#গোধূলি_লগ্ন
#Writer_Tabassum_Tajnim
#Part_15_16
তিয়ান ফোনটা কেটে দিলো। ওর সাথে কথা বলতে একদম ভালো লাগে নি।
এখন আর কাজেও মন বসবে না, তাই বাড়ি যাওয়ায় ভালো, গিয়ে একটু রেস্ট নিতে পারবে।
অনন্যা বেলকুনিতে রাখা চেয়ারটায় বসে বইটা দিয়ে মুখটা ঢেকে দিলো। কিছুই ভালো লাগছে না। বাসায় পূন্য ভাবি নেই,, গাছের নিচে পুলক নেই। কেমন জানি লাগছে। বইটা হালকা নিচে নামিয়ে চোখ খুললো আকাশের দিকে তাকালো,, তারায় তারায় ভরা আকাশ,, বাঁকা চাদ,, হালকা বাতাস বইছে,, বাতাসে অনন্যার খুলা চুলগুলো এসে মুখে পড়ছে,,, অনন্যা চুল গুলো পিছনে নিয়ে বেধে নিলো। বইটা চেয়ারে রেখে ছাদে চলে গেলো।
ছাদের রেলিং এ বসে পা নাড়াতে লাগলো। আর গুন গুন করে গান গাইতে লাগলো,
— “আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে, দেখতে আমি পায় নি তোমায়, দেখতে আমি পায় নি। ”
হঠাৎ মোবাইলের লাইটটা জ্বলে উঠলো। মেসেজ এসেছে।
–“প্রিয়তমা,
তোমাকে না বলেই চলে আসতে হলো। সকালে অনেক্ষণ অপেক্ষার পর দেখা মিলেছিলো, আর সময় সল্পতার কারনে চলে আসতে হয়েছিলো। সরি,, সো সরি। আমি জানি তুমি আমাকে মিস করছো, অনেক মিস করছো। আমিও তোমাকে অনেক অনেক মিস করছি। ”
অনন্যা মেসেজ টা পড়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো,, তারপর হাসলো,, পুলক মেসেজটা করেছে, কিন্তু ওর নাম্বার পেলো কোথায়!! অনন্যা বুঝতে পারছে পুলক ওকে খুব ভালোবাসে,, পুলককে সবকিছু খুলে বলতে হবে,,, প্রথমে ছেলেটা কষ্ট পেলেও আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। অনন্যা একটু নিচে উঁকি দিলো,, তারপর হাসলো,,সে তিনবার ছাদ থেকে লাফ দেওয়ার চেষ্টা করেও পারে নি,, ভয় পেয়ে গিয়েছিলো নিচের দিকে তাকিয়েই। অনন্যা শব্দ করে হাসলো,,
— এতো রাতে ছাদে কি করছো?? আর এতো জোরে জোরে হাসছো কেনো?? ভূতে পেয়েছে নাকি???
অনন্যা কিছুক্ষন চুপ করে দাড়িয়ে রইলো,, তিয়ান ভাইয়া,,, এতো রাতে ছাদে কি করে, আস্তে করে ঘুরে তিয়ানের দিকে তাকালো, তারপর বললো,,
–ঐ একটু আরকি,,, আচ্ছা আমি যায়।
— হুম। আর শুনো রুমে একটু কফি দিয়ে যেও।
অনন্যা মাথা নেড়ে চলে গেলো। অনেকদিন পর রান্নাঘরে ঢুকলো অনন্যা। পূন্য ভাবি তো নিজের মতো করে রান্নাঘর সাজিয়ে নিয়েছে, তাই অনন্যার একটু কষ্ট হলো জিনিস পত্র খুজে নিতে।
কফি বানিয়ে তিয়ানের ঘরে রেখে আসার সময় হঠাৎ চোখ পড়লো তিয়ান আর পূন্যর বিয়ের ছবিটা তে। অনেক সুন্দর লাগছে দুজনকে,, হাসি খুশি। অনন্যা ও হাসলো। রুমে এসে শুয়ে পড়লো,, পুলকের পাঠানো মেসেজটাই বারবার পড়তে লাগলো।
পূন্য বাসায় এসে এতো খেয়েছে যে গলা পর্যন্ত ভরে গেছে। এখন চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে,, মনে হচ্ছে বমি হবে,, উঠে বসলো,, তারপর কোনো মতে মুখ চেপে দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। পিছু পিছু তৃপ্তি ও গেলো,, কিন্তু আবার ফিরে আসলো, পূন্যর মোবাইল বাজছে দেখে। স্ক্রিনে একটা নাম্বার ভেসে উঠলো। তৃপ্তি ফোনটা রিসিভ করলো,,,
–হ্যালো,,,কে
তিয়ান কন্ঠস্বর টা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বললো,,
— তিয়ান,,, আপনি কে??
