ঘায়েল – পর্ব ১

0
550

#ঘায়েল
#পর্ব_১
#Saji_Afroz
.
.
.
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। এটা যেনো স্বপ্নের শহর!
দূর-দূরান্ত থেকেও মানুষ এসে বসবাস করে এখানে।
আবার ঢাকার একটি প্রাণকেন্দ্র হলো পুরান ঢাকা। যেনো নতুনের মাঝে পুরানের ছোঁয়া এখানে।
এই ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকার ধোলাইখালের ছেলে রানবী।
রানবী…
মা-বাবা বড্ড আদরের ছেলে সে।
যদিও তার আরো তিনটে ভাই বোন আছে। তবে সব মা বাবার কাছেই তার সন্তান আদরের হয়, সন্তানের সংখ্যা অত্যধিক হলেও। রানবী সবার চেয়ে আলাদা। চঞ্চল একটা ছেলে। বাসায় ভদ্র হলেও
বাইরে তাকে সবাই ৪২০নামেই ভালো চিনে। কেননা সে যে এই নিয়ে কতোটা প্রেম করেছে তা অগণিত!
কিন্তু কারো সাথেই সে বেশিদিন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পারেনা।
সে একজনেই সন্তুষ্ট নয়। প্রেম একজনের সাথে করলেও চোখ থাকে অপরজনের উপর।
এমন স্বভাবের ছেলের সাথে কোন মেয়েই বা থাকতে চায়বে!
তাই তার কোনো সম্পর্কই বেশিদিন টিকেনা। এতে আবার তার কোনো আফসোস নেই। এটাই যেনো তার কাছে মজার ব্যাপার! অবাক করার বিষয় হলো, তার সম্পর্কে সব জানার পরেও মেয়েরা তার প্রেমে পড়তে বাধ্য হয়।
কিন্তু সম্পর্ক হবার পরেই অতিষ্ট হয়ে যায়।
এই ছেলেটা যেমন মেয়েদের প্রেমে ফেলার ক্ষমতা রাখে তেমনি অতিষ্ঠ হবারও ক্ষমতা রাখে।
পুরান ঢাকার ‘কবী নজরুল সরকারী কলেজ’ এর মনোবিজ্ঞান নিয়ে সে অর্নাস করছে। বর্তমানে অনার্স চতুর্থ বর্ষের ছাত্র সে। তাই বড় ভাই হওয়াই কলেজে তার দাপটও খাটে প্রচুর।
.
.
আজ কলেজে পা রেখেই বন্ধুদের উদ্দেশ্যে রানবী বললো-
আজ ছয় দিন হলো, আমার কোনো গফ নেই। এই খেয়াল তোদের আছে কি?
.
বন্ধুদের মাঝে একজন বলে উঠলো-
অনার্স প্রথম বর্ষে লাইন ধরে ধরে মাইয়া এডমিশন নিচ্ছে দোস্ত। ওখান থেকে একটা চলবে নাকি?
-মেয়ে হলেই চলবে না আমার। অবশ্যই বড় ঘরের মেয়ে হতে হবে। যাতে তার পেছনে আমার কোনো খরচ না হয়। আর আমি তার পেছনে ঘুরতে পারবোনা। সেই আমার পেছনে ঘুরতে বাধ্য হবে আমার লুক দেখে। যাক, এসব তোদের অজানা নয়।
কিন্তু রানবী যে গফ ছাড়া ছয়দিন আছে! এর চেয়ে লজ্জাজনক তোদের কাছে আর কি হতে পারে?
.
বন্ধু মহলের মাঝে রানবী এর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হলো আকিব।
আকিব তার উদ্দেশ্যে বললো-
আসলেই লজ্জাজনক।
এই ছয়দিনে কোনো মেয়ে তোকে প্রপোজ করলোনা! ভাবা যায়!
.
হালকা কেশে রানবী বললো-
আমি চাইনি তাই করেনি।
-তুই চাসনি! কেনো?
-সাইকোলজির ভাষায় একটা কথা আছে।
-কি?
-মাঝে মাঝে, একা থাকা দরকার। নিজের অবসর সময় উপভোগ করার
জন্য ।
-তাই!
-জ্বী তাই আমি কিছুদিন একা ছিলাম। আর তাই এতো লজ্জা না করে গফ খুঁজ আমার জন্য।
-দোস্ত হেব্বি বড় লোকের একটা মেয়ে এই কলেজে এডমিশন নিয়েছে।
-বড় লোক কি করে বুঝলি?
-কার করে সেদিন আসতে দেখেছি তাকে। ফলোও করেছিলাম।
-তাই নাকি!
-হু। চলবে?
-রানবী শুধু মেয়ের গাড়ি আছেই শুনে পটে যাবে কি করে ভাবলি! তাকে অবশ্যই দেখতে হবে আমার। আমার সাথে ওকে কেমন মানায় না দেখেই রাজি কি করে হবো!
-তবে আয় ব্যাট্যা।
-কোথায়?
