দীপ্ত গোধূলি – পর্ব ৪২

0
380

#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে -স্বর্ণালী তালুকদার
#পর্ব -৪২

এত রাতে বাড়ির সদর দরজা খোলা দেখে মাথা গরম হয়ে যায় গোধূলির।হাতে থাকা গাড়ির চাবিটা শক্ত চেপে ধরে সিকিউরিটিকে ডাক লাগায়।

– সিকিউরিটি!সিকিউরিটি!
– জ্বি ম্যাম!
– বাড়ির সদর দরজা খোলা কেন?

সিকিউরিটি অপরাধবোধ নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।অপর পাশ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে গোধূলি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি স্থির রেখে ফের বললো,

– কি হলো কথা বলছেন কেন?
– সরি ম্যাম।
– আপনারা এতো কেয়ারলেস কেন?
– সরি ম্যাম।বাহিরে প্রচন্ড বাতাস তাই হয়তো….

সিকিউরিটি তার পুরো কথা শেষ করার আগেই হুট করে কারেন্ট চলে যায়।এতে গোধূলি বিরক্তি হয়ে বললো,

– ধ্যাৎ!এক্ষুনি এটাকে যেতে হলো।ঠিক আছে আপনি যান,পরের বার থেকে যেনো কাজে কোনো ধরনের গাফিলতি না দেখি।ক্লিয়ার!মনে থাকবে?
– জ্বি ম্যাম!
– ও হ্যাঁ শুনুন,রাতে মনে হয় ঝড় বৃষ্টি আসতে পারে সাবধানে থাকবেন কেমন।
– ওকে ম্যাম।
– ঠিক আছে যান এখন।

গোধূলি ওর ফোনের ফ্ল্যাশলাইট অন করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজাটা ভালো করে লক করে দেয়।সিঁড়ি দিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে নিজের ঘরে চলে যায়।বাহিরের জামা কাপড় চেঞ্জ করে ধুতি আর টিশার্ট পড়ে নেয়।কোনো দিক না তাকিয়ে সোজা গিয়ে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে।যখন ঘুম ভাঙে তখন সকাল নয়টা।সজাগ হয়ে আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে উঠতে যাবে ঠিক তখনই নিজের পেটের উপর ভারী কিছু অনুভব করে গোধূলি।পেটের উপর তাকিয়ে দেখে কেউ ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে পেটের উপর মুখ গুজে শুয়ে আছে।গোধূলি ভয় পেয়ে গিয়ে চিৎকার দিয়ে এক ধাক্কায় তাকে খাট থেকে নিচে ফেলে দেয়।অনেকক্ষণ হয়ে গেলো কিন্তু নিচ থেকে কোনো সাড়াশব্দ আসছে না দেখে গোধূলি খাটের একদম কিনারে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখবে বলে যেইনা মাথা নিচু করলো ওমনি ওর হাত ধরে কেউ টান মারে।আর গোধূলি ধড়াম করে নিচে পড়ে যায়।কোমড়ে বেশ লেগেছে গোধূলির।কোমড়ে হাত দিয়ে ব্যাথায় ছটফট করছে।চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।ওকে কেউ একজন ফেলে দিয়েছে এটা মাথায় আসতেই ফট করে পিছনে ফিরে তাকায় গোধূলি।ততক্ষণে সেই ব্যাক্তি উঠে দাঁড়িয়েছে।নিজের গায়ের ময়লা ঝাড়ছে।গোধূলি তার মুখ দেখতে পারছে না।কারণ ওকে পিছন ফিরে সে দাঁড়িয়ে আছে।গোধূলি রেগেমেগে যেই উঠতে যাবে ওমনি কোমড়ে টান পড়তেই আহ্ করে চিৎকার করে উঠে।এতক্ষণে সামনে থাকা মানুষটার হুশ ফিরে।একটু আগে যে তিনি কাউকে হেচকা টানে ফ্লোরে আছাড় খাইয়েছেন সেটা তিনি বেমালুম ভুলে নিজের শরীর ঝাড়তেই ব্যস্ত ছিলেন।পিছনে তাকিয়ে দেখে গোধূলি ফ্লোরে কনুয়ে এক হাতে ভর দিয়ে আধশোয়া হয়ে অন্য হাতে কোমড় ধরে আছে।গোধূলি তখনও তার দিকেই তাকিয়ে আছে।কোমড়ের ব্যাথায় নড়তে চড়তে পারছে না।সামনের উপস্থিত মানুষটাকে দেখা মাত্রই গোধূলি দেয় এক গগনবিদারী চিৎকার।গোধূলির চিৎকারে সামনের ব্যাক্তিটি থতমত খেয়ে যায়।তড়িৎ বেগে এসে গোধূলির মুখ চেপে ধরলো।শক্ত গলায় বললো,