— ওওও ভাইয়া,, সরি। আসলে আমি চিনতে পারি নি। নাম্বার টা সেইভ করা নেই তো তাই।
তিয়ান বুঝতে পারলো তৃপ্তি কথা বলছে। তাহলে পূন্য কোথায়??
— তোমার আপু কোথায়??
— ও,,ভাইয়া আপু অসুস্থ হয়ে গেছে,, বমি করছে।।
–কিহ্,, কেনো?? কখন অসুস্থ হলো?? আমাকে জানায় নি কেনো?? আমি আসছি…
তৃপ্তি কিছু বলার আগেই তিয়ান কেটে দিলো। উফফ,, এক সেকেন্ডের মধ্যে তিয়ান ভাইয়া কতো কথায় না বলে দিলো। আমার থেকে বেশি তাড়াতাড়ি কথা বলে। মোবাইল টা বালিশের উপর রাখে আবার ওয়াশরুমের দিকে বাড়ালো। ঠিক তখনি পূন্য দরজা খুলে বাইরে এলো। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছতে লাগলো। তৃপ্তি গিয়ে ধরলো,,তারপর বললো,,
— একা একা আম্মুর বেশি আদর খেলে এমনই হবে। খারাপ লাগছে বেশি??
পূন্য মাথা নেড়ে না করলো,, তারপর বললো,,
— একটু শুয়ে থাকলেই ঠিক হয়ে যাবে। আচ্ছা আমাকে একটু ঠান্ডা পানি এনে দে তো।
তৃপ্তি রুমে থেকে বেরিয়ে গেলো। পূন্য মোবাইলটা বালিশের উপর থেকে সরিয়ে পাশে রেখে দিলো,, পাখাটা ছেড়ে শুয়ে পড়লো। তৃপ্তি একটু পর পানি নিয়ে এলো,, একটানে পানি টা খেয়ে আবার শুয়ে পড়লো। তৃপ্তি ওর পাশে বসে মাথায় হাত বুলাতে লাগলো।
শিউলি বেগম খাবার গুলো গুছিয়ে পূন্যর রুমের দিকে আসছিলেন,, তৃপ্তি বলেছিলো মেয়েটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে,, তারই দোষ,,মেয়েটা খেতে চায় নি, আমি জোর করে খাওয়ালাম। কলিংবেল বাজাতে,, শিউলি বেগম ঘুরে দরজার কাছে গেলেন। তিনি যেতে যেতে আরো চার পাঁচ বার কলিংবেল বাজানো হয়েছে। অনেকটা বিরক্ত নিয়েই দরজা খুলে শিউলি বেগমের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। একি!! এখন জামাই এসেছে কেনো!!!
তিনি হেসে ভিতরে আসতে বললেন।তিয়ান ভিতরে এসে শিউলি বেগমকে সালাম করলেন, তারপর বললো,
— কেমন আছেন মা,,?
–জ্বি ভালো। তুমি কেমন আছো?? তোমার মা কেমন আছে??
— ভালো।
শিউলি বেগম তৃপ্তিকে ডাকলেন,, তৃপ্তি এসে কিছুক্ষন দাড়িয়ে রইলো অবাক হয়ে,, তারপর বললো,,
— আপনি এসে গেছেন!!! চলুন বুবুনের রুমে নিয়ে যাই।।
তিয়ান তৃপ্তির পিছু পিছু চলে গেলো। শিউলি বেগম মৃদু হাসলেন। তার মেয়ের ভাগ্য ভালো,, নাহলে এতো ভালো স্বামী কেউ পায় না।
একটু শরীর খারাপ করেছে শুনে এভাবে চলে এলো!! বড্ড ভালোবাসে আমার মেয়েকে,, কিন্তু পূন্য!!!!
