ঘায়েল – পর্ব ১৬

0
211

#ঘায়েল
#পর্ব_১৬
#Saji_Afroz
.
.
.
নিজের প্রাণের শহর চট্রগ্রামে ফিরে এলো পুনম। রানবীও তার সাথে এসেছে।
বাসায় এসেছে তারা বেশকিছুক্ষণ হলো। রানবী কে সকলে জামাই আদর দিতে ব্যস্ত।
রানবীর জন্য সকলের আদিখ্যেতা দেখে পুনমের শরীরে জ্বালা করে উঠছে।
যে ছেলেটি তাদের মেয়েকে কষ্ট দিয়েছে, তাকেই নাকি জামাই আদর করা হচ্ছে!
অদ্ভুত তার পরিবারের লোকেরা!
ডাইনিং টেবিলে বসে গরুর মাংস দিয়ে পরোটা খাচ্ছে রানবী।
.
মাহাফুজ ইসলাম তার উদ্দেশ্যে বললেন-
গায়ে হলুদের দিনেই আসলে তোমরা। একটু পর থেকেই মেহমান আসতে শুরু করবে। জামাই আদর তো করা হবেনা আর।
.
রানবী হেসে বললো-
কোনো দরকার নেই জামাই আদরের। ছেলে আদর করলেই চলবে।
-ছেলে আদর মানে?
-মানে আমিতো আপনাদের ছেলের মতোই। ছেলেকে যেভাবে আদর করেন, সেভাবে করলেই চলবে।
.
কথাটি শুনে আফরোজা ইসলাম বললেন-
মাইন্ড করছো না তো তুমি? আসলে জানোই তো এসব কেনো করছি।
-কি যে বলেন না! কিসের মাইন্ড!
.
এসব আর সহ্য করতে পারলোনা পুনম।
চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। হনহন করে এগিয়ে গেলো নিজের রুমের দিকে।
.
তার পিছুপিছু রানবী এসে বললো-
জেলাস?
.
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে পুনম বললো-
তাবিজ করতে জানেন আপনি? সকলে এভাবে আপনার তোষামোদ করছে কেনো?
-তাবিজ করতে জানলে তো তোমাকেই করতাম!
.
হু, যুক্তি আছে কথাটির। সেটি ভেবে পুনম বললো-
তাহলে কি করেছেন?
-ইমপ্রেস করেছি।
-কিভাবে?
-দেখেছোই তো।
-মিথ্যে বলে বলে।
-ভালোবাসার জন্য মানুষ কিনা করতে পারে। আমি নহয় মিথ্যেই বললাম!
-আমার রুম থেকে বেরিয়ে যান।
-কেনো! আমি আমার রুম তোমার সাথে শেয়ার করেছিলাম।
-আমি যেনো আপনার রুমে থাকার জন্য মরছিলাম!
-তবুও…
-শর্ত কি ছিলো মনে নেই? ভাই এর বন্ধু কি করে আমার রুমে থাকবে!
.
কথাটি বলে হাসতে থাকলো পুনম।
রানবী মুখে বিরক্তি এনে বললো-
আমি কোথায় থাকবো তবে?
.
.
.
মাহিমের সাথে তার রুমে আসলো রানবী।
মাহিম বললো-
আমার সাথেই থাকতে পারবে তুমি।
-এক রাতের জন্য? না মানে কাল তো ভাবী আসবে।
-হু। কালকের টা কালকে ভাবা যাবে। আজ অনেক গেস্ট আসবে। মাথায় রেখো, কেউ যেনো কিছু টের না পাই।
-পাবেনা।
.
.
দেখতে দেখতে রাত হয়ে গেলো।
এশারের নামাজের পরেই অনুষ্ঠান শুরু হবার কথা থাকলেও হলোনা।
সেই কখন থেকে পুনম কে দেখছেনা রানবী।
হয়তোবা সাজগোজ নিয়ে ব্যস্ত সে। এই মেয়েগুলোর জন্যই যেকোনো অনুষ্ঠান শুরু হতে দেরী হয়।
কিন্তু কথা সেটা না। কথা হচ্ছে রানবী অনেকক্ষণ যাবৎ পুনমের দেখা পাচ্ছেনা। তাই মনের মাঝে অস্থিরতা কাজ করছে।
একবার কি পুনমের রুমে গিয়ে দেখবে সে?
ভাবতে ভাবতেই একদল মেয়ের আগমন ঘটলো উঠোনে।
গায়েহলুদের আয়োজন বাড়ির সামনের উঠোনেই করা হয়েছে।
এতোগুলোর মেয়ের মাঝে পুনম কে চিনতে দেরী করলোনা রানবী।
সে যা ভেবেছিলো তার উল্টোটা হয়েছে। ভারী কোনো সাজে পুনম সাজেনি।
সোনালী ব্লাউজের সাথে সুতির একটা কমলা রঙের শাড়ি পরে, লম্বা চুলগুলো ছেড়ে দিয়েছে সে।
চোখে ঘাড় কাজল, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, কানে ঝুমকো, হাতে কাঁচের চুড়ি আর পায়েল পরিহিতা পুনম কে তার কাছে অপসরীর মতোই লাগছে।
পুনমের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রানবী বললো-
আরো একবার ঘায়েল হয়ে গেলাম!