-গেইটের কাছে চল। ওদের ক্লাসের সময় হয়ে আসছে। নিশ্চয় মেয়েটি আসবে এখন।
-পাক্কা?
-আরে পাক্কা। চল তো তুই। সে না আসলেও আরেকটা খুঁজবো। চল।
.
আকিবের কথামতো সকলে এগিয়ে গেলো মেইন গেইটের দিকে।
.
.
.
অনেকক্ষণ হয়ে গেলো.. কিন্তু যার জন্য তারা অপেক্ষা করছে তার দেখা পেলোনা এখনো।
রানবী ভ্রু জোড়া কুচকে আকিবের উদ্দেশ্যে বললো-
কোথায় তোর বড় লোকের মাইয়া?
-আসার তো কথা। আসলে…
.
আকিব খেয়াল করলো যে মেয়েটির কথা সে বলেছিলো, সে চলে এসেছে।
গাড়ি থেকে নামছে সে।
রানবী এর উদ্দেশ্যে আকিব বললো-
ওই দিকে দেখ ব্যাটা। এই সেই মেয়ে। যেমন সুন্দর তেমন বড় লোকও মনেহয়!
.
পরণে টপস আর জিন্স, স্ট্রেইট কালার করা খোলা চুল, চোখে সানগ্লাস, পায়ে হাই হিল, হাতে ব্যাগ নিয়ে একটা মেয়ে এগিয়ে আসছে রানবীদের দিকে। সবার দৃষ্টি মেয়েটির দিকে হলেও রানবী দৃষ্টি তার দিকে নয়। তার পেছনেই রিকশা থেকে নেমে এগিয়ে আসছে অন্য একটি মেয়ে।
সাদা প্লাজো ও গোলাপি রঙের কামিজ পরণে, চুলে বেণি করে এক পাশে এনে দেয়া আরেকপাশে উড়নাটা, চোখে কাজল, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, হাতে ঘড়ি ও কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দ্রুতবেগে এগিয়ে আসছে মেয়েটি।
.
.
রানবী এর উদ্দেশ্যে আকিব বললো-
শালা ওদিকে কি তাকিয়ে আছিস হা করে? এই মেয়ে তো গেলো বলে!
.
রানবী পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে চুলে বেণি করা মেয়েটির দিকে।
আর বিড়বিড় করে বলছে-
ইশ! ঘায়েল হয়ে গেলাম।
.
ততক্ষণে ওই মেয়েটি কলেজের ভেতরে প্রবেশ করে ফেললে আকিব বললো-
গেলো গেলো! চলে গেলো মেয়েটি। আর তুই কিনা একবারো তাকালি না?
.
এদিকে এই মেয়েটি কলেজের ভেতরে প্রবেশ করতে চেয়েও করলোনা।
কলেজের নাম দেখে সে বললো-
এটা তো মহানগর কলেজ না!
.
মেয়েটির কথা যেনো স্পষ্ট শুনতে পেলো রানবী।
খানিকটা তার পাশে এগিয়ে এসে বললো-
পাশেই মহানগর কলেজ।
.
মৃদু হেসে মেয়েটি জবাব দিলো-
ওহ! ধন্যবাদ।
.
কথাটি বলেই মেয়েটি এগিয়ে গেলো সামনের দিকে।
আকিব রা রানবী এর পাশে এসে বললো-
চল ভেতরে চল, ক্লাসে গিয়ে ওই মেয়ের খবর নিই।
.
রানবী দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে বললো-
তার ঠোঁটের উপরের সেই তিল, কেড়ে নিলো আমার এই দিল!
.
আকিব ভ্রু জোড়া কুচকে বললো-
আমি তো কতো পাশ থেকেই মাইয়াডারে দেখলাম। কই কোনো তিল ফিল তো দেখলাম না। যাই হোক ক্লাসে চল ওই মেয়ের। সে কোন ডিপার্টমেন্টের তাও জানি।
-মহানগর কলেজে যাওয়া যাবেনা?
.
সব বন্ধুই একইসাথে জিজ্ঞাসা করলো-
ওখানে কেনো? আর ওটা তো মহিলা কলেজ।
-আমি এই মেয়েটির সাথে প্রেম করবো।
.
.
.
প্রায় ৩০মিনিট পার হয়ে গেলো।
রানবী এর কথার মানে কেউই বুঝলোনা। রানবী হঠাৎ এমন একটা সাদাসিধে মেয়ের সাথে কেনো প্রেম করতে চায়ছে, তাদের মাথায় আসছেনা।
রানবী নিজে দেখতে ইন্ডিয়ার নায়ক রানবীর কাপুরের মতো। তাই যেকোনো মেয়েই তার প্রেমে ফেঁসে যায়। কিন্তু সে যে কারো প্রেমে ফাঁসবে এটা যেনো কেউ মানতে রাজিই না।
আকিব, বাদশা, রনি সবাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।
রানবী তাদের উদ্দেশ্যে বললো-
এতোদিন আমি প্রেমে পড়েছি কিন্তু আজ আমি ঘায়েল হয়েছি।
.
রনি বললো-
মানেটা কি?