যাক এখন মেয়ে জামাই এসেছে,, খাবার গরম করতে হবে। ওনি রান্না ঘরে চলে গেলেন।
পূন্য বিছানায় বসে চোখ বড় বড় করে তিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে,, এখন তিয়ান আসবে ভাবতেও পারে নি। তিয়ানে এসেই জিজ্ঞাসা করলো,,
— এখন কেমন আছো??
পূন্য কিছু বলার আগেই তৃপ্তি বললো,,
— বুবুন তো এখন ভালোই আছে,, আর তুমি আসাতে আরো ভালো হয়ে গেছে। তখন বেশি খেয়ে ফেলেছিলো তো তাই বমি হয়ে গেছে। কিন্তু তুমি যে সত্যি সত্যি চলে আসবে তা আমি সত্যি সত্যি ভাবতে পারি নি।
পূন্য এতক্ষনে সব পরিষ্কার হলো। তারমানে তৃপ্তি এসব বলেছে। কিন্তু বললো কখন?? তিয়ান এসে ওর পাশে বসলো,, পূন্য ওর দিকে তাকালো,, তারপর হাসলো।
তৃপ্তি রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। পূন্য কিছু চুপ থাকার পর বললো,,
— তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও।
— সেটা পরেও হতে পারবো। আগে বলো এখন কেমন আছো??
— ভালো।
— তুমি জানো,, আমি কতোটা ভয় পেয়ে গেছিলাম!! এখানে এসেই অসুস্থ হয়ে পড়লে,, তোমাকে আর কোথাও একলা ছাড়া যাবে না।
— কেনো??
— নিজের দিকে কোনো খেয়াল রাখো না তাই।
পূন্য হাসলো। তিয়ান পূন্যকে বুকে টেনে নিলো। তিয়ানের বুকে মাথা রেখেই পূন্য বললো,,
— অফিস থেকে এখানে চলে এসেছো??
— না,, বাড়ি থেকে।
— তাহলে ড্রেস চেঞ্জ করো নি কেনো??
— সময় পাই নি তো,, তাড়াতাড়ি এখানে চলে আসলাম। কতো ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিলে মনে,, তখন কি আর চেঞ্জ করার কথা মনে আছে!!
— তাহলে তো খেয়েও আসো নি?? চলো খেয়ে নিবে এখন।
— নাহ্,,
পূন্য উঠার চেষ্টা করলো,, কিন্তু পারলো না,, তিয়ান চেঁপে ধরেছে,, পূন্য বললো,,
— কি নাহ্,,
— আমার এখন খাওয়ার ইচ্ছা নেই। খুব টায়ার্ড লাগছে,, আমি এখন ঘুমাবো।
পূন্য মাথা তুলে বসলো। তারপর বললো,,
— অল্প কিছু??
— একদম না,, তাহলে তোমার মতো অবস্থা হবে।
তিয়ান হেসে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো।
তৃপ্তি রুমে ঢুকে পূন্যর দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকলো,, তারপর বললো,,
— বুবুন,,, চলে এসেছে?? দেখলে তো তোমাকে কতো ভালোবাসে। এখন কোথায় গেলো??
— ওয়াশরুমে,, তুই তখন কেনো বললি যে আমি অসুস্থ??