.
.
কেক কাটার পর্ব শুরু হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হলো।
একে একে সকলে মাহিম কে কেক খাইয়ে আসলো।
এরপরে শুরু হলো সাউন্ড বক্সে গান।
অনেকক্ষণ হিন্দি গান শুনতে শুনতে রানবীর কান যেনো ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে।
সে মনেমনে একটা বুদ্ধি আটলো।
পুনম কে ইমপ্রেস করার মতোই বুদ্ধি এটি।
.
এতোক্ষণ হিন্দি গান চললেও হঠাৎ করেই একটা বাংলা গান চলছে।
-মাশাআল্লাহ, তোর জেল্লা আমায় ঘায়েল করেছে!
.
সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো, এই গানটিতে রানবী স্টেজে একা নাচছে।
সকলেই অবাক হয়ে দেখছে তাকে।
বাংলাদেশের ছেলেও যে এতো ভালো নাচতে পারে জানা ছিলোনা তাদের।
পুনম এক দৃষ্টিতে তার নাচ দেখে চলেছে।
এদিকে আফরোজা ইসলাম ও মাহিমের কাছে সবাই জানতে চায়ছে, কে ছেলেটি।
মাহিমের বন্ধু বলাতে মাহিমের এক বন্ধু বললো-
ওকে তো কখনো দেখিনি। কখন তোর বন্ধু হলো রে?
-হয়েছে আর কি।
.
নাচ শেষ হবার পরেই বিয়ে বাড়ির সকলেই যেনো তার ভক্ত হয়ে গেলো।
রানবী মিশুক বলে সবাই কে আপন করে নিলো।
এদিকে তার উপর ঘায়েল হয়ে গিয়েছে পুনমের পাড়ার এক বান্ধবী। যার নাম রুম্পা।
পুনমের কাছে এসে সে বললো-
মাহিম ভাইয়ার এই বন্ধুটিকে আগে কখনো দেখিনি। কি নাম ছেলেটির?
-রানবী।
-কি! রানবীর! ও মাই গড! তাই তো বলি, রানবীর কাপুরের সাথে এতো মিল কেনো।
-রানবীর নয় রানবী।
-সে যাই হোক। মিল আছে। স্টেজে যখন ডান্স করছিলো, মনে হচ্ছিলো বাংলাদেশের রানবীর কাপুর ডান্স করছে। ইশ! ইন্ডিয়ার থেকে বাংলাদেশ কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। এই দেশেও রানবীর কাপুর আছে। তাদের যদি দেখাতে পারতাম!
.
রুম্পা যে চরম মাত্রায় ইন্ডিয়ার নায়ক রানবীর কাপুরের ভক্ত তা জানাই আছে পুনমের। কিন্তু সে যে রানবী ভক্তও হয়ে যাবে এটা ভাবেনি।
এতোজনের মুখে রানবীর প্রশংসা শুনে ভালো লাগলেও, রুম্পার কাছে এসব কথা শুনতে ভালো লাগছেনা পুনমের। তাই সে উঠে সোজা রানবীর কাছে গেলো।
-কি দরকার ছিলো ঢেইঢেই করে নাচার?
-নাচ জানি তাই নেচেছি।
-নাকি মেয়েদের ইমপ্রেস করার জন্য?
-মানে?
-মেয়েরা যে রানবী রানবী করছে এসব শোনার জন্যই তো নাচতে গেলেন।
.
দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে রানবী বললো-
কোন মেয়েটি প্রশংসা করেছে? না মানে একটু লাইন মারতাম আরকি। তুমি তো পাত্তা দাওনা আমাকে।
.
বলতে বলতেই রুম্পা হাজির হলো এখানে।
পুনম তাকে দেখিয়ে বললো-
এই যে ও। চরম ভক্ত হয়ে গেলো আপনার।
.
রুম্পা বললো-
হ্যাঁ রানবী। আমি তোমার চরম ভক্ত হয়ে গিয়েছি। আমিও না ভালো নাচতে পারি। আসোনা এক সাথে নাচি?
.
পুনম ভ্রু জোড়া কুচকে বললো-
রানবী মানে? নাম ধরে ডাকছিস যে?
-উহু পুনম! রানবী তোর ভাই এর বন্ধু তুই ভাই ডাক। আমি কেনো ডাকবো?
.
কোনো কথা বললো না পুনম।
এদিকে রানবীর সাথে সেলফি তোলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো রুম্পা।
পুনম হনহনিয়ে এগিয়ে গেলো নিজের রুমের দিকে।
সে সারারুমে পায়চারি করছে। রানবীর প্রতি রুম্পার এমন ব্যবহার কেনো যেনো ভালো লাগলো না পুনমের।
কিন্তু কেনো লাগছে না? তবে কি সে….