– হুশশ!চুপ,একদম চুপ!

গোধূলি পুরো স্টপ হয়ে যায়।তারপর গোধূলিকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে পিছনে একটা বালিশ রেখে গোধূলিকে আবার ওটাতে হেলান দিয়ে বসিয়ে দেয়।গোধূলি কোনো কথা বলছে না।চুপচাপ সামনের মানুষটার গতিবিধি লক্ষ্য করছে।পুরো রুম তন্নতন্ন করে কিছু খুঁজছে।আলমারিতে যত কাপড় ছিল সব এদিক সেদিক ছুড়ে ছুড়ে ফেলছে।গোধূলির ওয়ারড্রবের সবগুলো ড্রয়ার ফ্লোরে ঢেলে দিয়েছে।যেটা খুঁজছে সেটা পাচ্ছে না বলে রাগে ওর পুরো শরীর থরথর করে কাপছে।নীরব দর্শক হয়ে গোধূলি শুধু দেখেই চলেছে।শেষে কোনো কিছু না পেয়ে রাগে বললো,

– ফাস্টএইড বক্সটা কোথায়?

গোধূলি বেড সাইডের টেবিলের দিকে চোখে ইশারায় বুঝালো,ওটা টেবিলের ড্রয়ারে আছে।গোধূলির চোখের ইশারা পেয়েই সেখান থেকে ফাস্টএইড বক্স খুঁজে একটা পেইন কিলার স্প্রে নিয়ে গোধূলির দিকে এগোতেই গোধূলি হাত বাড়িয়ে স্প্রে টা নিতে চাচ্ছিলো কিন্তু স্প্রে টা গোধূলিকে না দিয়ে নিজের হাতে গোধূলির কোমড়ে স্প্রে টা করে দেয়।তার হাতের ছোয়া পেয়ে গোধূলির যে বেশ অস্বস্তি হচ্ছিলো সেটা তার নজর এড়ায় নি।স্প্রে টা টেবিলের উপর রেখে চলে যেতে নিলেই গোধূলি পেছন থেকে ওর হাত ধরে ফেলে।গোধূলির দিকে না তাকিয়েই শীতল কণ্ঠে বললো,

– লিভ মি!

গোধূলি উঠে এসে পিছন থেকে জাপটে জড়িয়ে ধরে বললো,

– ছেড়ে দেবো বলে তো ধরি নি!

গোধূলির এমন কথায় বেশ অবাক হয় সামনের মানুষটি।একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পিছনে ফিরে কিছু বলবে বলে যেই মুখ খুলতে যাবে ফট করে গোধূলি ওর বাম গালে চুমো দিয়ে বসে।গালে হাত দিয়ে ঢ্যাপঢ্যাপ করে গোধূলির দিকে তাকিয়ে আছে।আঙুল উঁচিয়ে যেই না আবার মুখ খুলতে যাবে গোধূলি আবার ওর ডান গালেও চুমো দিয়ে বসে।এইবার দুই গালে হাত দিয়ে হা করে গোধূলির দিকে তাকিয়ে আছে।গোধূলি এবার দীপ্তের গলা জড়িয়ে ধরলো।গোধূলি ওর নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না যে মানুষটা সত্যি সত্যি ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।গোধূলির সামনে থাকা মানুষটি আর কেউ নয় স্বয়ং দীপ্ত।