— তখন তুই অসুস্থ ছিলি তাই বলেছিলাম। আচ্ছা এখন ভাইয়াকে নিয়ে আয়, আম্মু খাবার গরম করেছে।
— খাবে না। এখন খেলে নাকি তার আমার মতো অবস্থা হবে।
— ওহ,, তাহলে আম্মুকে গিয়ে না করে দিই।
তৃপ্তি রুম থেকে বেরিয়ে হাসলো,, সত্যিই তিয়ান ভাইয়া বুবুনকে অনেক ভালোবাসে। এই ভালোবাসার জোরেই তো বুবুন নিবিড় ভাইয়ার কথা ভূলবে। তৃপ্তি মাকে গিয়ে বলে দিলো তিয়ান ভাইয়া খাবে না। তারপর রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো।
লাইট টা বন্ধ করে তিয়ান শুয়ে পড়লো। পূন্য এসে তিয়ানের বুকে মাথা রাখলো। তিয়ান হেসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,,
— ঘুমিয়ে পড়ো তাড়াতাড়ি।
নিবিড় কিছুক্ষণ মিতুর ঘুমন্ত মুখটা দেখলো। নাহ্,, মিতুর মধ্যে আগের সেই চঞ্চলতা ভাব টা নেই। কেমন যেনো কেটে গেছে। আজকে মিতু অনেকটা শান্ত ছিলো। কিন্তু কেনো জানি নিবিড়ের ভালো লাগলো না,, মিতু আর শান্তশিষ্ট দুটো বিপরীত। মিতুকে তার নিজস্ব চরিত্রেই ভালো লাগে। তাকে ধরা বাধা নিয়মে মানায় না। মাঝে মাঝে মিতু কে তার খুব ভালো লাগে,, আবার মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে। জেগে থাকলে বিরক্ত,, আর ঘুমিয়ে থাকলে ভালো লাগে। এই এখন যেমন ভালো লাগছে। মিতুর ফর্সা মুখটা নিবিড় কে বড্ড বেশি টানছে। কিছু টা ঝুঁকে গেলো মিতুর দিকে,, কিন্তু নিজেকে সংযত করে শুয়ে পড়লো। হঠাৎ মিতু এসে নিবিড় কে জড়িয়ে ধরলো,, এতো শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে মিতু!! নিবিড় ভাবলো,, তারপর মিতুকে ডাকলো,,
— এই মিতু,, উঠো,, নিজের জায়গায় যাও।
মিতু ঘুমের ঘোরে কি বললো,, তা বুঝতে পারে নি নিবিড়। তাই আবার ডাকলো,,
— মিতু,,,, উঠো,, এই মিতু,,
নাহ্,, মিতু উঠছে না, তাই নিজেই ওকে সরিয়ে দিলো। একটু অন্যপাশে ফিরে শুতেই মিতু আবার এসে জড়িয়ে ধরলো। নিবিড় এবার কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো,, এই মেয়েটা কি আমাকে শান্তি মতো ঘুমুতেও দিবে না!! এবার মিতুকে সরাতে গিয়েও সরালো না। উল্টো ওর হাতটা টেনে আরো একটু কাছে টেনে নিলো।
চোখ বন্ধ কর করতেই পূন্যর মুখটা ভেসে উঠলো। তৎক্ষনাৎ নিবিড় মিতু কে সরিয়ে দিলো, তারপর উঠে বসলো। সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে জ্বালালো। ইদানীং সে একটু বেশিই সিগারেট খাচ্ছে। পূন্যর ধরা বাধা নিয়মের বাইরে। একটার বেশি সিগারেট খেতেই দিতো না পূন্য। কখনো কখনো একটাও খেতে দিতো না। প্রথম যখন না করেছিলো সিগারেট খাওয়ার জন্য তখন লুকিয়ে লুকিয়ে খেতো। কিন্তু কারো না কারো চোখে ঠিক পড়ে যেতো।
হঠাৎ মিতু কাশতে লাগলো,, সিগারেটের ধোয়া মনে হয় ওর সহ্য হচ্ছে না। তাই উঠে বেলকুনিতে চলে গেলো।
চলবে,,
#গোধূলি_লগ্ন
#Writer_Tabassum_Tajinm
#Part_16
হঠাৎ মিতু কাশতে লাগলো,, সিগারেটের ধোয়া মনে হয় ওর সহ্য হচ্ছে না। তাই উঠে বেলকুনিতে চলে গেলো।
আকাশের দিকে তাকালো,, ঝড়ো বাতাস বইছে,, একটু আগেও আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছিলো, কিন্তু এখন একটা তারাও দেখা যাচ্ছে না। ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। মাঝে মাঝে বিজলি চমকাচ্ছে, একটা ভাপসা গরম বাতাস এসে নিবিড়ের গায়ে লাগলো। প্রচন্ড গরমে আবার গরম বাতাস!!! মুহূর্তের মধ্যেই নেমে এলো বৃষ্টি,, বড় বড় গাছ গুলো এদিক ওদিক নড়ছে,,
