#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে -স্বর্ণালী তালুকদার
#পর্ব -১৪
গোধূলির পুরো পরিবার অপারেশন থিয়েটারের সামনে পাইচারি করছে।কারোর মুখেই কোনো কথা নেই।শিখা বেগম মেয়ের এমন হাল সহ্য করতে না পেরে সেন্স লেস হয়ে পাশের কেবিনে ভর্তি রয়েছেন।রায়ানদের বাসা থেকে লাইফকেয়ার হসপিটালটা একদম কাছেই।ফলে ওরাই সব কিছু এরেঞ্জ করে রেখেছিল।দীপ্ত আর রাবিয়া বেগম হসপিটালে চলে এসেছেন।হসপিটালে এসেও তিনি অনবরত কেঁদেই যাচ্ছেন।আদিবা উনাকে কিছুইতে সামলাতে পারছে না।আর অন্যদিকে দীপ্তের অবস্থা তো পাগলপ্রায়।মাথার চুল উল্টে ধরে দিশেহারা হয়ে অপারেশন থিয়েটারের সামনে পাইচারি করছে।সাজ্জাস সাহেব তো এখন কথা বলার অবস্থাতেই নেই।আহসান সাহেব নিজের মেয়ের থেকেও গোধূলিকে বেশি ভালোবাসেন।তিনি নির্বিকার দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন অপারেশন থিয়েটারের ওই লাল বাল্বটার দিকে।ইমরুল সাহেব আর জ্যোতি বেগম আছে গোধূলির মায়ের কেবিনে।নিজের মেয়ের চিন্তায় তিনি বার বার জ্ঞান হারাচ্ছেন।ইহান আলিফ আলবী দুইজনকে দুই হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।আহানের দৃষ্টি স্থির হাসপাতালের করিডোরের মেঝেটাতে।ওর পরনের অফ হোয়াইট টিশার্টটা প্রানপ্রিয় বোন গোধূলির রক্তে রঞ্জিত হয়ে আছে।
কারোরেই মধ্যেই তেমন চলনশক্তি নেই বললেই চলে।ডাক্তার আর নার্সদের দিকটা রায়ান আর রনিত সাহেব দেখছেন।অনেকক্ষণ পর অপারেশন থিয়েটার থেকে সার্জারী ডাক্তার ডাঃ মতিউর রহমান বের হয়ে উৎকন্ঠিত স্বরে বললেন,
– রোগীর অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল।কপালটায় খুব বাজে ভাবে কেটেছে।কপালে হয়তো পেরেক জাতীয় কিছু ঢুকেছিল।শরীর মারাত্মক ভাবে ঠান্ডা হয়েছিল।অনেক কষ্টে পালস পাওয়া গেছে।তার থেকেও বড় সমস্যা হচ্ছে প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে।এক্ষুনি তিন ব্যাগ এবি নেগেটিভ ব্লাড লাগবে।হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে এবি নেগেটিভ ব্লাড পাওয়া যায় নি।বুঝতেই পারছেন রেয়ার ব্লাড!এবি নেগেটিভ,সহজে খুঁজে পাওয়া মুশকিল।আমরা আমাদের সাধ্য মতো চেষ্টা করছি আপনারাও দেখুন কোথাও পাওয়া যায় কিনা।
