#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে -স্বর্ণালী তালুকদার
#পর্ব -১৬
খুব সাবধানতার সহিত গোধূলির হাতটা দীপ্ত ওর বুকের সাথে আলতো করে চেপে ধরে।গোধূলির ফ্যাকাসে মুখপানে অশ্রু ভরা নয়নে তাকিয়ে আছে দীপ্ত।ওর মনে হাজারো প্রশ্নের ঝড় উঠে গেছে।গোধূলি যদি ওর মুখ আর দেখতে না চায়?ওকে যদি আর সহ্য করতে না পারে?ওর কাছ থেকে যদি দূরে সরে যায়?তখন ও কি করবো?কথাগুলো ভাবতেই কলিজা শুকিয়ে আসছে দীপ্তের।
দীপ্ত একদৃষ্টে তাকিয়ে গোধূলির মলিন মুখটার দিকে।
গোধূলি ঘুমের ঘোরেই বার বার ওর হাতটা টানছে তবে সময় ব্যবধানে।ফলে দীপ্ত বেডের দিকে একটু এগিয়ে বসে।ঘুমের মধ্যেও এতো ছটফট করে!ঠিক যেমন আগে করতো!দীপ্ত স্মিত হেসে ডুব দিলো অতীতে।
ফ্ল্যাশব্যাক _____
– সাজি এই নে তোর আইসক্রিম আর চকলেট।
গোধূলি আইসক্রিম আর চকলেট পেয়ে খুশিতে আহানের গলা জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলল,
– বড়দাভাই তুমি এতো ভালো কেন?
– আমি যদি ভালো না হতাম তাহলে কি বেশি ভালো হতো?
আহান গোধূলির দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বলল।গোধূলি আহ্লাদী গলায় বললো,
– একদম না।তুমি অলওয়েজ এরকমই থাকবে।তুমি হলে আমার বড়দাভাই,পৃথিবীর বেস্ট বড়দাভাই।
আহানও বোনকে জড়িয়ে ধরে মাথায় একটা চুমো দিয়ে বলে,
– ওকে,যা এখন গিয়ে অংক করতে বস।একটু পর আমি এসে তোর অংক গুলো দেখবো ঠিক আছে।
– ওকে।
দুই ভাই বোনের আলাপন আড়াল থেকে শুনছিল দীপ্ত।যদিও ইচ্ছাকৃত নয়।গোধূলির সব ভাইবোনদের রুমগুলো পাশাপাশি।দীপ্ত যেহেতু আহানের সাথে থাকে তাই ওই রুমের উদ্দেশ্যেই যাচ্ছিল।গোধূলির রুম ডিঙ্গিয়ে আহানের রুমে যেতে হয়।তাই দীপ্ত যখন আহানের রুমে যাচ্ছিল তখনই ওদের আলাপ শুনতে পেয়ে থেমে যায়।
গোধূলি টেবিলে বসে মনের সুখে এক হাত দিয়ে চকলেট খাচ্ছে আর অন্য হাত খাতায়।ও আহানের কথা মতো অংক করছিল।তাও আবার যে সে অংক না এক্কেবারে পাটিগণিত। যা গোধূলির মাথায় একদমই ঢুকে না।আহান বলেছে,যেটা বেশি কঠিন লাগবে সেটাই বেশি বেশি করে করবি।
– আমাকে পদে পদে হেনস্তা করা না!দাঁড়া আমি তোকে এমন শায়েস্তা করে ছাড়বো যে আমার পিছনে আর লাগতে আসবি না।
দীপ্ত কথাগুলো বিড়বিড় করে সর্পিল গতিতে পা টিপেটিপে গোধূলির রুমের ভেতর ঢুকে।গোধূলির পিছনে গিয়ে ছুঁ মেরে গোধূলির হাত থেকে চকলেটটা নিয়ে নেয়।গোধূলির পাশে থাকা চেয়ারটায় ধপ করে বসে চকলেটটা খেতে শুরু করে।
– ছোটদাভাই তুই আবার আমার চকলেট নিয়েছি….
দীপ্তকে দেখে গোধূলি ওর পুরো কথা শেষ করতে পারলো না।প্রচুর অবাকের সাথে চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছে দীপ্তের দিকে।যে ছেলে আসার পর থেকে ওর সাথে একটাবারও কথা বলে নি।এখন সোজা ওর রুমে ঢুকে পড়েছে?