ফ্ল্যাশব্যাক_________

দীপ্ত গত রাতে লন্ডন থেকে ফিরে এসেছে।সারপ্রাইজ দিবে বলে কাউকে কিছু বলে আসে নি।কিন্তু এসে দেখে বাসায় কেউ নেই।সিকিউরিটির কাছ থেকে জানতে পারে দীপ্তি বেগম উনার বাবার বাসায় গেছেন।মা বাবাকে সকালে সারপ্রাইজ দিবে বলে দাড়োয়ান আর সিকিউরিটি গার্ডকে বলে দিয়েছে ওরা যেন দীপ্তি বেগম বা জামাল সাহেবকে কিছু না বলে।অনেকটা পথ জার্নি করে এসে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল।তাই নিজের ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।একে তো কারেন্ট ছিল না তার উপর এতোটা রাস্তা ড্রাইভ করে এসে কোনো রকম ফ্রেশ হয়ে গোধূলিও শুয়ে পড়ে।ওর বিছানায় যে আরো একজন ঘুমিয়ে আছে সেটা ও খেয়ালই করে নি।যার নমুনা দুজনের মধ্যেই লক্ষনীয়।

বর্তমান_______

গোধূলির এই জোড়া চুমোয় দীপ্ত একটু না অনেকটাই অবাক হয়েছে।দীপ্ত ওর গাল থেকে হাত নামিয়ে নিয়ে গোধূলির কাছে থেকে ওর গলা ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,

– স্টপ দিস ননসেন্স!

দীপ্তের চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। তাও গোধূলি আবার দীপ্তের গলা জড়িয়ে ধরলো।অবাক হওয়ার ভঙ্গিমায় বললো,

– ননসেন্স!কোনটা ননসেন্স?
– এইটা নাকি এইটা?

আবারো দীপ্তের দুই গালে দুই চুমো দিয়ে চোখ টিপ দিয়ে ইশারা করে বললো।গোধূলির এহেন কান্ডে দীপ্ত অবাকের চরম পর্যায়ে।গোধূলির এমন হেংলামো ঠিক হজম হচ্ছে না দীপ্তের।যে মেয়ে ওর চোখে চোখ রেখে কোনাদিন একটু মিষ্টি করে কথা অবধি বলে নি আর সেই মেয়েই কিনা ডিরেক্ট ওকে কিস করছে?তাও আবার একটা না দুটো না চার চারটে!দীপ্ত আঙুল উঁচিয়ে চোখ রাঙিয়ে ভারী কন্ঠে বললো,

– এই মেয়ে এইবার কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে!আমি কি….

দীপ্তকে কথা বলতে না দিয়েই গোধূলি দীপ্তের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ওকে থামিয়ে দেয়।দীপ্ত ভ্রুকুটি করে গোধূলির দিকে তাকিয়ে আছে।গোধূলি দীপ্তের দিকে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,

– হুশশ!বাড়াবাড়ি তো এখন হবে!

কথাটা শেষ করেই গোধূলি দীপ্তের আরো কাছে যেতে লাগলো।গোধূলির এগোনো দেখে দীপ্ত পেছাতে পেছাতে একদম দেয়ালের সাথে গিয়ে ধাক্কা খায়।গোধূলিকে দেখে হঠাৎ এমন ভয় পাওয়ার মতো কি হলো দীপ্ত নিজেও বুঝতে পারছে।গোধূলিকে দেখে মনে হচ্ছে ও ওর মধ্যে নেই।দীপ্তের গলা শুকিয়ে আসছে।জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে টেনে টেনে বললো,

– মা্ মা্ মানে?