ডাক্তার সাহেব একজন বিদেশী ডাক্তার।উনি সিঙ্গাপুরের একটি স্বনামধন্য মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।লাইফকেয়ার হসপিটালের আটচল্লিশ ঘন্টার একটি ক্রিটিক্যাল অপারেশন করা হয়েছে তারই ডিরেকশনে।গোধূলিকে হসপিটালে নিয়ে আসার পর রনিত সাহেবের সাথে উনার দেখা হয়।তারা দুজনেই পূর্ব পরিচিত আর ভালো বন্ধুও।সেই খাতিরে গোধূলির ব্যাপারটা তিনিই হ্যান্ডেল করছেন।লাজুক আর মিহির এসেছে মাত্রই আসলো।আদিবার এনগেজমেন্টের তারিখ ঠিক হতেই লাজুক আর মিহির চলে গিয়েছিল।বাসায় কোনো কাজ ছিল বিধায় দুই ভাই বোনকে চলে যেতে হয়েছিল।তাই লাজুক আর মিহিরের আসতে একটু দেরি হয়েছে।
ছাতক পাখির ন্যায় দাঁড়িয়ে ছিল দীপ্ত।ভেবেছিল ডাক্তার হয়তো পজিটিভ কোনো খবরই দিবেন।কিন্তু তা আর হলো কই?ওর ভাবনা তো তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘুরে গেল।অক্সিজেন বিহীন মানুষ যেমন ছটফট করতে থাকে এই মুহূর্তে দীপ্তেরো একি হাল।ডাক্তার এর বলা প্রত্যেকটা কথা বার বার ওর কানে বারি খাচ্ছে।আর সহ্য হলো না দীপ্তের।উত্তেজিত সুরে বললো,
– স্টপ ইট ডক্টর!গোধূলির কিচ্ছু হবে না। আমি ওর কিছু হতে দেব না।আমি ব্লাড এনে দেবো।আপনি অপারেশন থিয়েটারে যান।
দীপ্ত আর একমুহূর্তও দেরি না করে সোজা হসপিটাল থেকে যায়।আহান আর ইহানও কোনো দিক না তাকিয়ে কাদের কাদেরকে যেন ফোন দেয়!তারপর ওরাও বেড়িয়ে যায়।
•
অপারেশন থিয়েটারের সামনে উৎসুকভাবে বসেছিল গোধূলির পুরো পরিবার।অপারেশন থিয়েটারের বাল্বটা অফ হতেই সবাই তড়িঘড়ি করে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ায়।কিছুক্ষণ পর ডক্টর মতিউর রহমান আর দীপ্ত অপারেশন থিয়েটার থেকে বেড়িয়ে আসে!দীপ্তও অপারেশন থিয়েটারেই ছিল!কিছুতেই দীপ্তকে অপারেশন থিয়েটারের বাইরে রাখা যাচ্ছিল না!শেষমেশ উপায় না পেয়ে ডাক্তার দীপ্তকে অপারেশন থিয়েটারে এলাউ করে!
সাজ্জাদ সাহেব ধীর পায়ে এগিয়ে কাতর স্বরে বললো,
– ডাক্তার সাহেব আমার মেয়ে কেমন আছে?
সাজ্জাদ সাহেব উত্তরের অপেক্ষায় ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।ডাক্তার সৌজন্যমূলক হেসে বললো,
– অপারেশন সাকসেসফুল। এন্ড নাউ শী ইজ আউট অফ ডেঞ্জার।
ডাক্তারের এমন বার্তা শুনে সবাই চিন্তামুক্ত হলো।রাবিয়া বেগমসহ বাকি সবাই আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় করছে।ডাক্তার সাহেব ফের বললো,
– গোধূলিকে কিচ্ছুক্ষণ অবজারভেশনে রাখতে দেওয়া হয়েছে।তারপর কেবিনে শিফট করে দেওয়া হবে।কাল সকাল নাগাদ গোধূলির জ্ঞান ফিরে আসবে বলে আশা করছি।
কথাটা বলে ডাক্তার সাহেব চলেই যাচ্ছিলেন কি মনে করে যেন আবার আসেন।বললেন,
– ও হে দীপ্ত,তোমায় একটা কথা বলতে তো ভুলেই গেয়েছিলাম।থ্যাংক্স ইয়াংম্যান!তুমি না থাকলে গোধূলিকে আজকে আরো সাফার করতে হতো!
– আমি আছি বলেই ওকে আজ এত কিছু সাফার করতে হচ্ছে!
