দীপ্ত গোধূলি – পর্ব ৩৭

0
471

#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে -স্বর্ণালী তালুকদার
#পর্ব -৩৭

গোধূলির এখনো জ্ঞান ফিরে নি।দীপ্ত ওকে সোজা বাড়িতে নিয়ে এসেছে।আহানকে ফোন করে বলে দিয়েছে গোধূলি ঠিক আছে।ওরা যেন কোনো টেনশন না করে।প্রচুর ঝড় বৃষ্টির জন্য রিসোর্ট থেকে কেউই আসতে পারে নি।আহান আসতে চেয়েছিল কিন্তু দীপ্ত ওকে বারন করে দিয়ে বলেছে রিসোর্টেই আহানের থাকাটা জরুরি ।কারেন্ট বিহীন পুরো শহর অন্ধকারে তলিয়ে আছে।কোথাও বিন্দুমাত্র আলোর ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না।আকাশে বিদ্যুৎ চমকানোর ঝলকানিতে ক্ষনে ক্ষনে পুরো শহর আলোকিত হয়ে যাচ্ছে।জানালার পর্দাটাগুলো সড়িয়ে দিলো দীপ্ত।ফলে সেই আলোর ঝলকানির প্রতিচ্ছবি কিছুটা গোধূলির ঘরে এসেও পড়ছে।

দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বুকে হাত গুজে জানালার গ্লাসটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে দীপ্ত।জানালার কাঁচে পড়া বৃষ্টির ফোঁটা গুলোর উপর বারংবার বৃষ্টির ফোঁটা এসে আঘাত করছে।নিমিষেই কাঁচটা আবার ঘোলা হয়ে যাচ্ছে।বৃষ্টির সেই ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে নিজের প্রতিচ্ছবিই হয়তো খোঁজার চেষ্টা করছে দীপ্ত!সেই সাথে গোধূলির গতিবিধির উপরও নজর রাখছে দীপ্ত।ঘন ঘন বজ্রপাতে গোধূলি বার বার কেঁপে উঠছে।দীপ্ত এগিয়ে গোধূলির পাশে গিয়ে বসে।আলতোভাবে গোধূলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো।ঘুমের ঘোরে দীপ্তকে জড়িয়ে ধরলো গোধূলি।দীপ্ত শুধু ভ্রুকুটি করে তাকায় গোধূলি দিকে।কিন্তু ও মোটেও অবাক হয় নি।পাশবালিশ জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর অভ্যাসটা গোধূলির সেই আতুর ঘর থেকেই!মাকে ছাড়া ঘুমাতে রাজি তবু্ও পাশবালিশ ছাড়া এই মেয়ে ঘুমাবে না।দীপ্ত ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে ওর বাম হাতটা ফের গোধূলির মাথায় রাখে।

দীপ্ত খাটে হেলান দিয়ে গোধূলির মাথায় হাত বুলাচ্ছিলো।কখন যে দীপ্তের চোখটা লেগে যায় বুঝতেই পারে নি।দীপ্তের ঘুম ভাঙ্গে গোধূলির কাঁন্নায়।গোধূলি কাঁন্নারত কন্ঠ কর্ণপাত হতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে দীপ্ত।কিছুটা হকচকিয়ে যায়।ভাবছে হয়তো তখনের কথা মনে করে গোধূলি কান্না করছে।দীপ্ত শুকনো গলায় জিজ্ঞাস করে,

– ওইভাবে কাউকে কিছু না বলে রিসোর্ট থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিলি কেন?

দীপ্তের কথাটা গোধূলির গায়ে যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।খাট থেকে নেমে দীপ্তের শার্টের কলার চেপে ধরে চিৎকার করে বলে উঠে,

– কি করতাম আমি!বলুন কি করতাম আমি?

– তখন আমি যদি ঠিক সময় না পৌঁছাতাম তাহলে কি হতো একবার ভাবতে পারছিস?