গোধূলি একদম দীপ্তের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।দুজনেই মধ্যে এক ইঞ্চি জায়গাও অবশিষ্ট নেই।দীপ্ত পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে আরেকটু উঁচু হয়ে দাঁড়িয়েছে।যাতে ওর শরীর গোধূলির শরীর স্পর্শ না করে।কিন্তু তাতেও লাভ হয় নি।গোধূলি আরো একটু দীপ্তের দিকে এগিয়ে যায়।অবশিষ্ট আধা ইঞ্চিখানেক জায়গাটাও নিঃশেষ করে দেয় গোধূলি।দীপ্ত দম আটকে দাঁড়িয়ে আছে।গোধূলির উষ্ণ নিঃশ্বাস গিয়ে দীপ্তের বুকে পড়ছে।হুট করেই দীপ্তের কলার চেপে ধরে গোধূলি।ঘটনাটা আকস্মিক হওয়ায় টাল সামলাতে না পেরে দীপ্ত কিছুটা নিচের দিকে ঝুকে পড়ে।দীপ্ত কিছু বুঝে উঠার আগেই গোধূলি ওর ঠোঁট জোড়া দীপ্তের ঠোঁট জোড়ায় মিলিয়ে দেয়।গোধূলির এমন আক্রমনাত্মক কান্ডে দীপ্তের চোখ কোটর থেকে বেড়িয়ে আসার উপক্রম।পরমুহূর্তেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয় দীপ্ত।গোধূলির ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারলো না ও।যতই হোক পুরুষ মানুষ তো!যদি কেউ নিজ থেকে কাছে ডাকে তবে কি তাকে ফেরানো যায়!আবার সে যদি হয় তার প্রেয়সী!

দীপ্ত এক হাতে গোধূলির কোমড় জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে গোধূলির চুল মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়।মিনিট দেড়েক পরেই গোধূলিকে ছেড়ে দেয় দীপ্ত।দ্রুত পা চালিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়।গোধূলি ঘনঘন শ্বাস ফেলছে।লজ্জায় ভয় ভালো লাগা সব মিলিয়ে অন্যরকম এক অনুভূতির সঙ্গে পরিচয় হলো ওর।চোখ বন্ধ করতেই ফিরে গেলো কিছুক্ষণ আগের মুহূর্তে।পরক্ষণেই ও নিজের করা কান্ডে নিজেই অবাক হচ্ছে।কপাল চাপড়ে বিড়বিড় করে বললো,

– ইশশ!এটা আমি কি করলাম?উনি এখন আমায় কি ভাববেন?ধ্যাৎ,কি আর ভাববেন!উনিও তো…. ইশশ কি লজ্জা!

গোধূলি দুই হাত দিয়ে ওর মুখ ঢেকে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো।ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে এসে দেখে পুরো রুম আগের মতো পরিপাটি করে গুছানো।গোধূলি বেশ অবাক হয়ে চারদিকটা ঘুরে ঘুরে দেখছে আর মনে মনে ভাবছে এত অল্প সময়ের মধ্যে কে এইভাবে সবটা গুছিয়েছে।দীপ্তের কথা মাথায় আসতেই ছুট লাগায় বাহিরের উদ্দেশ্যে।দরজার কাছে গিয়ে পায়ে কিছু আটকে পড়ে যেতে নিলেই নিজেকে কোনো মতে সামলে নেয় গোধূলি।নিচে তাকিয়ে দেখে ওর সব জামা কাপড় আর জিনিসপত্র নিচে পড়ে আছে।গোধূলির চোখ দিয়ে আগুন ঝড়ছে।কার এত বড় সাহস যে ওর সব জামা কাপড় এই ভাবে মাটিতে ফেলে রেখেছে।পরক্ষণেই একটু আগেই দীপ্তের করা কান্ডের কথা মনে পড়ে।তবে কি উনিই এই গুলো আবার বাহিরে ফেলে দিয়েছেন?রেগেমেগে দীপ্তের কাছে চলে যায় গোধূলি।গিয়ে দেখে দীপ্ত ডাইনিং রুমে বসে কফি খাচ্ছে।আরেকবার কাপে যেই চুমুক দিতে যাবে ওমনি গোধূলি হেচকা টানে দীপ্তের কাছ থেকে কফির কাপটা নিয়ে নেয়।গোধূলি ওর নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারলো।কাপে থাকা সবটুকু কফি এসে ওর গায়েই পড়লো।দীপ্ত ফিক করে হেসে উঠে।দীপ্তের হাসি দেখে গোধূলির রাগ আরো এক ধাপ বেড়ে যায়।কাটকাট গলায় বললো,

– আপনি আমার জামা কাপড় আর জিনিসপত্র বাহিরে ফেলে দিয়েছেন কেন?
– ওইগুলো একটাও আমার দরকারি না!