গোধূলি নিচ দিকে তাকিয়ে মনোযোগসহকারে খাতায় অংক করছিল।হাত থেকে চকলেট নিয়ে নেওয়ায় ও ভেবেছিল হয়তো ইহান নিয়েছে।কারণ ওকে জ্বালানোর জন্য ইহান প্রায়ই এমন করে থাকে।এ নিয়ে দুজনের মধ্যে কত্ত টম এন্ড জেরির ফাইট হয়েছে!গোধূলি দীপ্তকে ওর চকলেটটা খেতে দেখে শক্ত গলায় বললো,
– দীপ্ত ভাইয়া তুমি আমার চকলেটটা নিয়ে নিলে কেন?
গোধূলি ফের বেশ খানিকটা ঝাঝালো কন্ঠে বলল,
– আর শুধু নিয়েই ক্ষান্ত হও নি এক্কেবারে খেয়ে ফেলছো।
দীপ্ত নিজের মতো করে চকলেট খেয়েই যাচ্ছে।চকলেট খেতে খেতে গোধূলির দিকে আড়ঁচোখে তাকিয়ে বললো,
– এই চকলেটটা এত মিষ্টি কেন রে?
দীপ্তের কথায় গোধূলি বেশ বিরক্ত হয়।আজব!চকলেট তো মিষ্টিই হয়।গোধূলি কর্কশভাবে বললো,
– চকলেট কোনো দিন তেঁতো হতে শুনেছো?
দীপ্ত গোধূলির দিকে চোখ রাঙিয়ে বলে,
– একদম ত্যাঁড়াত্যাঁড়া উত্তর দিবি না।যা জিজ্ঞাস করলাম শুধু তার উত্তর দে।
গোধূলির তো রাগে গজগজ করছে।ওর চকলেটটা এইভাবে খেয়ে ফেললো?ছিঃ এটা তো ওর খাওয়া!এটা দীপ্ত এইভাবে খেয়ে ফেললো?কিন্তু সেটা বড় কথা নয়।কথা হলো দীপ্ত ওর চকলেটটা খেয়েছে।গোধূলি দীপ্তের প্রশ্নে দাঁত চেপে ধরে বললো,
– এমনি!
দীপ্ত কপাল কুচকে তাকায় গোধূলির দিকে।অবাক হওয়ার ভঙ্গিমা করে বললো,
– এমনি!এমনি কি?এমনি আবার কোন ধরনের উত্তর?আমার প্রশ্নের উত্তর যৌক্তিক বিশ্লেষণ দিয়ে বল।
রাগে গোধূলির সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে।একে তো ওর চকলেট খেয়ে সাবাড় করে দিচ্ছে আবার যৌক্তিক বিশ্লেষণও চাইছে যত্তসব উটকো ঝামেলা!এই এলিয়েনটা কি জানে না নাকি চকলেট কেন মিষ্টি হয়?
দীপ্ত গোধূলির দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে থেকে বলে।
– কি হলো?কি বিড়বিড় করছিস?
– কিছু না।
শক্ত গলায় বললো গোধূলি।দীপ্ত গোধূলির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে বললো,
– তুই কি বলবি? নাকি বাকি চকলেট গুলো খেয়ে আমি নিজেই উত্তর টা খুঁজে নেবো?
দীপ্ত হাত বাড়িয়ে টেবিলের উপর থেকে বাকি চকলেট গুলো ধরতে নিলেই গোধূলি চিৎকার করে উঠে।উৎকন্ঠিত স্বরে বললো,
– না!আমি বলছি!
– তাহলে বল!এত সময় নিচ্ছিস কেন?