করুন স্বরে বললো দীপ্ত।দীপ্তের কথা শুনে গোধূলির হাত আলগা হয়ে আসে।ছেড়ে দেয় দীপ্তকে।হাঁটু গেড়ে ধপ করে নিচে বসে পড়ে।ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে থেকে করুন সুরে বলল,

– আপনাদের যা খুশি আপনারা আমার সাথে তাই করবেন?ছোট বেলা থেকে যে যা বলতো কোনো প্রশ্ন ছাড়া সেটাই মেনে নিতাম!তাঁদেরকে কখনো প্রশ্ন করার দুঃসাহস দেখানোর সাহস আমার ছিল না!
তাই বলে কি আমার নিজের কোনো স্বাধীনতা থাকতে পারে না?আমিও তো আর পাঁচ জনের মতো রক্তে মাংসে গড়া মানুষ।আমারও তো ভালো লাগা খারাপ লাগা ইচ্ছা অনিচ্ছা বলে কিছু থাকতে পারে!আমার নিজের কোনো সিদ্ধান্ত থাকতে পারে না?তাঁদের সিদ্ধান্তে আমি কখনোই আপত্তি জানাতাম না!এতকালে যা করি নি আজও তার ব্যাতিক্রম ঘটতো না।কিন্তু তাই বলে আমাকে কিছু জানানোর প্রয়োজনটুকুও কি তাঁরা মনে করে নি?আমাকে অন্তত একটা বার বলতে পারতো। আমি এইসবের জন্য প্রস্তুত…..

– মানছি তুই মোটেও এইসবের জন্য প্রস্তুত ছিলি না।তাই বলে তুই এইরকম করবি?

গোধূলিকে বলতে না দিয়ে দীপ্ত উল্টো প্রশ্ন করে।গোধূলি নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে।দীপ্ত ফের বললো,

– তোর যদি কিছু হয়ে যেতো তাহলে বাড়ির সবাইকে আমি কি জবাব দিতাম?তোর দায়ভার এখন পুরোপুরি আমার!তোর যতো রাগ অভিমান সবটাই আমাকে ঘিরে হওয়া উচিত!সবটার জন্য দায়ী আমি!

মাথা নিচু করে চুপচাপ চোখের অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছিল গোধূলি।দীপ্তের প্রশ্নে বা কথায় কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া করে নি।কিন্তু দীপ্তের বলা শেষের কথাটা কানে যেতেই মাথা তুলে বিস্ফোরিত চোখে তাকায় গোধূলি।দীপ্তের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে ভাবছে,আজ সেটা ওর সঙ্গে ঘটেছে বা ঘটানো হয়েছে সেটার জন্য সবটা না হলেও সমান দোষে দীপ্তও দোষী!কিন্তু উনি সব দোষ উনারই কেন বলছেন!উনাকে এতটা বিচলিতই বা কেন দেখাচ্ছে?কই রিসোর্টে তো উনাকে দেখে একবারও মনে হয় নি যে উনি অখুশি ছিলেন!বরং বেশ উৎফুল্লের সাথেই সবটা এনজয় করছিলেন।গোধূলির মাথায় এইসব কথা ঘুরপাক খাচ্ছিলো।কিছুই বুঝতে পারছিল না।দীপ্ত গোধূলির দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে মাথা নেড়ে শীতল কণ্ঠে বলে,

– হ্যাঁ!এইসব কিছুর জন্য আমিই দায়ী গোধূলি।

দীপ্তের কথা শুনে গোধূলি ওর চোখ মুখ মুছে শক্ত গলায় বলে,

– মানে?আপনি কি বলতে চাচ্ছেন?

– শুরুটা যখন আমি করেছিলাম শেষটাও না হয় আমিই করি!

গোধূলি প্রশ্নাতীত চোখে দীপ্তের দিকে তাকিয়ে আছে।দীপ্তের কথার কিছুই ও বুঝতে পারছে না।দীপ্ত গোধূলির সামনে এক হাঁটু ভাঁজ করে বসে হাতে থাকা ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলে,

– ভোর চারটায় আমার ফ্লাইট!

দীপ্তের কথা শুনে বিস্মিত হয়ে ওর দিকে তাকায় গোধূলি!দীপ্ত গোধূলির চোখের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে,

– লন্ডনে চলে যাচ্ছি আমি!

গোধূলির কাছে সবটা কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে।হতভম্ব হয়ে দীপ্তের দিকে তাকিয়ে আছে।দীপ্ত গোধূলি চোখের ভাষা বুঝতে সক্ষম।ওই চোখ যে হাজারো প্রশ্নোত্তরের অপেক্ষায় চেয়ে আছে!দীপ্ত ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি টেনে গোধূলির হাতে একটা সবুজ রঙের ডায়েরি দিয়ে বলল,

– ছয় বছর ধরে খুব যত্নে রেখেছিলাম।আজ এর প্রয়োজন ফুরালো!এটাতেই তুই তোর সর প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবি।

গোধূলি ওর হাতে থাকা ডায়েরিটার দিকে ভারাক্রান্ত নয়নে তাকায়।মাথা ঝিমঝিম করছে।বুঝতে পারছে না ওর প্রশ্নের উত্তর ছয় বছর আগের ডায়েরিতে কিভাবে থাকবে!