দীপ্তের একরোখা জবাবে গোধূলি খানিকটা উচ্চ গলায় বললো,

– তো?
– তাই ফেলে দিয়েছি।
– মানে আপনি…..

গোধূলিকে বলার সুযোগ না দিয়ে দীপ্ত ওখান থেকে বেড়িয়ে আসে।গোধূলি ওর রাগ ঝাড়ার জন্য কোনো কিছু না পেয়ে শেষে বাম পায়ে ফ্লোরে আঘাত করে আবার রুমে চলে যায়।

রুমের সোফায় বসে ল্যাপটপে মুখ গুজে কাজ করছে দীপ্ত।ক্ষনে ক্ষনেই পাশের টি টেবিলে রাখা জুসের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে।বাম হাতে জুসের গ্লাসটা নিয়ে আবার চুমুক দিয়ে মুখে নিয়েছে মাত্র ঠিক তখনই দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে সামনে তাকাতেই বিষম খেয়ে বসে দীপ্ত।মুখের মধ্যে থাকা সব জুস ল্যাপটপের উপর ছেড়ে দেয়।সবেই গোধূলি শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়েছে।হঠাৎ দীপ্তের বিষম খাওয়ার মানে বুঝতে না পেরে গোধূলি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো।দীপ্ত মাথা নিচু করে বসে আছে।দীপ্তের ভাবাবেগের কোনো পরিবর্তন নেই দেখে গোধূলির হাতে থাকা টাওয়াল দিয়ে ওর চুল মুছতে মুছতে দীপ্তের ঠিক পাশে সোফায় অবশিষ্ট জায়গাটা দখল করে বসলো।গোধূলি আপন মনে নিজের মতো করে ওর কাজ করছে।কিন্তু আরেক জনের বিপি হাই হয়ে যাচ্ছে।মাথা নিচু রেখেই দীপ্ত আড়চোখে গোধূলির উন্মুক্ত পায়ের দিকে তাকিয়েই বুকের ভেতরটা কেমন যেন ধুপ করে উঠলো। মুহূর্তেই আবার নজর সড়িয়ে নেয়।দীপ্তের হোয়াইট শার্ট ব্যতীত গোধূলির শরীরে আর কোনো কাপড়ের বিন্দুমাত্র অস্তিত্ব নেই।গোধূলি গুনগুন করছে আর হাত দিয়ে চুলে বারি দিচ্ছে।ফলে চুলে থাকা অবশিষ্ট পানির ছিটেফোঁটা এসে দীপ্তের চোখে মুখে পড়ছে।সদ্য স্নান সেড়ে আসা গোধূলিকে ভেজা চুলে খুবই আবেদনময়ী লাগছে।দীপ্তের মধ্যে এক অন্য রকম ফিলিংস এসে ভীড় করছে।বেশিক্ষণ এই ভাবে বসে থাকলে হয়তো যেকোনো সময় নিজের কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলতে পারে! দীপ্ত ফট করে দাঁড়িয়ে গিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,

– এটা আমার শার্ট!

গোধূলি নিজেকে একটু দেখে নিয়ে বললো,

– হুম, তো?

গোধূলির কথায় দীপ্ত দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

– আমার জিনিসে কেউ হাত দিক এটা আমার পছন্দ না।

গোধূলি উঠে গিয়ে দীপ্ত যেইদিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে সেইদিকে গিয়ে ঠিক দীপ্তের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,

– আচ্ছা তাই বুঝি?তা একটু আগে আমার জিনিসে হাত দেওয়ার সময় বুঝি এই থিওরী মাথায় ছিল না?

গোধূলির কথায় দীপ্ত রেগে গিয়ে গোধূলির দিকে কিছুটা ঝুকে বললো,

– শার্ট টা আমার ফেরত চাই,রাইট নাও!

গোধূলি কিছুটা পিছিয়ে যায়।বাম হাতটা বুকে রেখে ডান হাত দীপ্তের মুখের সামনে উঁচিয়ে বললো,

– ওয়েট!

দীপ্তের চোখে মুখে বিরক্তির চাপ স্পষ্ট।সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে ও।

– আমার শার্ট আমারো দরকার নেই।এক্ষুনি খুলে দিচ্ছি!

কথাটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই বিস্ফোরিত চোখে গোধূলির দিকে তাকায় দীপ্ত।গোধূলির দিকে তাকাতেই দীপ্তের চোখ কোটর থেকেবেড়িয়ে আসার উপক্রম।কেননা গোধূলি দীপ্তের সামনেই শার্টের বাটন খুলতে শুরু করেছে।অলরেডি একটা খুলেও ফেলেছে।দীপ্ত চিৎকার করে বললো,

– এই!এখানে খুলতে বলি নি স্টুপিড।

– তো?আপনি না মাত্র বললেন?

গোধূলি অবাক হয়ে বললো।দীপ্ত দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত গলায় বললো,

– তাই বলে আমার সামনে?

– তাতে কি হয়েছে?

– স্টুপিড!

– আপনি আবার আমাকে স্টুপিড……..

গোধূলির কথাকে পাত্তা না দিয়েই দীপ্ত ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়।দীপ্তকে জ্বালাতন করতে পেরে গোধূলি বিশ্বজয়ের একটা বাঁকা হাসি দেয়।তার সাথে ও বেশ অবাকও হচ্ছে।গোধূলি সকাল থেকেই লক্ষ করছে দীপ্ত একটা বারের জন্যও গোধূলির নাম নেয় নি।এমনকি তুই সম্মোধনটাও অবধি উচ্চারণ করে নি।পরমুহূর্তেই ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে অস্ফুটস্বরে বললো,

– বুঝতে পারছি সাহেবের মনে অনেক অভিমান জমে আছে।তবে এখন সেই অভিমান ভাঙার সময় হয়ে গেছে।

ছেলে ফিরে এসেছে শুনে দীপ্তি বেগম আর এক মুহূর্তও দেরি না করে বাসায় চলে আসেন।দীপ্তকে বুকে জড়িয়ে কি কান্নাটাই না করেছেন।অবশ্য কান্না করাটাই স্বাভাবিক।তিন বছর পর সন্তানকে কাছে পেয়ে কোন মা কান্না না করবে?মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে দীপ্ত।ছেলের মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন দীপ্তি বেগম।দীপ্ত ওর মাকে ভারী গলায় জিজ্ঞাস করলো,

– আম্মু,ওই মেয়ে আমাদের বাসায় কি করছে?
– কে?সাজি?
– হুম!
– ও গত দুই বছর যাবত আমাদের বাসাতেই আছে।

কথা কর্ণপাত হতেই দীপ্ত বিস্ফোরিত চোখে তাকায় মায়ের দিকে।চটজলদি উঠে মায়ের মুখোমুখি বসে।উৎকন্ঠিত স্বরে জিজ্ঞাস করলো,

– কেন?

– জানি না!তবে যেদিন এসেছিল সেইদিন তোর রুমের দরজা বন্ধ করে খুব কান্না করেছিল।ও কেনই বা এখানে এসেছে?কেনই বা ওদের বাসায় না থেকে আমাদের বাসায় থাকছে?এসব প্রশ্ন কোনোদিনই আমি ওকে করে নি।তুই চলে যাওয়ার পর একটা বছর আমি কিভাবে পাড় করেছি সেটা একমাত্র আমরাই জানি।কিন্তু বিশ্বাস কর গত দুইটা বছরে একটা বারের জন্যও সাজি আমাদেরকে তোর অভাবটা বুঝতে দেয় নি।নিজের মেয়ের মতোই আগলে রেখেছে আমাকে আর তোর আব্বুকে।

– সারা জীবনের জন্যেই তো এই বাড়িতে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম।

মিনমিনে স্বরে কথাটা বললো দীপ্ত।

– কিছু বললি?

– না আম্মু!তুমি কিছু বলছিলে না?

– হুম।ওকে ছাড়া কেউই ওই বাড়িতে ভালো নেই।যে বাবাকে ও সবচেয়ে বেশি ভয় পেতো সেই বাবাকেও মুখের উপর বলে দিয়েছ ও এইখানেই থাকবে।তোর নানুজানও সাজিকে ছাড়া থাকতে পারে না বলে দুই বাসাতেই উদল বদল করে থাকে।আমাদের বাসাতেই ছিল কালকেই গোধূলি দিয়ে এসেছে।

– তুমি তো কখনো বলো নি যে ও আমাদের বাসায় থাকে।

– তুই কখনো ওর কথা জিজ্ঞাস করেছিস?