গোধূলি চোখ রাঙিয়ে একবার দীপ্তের দিকে তাকায়।তবে সেটা দীপ্তের নজরে আসে নি।ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে দীপ্তের অগোচরে।গোধূলি সময় নিচ্ছে দেখে দীপ্ত চোখ পাকিয়ে তাকায় গোধূলির দিকে।গোধূলি মেকি হেসে বললো,
– চকলেট মিষ্টি হয় কারণ, চকলেটে মিষ্টি জাতীয় উপাদান যেমন চিনি,গুড়,মধু,দুধ ইত্যাদি দেওয়ার জন্য।আর যে ফ্যাক্টরিতে চকলেট তৈরি করা হয় সেখানকার লোকেরাও অনেক ভালো হয়।আমাদের মতো ছোট ছোট বাচ্চাদের কথা চিন্তা করে তারা চকলেট গুলো তৈরি করে।তাই চকলেট তৈরি করার সময় মিষ্টি বেশি দেয়। কারণ বাচ্চারা তো ঝাল খেতে পারে না।যদি ঝাল বেশি হয় তাহলে বাচ্চারা চকলেট কিনবে না আর খাবেও না।বাচ্চারা যদি চকলেট না কিনে তাহলে তাদের অনেক টাকার ক্ষতি হবে।তাই তারা চকলেটে মিষ্টি বেশি দেয় যাতে বেশি বেশি বিক্রি হয় আর তাদের লাভ হয়।
গোধূলির কথা শুনে দীপ্তের মাথা বনবন করছে।দীপ্ত এতক্ষণ গালে হাত দিয়ে ‘”চকলেট কেন মিষ্টি”‘? এই প্রশ্নের যৌক্তিক বিশ্লেষণ শুনছিল।কিন্তু এখন ওর মনে হচ্ছে আর কিচ্ছুক্ষণ এখানে থাকলে গোধূলি ওকে সেই চকলেট ফ্যাক্টরির দারোয়ানই বানিয়ে দেবে!মাছি তাড়ানোর জন্য!এখান থেকে কেটে পরায় ভালো।দীপ্ত একটা হাই তুলে বললো,
– তোর কথা শুনতে শুনতে আমার একেবারে ঘুম পেয়ে গেছে।আমি ঘুমাতে গেলাম।এই অবেলায় এত ঘুম পাচ্ছে কেন কে জানে!ও হে ভুলেই গিয়েছিলাম,তোর চকলেট ফ্যাক্টরির গল্প শুনে!লাভ ক্ষতির হিসাব করতে তো ভালোই শিখেছিস।
গোধূলির কথাগুলো মনে করতেই চরম হাসি পাচ্ছে দীপ্তের।কিন্তু কোনোমতে দীপ্ত নিজের অট্টহাসি সংবরণ করে বললো,
– চিন্তা করিস না এই এই বছর তুই পাটিগণিতেই বেশি মার্ক পাবি দেখে নিস।
দীপ্তের বলা কথাটা গোধূলির বোধগম্য হলো না।হতভম্ব হয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো দরজার দিকে। পরমুহূর্তেই গোধূলি এক লাফে বিছানায় উঠে লুঙ্গি ডান্স দেওয়া শুরু করে দেয়।নাচানাচি শেষ করে একটু শান্ত হয়ে বিছানা মাঝখানে বসে একটা শয়তানি হাসি দিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলে,
– কি দীপ্ত এলিয়েন!কেমন বিশ্লেষণ দিলাম হে?আমাকে বেকায়দায় ফেলা!আমাকে বোকা ভেবেছিলে না?আমি তো বেশ বুঝতে পেরেছিলাম তুমি…….
গোধূলি আরো কিছু বলার আগেই আহান রুমে ঢুকে পড়ে।আহান অবাক হয়ে বললো,
– গোধূলি তুই বিছানায় বসে কি করছিস?অংক করা শেষ?
গোধূলি কর্কশ গলায় বললো,
– না!করছিলাম তো,জানো বড়দাভাই তারপর কি হয়েছে?
– না বললে কিভাবে জানবো?
গোধূলি আহানের হাত ধরে টেনে নিয়ে বিছানায় বসায়।আহান গোধূলির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।গোধূলি কি করতে চাইছে?দেখে মনে হচ্ছে রেগেও আছে।আহান কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,
– কি হয়েছে?
গোধূলি আহানকে একে একে সব কথা বলল।দীপ্ত ওর সাথে কি করেছে, ও দীপ্তকে কিভাবে নাকানিচুবানি খাইয়েছে!সব আহানের কাছে বললো।আর গোধূলির মুখে এইসব শুনে আহানের মাথায় হাত।আর দীপ্তের মাথায় আগুন!
আহানের রুমে গিয়ে দীপ্তের মনে পড়লো ও কেন গোধূলির রুমে গিয়েছিল।চকলেটের চক্কেরে আসল কারণটাই বেমালুম ভুলে গেছে।গোধূলির রুমে যাবে বলে দীপ্ত আবার আসছিল।কিন্তু দরজার কাছেও আসতেই দীপ্ত ফের গোধূলির সব কথা শুনে নেয়!
এই মুহূর্তে দীপ্তের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তবে নিজের উপর!
বার বার ওই মেয়েটা ওকে গোল খাওয়াচ্ছে!গোধূলিকে যতটা বোকা ভেবেছিল ও আসলে ততটাও বোকা নয়।তখন তো দীপ্ত ওর কথাগুলো সত্যিই ভেবেছিল।দীপ্ত মনে করেছিল গোধূলি হয়তো ওর ধারণা থেকেই ওইসব মনগড়া বিশ্লেষণ দিয়েছে!নেহাতি এখনো অনেক ছোট তাই হয়তো ওর এমন ধারণা।কিন্তু না এখন তো দেখছে ও আস্ত একটা ধানি লঙ্কা!
চলবে…