বৃষ্টির ঝাপটা এসে নিবিড়ের গায়ে পড়তেই নিবিড় তারাতারি ঘরে চলে এলো। বেলকুনির গ্লাস টা খুলে বিছানায় শুয়ে পড়লো। রুমের ভিতর হালকা ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে,, নিবিড় এসি টা বন্ধ করে করে দিলো। শীত শীত লাগছে,, মিতু খানিকটা এসে নিবিড়ের বুকে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরলো। কাথাটা দিয়ে দুজনের শরীর টাই ঢেকে দিলো।
সারারাত বৃষ্টি হয়েছে, সকালের দিকে কমে গেছে। তিয়ান ঘুমিয়ে আছে,, আর পূন্য তিয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। পূন্য উঠে বসলো,, ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো জানালাটার কাছে। কিছু দাড়িয়ে বাইরের প্রকৃতিটা দেখলো, বৃষ্টি সব কিছু গোসল করে এখন এক নতুন সাজে সেজেছে। বাইরে হালকা বাতাস ও মনে হয় বইছে,, একটা উড়ে এসে জানালার গ্লাস টায় বসে গেলো। বৃষ্টি হওয়ার কারনে গ্লাসটা ভিজে ছিলো, তাই আটকে গেছে পাতা টা। পূন্য জানালা টা খুলে দিলো,,মুখে এসে এক ঝটকা ঠান্ডা বাতাস লাগলো,,পূন্যর শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠলো। রুমটা কিছুক্ষণের মধ্যেই ঠান্ডা হয়ে গেলো। তিয়ানের দিকে তাকালো,, সে এখন কাথা খুঁজছে,, সারারাত এতো গরম ছিলো,, যে কাথা নেওয়ার প্রয়োজন মনে করে নি তিয়ান। কিন্তু এখন এতো ঠান্ডা লাগছে যে কাথা ছাড়া তার চলছে না। পূন্য এসে তিয়ানের গায়ে কাথা দিয়ে দিলো। রাতে পূন্য কতোবার চেয়েছিলো,, জানালাটা খুলে দিতে কিন্তু তিয়ান দেয় নি। তখন খুললে ভালোই হতো। তিয়ান একটু ঘুমুতে পারতো ভালো করে। সারারাত গরমের জন্য ঘুমুতে পারে নি। আর বলেছে, তোমাদের বাসায় গরম থাকতে আমি আর কোনোদিন আসবো না।
পূন্য ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো,, তিয়ান জানালা লাগাচ্ছে। তিয়ান পূন্যকে না দেখেই বললো,,
— এতো ঠান্ডা বাতাসে তো ঠান্ডা লেগে যাবে। এটা খুলে রেখেছো কেনো??
— রুম টা গরম ছিলো,, তাই খুলে দিয়েছিলাম। খুলা থাকুক না।
— না,,লাগানো থাক।
কথাটা বলে তিয়ান ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। একটু পর ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো। তারপর পূন্য কে বললো,,,
–কফি দাও তো একটু।
পূন্য উঠে দাড়ালো, তারপর দরজা খুলে রান্নাঘরের দিকে গেলো। রান্নাঘরে তৃপ্তি চা করছে। তৃপ্তি পূন্য কে দেখে একটু হেসে বললো,,
— আপনি কি জন্যে রান্না ঘরে??
— কফি বানাতে এলাম।
— তুই কফি খাবি!!!! তুই না কফি খাস না?
–আমার জন্য না।
— ওহ,, আচ্ছা আমি বানিয়ে দিচ্ছি। তুই বস।
পূন্য পিঁড়ি টা টেনে বসলো। তারপর তৃপ্তির দিকে তাকালো তৃপ্তি এতো সকাল সকাল চা বানাচ্ছে!!! যার ঘুম কিনা ১০ টার আগে ভাঙ্গতেই চায় না,,আজ সে সাতটায় চা বানাচ্ছে,, অদ্ভুত হয়ে গেছে এই তৃপ্তি ঠিক অনন্যার মতো।
তৃপ্তি মগটা পূন্যর দিকে এগিয়ে দিলো। পূন্য মগটা নিয়ে উঠে দাড়ালো,, তৃপ্তি পিছন থেকে বলে উঠলো,,
— তিয়ান ভাইয়া তোকে ভালোবাসে,, খুব ভালোবাসে,, কিন্তু নিবিড় ভাইয়ার থেকে বেশি না।
পূন্য তৃপ্তির দিকে ঘুরলো,,, অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো,, কিছু বলতে গিয়েও বললো না। রুমে চলে আসলো। তিয়ানের হাতে কফিটা দিয়ে বিছানায় বসে পড়লো,, তিয়ান পূন্যর দিকে তাকিয়ে ধোঁয়া উঠা কফিতে চুমুক দিলো। তারপর বললো,,
— আজ কফিটা তুমি বানাও নি!!
