ঘায়েল – পর্ব ১১

0
228

#ঘায়েল
#পর্ব_১১
#Saji_Afroz
.
.
.
নুসাইবা কে সাজিয়ে দিয়েছে নাতাশা। তাকে দেখতে পরীর চেয়ে কোনো অংশে কম সুন্দর লাগছেনা। কিন্তু এই পরীটার মুখটা কেনো ফ্যাকাসে হয়ে আছে জানা নেই নাতাশার।
নুসাইবার পাশে বসে নাতাশা বললো-
এভাবে মুখ ভার করে আছিস কেনো? আমি কষ্ট পাচ্ছিনা, পাবোও না। তখন একটু বেশিই বলে ফেলেছি। সরি রে!
.
মৃদু হেসে নুসাইবা বললো-
তুই সরি বলিস না আপু। আর আমি ঠিক আছি।
.
ফোন বেজে উঠলো নুসাইবার।
স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো রানবীর ফোন।
রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে রানবী বললো-
বর আসতে চলেছে তোমার। তৈরী হয়েছো তো?
-হু।
.
নাতাশার সামনে কিছু না বললেও নুসাইবার মনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
যেদিন রানবীর পরিবার তাকে দেখতে এসেছিলো, রানবী ও তাকে আলাদা কথা বলতে দেয়া হয়েছিলো
রানবী কে নিজের সমস্যার কথা সবটাই বলে নুসাইবা।
তার বফ এর বাসায় তাদের সম্পর্ক টা মেনে নেওয়ানোর দায়িত্ব নিয়েছিলো রানবী।
তবে আজ সেই কেনো এনগেজমেন্ট টা করতে আসছে!
তবে কি সেই বিয়েটা করতে চায়!
এতোবড় ধোকা টা রানবী দিতে পারলো তাকে!
অবশ্য পারবে টাই বা না কেনো?
সেতো এমনি..
তার কথাও বলেও কি লাভ! যেখানে তার বফ নিজের পরিবার কে রাজি করাতে পারেনি।
অবশেষে এই ৪২০ আর বোনের প্রাক্তন প্রেমিকই তার ভাগ্যে জুটলো!
.
.
সাবিনা, সবুজ ও খায়রুনের সাথে সাদ্দামের বাসায় প্রবেশ করলো রানবী বেশ কিছুক্ষণ হলো।
এদিকে নুসাইবা কে নিয়ে আসলো নাতাশা।
নুসাইবা কে বসানো হলো রানবীর পাশে।
রানবী খেয়াল করলো, নুসাইবা মুখটা ফ্যাকাসে করে রেখেছে।
রানবী তার উদ্দেশ্যে ফিসফিসিয়ে বললো-
আমি দেখতে কি তোমার বফ এর চেয়েও খারাপ? না মানে, আমার সাথে এনগেজমেন্ট হচ্ছে বলে মনেহচ্ছে তুমি খুশি না।
.
এদিকে রানবীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নাতাশা।
মনেহচ্ছে নিজের মনে রানবীর চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে যাচ্ছে সে।
.
সাদ্দাম বলে উঠলো-
এবার তাহলে এনগেজমেন্ট শুরু করা যাক?
.
রানবী দাঁড়িয়ে বললো-
কিন্তু আসল বর তো আসেনি।
-আসেনি মানে?
-নুসাইবার হবু বর তো আসেনি!
.
কথাটি শুনে চমকে গেলো সকলেই।
সাদ্দাম হেসে বললো-
মজা নিচ্ছো কেনো ভাই! হবু বর তো তুমিই।
-আমি নয়।
.
কথাটি বলতেই সদর দরজা দিয়ে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করলো কয়েকজন।
তাদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো নুসাইবা।
সাদ্দাম বললো-
এরা কারা?
.
রানবী নুসাইবার বাবার পাশে এসে বললো-
আপনি নিজের মেয়ের জন্য একটা ভালো ছেলেই খুঁজেছেন। তাইতো আমি এখনো স্টুডেন্ট জেনেও বিয়েটাতে রাজি হয়েছেন?
-হু।
.