না, না।
রানবী একটা প্রতারক। এটা সবসময় মাথায় রাখতে হবে। আর একজন প্রতারক কে শাস্তি দেয়াই শ্রেয়।
.
.
.
বিয়েটা সম্পন্ন হলো ভালোভাবেই কোনো ঝামেলা ছাড়া।
ইপশিতা কে বউ হিসেবে পেয়ে পুনমের পরিবারের সকলেই ভীষণ খুশি।
ইপশিতাকে বসানো হয়েছে মাহিমের রুমে।
একেএকে নতুন বউ এর মুখ দেখছে মেহমানরা।
সেসব দৃশ্য যেনো বড়ই সুন্দর!
বিয়ে বুঝি এটাকেই বলে!
চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু চলে এলো পুনমের।
ভাই এর রুমে থেকে বেরিয়ে এসে নিজের রুমে আসলো পুনম।
-কি হয়েছে তোর?
.
বড় ভাই এর প্রশ্নে চোখের পানি মুছে জবাব দিলো পুনম-
কিছুনা।
-আমাকেও বলবি না?
.
খানিকক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে শান্ত করে পুনম বললো-
আচ্ছা ভাইয়া, তুমিও তো প্রেম করে বিয়ে করেছো। তাহলে নিজের বোন যখন প্রেম করছে শুনেছো, তবে এমন রিয়াক্ট করলে কেনো? এমন না করলে হয়তো এভাবে আমি রানবীর উপর রাগ ঝাড়তাম না। সেও আমাকে বিয়েটা এইভাবে করতো না।
.
এর উত্তর দিতে পারলোনা মাহিম।
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বেরিয়ে পড়লো সে।
তবে ভেতরে প্রবেশ করলো রানবী।
পুনমের পাশে এসে বললো সে-
তোমার বিয়ে ধুমধাম ভাবেই হবে আবার।
.
পুনম নিশ্চুপ। রানবী মুচকি হেসে বললো-
তোমার ভাই এর বিয়েতে সাউন্ড বক্স বেজেছে, তোমারটাই ব্যান্ড হবে ব্যান্ড।
.
রানবীর কথা শুনে হেসে ফেললো পুনম।
হঠাৎ দরজার পাশে এসে রুম্পা বললো-
ওহ তোমরা এখানে! ডাকছে তোমাদের।
.
পুনম জিজ্ঞেস করলো-
কে?
-আসলেই দেখবে। তবে দুজনকেই ডাকছে।
.
পুনম রানবীকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে এগিয়ে আসতেই দেখা পেলো সালাউদ্দিনের।
রানবী না চিনলেও পুনম চিনতে পারলো তাকে।
সে সালাম দিতেই সালাউদ্দিন হেসে বলে উঠলেন-
ভালো আছো মা? অনেকদিন পর দেখলাম তোমাকে।
-জ্বী আছি।
.
রানবীর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন-
তুমি কি রানবী?
-জ্বী।
.
মাহাফুজ ইসলামের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন-
আজ কিন্তু মাকে দেখতে আসছি শুধু তা নয়। আরেকটা প্রস্তাব নিয়ে আসছি।
-কি?
-আমার বোনের মেয়ে রুম্পা, রানবী কে পছন্দ করছে। আমি আবার সোজা কথা বলার মানুষ। তাই বলছিলাম কি রানবী কে রুম্পার জামাই বানাতে চাই।
.
কথাটি শুনে উপস্থিত সকলের চোখ যেনো কপালে উঠে গেলো।
মাহাফুজ ইসলাম কেশে উঠলেন। তার মেয়ের জামাই এর জন্য কিনা শেষমেশ বিয়ের প্রস্তাব আসলো!
.
সালাউদ্দিন রানবীর দিকে তাকিয়ে বললেন-
রুম্পার সাথে ভালো থাকবে তুমি। ওদের টাকা পয়সার কোনো অভাব নাই। তাই তুমি ছাত্র এটা নিয়ে কোনো সমস্যা নাই।
.
আফরোজা ইসলাম বলে উঠলেন-
ওকে বিয়ে দিবেনা এখন ওর পরিবার।
-আরে আমি নিজে যাবো ঢাকা ওদের বোঝাতে। রানবী তুমি কি বলো? আমি কিন্তু না শুনতে একদম পছন্দ করিনা।
.
সবার চোখে মুখে একটা আতঙ্ক দেখলো রানবী।
কিন্তু পুনম মুচকি মুচকি হেসে চলেছে।
সে ফিসফিসিয়ে বললো-
আরো ডান্স করেন। এবার মজা বুঝেন।
.
রানবী ভাবলো পুনম কে শিক্ষা দেয়ার জন্য হলেও বিয়েটাতে রাজি হতে হবে।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here