চোয়াল শক্ত করে বিড়বিড় করে বলল দীপ্ত।তবে সেটা ডাক্তারের কান অব্দি পৌছালো না।ডাক্তার সাহেব আবার বললো,
– ওই অবস্থাতে থেকেও তুমি যেভাবে সবটা সামাল দিলে।থ্যাংক ইউ ওয়ান্স এগেইন।সারাজীবন এইভাবেই ওর পাশে থেকো।
শেষের কথাটা ডাক্তার সাহেব দীপ্তের কানে কানে ফিসফিস করে বললেন।দীপ্ত স্মিত হাসলো।ডাক্তার আবার গলার স্বর উঁচু করে বলেন,
– হীরার টুকরো ছেলে আপনাদের।দেখবেন ওর প্রতি যাতে কোনো অন্যায় না হয়।
সবাই শব্দবিহীন তৃপ্তির হাসি দিয়ে মাথা নাড়িয়ে ডাক্তারকে আশ্বাস দিলেন।
________________
মেয়ের অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে শুনেই শিখা বেগম মেয়েকে দেখার জন্য রীতিমতো পাগলামি শুরু করে দিয়েছেন।যতই হোক মায়ের মন এমনি এমনি কি আর মানে?সবাই বাধ্য হয়েই গোধূলির সাথে শিখা বেগমকে দেখা করাতে নিয়ে গেছে।আহান দীপ্তকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে কপালে আর হাতে ব্যান্ডেজ করিয়ে আনে।গোধূলির চিন্তায় দীপ্তের দিকে কারোর তেমন নজর ছিল না।তবে ব্যান্ডেজ লাগানোয় এবার সবার নজর দীপ্তের উপরেই স্থির।দীপ্তকে ওই অবস্থায় দেখে দীপ্তি বেগম উৎকন্ঠিত স্বরে ছেলেকে জিজ্ঞাস করেন,
– দীপ্ত তোর হাত আর কপালে ব্যান্ডেজ কেন?কি হয়েছে তোর?এইভাবে কাটলো কোথায়?
– কই কেটেছে?তেমন কিছু হয় নি আম্মু!
আমতা-আমতা করে বলে দীপ্ত।দীপ্তি বেগম চোখ রাঙিয়ে বললো,
– তা তো আমি দেখতেই পাচ্ছি!হেয়ালি না করে বল তাড়াতাড়ি।
– আসলে আম্মু,ড্রাইভ করার সময় সীট বেল্ট বাঁধতে ভুলে গেয়েছিলাম।জোরে ব্রেক করায় ব্যালেন্স হারিয়ে একটু কপালে লেগেছে আরকি এই যা।
দীপ্তের কথাটা দীপ্তি বেগমের কাছে বেশি গ্রহনযোগ্য না হলেও বিশ্বাস করলেন।কারণ তিনি তার ছেলেকে চিনেন।সীট বেল্ট না বেঁধে ড্রাইভ করার মতো এতটাও ইরেসপন্সিবল ছেলে দীপ্ত না!তাও তিনি ছেলেকে জিজ্ঞাস করলেন,
– তা এত জোড়ে গাড়ি চালানোর কারণটা কি জানতে পারি?
দীপ্ত মায়ের কথায় ফিচেল হেসে বললো,
– আম্মু আসলে হয়েছে কি, আহান আর আমি একটু কার রেস্লিং করতে গিয়েছিলাম।আর রেস্লিং এ কি আস্তে আস্তে গাড়ি চালালে হয় বলো?
ওইদিকে আহান যেনো আকাশ থেকে পড়লো!দীপ্তের কথা শুনে অবাকের উপর অবাক হচ্ছে।কিসের রেস্লিং?ও আবার কখন দীপ্তের সাথে রেস্লিং করতে গেছে?বজ্জাত হারামি নিজে ধরা খেয়ে এখন ওকে ফাঁসানো হচ্ছে। দীপ্তি বেগম রেগেমেগে তেড়ে আহানের দিকে এগিয়ে গিয়ে ঝাঝালো গলায় বললো,
– আহান, তুই কবে থেকে ওর সাথে এই সব করতে শুরু করেছিস?যদি বড় কোনো এক্সিডেন্ট হত?
আহান হকচকিয়ে গিয়ে গলা টেনে বললো,
– ফুপি আমি নাআআ….