-এতোদিন কোনো মেয়েই আমাকে ঘায়েল করতে পারেনি। কিন্তু এই মেয়েটি করেছে। আমার একে লাগবে।
-কিন্তু দোস্ত এই মেয়ে প্রেম ট্রেম করবে বলে কি মনেহয়? মনেহচ্ছে সাদাসিধা ফ্যামিলির মেয়ে। ওকে নিয়ে মজা করা তোর ঠিক হবেনা।
-আমি ওকে সারাজীবনের জন্য চাই।
.
কথাটি শুনে বন্ধুরা সকলে হাসাহাসি তে লিপ্ত হয়ে পড়লে রানবী বিরক্তিভরা মুখ নিয়ে বললো-
তোরা আমার ফিলিংস নিয়ে মজা নিচ্ছিস?
.
বাদশা হাসতে হাসতেই বললো-
তোর আবার ফিলিংসও আছে নাকি দোস্ত?
.
আকিব বললো-
বাদ দে। কয়েকদিন প্রেম করে ঠিকই সবার মতো করে ছেড়ে দিবে দেখিস।
.
শান্ত স্বরে রানবী বললো-
ছাড়বোনা। তোরা কি আমকে হেল্প করবি নাকি…
.
সকলে একইসাথে বলে উঠলো-
করবো।
.
.
.
পুরান ঢাকার মেয়েদের কাছে জনপ্রিয় কলেজ হলো ”ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজ”।
“ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজ” পুরান ঢাকার অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সুনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্টান। ঢাকা দঃক্ষিণের বাবা-মায়ের লক্ষ থাকে তার মেয়েকে এই কলেজে শিক্ষা পাঠের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। তবে পুনমের লক্ষ্য এই কলেজ না হলেও বাবার জন্যই তাকে এখানে এডমিশন নিতে হলো।
পুনম…
সেই বেণি করা মেয়েটির নাম পুনম।
চট্রগ্রামের মেয়ে সে। বাসার ছোট মেয়ে সে। তার বাবার ইচ্ছে ছিলো, তার মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। কিন্ত অনেক পরিশ্রমের পরেও সফল হলোনা পুনম। তবে তার বাবার ইচ্ছে রাখার জন্য ঢাকাতেই সে পড়তে আসলো। বাংলাদেশের রাজধানীর কোনো প্রতিষ্ঠানে পড়াই যেনো তার বাবার গর্ব!
পুনম ঢাকাতে তার ফুফুর বাসায় উঠেছে। আর কলেজে ভর্তি হয়েছে হিসাববিজ্ঞান বিভাগে।
আর হতাশ করতে চায়না সে তার বাবাকে। মন দিয়ে পড়াশোনা করবে এটাই তার লক্ষ্য।
কিন্তু তার জন্য যে রানবী বাধা সৃষ্টি করবে এটা তার এখনো অজানা।
নতুন শহর, নতুন কলেজ, নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে তো পুনম???
.
.
.
বন্ধুদের নিয়ে মহানগর কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রানবী।
এই পর্যন্ত যতোগুলো প্রেম সে করেছে, সব মেয়েরাই তাকে নিজ থেকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে। অবশ্য রানবীই তাদের বাধ্য করেছিলো প্রেমে ফেলতে। কিন্তু আজ রানবী প্রপোজ করবে সেই মেয়েটিকে। প্রথম দেখায় ভালোবাসা তার সেদিনই প্রস্তাব দেয়া! এসব যেনো কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেনা তার বন্ধুরা। এই কোন নতুন রানবী কে দেখছে তারা!
কি এমন দেখেছে সে ওই মেয়েটির মাঝে? একবার দেখেই ঘায়েল হয়ে গেলো!
.
.
অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরে পুনমকে দেখতে পেলো রানবী।
এই প্রথম কোনো মেয়ের সাথে কথা বলতে তার ভয় করছে। হার্টবিট যেনো বেড়ে যাচ্ছে। ঘামছে সে অনবরত।
সাইকোলজির ভাষায় এমন হওয়াটাই কিন্তু ভালোবাসা। ওই যে, প্রথম দেখাতেই ভালোবাসা!
.
তার অবস্থা দেখে আকিব বললো-
আমি তোর হয়ে কথা বলবো মেয়েটির সাথে?
.
চোখ রাঙিয়ে রানবী বললো-
আমার কথা আমিই বলবো।
তুই জানিস না? নিজের ভালোবাসার কথা নিজে জানানো টায় প্রকৃত প্রেমিক বা পুরুষের কাজ। আর এটা সাইকোলজিকাল ফ্যাক্ট এবাউট লাভ।
-না বাবা জানিনা। আমি তো তোর মতো সাইকোলোজি নিয়ে এতো গবেষণা করিনা।
.
.
রানবী খেয়াল করলো মেয়েটি এগিয়ে আসছে।
সে কাছে এগিয়ে আসতেই রানবী এগিয়ে গেলো তার দিকে।
ঘায়েল হয়েছেই যখন, ভালোবাসার কথা জানাতে দেরী করে লাভ কি!
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here