– আরে ইয়ার এনগেজমেন্ট হয়েছে।এনগেজমেন্ট!বুঝতে পারছিস তুই!এই সম্পর্কের কোনো ভিত্তি নেই!আই সোয়ার,আজকের পর থেকে এই বিষয় নিয়ে তোকে কেউ কোনোদিন কিচ্ছু বলবে না।কেউ তোকে কোনো প্রশ্নও করবে না।আর তুইও কাউকে কিছু জিজ্ঞাস করবি না।তোর সব প্রশ্নের জবাব তুই আমার এই ডায়েরিতেই পেয়ে যাবি।কালকের সকালটাও তুই বাকি সকাল গুলোর মতোই শুরু করবি!আমার মুখ তোকে দেখতে হবে না!আজ যা হয়েছে সেটা কোনো দুঃস্বপ্ন মনে করে ভুলে যাস!

কথা গুলো বলতে বলতেই দীপ্তের গলা ধরে এসেছে।নিজেকে যথাসম্ভব কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে।যতই হোক পুরুষ মানুষের কান্না সাজে না!বুকে পাথর চাপা দিয়ে কথা গুলো বলেছে দীপ্ত।গোধূলির অগোচরে চোখে জলও মুছে ফেলেছে বারকয়েক।দীপ্তের বলা কথার পিছনে গোধূলি তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,

– সব দুঃস্বপ্নই বুঝি ভুলে যাওয়া যায়?

জোরপূর্বক হাসে দীপ্ত। গোধূলির বাম হাতের অনামিকায় থাকা আংটিটা খুলতে খুলতে শীতল কণ্ঠে বললো,

– না হয় একটু চেষ্টা করেই দেখলি!

গোধূলি ওর হাতে দীপ্তের স্পর্শ পেতেই মাথা তুলে দীপ্তের দিকে তাকালো।বাধা দিতে গিয়েও পারলো না।কোন অধিকারে ও বাধা দেবে?অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে? কিন্তু সেটাও তো ও মেনে নিতে পারছে না!তাহলে কোন অধিকারে ও দীপ্তকে বারন করবে?অমঙ্গল হতে পারে তাই বলে?কিভাবে নিজ মুখে বলবে সে কথা?নির্বাক চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া গোধূলির আর কিছুই করার নেই।

– সামান্য একটা আংটির জন্য কারো সামনে তুই অস্বস্তিতে পড় এটা আমি কখনোই চাইবো না!দেখ, আমার কোনো অস্তিত্বই রাখি নি!এখন তুই চাইলেই এই ভিত্তিহীন সম্পর্কটাকে অস্বীকার করতে পারিস!

ভারী কন্ঠে বলা কথাগুলো গোধূলির কর্ণধার এসে পৌছুতেই টপ করে এক ফোটা চোখে জল উষ্ণ গাল বেঁয়ে গড়িয়ে পড়লো ওর চিবুকের উপর।দীপ্ত উঠে দাঁড়ায়।গোধূলি ওর খালি হাতটার দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।দীপ্তের বলা কথাগুলো বারবার কানে বারি খাচ্ছে।মাথাটা চিনচিন করে ব্যাথা করছে।ক্রমশ শরীরটা অবশ হয়ে আসছে।দীপ্ত গোধূলির দিকে তাকায় এক পলক তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হেসে পা বাড়ায় দরজার দিকে।

– গোধূলি!

দীপ্ত চলেই যাচ্ছিলো।কিছু একটা ভেবে দরজার কাছে গিয়ে থেমে যায়।গোধূলি দীপ্তের গলা শুনে পিছনে তাকায়।দীপ্ত ছুটে এসে গোধূলিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।গোধূলি শক্ত হয়ে বসে আছে।সেকেন্ডে দশেক পরেই গোধূলিকে বাহুডোর থেকে আলগা করে ওর দুই গালে হাত রেখে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো দীপ্ত।অশ্রুসিক্ত নয়নে গোধূলির তাকিয়ে কাতর স্বরে বলল,

– নিজের যত্ন নিস।

গোধূলি কিছু বুঝে উঠার আগেই দীপ্ত কথাটা শেষ করে আর এক সেকেন্ডও দেরি না করে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়।গোধূলি স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।কি থেকে কি হয়ে গেলো।এরপরে কি হবে?হাতে থাকা ডায়েরিটা বুকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে!তবে সেই কাঁন্নার কারণ গোধূলির কাছেও অজানা!

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here