— না,,কিন্তু বুঝলে কিভাবে??
— তুমি কফিতে একটু বেশিই মিষ্টি দাও। তার আজকের টা একদম কম মিষ্টি। তারমানে তুমি বানাও নি।
পূন্য হাসলো। তৃপ্তি চায়ের কাপ নিয়ে রুমে ঢুকলো,, মোবাইলটা বাজছে,, অন্তু গাধা টা ফোন দিয়েছে,, অনেকটা বিরক্ত নিয়েই ফোনটা রিসিভ করলো তৃপ্তি, তারপর বললো,,
— কি হয়েছে রে গাধা??এতো সকাল সকাল কল দিলি কেন??
— ঐ পেচি,, সব সময় গাধা ডাকবি না আমাকে। আচ্ছা শুন,, এক জায়গায় যাবি??
— কোথায়??
— বান্দরবনে
— কেন গাধার আবার বান্দর দেখার শখ হইছে নাকি??
— ধূর,,যাবি নাকি বল!!
— না।
কথাটা বলার পর ফোনটা কেটে দিলো তৃপ্তি । ইদানীং তৃপ্তির মন মেজাজ একদম ভালো থাকে না,, খুব বিরক্ত হয় সবার উপরে,, শুধু বুবুন পাশে থাকলে ভালো লাগে কেনো জানি।
রূপন্ত মোবাইলটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষন চুপ করে রইলো। এই পেচি টাকে বলা ভূল হয়েছে তার। নিবিড় ভাইয়াকে বলবে,,নিবিড় ভাইয়া নিশ্চয় রাজি হবে।
বিকালের দিকে কালো রংয়ের একটা শাড়ি পড়ে পূন্য রেডি হয়ে গেলো। অরুর সাথে দেখা করতে হবে।অরু কেনো কল দিয়ে বললো তাড়াতাড়ি যেতে,, কিছু ঠিকানা দিলো আরেক জায়গার। ঐ জায়গায় কেনো যাবে!!
তৃপ্তি এসে ওর সামনে দাড়ালো,, তারপর চোখ বড় বড় করে বললো,,
— তুই ও কালো!!
— হুম,,কেনো আমি কালো পড়তে পারি না??
— নাহ,, চল দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে অরু আপু বিয়ে করে নিয়েছে। তোকে বৌভাতের দাওয়াত দিয়েছে।
তৃপ্তি আজকাল অদ্ভুত টাইপের কথা বলে, এই মেয়েটার যে কি হয়েছে,, আল্লাহ জানে।
পূন্য একটু এগিয়ে গিয়ে বললো,,
— হু,,, তোকে বলেছে??
— হুম বলেছে,, সিক্সথ সেন্স।
অনেকক্ষণ দাড়িয়ে থাকার পর একটা রিকশা পেলো। রিকশা ওয়ালা কে এড্রেস টা বলে দিলো। প্রায় আধাঘন্টা পর রিকশাওয়ালা থেমে গেলো। তৃপ্তি বললো,,
— এসে গেছি??
রিকশাওয়ালা মাথা নেড়ে না করলো। তারপর বললো,,
— আফা সামনের রাস্তা দিয়া রিকশা যাইবো না।
রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিয়ে পূন্য বাড়ালো,, কেমন যেনো এই এলাকাটা। দুইপাশে এতো ঘর,, হাটার জায়গাটা পর পর্যন্ত নেই। দু একজনকে জিজ্ঞেস করে অরুর দেওয়া ঠিকানায় পৌছালো।
সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেলো। আজান পড়ছে চারদিকে,, এই বাসা টায় শাখ বাজলো,, উলুধ্বনি দিলো,, একজন।
পূন্যরা এখনো ভিতরে ঢুকে নি। বুঝতে পারলো এটা হিন্দু বাসা,, এখানে এখন ঢুকা কি ঠিক হবে!!
তৃপ্তি বললো,,
— ঐ চল ভিতরে ঢুকি। এখানে দাড়িয়ে থাকবো নাকি!!