নুসাইবার বফ এর দিকে দেখিয়ে দিয়ে রানবী বললো-
নুসাইবা ভালোবাসে এই ছেলেটিকে। একটা স্টুডেন্ট হয়ে এই সময়ে বিয়ের কথা বাসায় জানানোটা সবার পক্ষে পসিবল হয়না। নুসাইবার বফ এর পক্ষেও তা হয়নি। এদিকে নুসাইবার বিয়ে নিয়ে তাড়া দিচ্ছেলেন আপনারা। এসব সবই নুসাইবার কাছ থেকে জানা। আর তাই সেদিন বিয়েতে রাজি হবার নাটক করেছি আমরা। যাতে করে ওর বফ এর পরিবারের সাথে আমি কথা বলে সব বুঝাতে পারি। দুটো মানুষ যেখানে একে অপরকে ভালোবেসেছে, এক সাথে থাকতে চায় সেখানে বয়স কিসের সমস্যা! তবুও যদি তাই মনেহয় এখন এনগেজমেন্ট বা আকদ করিয়ে রাখলে পরে নাহয় বউ তুলে নিবে ঘরে।
.
নুসাইবার প্রেমিকের এর মা বলে উঠলেন-
এসবই আমাদের রানবী বুঝিয়েছে ভাই সাহেব। আপনার শরীরের কথাও বলেছে। মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় আছেন আপনি। আমি সবটা বুঝেছি। তাই ডিসিশন নিয়েছি, নুসাইবার সাথে ছেলের এনগেজমেন্ট করিয়ে রাখি এখন। ছেলে স্যাটেল হলেই নাহয় ধুমধাম করে বিয়েটা হবে।
.
নুসাইবার বাবা হেসে বললেন-
নুসাইবা খুশি থাকলেই হলো।
.
কথাটি শুনে নুসাইবার চোখটা ছলছল করে উঠলো।
নাতাশা তার পাশে এসে বললো-
আমাকে কেনো বলিস নি তুই অন্য কাউকে ভালোবাসিস?
-কেননা তুই প্রেমের উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিস।
-কিন্তু তোকে দেখে বিশ্বাস টা আবার জন্ম নিয়েছে। তোর জন্য অনেক খুশিরে আমি। আমার প্রেম পূর্ণতা না পেলেও তোরটা পেতে চলেছে।
.
রানবী নাতাশাদের দিকে তাকাতেই নাতাশা ইশারা করে বললো-
ধন্যবাদ।
.
রানবী মৃদু হেসে বললো-
এনগেজমেন্ট শুরু করা যাক?
.
.
.
অনেকক্ষণ যাবৎ পুনমের পাশে বসে আছে রিমা।
পুনম সেই কখন থেকেই নিচের দিকে দৃষ্টি রেখে এক জায়গায় বসেই আছে!
রিমার নিজেরই বিরক্ত লাগছে। তাই সে বলে উঠলো-
ভাবী তোমার বিরক্ত লাগছেনা এভাবে বসে থাকতে? না মানে হাটাহাটি করো একটু!
.
নিশ্চুপ পুনম।
রিমা তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো-
পানি খাবে?
.
হঠাৎ রুমে প্রবেশ ঘটলো আনোয়ারা ইসলামের।
তিনি পুনমের পাশে বসে বললেন-
তোমাকে আমার ছেলেটা ভালোবেসেই বিয়েটা করেছে। রাগ করে থেকোনা আর। কোনো অযত্ন ও হতে দিবেনা তোমার।
.
আনোয়ারা ইসলামের কথাতে অবাকই হলো পুনম।
সে বললো-
আপনি ওর আসল মা তো?
না মানে ছেলের ভুল ধরিয়ে না দিয়ে তার হয়েই সাফাই গাইছেন? আমি তো বিয়ের জন্য পাগল হয়ে যাইনি। আপনার ছেলেই আমাকে জোর করে বিয়েটা করেছে। যত্নে রাখলেও থাকবোনা আমি। চলে যেতে চাই আমি। পারলে সেই ব্যবস্থা করুন। নাহলে জ্ঞান দিতে আসবেন না।
.
-আমার মায়ের সাথে এভাবে কথা বলবেনা তুমি। যা করার আমি করেছি উনি নয়।
.
রানবীর কথায় দাঁড়িয়ে পড়লো তার মা ও রিমা।
আনোয়ারা ইসলাম বললেন-
থাক বাবা…
-না থাকবেনা। তুমি নিজের রুমে যাও। ওকে বিষয়টা ভালো করেই বুঝিয়ে দিচ্ছি আমি।
.
আনোয়ারা ইসলাম ও রিমা রুমের বাইরে যেতেই পুনমের হাত ধরে টেনে, তাকে বসা থেকে উঠালো রানবী।
গম্ভীর গলায় বললো-
আমার কাছে সব কিছুর উপরে আমার মা। সেটা আমার ভালোবাসার উপরেও।
.
তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিয়ে পুনম বললো-
ভালোবাসা? তাই অন্যজনের হাতে আন্টি পরাতে গিয়েছিস?
.
কথাটি শুনে রাগ যেনো কমে গেলো রানবীর। দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে বললো-
জেলাস তুমি?