মায়ের কথায় চোখ নামিয়ে নেয় দীপ্ত।আসলেই তো ও এই তিন বছরে একটা বারের জন্যও গোধূলির খোঁজ নেয় নি।তবে সেটা ছিল তো লোক দেখানো।কিন্তু ভেতরে ভেতরে ও ওর চডাইপাখির নামে রোজ পুড়েছে, প্রতি ক্ষণেই পুড়েছে।পুড়তে পুড়তে হৃদয়টা ঝলসে গেছে।দীপ্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়।

___________________

গোধূলির এই সময়টা দীপ্তের কাছে বরাবরই খুব প্রিয়। এ আর এমন নতুন কি।ছাদের পশ্চিম কোণে কার্নিশের কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে দীপ্ত।একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সীমাহীন আকাশটার দিকে।নিজের মনের অজান্তেই দু’চোখ বেঁয়ে উষ্ণ নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে।হাতের পিঠে বার বার মুছার পরেও অবাধ্য চোখের জল কোনো বারনেই মানছে না।হুট করেই ফোনের রিংটোনের শব্দে ধ্যান ভাঙ্গে দীপ্তের। চোখ মুছে চার পাশটায় তাকাতেই দেখে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে খেয়ালই করে নি ও।চোখ গোলগোল করে গাল ফুলিয়ে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে ফোনটা হাতে নেয় দীপ্ত।সাজ্জাদ সাহেব কল করেছেন।নাক টেনে কলটা রিসিভ করতেই ওইপাশ থেকে সাজ্জাদ সাহেব বললেন,

– দীপ্ত একটু নিচে আয় তো বাবা।

আসছি বলেই কলটা কেটে দেয় দীপ্ত।ও বুঝতে পেরেছে সাজ্জাদ সাহেব ওদের বাড়িতে এসেছে।দীপ্ত দ্রুত পায়ে ছাদ থেকে নেমে নিচে চলে আসে।নিচে এসে দেখে ড্রয়িংরুমে কেউ নেই।দীপ্ত আবার সাজ্জাদ সাহেবকে কল দেয়।সাথে সাথে রিং বাজতেই চমকে উঠে দীপ্ত।সেকেন্ড দু’এক পরেই বুঝতে পারে সাজ্জাদ সাহেব ওর মায়ের রুমে।দীপ্ত পা বাড়ালো মায়ের ঘরের দিকে।সেখানে গিয়ে দেখতে পায় মোটামুটি একটা বৈঠক বসেছে।গোধূলি আর শিখা বেগম ছাড়া ওই বাড়ির সবাই এইখানে উপস্থিত।থমথমে একটা পরিবেশ।দীপ্ত একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলো,

– কি ব্যাপার সবাই এইখানে কেন?

– তোর মামু তোকে কিছু বলবে বলে এখানে ডেকেছে।

জামাল সাহেবের কথায় দীপ্ত বললো,

– তা বেশ তো!ড্রয়িং রুমে চলো!

– না এখানেই ঠিক আছে।এইদিকে আয় তুই।

সাজ্জাদ সাহেব ধীর কন্ঠে বললেন।দীপ্ত উনার কথা মতো উনার সামনে গিয়ে বললো,

– বলো কি বলবে?

– তোর মা বলছিল বিয়ের কাজটা সেড়ে ফেলতে!কিন্তু আমার মনে হচ্ছে বিয়েটা হওয়ার আগেই তোমাদের সবার সত্যিটা জেনে নেওয়া প্রয়োজন!

– কি সত্যি?

…….

– কি হলো মামু?

…….

– বলো!

– সাজি আমার নিজের মেয়ে না দীপ্ত!

চলবে……

বিঃদ্রঃ আগামী দুই এক পর্বের মধ্যেই গল্পের ইতি টানবো পাঠকমহল।হ্যাপি রিডিং🥰

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here