কথা বলতে বলতে দীপ্তের দিকে তাকাতেই দীপ্ত ওকে কিছু না বলতে ইশারা করলো।আহান দীপ্তের দিকে তাকিয়ে দাঁত কড়মড় করে গলা খাঁকারি দিয়ে করুণ স্বরে বললো,
– না মানে ফুপি!আর হবে না এই কান ধরছি এইবারের মতো মাফ করে দাও।
– হয়েছে থাক।আর কান ধরতে হবে না।আমি আমার ছেলেকে খুব ভালো করেই চিনি!আমি জানি এখানে তোর কোনো দোষ নেই।
দীপ্ত মায়ের কথা শুনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ও নিজেও জানে ওর একটা কথাও দীপ্তি বেগম বিশ্বাস করে নি।দীপ্তি বেগম দীপ্তের দিকে তাকিয়ে গলার স্বর উঁচু করে বললো,
– তা বাবা দীপ্ত, হাতটা কিভাবে কাটলো শুনি?
চমকে উঠলো দীপ্ত।এই রে!এখন কি বলবে? কার ঘাড়ে দোষ চাপানো যায় এই প্রশ্নের জবাবে ইহানকেই পেলো দীপ্ত!এক সেকেন্ডও দেরি না করে দীপ্ত বলে উঠে,
– ইহান!
ইহান সবে আসলো আলিফ,আলবী আর রাবিয়া বেগমকে বাসায় দিয়ে।ও এই সব কিছুই জানে না।
দীপ্তি বেগম অবাক হয়ে বললো,
– ইহান?
দীপ্ত ফোকলা হেসে বললো,
– হ্যাঁ আম্মু!আমি আর ইহান ট্রুথ অর ডেয়ার খেলছিলাম।ইহান আমাকে ডেয়ার দিয়েছিল দেয়ালে পাঞ্চ করতে হবে।পাঞ্চটা একটু বেশিই জোড়ে মেরেছিলাম তাই একটু ছুলে গেছে!সামান্য একটা পাঞ্চই তো!আমি কি ভয় পাই নাকি?তোমার ভাইপো যা ভীতুর ডিম।ও নিবে ডেয়ার?
দীপ্ত স্মিত হেসে ফের বললো,
– আহান তো আমার একটু বেশিই কেয়ার করে।জোর করে এই ব্যান্ডেজ ফ্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়েছে!অযথায়! এই সবের কিছুই দরকার ছিল না।
ইহান একবার দীপ্ত আর একবার ফুপির দিকে তাকাচ্ছে।দুই মা ছেলের মধ্যে কি কথপোকথন চলছে ও কিছুই বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে আহানকে জিজ্ঞেস করে,
– কিরে দাভাই, দীপ্ত ভাইয়া ভুলভাল এইসব কি বলছে?আমি কোন কালে ট্রুথ অর ডেয়ার খেলেছি তাও আবার দীপ্ত ভাইয়ার সাথে?
আহান দাঁতে দাঁত চেপে মিনমিনে স্বরে বললো,
– চুপ থাক!বেটা ফেঁসেছে তাই তোর নাম নিচ্ছে!তুই ওকে চিনিস না?মুখ ওমন করে লাভ নাই ভাই একটু আগে তোর মতো সেইম রিয়েকশন আমারো ছিল!
ট্রুথ অর ডেয়ার?তাও আবার ইহান এর সাথে?দীপ্তি বেগম বেশ বুঝতে পারছেন।যে ছেলের মশা মারতে কামান লাগে সেই ছেলে নাকি খেলবে ট্রুথ অর ডেয়ার।দীপ্তের এই ব্যাখ্যা দীপ্তি বেগম বিশ্বাস করলেন না।তবে তিনি এটা বুঝতে পারছেন ছেলে মিথ্যা কথা বলছে।ও যখন একবার ঠিক করে নিয়েছে কিছু বলবে না তো বলবেই না।তাই দীপ্তি বেগম আশানুরূপ উত্তর না পেয়ে ছেলেকে আর প্রশ্ন না করে চলে যান!
– উফ বাবা বাঁচলাম!
এতক্ষনে আটকে রাখা দম ছেড়ে বুকে হাত দিয়ে প্রান ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে দীপ্ত।পুরো পৃথিবী একদিকে ওর মা একদিকে। দীপ্তের এই হাল দেখে আহান আর ইহান ঠোঁট টিপে মিটিমিটি হাঁসছে।
চলবে….