-আমি কেনো জেলাস হবো বাল!
-বাল! তুমি এসব জানো?
-আমাকে দেখে কি হুজুরনি মনেহয়? আরো অনেক কিছুই জানি। শুনবি?
-না দরকার নেই বাবা! তবে যেটা জানোনা সেটা জেনে নাও।
-কি?
-নুসাইবার সাথে এনগেজমেন্ট হইনি আমার।
.
কথাটি শুনে পুনম রেগেমেগে বললো-
একটা মেয়েকে বসিয়ে রেখে তার আশা ভঙ্গ করতে বিবেকে বাধলোনা তোর?
.
রানবী অবাক হয়ে বললো-
এই যা! রিং পরালেও দোষ না পরালেও দোষ!
.
চুপ হয়ে আছে পুনম।
আচমকা রানবী তাকে নিজের কাছে টেনে এনে বললো-
নুসাইবার আশা ভঙ্গ হয়নি। বরং পূরণ হয়েছে। ওর বফই ওর আঙুলে রিং পরিয়েছে। আর ওদের এনগেজমেন্ট টা হতে সাহায্য করেছি আমি। বুঝেছো?
.
পুনম গলার স্বর শান্ত করে বললো-
ছাড় আমাকে।
.
পুনমের গলা থেকে মালাটা সরিয়ে রানবী বললো-
ভালোবেসে পরিয়েছি বলে এতো ভারী মালাটা সরাতে ইচ্ছে করছেনা?
.
পুনম বিরক্তিভরা কণ্ঠ নিয়ে বললো-
বাল!
.
.
.
বেশ খানিকক্ষণ কেটে গেলো।
খায়রুন একটা শাড়ি নিয়ে এসেছে পুনমের জন্য।
পুনম এখনো বিছানার উপরেই বসে আছে।
খায়রুন তার উদ্দেশ্যে বললো-
গোসল করে ড্রেসটা বদলে নাও। ঘেমে একাকার হয়ে গেলে তো।
.
পুনম শাড়ি দেখে বললো-
হু কিন্তু আমি শাড়ি পরতে জানিনা।
-আমি তো জানি। পরিয়ে দিবো। তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি এখানেই বসছি।
.
.
পুনম গোসল সেরে আসার পরেই খায়রুন নিজের হাতে শাড়ি পরতে সাহায্য করলো তাকে।
চুলগুলোও মুছে দিলো ভালোভাবে।
খায়রুনের এমন আচরণে তার জাহারা ফুফুর কথা মনে পড়ে গেলো।
জাহারা বা তার বাসার কেউ খবর নিচ্ছেনা কেনো?
তারা কি সবাই ভুল বুঝেছে পুনম কে!
ভাবতে ভাবতেই রুমের ভেতরে প্রবেশ করলো সাবিনা। হাতে তার ভাতের প্লেট।
টেবিলের উপর রেখে পুনমের উদ্দেশ্যে বললো-
খেয়ে নাও। অনেক তো ধকল গেলো।
.
তাদের সবার আচরণ দেখে পুনম বেশ অবাকই হচ্ছে।
প্রত্যেকের আচরণ খুবই স্বাভাবিক। মনেহচ্ছে কিছুই ঘটেনি, বিয়েটা যেনো হবারই ছিলো!
.
খায়রুন ও সাবিনা বেরিয়ে যাচ্ছে।
পুনম তাদের থামিয়ে বললো-
রানবী এমন একটা কান্ড করলো। ওর উপর রাগ হচ্ছেনা আপনাদের?
.
খায়রুন হেসে জবাব দিলো-
বিয়েই তো করে এনেছে। এতে রাগ করার কি আছে!
.
খায়রুনের কথার কোনো মানে পুনম খুঁজে পেলোনা।
তবে যাই হয়ে যাক এখানে সে থাকবেনা।
.
.
নিজের রুমে এসে স্বামী জাফরের দেখা পেলো খায়রুন। অনেকক্ষণ পরেই সে বাসায় এসেছে। দেখতে তাকে খুব গম্ভীরই লাগছে।
খায়রুন তার পাশে বসে বললো-
মাথা ঠান্ডা হয়নি?
-কি করে হবে! এতো বড় একটা কান্ড ঘটিয়েছে রানবী। এখানে নুসাইবার দোষ কি! সে বেচারী কতো আশা নিয়ে বসে ছিলো।
.
জাফরের কথা শুনে উচ্চশব্দে হেসে উঠলো খায়রুন।
জাফর অবাক হয়ে বললো-
হাসছো কেনো?
