুরো রুমটায় চোখ বুলিয়ে নেয়।বুঝতে বাকি রইলো এটা হাসপাতাল।গোধূলি অনেক কষ্টে অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,

– আমি হাসপাতালে কেন?

দীপ্তের কলিজাটা ধক করে উঠলো।গোধূলির চোখ বেঁয়ে অনর্গল পানি পড়ছে।দীপ্তের মনে হচ্ছে কেউ ওর গলাটা চেপে ধরেছে শ্বাস নিতে যে বড্ড কষ্ট হচ্ছে।চোখ জোড়া সড়িয়ে নিয়েছে দীপ্ত।গোধূলির দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারছে না।জ্ঞান ফিরেছে শুনে ডাক্তার গোধূলিকে দেখতে এসেছে।ডাক্তার এসে স্যালাইনটা অফ করে দিয়েছেন।স্যালাইন প্রায় শেষের দিকেই ছিল।

– ডাক্তার সাহেব স্যালাইন কি চলছে না?

হতাশার সুর তুলে বলেন সাজ্জাদ সাহেব।ডাক্তার সাহেব মৃদু হেসে বললো,

– আপনার মেয়ে অনেক স্ট্রং সাজ্জাদ সাহেব।জ্ঞান ফিরে এসেছে এখন আর স্যালাইনের প্রয়োজন নেই।গোধূলি মা তোমার কেমন লাগছে এখন?

মাথায় হাত দিয়ে আদুরে গলায় গোধূলিকে জিজ্ঞাস করে ডাক্তার সাহেব।গোধূলির চোখ থেকে অনবরত পানি পড়েই চলেছে।ডাক্তারের কথায় মাথাটা হালকা উপর নিচ করে জবাব দিলো ভালো লাগছে!

– ডাক্তার ও কথা বলতে পারছে না কেন?

শিখা বেগম কান্নারত অবস্থায় বললেন।

– কান্নাকাটি করবেন না। আপনার মেয়ে কথা বলতে পারবে।কিচ্ছুক্ষণ পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে।আমি একটু পরে আবার আসবো ওকে দেখতে। চিন্তা করবেন না।ও তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।

_____________

গোধূলির মাথার দুপাশে আদিবা আর লাজুক বসে আছে।শিখা বেগমের শরীরটা ভালো নেই তাই তাকে জোর করে সাজ্জাদ সাহেবকে দিয়ে বাড়ি পাঠানো হয়েছে।সাথে জাকিয়া বেগম আর আহসান সাহেবও গেছেন।নাতনির জ্ঞান ফিরে এসেছে শুনে রাবিয়া বেগম বাসায় রীতিমতো চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিয়েছেন তাকে নিয়ে আসার জন্য।তাই আহান উনাকে নিয়ে এসেছে।আহান এসে ইহানকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। বাসায় গিয়ে একটু রেস্ট আর ফ্রেশ হয়ে নেওয়ার জন্য। ইমরুল সাহেব আর জ্যোতি বেগমকেও চলে যেতে বলা হয়েছে তারাও তো কাল থেকে হাসপাতালেই আছে।

রাবিয়া বেগম গোধূলির মাথার কাছে বসে আছেন। গোধূলি ওর দাদুর সাথে কথা বলার চেষ্টা করছিল কিন্তু কথা বলতে পারে নি।নাতনির এই হাল রাবিয়া বেগমের আর সহ্য হলো না কেঁদে দিলেন।রাবিয়া বেগমকে এখানে রাখা ঠিক হবে না।উনি এমনিতেই বয়স্ক মানুষ তারউপর যদি এতো কাঁন্নাকাটি করেন তাহলে উনিও অসুস্থ হয়ে যাবেন।আহান ওর দাদুর কাছে গিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,

– দাদুজান তোমাকে এইভাবে কাঁদতে দেখলে গোধূলিও কাঁদবে না?তুমি কেঁদো না প্লিজ।

আহান গোধূলির দিকে তাকিয়ে দেখে ঘুমিয়ে গেছে।আহান ফের বললো,

– গোধূলি ঘুমিয়ে আছে।মনে হয় না এখন ওর ঘুম ভাঙবে বলে।বুবু তুই আর লাজুকও না হয় বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি তো এখানে আছিই।আর সাথে করে দাদুজানকেও নিয়ে যা।

– না আমি যাব না।

কঠোর গলায় বললো রাবিয়া বেগম। আহান শান্ত স্বরে বললো,

– তুমি এখন বাসায় যাও। পরে তোমাকে আবার আমি গিয়ে নিয়ে আসবো।

আহানের কথায় রাবিয়া বেগম কিছুতেই রাজি হচ্ছিলো না।আহান উনাকে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আদিবা আর লাজুকের সাথে বাসায় পাঠালো।এখন দীপ্ত আর ও-ই আছে গোধূলির কাছে।আহান দীপ্তের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকায়।দীপ্ত এখনো ওইখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।দীপ্তের চোখে মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।আহান এগিয়ে গিয়ে দীপ্তের কাঁধে আলতো করে হাত দিয়ে শীতল কণ্ঠে বললো,

– তুই এখনো এইভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবি?

– আমাকে একটু একা থাকতে দে!

কাল থেকে করা দীপ্তের প্রত্যেকটা আচার আচরণ আহান খুব ভালো করেই লক্ষ্য করেছে।গোধূলির প্রতি ওর যে একটা অন্যরকম ফিলিংস আছে সেটা আহান ঢের বুঝতে পারছে।আহান ক্ষুদ্র একটা নিঃশ্বাস ফেলে ওদেরকে একটু স্পেস দিয়ে কেবিন থেকে বেড়িয়ে আসে।

আহান চলে যেতেই দীপ্ত এলোমেলো পা ফেলে গোধূলির দিকে এগিয়ে গেলো।হাঁটুর উপর ভর দিয়ে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে।কাঁপাকাঁপা হাতে গোধূলির ক্যানুলা বিহীন ডান হাতটা দীপ্ত ওর হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করে নেয়।গোধূলির হাতের পিঠে ভরাক্লান্ত চোখে তাকিয়ে থেকে চুমো এঁকে দেয়।

চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here