— কার বাসায় হুট করে ঢুকে যাবো!! চিনি না জানি না।
চারদিকে ঘর,, মাঝখানে ছোট্ট উঠান। বারান্দা দিয়ে একজন হেটে যাচ্ছিলো দেখে মনে হলো বউ,,তৃপ্তি তাকে ডাকলো,,
— এই যে শুনুন,,
এর পর আর কারো মুখ থেকে কোনো কথা বেরুলো না,,, পূন্য হা করে তাকিয়ে আছে,, তৃপ্তির গলা দিয়েও আর কোনো কথা বেরুলো,,, অরু নেমে আসছে। লাল টুকটুকে একটা শাড়ি গ্রামের মেয়েদের মতো পড়া,, পায়ে আলতা, কপালে একটা লাল টিপ। হাতে শাখা-পলা,,, সিঁথি ভর্তি সিঁদুর,,,
তৃপ্তি পূন্যকে ধাক্কা দিয়ে বললো,,
— আমি বলেছিলাম,,, এখন ঠিক হলো তো।
পূন্য কিছু বললো না,, শুধু অরুকেই দেখছে। আজকে অরুকে খুব সুন্দর লাগছে,, এতো সুন্দর লাগছে বলার বাহিরে। মাথার সিঁদুর টার জন্য আরোও সুন্দর লাগছে, বিশেষত উজ্জ্বল শ্যমলা গায়ের রং টার কারনে আজ অরুর সৌন্দর্য টা ফুটে উঠেছে । এখন পূন্যর কাছে মনে হচ্ছে অরুদের পূর্ণতা সিঁথির সিঁদুরেই হয়।
অরু এগিয়ে এসে পূন্যকে জড়িয়ে ধরলো,, হেসে বললো,,
— কেমন আছিস??
পূন্য এখনো ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,,,ওর সিধুর টা দেখতে দেখতে বললো,,
–বিয়ে করেছিস?? কবে?? আমরা তো জানতে পারি নি। আঙ্কেল আন্টিও তো আম্মুকে কিছু বলে নি।
তৃপ্তিও অরুর দিকে তাকিয়ে আছে,, ও বললো,,
— অরু দি,, তোমাকে দেখতে অনেক সুন্দর লাগলে। শ্যামলা রংয়ের কারণে তোমাকে আজকে অপূর্ব লাগছে।
জবাবে তৃপ্তির গাল স্পর্শকরে একটা মৃদু হাসি দিলো। তৃপ্তি অরুর হাত টা ধরলো। তারপর পূন্যর দিকে তাকিয়ে বললো,,
— তুই খুব বোকা,,, পালিয়ে বিয়ে করেছে,, আঙ্কেল আন্টি নিজেরাই জানে না,, আর আম্মুকে বলবে কি??
অরু পূন্যর হাত ধরে ভিতরে নিয়ে এলো। একটা রুমে নিয়ে এলো,, টিন শেডের রুম,, নিচটা মাটির ,, ঘরে তেমন বেশি ফার্নিচার নেই,, একটা খাট, একটা ভাঙ্গাচোরা আয়না,, আর একটা আলনা। সেখানে কয়েকটা কাপড় ভাজ করা,, টিনের মধ্যেও কয়েকটা ছিদ্র। সব কিছু দেখতে দেখতে পূন্য বিছানায় বসলো,, বসতেই একটা শব্দ হলো,, পূন্য উঠে লাফ দিয়ে দাড়িয়ে গেলো। এতোক্ষন কিছু না বললেও,, এখন অরুর দিকে তাকিয়ে বললো,,
— অরু,, তুই কোথায় এসেছিস?? কেনো এই কাজটা করলি!!!
অরু মৃদু হেসে বললো,,
— ভালোবাসতাম,, বাবা-মা মেনে নেয় নি তাই এই কাজটা করতে বাধ্য হয়েছি। আমি তোর মতো এতো বাধ্য মেয়ে নই, যে পরিবার মেনে নিলো না, তাই অন্য কাউকে বিয়ে করে নিবো,, তারপর নিজেও জ্বলবো,, অন্যকেও জ্বালাবো।
পূন্য হাসলো,, হেসে গিয়ে আবার বিছানায় বসলো,, এবার শব্দ হলেও আর উঠলো না। ঠিক কথায় বলেছে,,
পূন্য বললো,,
— আঙ্কেল আন্টি মেনে নিয়েছে??