-নুসাইবা আশা নিয়ে বসে ছিলো। তবে রানবীর জন্য নয়। ওর বফ এর জন্য।
-মানে টা কি!
.
খায়রুন সব খুলে বলতে লাগলো জাফর কে।
.
.
.
রাতের খাবারের পর দেয়ালে টাঙানো বাবার ছবিটা তুলে নিলো রানবী।
ছবিটি মায়ের হাতে দিয়ে বললো-
কিছুদিন ছবিটা তোমার কাছেই রাখো।
.
আনোয়ারা ইসলাম বললেন-
হু।
.
.
একটু পরেই নিজের রুমে এলো রানবী।
সে দেখলো, গুটিসুটি হয়ে বসে আছে পুনম।
শাড়ি পরিহিতা পুনম কে দেখে বউ বউ লাগছে রানবী এর।
লাগছে মানে! পুনম তো ওর বউই!
কথাটি মনে হতেই ফিক করে হেসে দিলো রানবী।
পুনম চোখ রাঙিয়ে বললো-
অহেতুক হাসার মানেটা কি?
-কোমর ব্যাথা করছেনা এতোক্ষণ বসে থাকতে?
-নাহ।
.
টেবিলের উপরে চোখ পড়তেই রানবী দেখলো, ভাতের প্লেট টি।
প্লেট ভর্তি খাবার রয়েছে। তার মানে পুনম খায়নি কিছুই।
-খাবারের সাথে রাগ করতে নেই।
.
কোনো জবাব পুনম দিলোনা।
শুয়ে পড়লো বিছানার উপরে।
রানবী এসে তার পাশে শুতে চায়লে সে বসে চেঁচিয়ে বলে উঠলো-
আমার পাশে শুবিনা তুই।
-সিরিয়াল পেয়েছো? বিবাহিতা বউ এর পাশে না শুয়ে সোফাতে বা মেঝেতে পাটি বিছিয়ে শুবো?
-কেনো! রিয়েল লাইফে এভাবে শোয়া যায়না?
-গেলেও আমি পারবো না। কেননা আমার রুমে না আছে সোফা না আছে পাটি। আর বিছানা টা আমার। সো আমি এখানেই শোবো। তোমার ইচ্ছে হলে ফ্লোরে শুতে পারো।
.
কোলবালিশ টা মাঝখানে রেখে পুনম বললো-
মাঝখানে এটা থাক।
.
রানবী শুয়ে জড়িয়ে ধরলো কোলবালিশ টাকে।
পুনম ভ্রু জোড়া কুচকে বললো-
এটা জড়িয়ে দরার কোনো দরকার আছে কি?
-বিয়ের পরে বউ কে জড়িয়ে ধরে ঘুমোবো ভেবেছিলাম। বউ তো দিবেনা। তাই আমি কোলবালিশকেই সঙ্গী বানালাম।
.
আর কথা না বাড়িয়ে ওপাশ ফিরে চুপচাপ শুয়ে পড়লো পুনম।
জানেনা কখন মুক্তি পাবে সে এসব থেকে!
.
.
ভোর ৬টা…
রুমের মাঝে পায়চারী করছে পুনম।
সারারাত ঘুম হয়নি পুনমের।
কিন্তু রানবীর ভালোই ঘুম হয়েছে। এখনো সে ঘুমিয়ে রয়েছে।
জানালার পর্দা ভেদ করে আলো এসে পড়লো রানবীর মুখে।
তার মুখটা ঘুমের মাঝেই ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে।
রোদ পড়ার কারণেই এমন হচ্ছে বুঝতে পারলো পুনম। তাই সে পর্দাটা ভালোভাবে টেনে দিলো, যাতে রানবীর ঘুম না ভাঙ্গে।
তারপর রানবীর দিকে তাকিয়ে সে বললো-
তোর ঘুমটা ভাঙ্গলে আমারই সমস্যা। তাই ভাঙলাম না। থাপ্পড় দেয়াই প্রতিশোধ নেবার জন্যই আমাকে বিয়েটা করলি তুই। নাহলে তোর মতো ৪২০ছেলে কাউকে ভালোবাসতে পারেনা। বিয়ে তো জোর করেই করেছিস। সংসারও কি জোর করে করবি!
নাহ, পারবিনা। এখুনি চলে যাচ্ছি আমি।
.
.
ঘুম ভাঙ্গার পর পুনম কে দেখতে না পেয়ে, রানবী এর বুকটা ধুক করে উঠলো।
সারাবাড়ি খুঁজেও সে পেলোনা তার বউ কে।
কাল বিয়ে হলো আর আজই বউ গায়েব!
.
(চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here