অরু পূন্যর দিকে তাকিয়ে হাসলো তাল মিলিয়ে তৃপ্তি ও হাসলো। অরু হাসি থামিয়ে বললো,,
— তোর মাথাটা পুরো ফাকা হয়ে গেছে। কেউ মেনে নিবে না,,, আমার মা-বাবাও মেনে নেয় নি। তোর উপর দ্বায়িত্ব দিলাম,, তুই ম্যানেজ কর। এখন বল কি খাবি??
তৃপ্তি মাঝখান থেকে বলে উঠলো,,
— আগে তোমার Husband কে তো দেখাও। তার নাম কি??
অরু বলার আগেই পূন্য বললো,,
— রূপক,,, তাই না।
অরুর দিকে তাকালো পূন্য,, অরু হেসে মাথা নেড়ে হ্যা বললো। তৃপ্তি আর কিছু বললো না। পূন্য উঠে দাড়ালো,, তারপর বললো,,
— আজকে আসি।
— সেকি,, না খেয়ে যাওয়া যাবে না।অন্তত চা খেয়ে যাও।
কথাটা শুনে পূন্য, তৃপ্তি, অরু দরজার দিকে ঘুরলো। একজন মধ্যবয়সী মহিলা দাড়িয়ে আছে,, হাতে চায়ের কাপ। অরুর কথা বার্তায় বুঝা গেলো ওনি ওর শাশুড়ি।
অরুর বাসা থেকে বেরিয়ে পূন্য আর তৃপ্তির হাঁটতে লাগলো খুব তাড়াতাড়ি,, প্রায় আটটা বেজে গেছে। তৃপ্তি পাশে এসে বললো,,
— বুবুন,, আজকে আমরা একটা ঝামেলায় পড়বো বলে মনে হচ্ছে । তুই কিন্তু ঘাবড়ে যাস না।
পূন্য মোবাইলের টর্চটা জ্বালিয়ে গলির রাস্তাটার দিকে ধরলো,, তারপর বললো,,
— তোকে বলেছে,,ঝামেলায় পড়বো,,
— হুম তুই দেখিস, আমার সিক্সথ সেন্স বলছে। তুই ভয় পাস না,, আমি আছি তো।
— আচ্ছা,, তুই আমাকে বাঁচাবি?? তোকে কে বাঁচাবে??আর সব সময় তোর কথা নাও মিলতে পারে।
–আমার কথা তোর না ভাবলেও চলবে,, আমি নিজের রক্ষা নিজে করতে পারি। কি হবে, কি হবে না সেটা তো সময়েই বলে দিবে।
কোনো রিকশা নেই। সন্ধ্যার দিকেই রাস্তা একেবারে খালি হয়ে গেছে। কোনো মানুষের দেখা নেই,, মেইন রোড এমন ফাঁকা থাকে নাকি। পূন্যর একটু একটু ভয় করছে,, তৃপ্তি এসে হাত ধরলো। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে তৃপ্তিকে অনেক সুন্দর লাগছে।
কিছুদূর হেঁটে আসতেই তৃপ্তির জুতোয় কিছু আটকে গেলো তাই তৃপ্তি পিছনে পড়ে গেলো,, পূন্য একটু এগিয়ে এলো,, হঠাৎ পূন্যর গলার চেইনটায় টান লাগলো,, পূন্য সামনের দিকটা টেনে ধরলো,, পিছনের দিকটা অন্যকেউ টেনে ধরলো,, সামনের দিকের টা ওর হাতে আর বাকিটা ছিনতাইকারীর হাতে,, হাতের পার্স টাও নিয়ে গেছে।
পূন্য চিৎকার করতে চেষ্টা করলো,,কিন্তু আওয়াজ হলো না। শুধু বললো,,
— এই,, এই,, এই
লোকটা দৌড় দিলো,,কিন্তু তার আগেই কেউ পিছন থেকে মাঝারি টাইপের একটা ইট ছুড়ে মারলো,,তারপর লাঠি নিয়ে মাথায় একটা ঘা বসিয়ে দিলো। লোকটা বসে পড়লো রাস্তায়। তৃপ্তি পূন্যর দিকে রাগি চোখে তাকালো,, হাতে লাঠি,, ইচ্ছা করছে লাঠিটা দিয়ে বুবুনের মাথায় একটা বসিয়ে দিতে।
চলবে,,,,